কালু হাসুয়া নিয়েই দৌড় দিয়েছে প্রাক্তন এমপি টিপু সুলতানের বাড়ির দিকে। বেশি দূরে তো না, পাঝরা পাড়া থেকে বিশ বাইশ মিনিটের পথ।
একসময় নবাবগঞ্জের তিনটা পাড়ার অনেক রবরবানি ছিল। এগুলো হলো লইলা পাড়া, চুড়িঅলি পাড়া আর পাঝরা পাড়া। এ তিন পাড়ার মধ্যে আগে মাঝে মধ্যেই সংঘর্ষ বাঁধত। সংঘর্ষ শুরু হলে টেস্ট ক্রিকেটের মতো তিন থেকে পাঁচ দিন চলত। দল বেঁধে এসে ওরা বাগানে, মাঠে-ময়দানে, রাস্তার মোড়ে মুখোমুখি হতো—ঠিক সেই সামন্তযুগের যুদ্ধের মতো। সেই সময় এ পাড়ার লোক ও পাড়ার কাউকে পথে ঘাটে হাটে রাস্তায় একা পেয়ে গেলে তার আর রক্ষে থাকত না। হাত পা ভেঙে পথে ফেলে রেখে যেত। পুলিশ কোনওভাবেই এ সংঘর্ষ বন্ধ করতে পারত না—যতক্ষণ না একটা মার্ডার হতো। যেকোন পক্ষের একজন টপকালে গ্রেফতারের ভয়ে দুটো পাড়াই পুরুষশূন্য হয়ে পড়ত। এরপর কিছু দিনের জন্য এলাকায় শান্তি ফিরে আসত। এ ধরনের সংঘর্ষ বাধত কখনও পাঝরা পাড়ার সাথে লইলা পাড়ার, কখনও লইলা পাড়ার সাথে চুড়িঅলি পাড়ার, কখনও বা চুড়িঅলি পাড়ার সাথে পাঝরা পাড়ার—আবার তিন পাড়ার মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষের ইতিহাসও আছে। এসব সংঘর্ষের পেছনে বড় কোনও কারণ থাকত না। কখনও তো এমনও হতো—সংঘর্ষে জড়িয়েও অনেকে নিজেরাও জানত না কেন তারা সংঘর্ষে জড়িয়েছে। বল্লম, তীর-ধনুক, রামদা, কুড়াল, ছুরি, তরবারি এসব নিয়ে তারা যুদ্ধের ময়দানে নামত।
লইলা পাড়ার পুরনো বাসিন্দারা লাইলা নামেই পরিচিত। বর্গিদের নৃসংশ আক্রমণ থেকে বাঁচতে এরা বিহার অঞ্চল হতে এ অঞ্চলে চলে আসে। এদের মূল পেশা ছিল নলখাগড়া দিয়ে পাটি বানানো। নলখাগড়ার কাজ করত বলে এদের নলুয়া বলা হত। নলুয়া থেকে নইলা। চুড়িঅলি পাড়ার বাসিন্দারাও এ অঞ্চলে প্রাচীন অধিবাসী না, তারা সুদূর আসাম থেকে চুড়ির ব্যবসা করতে এখানে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। শোনা যায় সুদূর আসাম থেকে এরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার হয়ে বিভিন্ন সময় এ অঞ্চলে এসেছে। উর্দু-বাংলা মিশ্রিত একধরনের ভাষায় তারা কথা বলে। ভাষাটি খোট্টা ভাষা হিসেবে পরিচিত। এখনও তাদের ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যে এ ভাষার প্রচলন আছে। তুলনামূলকভাবে চুড়িঅলি পাড়া সামর্থ্য ও লোকবলের দিক থেকে দুর্বল। যেহেতু ওরা নানা ঘাত প্রতিঘাত দেখেছে—যেমন দুর্ভিক্ষ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা—ফলে উদ্বাস্তু জীবনে মোকাবেলা করে এখনও টিকে আছে। তাই তারা জানে, শত্রুর সাথে যুদ্ধে কিভাবে টিকে থাকতে হয়। বলতে গেলে এটা তাদের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে অর্জন করা এক কৌশল।
পাঝরা পাড়ার অধিবাসীরা মূলত মুসলিম জেলে সম্প্রদায়। বহুবছর ধরে বংশ পরম্পরায় এরা এখানে বসবাস করছে। দুই পড়ার মধ্যে এরাই বেশি সংঘবদ্ধ, শক্তিশালী, সাহসী, নির্দয়। সর্দারের ডাকে তারা মুহূর্তের মধ্যে অস্ত্র হাতে জীবনটা হাতের মুঠোয় নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে পথে। এতদিন তারাই ছিল নবাবগঞ্জের ত্রাস। তাদের সাথে ঝগড়া-দ্বন্দ্বে জড়ানোর কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবত না। কিন্তু এখনকার বিষয়টা আলাদা—পাঝরাদের সেই ত্রাস, সেই শক্তি, সেই ঐক্য আজ আর নেই। দেশভাগের সাথে সাথে নবাবগঞ্জ মালদা জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হলো। অন্তর্ভূক্ত হলো রাজশাহীর মহাকুমা হিসেবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার একযুগ পর নবাবগঞ্জ জেলার স্বীকৃতি পেল। এ অঞ্চলের অবকাঠামোগত উন্নয়ন শুরু হলো দ্রুত—স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, থানা, ভূমি অফিস...। এসব উন্নয়নের সাথে সাথে একধরনের মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় গড়ে উঠল ক্ষুদ্র এই শহরে। জমির দাম বাড়তে লাগল হু হু করে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত পাঝরা পাড়াটা শহরের নতুন বাসিন্দাদের চক্ষুশূল হয়ে পড়ল। এ যেন শহরের ঠিক মাঝখানে এক দুষ্ট ক্যান্সার। পাড়াটার আঁশটে মেছো গন্ধ যেন গোটা শহরটাকে দুর্গন্ধময় করে তুলছিল। এদিকে পাঝরা পাড়ার জনসংখ্যা বাড়ছে কিন্তু তাদের জমি তো বাড়ছে না। পাড়ার কবুতরের ফোকরের মতো ঘরগুলো গাদাগাদি হয়ে দিন দিন শ্বাস বন্ধ হয়ে ছটফট করছিল। তাই অনেকেই তাদের ভিটে-মাটি চড়া দামে বিক্রি করে অন্যত্র গিয়ে সস্তা জমি কিনে বা রেলের ধারে সরকারি জায়গায় বসবাস শুরু করেছে। ফলে স্বাধীনতার বিয়াল্লিশ বছরে তাদের অল্প কিছু ঘরই এখানে টিকে আছে। যে কটা ঘর আছে—পারস্পরিক সেই ঐক্য এখন আর নেই। নানা রাজনৈতিক দলে তারা বিভক্ত হয়ে পড়েছে। নিজেদের মধ্যে নানা বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। তবে এখনও তারা বাপ-দাদার জালুয়া—জাত ব্যবসাটা চালিয়ে যাচ্ছে। আগে তাদের পূর্বপুরুষেরা মহানন্দার বুক খিচে মাছ তুলে আনত। এখন ভোরে মাছের আড়তে ডাকে যোগ দিয়ে নিজের সাধ্য মতো মাছ কিনে বাজারে বিক্রি করে।
এ পাড়ায় এখনও যারা টিকে আছে তাদের একজন কালু। কালুর ছোট দুই ছেলে তার সাথে বাজারে মাছ বিক্রি করে। বড় ছেলে শহরে রিক্সা চালায়। সে বউ বাচ্চা নিয়ে পৃথক খায়। বাপের সাথে ঝগড়া করে বাড়ির দুটো ঘরের মধ্যে একটা ঘর দখলে নিয়েছে। সে ঘরেই সে থাকে। ছোট দুই ছেলেরও বিয়ের বয়স হয়েছে কিন্তু বিয়ে এখনও দেয়নি কালু। ওরা বউ নিয়ে থাকবে কোথায়? কবরের মতো দুটো ঘর (দুটোর একটা তো বড় ছেলের দখলে) আর সামনে ছাউনি দেয়া এক চিলতে উঠন। বাড়িতে আছে বিবাহযোগ্যা মেয়ে। নাম তার সেমালি। সেমালি বাবা-মায়ের সাথে ঘরেই ঘুমায়। সোমত্ত মেয়েকে সাথে নিয়ে ঘরে ঘুমাতে লজ্জা লাগে কালুর, কিন্তু সে নিরুপায়। আর ছেলে দুটো উঠানের একধারে চকিতে গুটিসুটি হয়ে শোয়। সেমালির বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। পনের মাড়িয়েছে কয় বছর হলো যেন। দেখতে শুনতে ভালো। চিকন-চাকন থাকতে পছন্দ করে সেমালি। প্রতিদিন ধোয়া কাপড় পরে কামে বের হয়। এ জন্য এমপি টিপু সুলতানের বউ ওকে খুব পছন্দ করে। আগে দু’তিন বাড়িতে কাম করত এখন শুধু এমপির বাড়িতে করে। ও বাড়তে কাজ করে আরাম। বছরের অধিকাংশ সময় তো এমপিরা ঢাকায় থাকে।
হাইরে সেমালি! সেমালির সুন্দর কাটিংয়ের নাক-নকশা আর চিকন-চাকন চলাফেরা আজ তার জন্য কাল হয়েছে। কালুর ভেতরটা ধড়ফড় করে ওঠে। কালুর বয়স পঞ্চাশ, পঞ্চান্ন কি ষাট হবে। সে তার বাপ-দাদার সেই তেজি রবরবানির কথা এখনও ভোলেনি। ভুলবে কেমনে? সে যে তাদেরই বংশধর। তার শরীরে তাদেরই রক্ত বইছে। তার দাদা মেসবাহ পাঝরা পাড়ার দাপুটে সর্দার। তেভাগা আন্দোলনের সময় সে কয়েকশ’ পাঝরা নিয়ে নাচোলে কৃষকদের সাথে যোগ দিয়েছিল। সে আন্দোলনে মেসবাহ সরদারের এক হাবিলদারকে নাঙ্গা করে নাচোল ছাড়া করবার গল্প এখনও পাঝরা পাড়ায় মুখেমুখে বেঁচে আছে। ব্রিটিশ সরকারের হাবিলদারকে নাস্তা-নাবুদ করা কম কথা নয়। তার বাপ রমজান লইলাদের সাথে দাঙ্গায় তিন তিনটা খুন করেছিল আর তা স্মরণে রাখতে সুদেষ্ণা উল্কিশিল্পীকে দিয়ে বুকের কাছে তিনখান তারার মতো উল্কি আঁকিয়েছিল। কালুর বাপ লইলা আর চুড়িঅলি পাড়ার লোকেদের কাছে এক অতঙ্কের নাম ছিল। ছোট বেলায় কালুও অনেক দাঙ্গায় সরাসরি অংশ নিয়েছে বাপের সাথে। ঢিল ছোড়া, বাপকে তীর এগিয়ে দেয়া, পাড়ার রাস্তার মোড়ে পুলিশের গাড়ি আসলে বাঁশি বাজিয়ে সতর্ক করা...।
এখন আর সেভাবে সংঘর্ষ বাঁধে না। পাড়াটা এখন বিএনপি-জামাত-আওয়ামীলীগে বিভক্ত হয়ে গেছে। পাড়ার অল্পবয়স্ক ছেলে ছোকরাদের পয়সা দিয়ে ভাড়া করে নিয়ে যায় ওসব দলের নেতারা। অস্ত্র হাতে তুলে দেয়। পাঝরা পাড়ার ছেলে মালু এইসব গুণ্ডাগিরি করে মার্কেটে দোকান কিনেছে। কালু এসব পছন্দ করে না। তার ছেলেদেরও নিষেধ করে। এসবে ইজ্জত নাই। পা চাটা, পয়সায় কেনা পালিত কুত্তা সে হবে কেন?... কালুর বেটা তিনটা বংশের সে তেজ পায়নি। ওরা হয়েছে কুর্চা মুরগির মতো। বাড়িতে মা-বোন বউ-বেটির ওপর রোব ঝাড়বে, বাইরে ম্যাঁও ম্যাঁও। তা না হলে তিন ছেলের বাপ হয়েও সমাজে তার এই হাল কেন হবে?... আজ কালুর ওপর তার বাপ-দাদার ভূত ভর করেছে। সব কিছু তছনছ করে দেবে। কলাগাছের মতো কচাকচ কাটবে টিপুর বেটারে। ‘শালা চুথিয়ার সাহস কত!...’ ভাবতে গিয়ে কালুর রক্ত রাগে ঘৃণায় উথাল-পাতাল হয়ে যায়—এত সাহস যোগায় কে?
কালুর মেয়ে সেমালি কিচ্ছুক্ষণ আগে আধমরা অবস্থায় বাড়ি ফিরেছে। হাত-পা আতঙ্কে কাঁপছিল। সে কী ভয়ানক দৃশ্য! হাতে মুখে খামচানির রক্তাক্ত দাগ। কোনও বাপ সে দৃশ্য সহ্য করতে পারে? সে চিৎকার দিয়ে ওঠে, ‘মা! তোর এ অবস্থা কে করেছে কহা হামাকে। কল্লাটা কেটে আনি!’ সেমালি ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলে, ‘এমপির বেটা হাকে দুপুরে একলা পেয়ে...’ আর কিছু বলতে পারে না। হু হু করে কেঁদে ওঠে। কালুর বুকটা রাগে উত্তেজনায় বর্ষার মহানন্দার মতো সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে। বটতলা হাটে কাশেমের জিলেপি ভাজা কড়াইয়ের তেলের মতো রক্ত টগবগ ফুটে ওঠে। সে মেসবাহর পোতা, রমজানের ছেলে—যাদের দেখে কতো লোক লুঙ্গি ভিজিয়েছে। অত সহজে ছেড়ে দিবে সে! মেম্বার-চেম্বার এমপি-মিনিস্টার যার বেটা হোক না সে—তার রক্ষা নাই। কলা গাছের মতো করে ঘচাঘচ সবার গলা কাটবে—যে তাকে বাধা দিতে আসবে তার রক্ষে নাই। টিপুর বেটা আরিফের কল্লা নিয়ে তবে বাড়ি ফিরবে সে। চুথিয়ারা জানে না সে কে? মগের মুল্লুক পেয়েছে, না! যা খুশি তাই করবে? ভোটের সময় তো কাচুমাচু মুখ নিয়ে ঐ এমপি তার দরজার গোঁড়ায় দাঁড়ায়। এখন মা-বেটির ইজ্জতে হাত। যদি কল্লা নামাতে না পারে এমপিরর বেটার—উপরে গিয়ে বাপ-দাদাদের কী মুখ দেখাবে?...
এমপি টিপু সুলতানের বাড়ির গেটে এসে কালু হাঁপাতে হাঁপাতে মাছ কুটা হাসুয়াটা উঁচিয়ে দারোয়ানকে বলে, ‘দরজা খোল আইজ এমপির বেটার কল্লা কেটে হামি বাড়ি যাব, না তো না। খোল দরজা, খোল। ’
দারোয়ান বেনু তাদেরই পাড়ার ছেলে। বয়স পঁচিশ ছাব্বিশ। সে সামান্য হেসে বলে, ‘চাচা, এত খেপেছেন ক্যানে? বসেন বাইরে ওই জায়গাটাতে বসেন। হাপাছেন, আগে রেস্ট লেন। ’ দরজার দু’পাশের শান বাঁধানো বেঞ্চগুলো দেখিয়ে দেয় বেনু।
-হামি বসতে আসিনি। দরজা খোল। টিপুর বেটার কল্লা লিব। শালা নিজের ব্যাটাকে সামলাতে পারে না, দেশ সামলাতে এসেছে। গুণ্ডা পুষে নেতাগিরি মারায়। আসুক ওর কত গুণ্ডাবাহিনী আছে। সব শালার গলা কাটব। শালা গরীব মানুষের টিন চুর। ওতোগুলান মাংস আইলো সৌদি থেকে সক্কাল থেকে বসিয়ে রেখে রাতে কহে সব শেষ। হারামি রিলিপ খোর। সুদখোর রাজাকারের বেটা আইজ দেশপ্রেমিক স্যাজেছে। শালার গোমোর ফাঁক করব। একাত্তরে বাপে-বেটায় গাঁও-গেরামের মেয়েদের ইজ্জত মেরেছে এখন বেটারে তালিম দিছে। সব শালা চুথিয়ারে কঁচু কাটা করব।
দারোয়ান বেনু সবই জানে। সে সেমালিকে কাঁদতে কাঁদতে এলোমেলো পোশাকে বাড়ি যেতে দেখেছে। তাছাড়া এমপির ছেলের স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে তার ভালোই জানা আছে। বিষয়টা বোঝার জন্য বেশি বুদ্ধি খরচ করতে হয়নি তার। গত দু’বছর যাবৎ এ বাড়ির সবগুলো নাটক তো তারই চোখের সামনে ঘটেছে...। তবে সে এমপির একেবারে বফাদার আদমি। জীবন যাবে তবু এ বাড়ির কোনও ক্ষতি হতে দেবে না—দারোয়ানের পেশাটাই তো এমন। বেনু দরজা না খুলেই বলে, ‘চাচা আপনি কেন রেগে আছেন এমন, হামি বুঝছি। কিন্তু আপনার কিছু হয়ে গেলে আপনার বউ আর বেটির কী হবে একবার ভেবেছেন? আপনার বেটাগুলা দায়িত্ব লিবে ওদের?’
‘তুই এমপির টান টানছিস বেনু। সেমালি তোর বোনোর মতো না?’—কালু উত্তেজিত হয়ে বলে।
বোনের মতো কী? বোনই তো মানি। একই পাড়ায় চোখের সামনে মানুষ হলো। আপনাকে নিজের মানুষ মনে করছি বুলেই তো বললাম। র্যাব যদি আপনাকে বাড়ি থেকে উঠিয়ে লিয়ে ক্রসফায়ার করে মহানন্দায় চুবায়ে রেখে যায়। আপনার বউ বাচ্চার কী হোবে? আপনি আমাদের পাড়ার মুরুব্বি বলেই বুল্লাম। আপনি কার বিরুদ্ধে কথা কোহোছেন একটু ভেবেছেন?
এবার কালু সামান্য ঠাণ্ডা হয়। লইলা পাড়ার পাঁচু—এমপির বিরুদ্ধে হোম্বিতোম্বি করে বেড়াত। একদিন ভোরে তার লাশ পাওয়া গেল সদরঘাটে। কপালে এক ইঞ্চি বুলেটের গর্ত। সবাই জানে এটা র্যাব অথবা পুলিশের কাজ কিন্তু কারও মুখে রা নাই। এমন কি পরিবারের লোকজনও থানায় একটা অভিযোগ করারও সাহস পেল না।
নিচের হল ঘরে এমপি টিপু সুলতান নেতা-কর্মীদের নিয়ে বসেছিল। কিছুক্ষণ আগেই সে বউকে সাথে নিয়ে শিবগঞ্জের বাগান বাড়ি থেকে ফিরেছে। গাড়ি ভরে খিরসাপাত আম নিয়ে এসেছে। আমগুলো পুষ্ট আর হলুদ হয়ে উঠেছে। ক’দিনে পাকবে। এগুলো ঢাকায় যাবে—দলের বড় বড় নীতি নির্ধারকদের বাড়িতে বাড়িতে। ফ্রেশ হয়ে নিচে এসে কেবল নেতা-কর্মীদের মাঝে বসেছে এমপি আর এমন সময় গেইটে কালুর চিল্লা-ফাল্লা!
উপস্থিত নেতা-কর্মীরা বলে, ‘টিপু ভাই, আপনি উপরে যান। আমরা কালুকে দেখছি। ’
তোমরা দেখবে কেন। এ এলাকার সবাই আমার আপনজন। যা করবার আমি করব। তোমরা কেউ ঘর থেকে বের হবে না। এখানেই বসো। ’
কালু কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর আবার চিৎকার শুরু করে। ‘খানকির পোলারে ঘরে লুকিয়ে রেখেছে কেনে? বাইরে বের হতে কী হোছে? চোর এমপি কোথাকার!’
‘বাহ! দুপয়সার জেলে হয়েও রাজনীতির ভালো খবর রাখে দেখছি!’ এমপি সাহেব অবাক হয়ে ভাবে, ‘সবই মিডিয়ার কল্যাণে। মিডিয়া এখন রাজপ্রাসাদ থেকে বস্তি সব জায়গায় ছড়িয়ে গেছে। ’ এমপি এবার নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলে, ‘বুঝলে তোমরা?’
‘কী ভাই?’ সবাই একযোগে জিজ্ঞেস করে ওঠে। আসলেই তারা কিছু বুঝতে পারছে না। কেন কালু—এমপি সাহেবের ছেলের ওপর এত খেপেছে? কী এমন করেছে সে? তারা সবাই জানে তাদের টিপু ভাইয়ের ছেলে একটু বখাটে টাইপের... তবে কি?
‘এ দেশে সত্যিকারের গণতন্ত্র আসতে দেরি নাই। সবাই কথা বলতে শিখেছে। ’—এমপি মুচকি করে হেসে বলে।
‘কালু একটা পাগল। যেখানে সেখানে হট্টোগোল বাঁধানো ওর কাম। মাছের বাজারে এমন দিন নাই যেদিন কালু ঝগড়া করে না। ওর বাপও ছিল একটা পাগলা। শালারা পাগলের গুষ্ঠি। ’—দলের এক কর্মী বলে।
‘ওর দুটা ছেলে আছে না?’—এমপি জিজ্ঞেস করে।
‘জি ভাই। ’ কাসেম বলে। ‘তিনটা। ’
‘কোন দলের?’—এমপি জিজ্ঞেস করে।
‘ভাই ওরা কোন্দলেও নাই কোনও দলেও নাই। নিরীহ গোছের। বাপের মতো ট্যারা স্বভাবের না। ’
এদিকে কালু চিৎকার করে চলে, ‘টিপু মরল না কি? তোর বেটাকে লিয়ে আয়। কল্লা নামাব। ’
সবাই অবাক হয়, এমপি এভাবে বসে আছে কেন—কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে?
দারোয়ার বেনু এমপির কাছে এসে বলে, ‘ভাইজান, আপনি বলেন, কী করি? ধরে বাঁধব না মেরে তাড়াব?’
এমপি সামান্য হেসে বলে, ‘তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না। যাও গেটে দাঁড়াও গে। ’
এমপি একটা সিগারেট ধরায়। সে জানে কিভাবে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এতটুকু বুদ্ধি না থাকলে এলাকার বাঘা বাঘা পুরনো নেতাদের বোকা বানিয়ে সে কী করে দলের কেন্দ্র থেকে নমিনেশন পেল—এমপি হলো।
‘তোমরা আম না খেয়ে যাবে না কিন্তু। তোমাদের জন্য কিছু গাছপাকা আম এনেছি। ’—সিগারের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে এমপি বলে।
‘টিপু ভাই, আপনি বললে আমরা বিষয়টা হ্যান্ডেল করতে পারি। প্রেসের কানে গেলে আপনার বদনাম হবে। ’—ঘটনাটা আসলে কী? সত্য—কী ঘটেছে?... এমন সব প্রশ্ন সবার মনে থাকলেও এমপিকে সে বিষয়ে জিজ্ঞেস করার কেউ সাহস পাচ্ছে না। প্রকৃত ঘটনার আশপাশ দিয়ে ঘুরপাক খেতে থাকে তারা।
এমপি টিপু সুলতান এবার তার সিগরেটের শেষটা ফেলে সবাইকে বসতে বলে বাড়ির মেইন গেটের দিকে এগিয়ে যায়। কালু তখনও চিৎকার করে চলেছে। টিপু কাছাকাছি চলে এলে কালুর কণ্ঠের তীব্রতা কমে আসে। হাসুয়া ধরা হাতটাও ভারী হয়ে আসে এবং ধীরে ধীরে হাত দুটো পিঠের পেছনে হারিয়ে যায়।
‘কী রে কালু? কী হয়েছে তোর?’
‘আপনার ছেলে কই? ওকে ডাকেন। ’
‘আমার ছেলের সাথে তোর দরকার কী?’
‘দরকার ছিল এমপি সাহেব। আপনার সাথে আমার কিছু না। ’
‘বাড়ি যাহ। কাল সকালে আসিস। বাড়িতে মেহমান আছে। এই নে কিছু টাকা রাখ। ’
এমপি দরজার গ্রিল দিয়ে বন্দি বাঘকে একতাল মাংস ছুড়ে দেয়ার মতো করে কিছু টাকা ছুঁড়ে দেয়।
‘আপনার ছেলের সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম। ’—টাকাগুলো কালু হাতে নেয় না।
‘আবার এক কথা! বল্লাম না দেখা হবে না। ’
‘তাহিলে হামি যাব না। ’
‘আমার শত্রুরা তোকে পাঠিয়েছে, না? আমাকে বদনাম করতে চাস? সে সুযোগ কিন্তু পাবি না। বন্ধুত্বের হাত বাড়াবি তো বন্ধুত্ব পাবি। শত্রুতা করবি তো শত্রুর ভাষাও আমি জানি। মাটির এমন নিচে ঢুকাব তোকে কেউ খুঁজে পাবে না। ’ এমপির চোখ-মুখ লাল হয়ে ওঠে।
‘আপনার ছেলেটা এমন করল’...
‘আহা থাম। ’—এমপি কালুকে থামিয়ে দেয়। ‘সেটা কী হয়েছে আমি দেখব। আমার ছেলে কোনও অন্যায় করলে তার শাস্তি সে পাবে। সে বিষয়ে আমি ছাড় দিব না। তুই টাকা কটা নিবি না?’—এমপি কটোমটো চোখে কালুর দিকে চায়।
কালু কাঁপা কাঁপা হাতে টাকাগুলো কুড়িয়ে নেয়। পা দুটা যেন ভারী হয়ে গেছে তার। গলায় যেন কাঁচা গাবের আঠা জমেছে। চোখ দুটো জলে ভিজে যায়। সে ভুলেই যায় বতার বাবা রমজানের কথা, ‘পুরুষ মানুষের চোখে জল না প্রতিশোধের আগুনই মানায় বাপ। ’
অতপর কালু যখন ফিরে আসছিল বিলের বকের মতো মাথাটাকে নিচু করে—শেষ বিকেলের রোদেও সে তার বাপ-দাদার ছায়া দুটোকে স্পষ্ট দেখতে পেল। ওরা দুজন সাপের নৈঃশব্দ্যে কালুকে অনুসরণ করছিল। কালুর কিন্তু সাহস হলো না পেছন ফিরে ওদের মুখোমুখি হতে। কারণ ওদের চোখে চোখ পড়লেই ওরা গালি দিয়ে বলবে, ‘হারামি! দু পয়সায় মেয়েটার সাথে সাথে বাপ-দাদার ইজ্জত বেঁচে আইলি?’
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৫