মানুষ চিরদিন বেঁচে থাকার নয়। তবে কোনও কোনও মৃত্যু মেনে নেওয়ারও নয়।
মূলত ষাটের দশকেই ছোটকাগজের বিকাশ ঘটেছে ভিন্ন চিন্তা-চেতনা, স্পর্ধা, শক্তি আর ভিন্ন দর্শন সঙ্গে নিয়ে। এ সময় বগুড়াও থেকেছে অগ্রগামী ও সক্রিয়। এ দশকেই মূলত বগুড়ায় ছোটকাগজের বিকাশ ঘটে। ষাটের প্রথমার্ধে, পঞ্চাশের শেষার্ধে অধ্যাপক মহসীন আলী দেওয়ানের অনুপ্রেরণা, প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে সাহিত্যচর্চার পরিবেশ। প্রকাশ পায় শিল্প-সংস্কৃতির কাগজ ‘অতএব’। আর এ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে এক নবচিন্তার উন্মাদনা জমাটবদ্ধ হতে থাকে। অনতিতরুণ থেকে সাহিত্যপ্রেমী বয়োবৃদ্ধ সকলেই সাহিত্য কাগজের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে, যা পরবর্তীতে সাহিত্য কাগজকেন্দ্রিক চর্চা, তথা আন্দোলনকে বেগবান করে তোলে। এই আন্দোলনে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন কবি ও প্রাবন্ধিক ফারুক সিদ্দিকী।
তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি প্রতিনিয়ত কবিতার আঁচলে আঁকতেন চিন্তার বিচিত্র ছবি। তাঁর তুলির ঠোঁটে ঢেউ খেলত নান্দনিক শব্দের পশরা। কবিতার ভাঁজে-ভাঁজে জাগিয়ে রেখেছেন ছন্দের যৌবনকে। তাঁর কবিতা পাঠকের হৃদয়কে শীতল ছায়া দেয়—তাঁর একমাত্র কবিতাগ্রন্থ ‘স্বরচিহ্নে ফুলের শব’ প্রকাশিত হয় বাহাত্তরে। প্রকাশক বিপ্রতীক গোষ্ঠির পক্ষে কবি রেজাউল করিম চৌধুরী, বাদুরতলা, বগুড়া। এর কবিতাগুলো সবই আগে বিভিন্ন ছোটকাগজে প্রকাশিত। কারণ তিনি মূলত ছোটকাগজেরই লেখক ছিলেন। ছোটকাগজকে ঘিরেই তাঁর বেড়ে ওঠা। ফারুক সিদ্দিকী কবিতা নির্মাণের কেমন কারিগর ছিলেন তাঁর কবিতা পড়লে অনেকটা ধারণা পাওয়া যায়। স্বরচিহ্নের জ্বর, খোলাচিঠি, বৈরীদেবতা, তৃতীয় ফলক পুষ্পঘাতক, হে প্রেম হে খড়হাঁস কবিতার নাম করণে রহস্যময়তা উপস্থিত। কবিতার শরীর জুড়েই কাব্যিকতা, কিছু পঙক্তি এমন—
দুগ্ধবতী পদ্মকোরক ফুল দল অপঘাত আঘাত দগ্ধ (জ্বর)
প্রিয়তমা, আমি তোমার অখণ্ড আঁধার (খোলাচিঠি)
প্রিয়তমা, তুমি গোলাপ অশ্রুর মতো ক্ষণিক রূপকথা (খোলাচিঠি)
বিলাপ শব্দের গন্ধময় অমিতাভ কোকিল কাল (বৈরী দেবতা)
এইখানে পৃথিবীর বয়সী বাতাসে থেমে গেছি (তৃতীয় ফলক)
চকিত আঁধারে সব সাজানো লাবণ্য অনুভূতি? (পুষ্প ঘাতক)
তুমি কী চাও কোন স্বপ্নের পরিচিত নামাবলি হতে? (হে প্রেম হে খড়হাঁস)
ছোটকাগজের আয়ুবর্ধনের প্রতিযোগিতায় ‘বিপ্রতীক’ দীর্ঘ পথ হেঁঠেছে—হাঁটবে, থেমে থাকবে না ফারুক সিদ্দিকীর ছোটকাগজ। তিনি জীবনকে উপভোগ করেছেন সম্পাদনা ও কবিতায়। তাঁর সৃষ্টি বেঁচে থাকবে কালের অন্তরে, সঙ্গে তিনিও। তাই আজও বিশ্বাস করতে পারি না সম্পাদক ফারুক সিদ্দিকী চলে গেছেন কোন এক অজানা পৃথিবীর আড়ালে। তিনি আছেন নান্দনিক শব্দের বর্ণে, ছোটকাগজ উচ্চারণের নীরব গুহায়।
সম্পাদনা করেছেন ‘বিপ্রতীক’, একান্ত দ্রোহের অধিকারে। কবিতাপত্র ‘বিপ্রতীক’-এর শুরু ১৯৬৭-এর জানুয়ারি। বিপ্রতীক ছিল তরুণদের স্বপ্নের কবিতাপত্র, ফারুক সিদ্দিকী ছিলেন ছোটকাগজটির জন্মদাতা। প্রথম সংখ্যার সম্পাদক মহাদেব সাহা ও কাজী রব প্রকাশক ফারুক সিদ্দিকী, প্রচ্ছদ করেছিলেন সংগীতশিল্পী অধ্যাপক মৃণালকান্তি সাহা। কবিতাবিষয়ক প্রবন্ধ ও গ্রন্থ আলোচনা এ পত্রিকার বিষয় ছিল। বিপ্রতীক সারা দেশে তরুণদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ষাটের দশকে যে তরুণরা বিপ্রতীকে লিখতেন তাদের মধ্যে ছিলেন আবদুল মান্নান সৈয়দ, নির্মলেন্দু গুণ, হুমায়ুন কবির, সাযযাদ কাদির, আবুল হাসান, আসাদ চৌধুরী, আফজাল চৌধুরী, রাজীব আহসান চৌধুরী, রবীন সমাদ্দার, মোহসিন রেজা প্রমুখ। নবীন-প্রবীণ অনেকের লেখাই বিপ্রতীক ধারণ করেছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকেও অনেকে লিখতেন।
বিপ্রতীকের মোট ৩৫টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। এটি সম্ভব হয়েছে কবি ও সম্পাদক ফারুক সিদ্দিকীর ঐকান্তিক আগ্রহ ও নিষ্ঠার কারণে। সম্পাদনার বাইরেও তিনি লিখেছেন কবিতা ও প্রবন্ধ। ১৯৭২-এর সেপ্টেম্বর মাসে ফারুক সিদ্দিকীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘স্বরচিহ্নে ফুলের শব’ প্রকাশিত হয়। ছাপা হয় ঢাকায় এবং প্রকাশ করেন রেজাউল করিম চৌধুরী বিপ্রতীকের পক্ষে। এখন পর্যন্ত ফারুক সিদ্দিকীর এই একটিমাত্র কবিতার বই। মোট ৪৮টি কবিতা নিয়ে এর আত্মপ্রকাশ। স্বাভাবিকভাবে ষাট দশকের অবয়ব এবং ষাট দশকীয় ধ্যান-ধারণা এ কবিতাগুলোয় বিদ্যমান। ফারুক সিদ্দিকী শব্দকুশলী কবি। শব্দই যেহেতু তাঁর কবিতার প্রাণ—একের পর এক শব্দ সাজিয়ে সেগুলো হয়ে উঠেছে কবির আত্মোপলব্ধির এক অমল স্বাক্ষর। ফারুক সিদ্দিকীর ব্যতিক্রমী কবিতাবলির উল্লেখযোগ্য বাকভঙ্গিটি হচ্ছে দীর্ঘ ক্রিয়াপদশূন্য পঙক্তির ঋজু ব্যবহার। কবি সমাজসত্যের দিকেও যেমন চোখ রেখেছেন আবার রোমান্টিক চেতনাকেও অস্বীকার করেননি। ফারুক সিদ্দিকী শব্দের অন্বেষণে বহুদূর যান। শব্দায়ন এবং শব্দপ্রয়োগের নিপুণতাই ‘স্বরচিহ্নে ফুলের শব’-এর কবি ফারুক সিদ্দিকীকে ব্যতিক্রমধর্মী কবি হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
যেমন কবিতায়, তেমনি প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রেও ভিন্ন পথযাত্রী ছিলেন ফারুক সিদ্দিকী। ২০০৩-এর ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত তাঁর প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ ‘তামসিক নিসর্গে ঈশ্বরনামা ও অন্যান্য’ সাহিত্যের পরাপাঠকদের চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে। তাঁর গদ্যের ভাষা প্রবহমান ধারায় বাধাগ্রস্ত মনে হলেও প্রবন্ধের বিষয়ে অনেকেরই অধিগম্য হওয়ার কথা। বিষয় সহজ, ভাষা জটিল অর্থাৎ ফারুক সিদ্দিকীর গদ্যভাষা তার স্টাইলের অনুসারী।
গত বছর ২৩ এপ্রিল ৭৩ বছরের স্মৃতি রেখে ফারুক সিদ্দিকী চলে যান না ফেরার দেশে। প্রথম মৃত্যু বার্ষিকীতে কবির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানিয়েই এ লেখা। ফারুক সিদ্দিকীর জন্ম ১৯৪১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর।
সাহিত্য ও লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনে বিশেষ অবদান রাখার জন্য তিনি বগুড়া লেখক চক্র, কবি মনোজ দাশগুপ্ত স্মৃতি পুরস্কার, বগুড়া জেলা প্রশাসন পদক ও লিটলম্যাগ সম্মিলিত প্রয়াস সম্মাননাসহ আরও অনেক সম্মাননা পেয়েছেন।
মানুষ চলে গেলেও থাকে তার সৃষ্টি। বাংলাদেশে লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে বিপ্রতীক। একজন কিংবদন্তী সম্পাদক হিসেবে লেখা হবে কবি ফারুক সিদ্দিকীর নাম। ইতিহাস সাক্ষী দেবে কাল থেকে মহাকালে। ফারুক ভাই অনন্তকাল বেঁচে থাকুক নান্দনিক চেতনায়। তাঁর চিন্তা, সৃষ্টি ও নান্দনিকতার নিকট আমরা চিরকাল ঋণী থাকব। প্রিয় ফারুক ভাই কাছে থেকেও কাছে নেই। দেখা হবে বর্ণে, চরণের অন্তরালে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০১৫