আমার ঘরের অনেক আসবাবপত্রের প্রাচুর্যের ভিতরে কিভাবে যেন প্রাচীন একটা ট্রাংক পড়ে ছিল। আমরা সবাই তার কথা ভুলে গিয়েছিলাম—এমনকি আবহাওয়া—যে কিনা শক্ত যুবক ধাতুকেও একদিন মরিচার বার্ধক্যে জীর্ণ করে ফেলে—অথচ ট্রাংকটা আবিষ্কৃত হওয়ার পরে দেখা গেল সে এখনও ওই বৃদ্ধের দাঁতের মতো অটুট—যে বাঁধানো দাঁতের লোকদের উপহাস তো করেই, পাশাপাশি সে এবং তার আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশিরা সেই দাঁতের গল্পে ঢুকিয়ে দেয় গর্ব ও বিস্ময়ের বিচিত্র সব উপকথা।
তো ট্রাংকটা আবিষ্কৃত হওয়ার পর তার ভেতরে কী আছে জানার জন্য আমরা এত বেশি ব্যাকুল হয়ে উঠলাম যে, গুপ্তধন পাওয়া লোকেরাও এই ব্যাকুলতা দেখলে হীনমন্যতায় ভুগতে শুরু করবে। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক, কারণ ট্রাংকটা যখন সক্রিয় ছিল—সেই সময়কার পারিবারিক সদস্যদের অনেকেই এখন ইহধামে নেই এবং যারা আছে তারাও সেই দিনগুলি থেকে এত সুদূরে চলে গেছে যে স্মৃতির শ্রেষ্ঠ দূরবীনটাও আর পারছিল না দূরত্বের এই অকল্পনীয় আলোকবর্ষ অতিক্রম করতে। ফলে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় ট্রাংকটার ডালার পোশাক খুলে ফেলে তার শরীরের মধ্যে কামুক হাত ঢুকিয়ে তার যাবতীয় যৌনতাকে তচনচ করে আমাদের অজানা অতৃপ্তিকে শান্ত করার অভিযান শুরু করলাম আমরা। এই অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছিল আমার বউ—সঙ্গে ছিল তার নাবিক ছেলে এবং আমি একটু দূরে বসে বিজ্ঞানের বিশেষ একটা শাখার বিশেষজ্ঞের মতো অপেক্ষা করছিলাম এন্টার্কটিকার অজনা এই অঞ্চল কী উপাত্ত দেয় তা জানতে।
পৃথিবীর সব প্রাচীন ট্রাংক পরবর্তী প্রজন্মের কাছে যে সমস্ত জিনিস ফিরিয়ে দেয়—দেখা গেল আমাদের ট্রাংকটাও সেই সব জিনিসই জমিয়ে রেখেছিল। আমার বউয়ের আইসব্রেকার হাত বহু বছর ধরে যে নীরবতার বরফ জমে ছিল ট্রাংকটার মধ্যে—তাকে ভেঙে নিচের জল থেকে এই আলাদা সময় মহাদেশটির বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদের মতো তুলে আনছিল বিভিন্ন পোশাক, কাঁথা, বাসনপত্র। আর তার সহকারি আমার নাবিক পুত্র মায়ের কৌতূহলের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে জিনিসগুলির প্রথম দর্শনের নোঙর নিক্ষেপ করেই উঠিয়ে নিচ্ছিল নিজের জাহাজটা সেখানে ভিড়াতে চায় না বলে। তার জ্যান্ত পৃথিবী তাকে ডাকছে কিন্তু তারপরও এই প্রাচীন নগরীতে যদি হঠাৎ সে পেয়ে যায় কোনও পছন্দের বাসস্থান—সেই আশায় নিজেই একসময় নেমে যেতে চাইল ট্রাংকটার মধ্যে। কিন্তু তার মা তাকে থামিয়ে রেখে একটার পর একটা জিনিস বের করে রাখছিল খাটের ওপরে এবং আমি অনেকদিন আগে দেখা কোনও কোনও মুখের মধ্যে হঠাৎ করে খুঁজে পাচ্ছিলাম একটা পরিচিত থুতনির আদল কিম্বা কপালের ভাঁজ অথচ সম্পূর্ণ মুখটা বা সেই মুখের মালিকের নাম মনে আসছিল না সহজে।
এইরকম সময় হঠাৎ ট্রাংকের ভিতর থেকে একটা শার্ট বেরিয়ে এসে আমাকে বর্তমান থেকে উঠিয়ে নিয়ে আঁছড়ে ফেলল আমার শৈশবের দিনগুলিতে। এটা আমারই ছোটবেলার জামা কিন্তু মনে হচ্ছিল পিরামিডের কোনও একটা গুপ্ত কবর থেকে বেরিয়ে এসেছে আমার পূর্বপুরুষের মমি। আমাকে সে ইতিহাসের কথা জানাবে—জানাবে হাজার হাজার বছর আগে আমি কেমন ছিলাম—কিভাবে কাটত আমার জীবনের দিনগুলি—এইসব। অথবা শার্টটা যেন সেই প্রথম এককোষী প্রাণ যা পরবর্তীতে বিবর্তিত হতে হতে আজ এখন এক জটিল প্রাপ্তবয়স্ক মানুষে পরিণত হয়েছে।
এখন আমি ট্রাংকের আর সব জিনিসগুলির কথা ভুলে গেছি। মনে হচ্ছে এই শার্টটাই যেন ওই ট্রাংকে ছিল—এবং শার্টটাকে আমার কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যই যেন ট্রাংকটা এতদিন ধরে জীবিত রেখেছে নিজেকে।
শার্টটাকে হাতে নিয়ে প্রথমেই আমি দেখতে চাইলাম তার বর্তমান অবস্থা। এখন কেউ আমাকে দেখলে এক নিমেষেই বলে দেবে আমি একটা মমির ব্যান্ডেজ খোলার কাজে ব্যস্ত আছি। সতর্কতা এখন মনযোগের শীর্ষবিন্দুতে একটা সুঁইয়ের মতো প্রখর। সেই সাথে মমতা—আমার হাতে নারীর স্তনের মতো কোমল একটা দস্তানা সে যেন পরিয়ে দিয়েছে। এই শার্টটার কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। ছোটবেলায় অনেক অনেক ঘটনার মতো বিস্মৃত হয়ে হারিয়ে গিয়েছিল সে। ওটাকে পাবার এক মুহূর্ত আগেও জানতাম না এইরকম একটা শার্ট আমার ছিল কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এটাই যে—যেই শার্টটাকে দেখলাম অমনি শুধু শার্টটাই না বরং তার সঙ্গে জড়িত সেই দিনগুলি তাদের সমস্ত আলো অন্ধকারসহ এমনভাবে হাজির হলো আমার স্মৃতিতে যে ভুলে যাওয়ার ব্যাপারটাকেই মনে হলো অবাস্তব। একটা কলিংবেল যেভাবে জাগিয়ে দেয় একটা ঘুমন্ত বাড়িকে তার সব আসবাপত্রসহ—এই শার্টটাও যেন সেইরকমই করল আমার সঙ্গে।
এখন আমি শার্টটাকে সামনে বিছিয়ে রেখে বসে আছি খাটের ওপরে। এখন আমি এই শার্টটাকে ছাড়া ভুলে গেছি আমার চারপাশের ছড়িয়ে থাকা বর্তমানের আর সব কিছুকে। আমার স্ত্রী, পুত্র, হঠাৎ করে আবিষ্কৃত হওয়া একটা ট্রাংক, ট্রাংকের ভিতরে পাওয়া বিভিন্ন জিনিসপত্র, স্ত্রীর কৌতূহল, পুত্রের অনুসনদ্ধিৎসা—সবকিছুই এখন পকেট ভর্তি টাকা থাকার পরে রাস্তায় পড়ে পাওয়া একটা সিকির মতো তুচ্ছ। আমার প্রত্নতাত্ত্বিক ব্যাকুলতা আমার পূর্ব পরিচয়কে আবিষ্কার না করে এখন আর শান্ত হতে চাইছে না। জানতে চাইছে আমার আদিম গ্রামের মানচিত্র—বহুবছর আগে যাকে ছেড়ে এসেছি। আমার রক্তের মধ্যে একটা বিবর্ণ সিংহ যেন উদ্দাম হয়ে উঠতে চাইছে তার অরণ্য মাতৃভূমির গন্ধে চিড়িয়াখানার মাপা মাংসের দৈনন্দিনতা থেকে বেরিয়ে এসে।
এদিকে আমার বউ ততক্ষণে বের করে ফেলেছে ট্রাংকটার সব জিনিস এবং পরিমাপ করতে শুরু করেছে ওইসব জিনিসের ঐতিহ্যগত মূল্য। আর আমার পুত্র এইসব ঐতিহ্যের সাংঘাতিক সব মূল্য সম্বন্ধে ভয়ংকর অসচেতনতার পরিচয় দিয়ে চলে গেছে তার জীবন্ত পৃথিবীর নিজস্ব জগতে। যা কিছু সে ভালোবাসে—তারা সব ট্রাংকের বাইরে থাকে বলেই সে আর এখন এখানে নেই। হঠাৎ আমার মনে হলো ছেলেটাকে এই শার্টটা দিয়ে দিলে কেমন হয়। আমি তো আমার স্ত্রীর ভিতর দিয়ে আমাকেই আবার জন্ম দিয়েছি আমার ছেলের চেহারায়। ফলে নিজের শৈশবটাকেও যদি এই শার্টের ভিতর দিয়ে তাকে দিয়ে দেওয়া যায়—তাহলে হয়তো আমার আমিত্বটায় একটা সম্পূর্ণ পুনর্জন্ম ঘটানো যাবে। কোথাও এতটুকু ফাঁক থাকবে না অপূরণীয়তার।
কথাটা মনে আসতেই বউয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম প্রস্তাবটা তার কাছে পেশ করার জন্য। বউ তখন একটা অতিপ্রাচীন কাঁথার সেলাই সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ছিল। ফলে আমার দৃষ্টি আর্কষণের চেষ্টাটা তাকে বিরক্তই করল বলে মনে হলো। এবং আমার সময়জ্ঞান সম্বন্ধে কোনও ধারণাই নেই—এইরকম একটা মন্তব্য করে আবার ফিরে গেল নিজের মুগ্ধতায়। সেই সঙ্গে কাঁথাটির জন্ম ইতিহাস সম্বন্ধে শুরু করল এমন সব প্রশ্ন—যার উত্তর আমি কোনদিনও জানতাম না। ফলে ফিরে গেলাম নিজের ছোটবেলার শার্টটার কাছেই। ধুয়ে ভাঁজ করে রাখা এই শার্টটা যেন আর কিছুক্ষণ পরেই আমার মা আমাকে পরিয়ে দিয়ে আমাদের বাড়ির পাশের মাঠটায় খেলতে পাঠাবে। আর আমি ঝকঝকে বিকালের উদ্দীপ্ত আলোয় এই শার্টটার মতোই উজ্জ্বল পরিচ্ছন্ন একটা বিরাট জীবনে মিশে যাব নিজের ছোট্ট একটুকরা জীবনকে নিয়ে।
ছেলেকে শার্টটা দিয়ে দেবার জন্য পাশের ঘরে গেলাম ওকে খুঁজতে, জীবনের অনেক বিষয়ে বউয়ের পরামর্শ না নিলেও চলে—এই ধারণার বশবর্তী হয়ে। কিন্তু ছেলেটাকে খুঁজে পেলাম না সেখানে। ফিরব ভাবছি এমন সময় হঠাৎ একটা দীর্ঘ আয়না এসে দাঁড়াল আমার সামনে। স্টিলের আলমারির সঙ্গে লাগানো আয়নাটা মুখামুখি হবার সাথে সাথেই তার বুক চিরে বের করে আনলো আমার প্রতিকৃতি। হাতে আমার ছেলেবেলার শার্ট।
দৃশ্যটাকে দেখেই আমার মনে হলো শার্টটাকে যদি এই জটিলতর প্রাপ্তবয়স্ক শরীরে একবার পরি—তাহলে বোধহয় বুঝতে পারব কতটা বড় হয়েছি আমি। ভাবনাটা মাথায় আসতেই এতক্ষণ ধরে পড়ে থাকা শার্টটাকে খুলে ফেললাম শরীরটাকে উলঙ্গ করে দিয়ে। এখন আয়নায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আমার পেশীবহুল রোমশ দেহটাকে—যার একটা খণ্ড একদিন ওই শার্টটার খোলশে একটা নরম শিশু শামুকের মতো ছিল। এখন কতটুকু ঢুকতে পারব আমি ওই খোলশটাতে? হয়তো যেখানে একদা আমার বাহু থাকত একটা সুডৌল কলার মতো—সেখানে এখন আমার হাতটা ঢুকতে গিয়ে দম আটকে মরবে। শার্টটাও হয়তো ছটফট করে উঠবে। যন্ত্রণার রক্তপাত হবে। আর আমি কোনও এক হঠাৎ উত্তেজনার মুহূর্তের পরের মনোবেদনায় আচ্ছন্ন হব। শার্টটা তো এখন আমার ছেলের কিন্তু তারপরও মনের এক গোপন অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা একটা কৌতূহলের প্ররোচনায় শার্টটার হাতার ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিলাম তার নরম যৌনতাকে স্পর্শ করবার জন্য।
সাথেসাথেই ঘটে গেল একটা অবাক করা ঘটনা। যা ছিল অকল্পনীয়, অবস্তুগত—পৃথিবীর বিস্তৃততর কল্পনাগুলিও যাকে তাদের ডানার তলায় আশ্রয় দিতে কুণ্ঠিত হবে—সেই ঘটনাটাকেই এত সহজে ঘটতে দেখে অবাক হওয়া ছাড়া আর কিইবা হতে পারি আমি। স্পষ্ট দেখলাম আমার হাতটা শার্টের হাতার ভিতর দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে অক্লেশে এবং হাতাটা একেবারে আমার বাহুমূল পর্যন্ত এগিয়ে এসে থামল।
কিন্তু আসলে থামল না বরং আরও যেন ঢুকে পড়তে চাইল আমার সমস্ত শরীরটাকে গিলে খেয়ে ফেলার জন্য। অথচ আমিই শার্টটার ভিতরে ঢুকতে চেয়েছিলাম—পরীক্ষা করতে চেয়েছিলাম নিজের বড় হয়ে ওঠার মাত্রাটাকে। আর এখন ছোট্ট সেই শার্টটা একটা বিরাট অজগরের মতো তার লালায় আমাকে পিচ্ছিল করে নিয়ে একটু একটু করে গিলছে।
তারপর একটা সময় আমি সবটা ঢুকে পড়লাম শার্টের মধ্যে। অজগরের চোয়ালের ভিতর দিয়ে লালা মিশ্রিত একটা খাদ্য শরীরের মতো ধীরে এবং নিশ্চিতভাবে আমার শৈশব গিলে ফেলল আমার বর্তমানের আমিটাকে। বিরাট একটা আলখাল্লার অজস্র কাপড়ের স্তূপের নিচে আমি চাপা পড়ে আছি এখন। হঠাৎ দম আটকে যেতে চাইল আমার। বাতাসের জন্য ছটফট করে উঠল ক্ষুধার্ত ফুঁসফুঁস। ঘটনাটা কী? এই রকম তো হতে শুনিনি কখনও। একটা বিরাট প্রাপ্তবয়স্ক আমি এইভাবে আমার শৈশবের ছোট্ট একটা জামার মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যাব—এটা কি সম্ভব?
কিন্তু ব্যাপারটা ছিল ওইরকমই এবং আমি সত্যি সত্যিই শার্টটার মধ্যে লুপ্ত হয়ে গেলাম।
অনেকক্ষণ পরে খোঁজাখুঁজি করে কোথাও আমাকে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত পাশের ঘরে এসে আমার বউ দেখল একটা ছোট্ট শার্ট পড়ে আছে মেঝেতে। কে এটাকে এখানে ফেলল—সেই কারণ উদ্ধার করতে না পেরে সে শার্টটাকে তুলে নিল হাতে। পরে এই বিশৃঙ্খলার উৎস সন্ধান করবে ভেবে এবং ভাঁজ করে রাখতে চাইল পাশের আলনায়।
এমন সময় শার্টের ভিতরে কী যেন একটা নড়েচড়ে উঠল। আভাসে কালো একটা পোকার মতোই মনে হলো সেটাকে এবং আরশোলাকে ভয় পেতে অভ্যস্ত আমার বউ শিউরে উঠে তাড়াতাড়ি শার্টটাকে বারান্দায় এনে ঝাড়া দিয়ে পোকাটাকে মাটিতে ফেলে পায়ের চাপে থেলে পিষে ফেলল অহেতুক পোকাদের জন্ম রোধের প্রয়োজনে।
এরপর কী হয়েছিল আমার আর জানা নেই।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০১৫