রাত তখন বেশ গভীর, দুইটা পেরিয়েছে। ডিজিটাল ল্যান্ডফোনের পিনপিনে রিংটোনের আওয়াজে সড়ক ও জনপথ বিভাগের সাব-ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার ফারহান আখতারের গাঢ় হয়ে আসা ঘুমটার দফারফা হয়ে গেল।
ভেসে এলো অস্থির কণ্ঠ, ‘স্যার, আমি এস আই ফরিদ, কুন্টিংছড়ি স্টেশন থেকে! এখানে মেইন রোডে একটা ব্রিজ ভেঙে পড়েছে, স্যার। রাস্তা পুরা বন্ধ। তবে অন্য কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ’
‘হোয়াট! কোথায়? কোন পয়েন্টে?’
‘কুন্টিংছড়ি থেকে বান্দরবন যেতে, আড়াই কিলো দূরেই হবে, স্যার। ’
এর থেকে আর বড় সমস্যা হয় না। বিশেষত চিটাগাং সার্কেলের ইঞ্জিনিয়ার হলে তো কথাই নেই! তবে এমন ঘটনা বড় একটা ঘটে না এখন, বহুদিন হয়নি।
‘এখন তো আর কিছুই করা সম্ভব না, আমি এখন উপরে জানিয়ে দিচ্ছি আর ভোরেই রওনা দিয়ে দেব। একটা বেইলি ব্রিজ আপাতত করে ফেলতে হবে। আপনারা এখনকার মতো ট্র্যাফিক কন্ট্রোল করুন আর খবরটা রাস্তার প্রবেশমুখে জানিয়ে দিন, যেন ব্রিজ পর্যন্ত এসে হয়রানি না হয়। ’
একটা ওয়াটার স্কুটারে চেপে বেশ খানিকটা গভীর সাগরে চলে এলো নৃ, এদিকটায় কেউ নেই। পানি এখানে নিথর। ইঞ্জিন থামাল ও, বুক চিতিয়ে স্কুটারের ওপর দাঁড়াল, তারপর আলগোছে একপাশ দিয়ে পানিতে নেমে পড়ল। খানিকক্ষণ ভাসল, তারপর দু’হাতে আস্তে আস্তে গাঢ় নীল পানি কেটে এগুলো। হৃদপিণ্ডের স্পন্দন একটু বাড়াল, পানিতেই একরকম স্ট্রেচিং করল ও, সারা শরীরের জয়েন্টগুলো সচল করে নিল। ব্যাকস্ট্রোক, বাটারফ্লাই সহ আরও দু’একটা স্টাইলে সাঁতরাল খানিকক্ষণ, পানিতেই প্রায় সব ক’টা মাসলগ্রুপের ওপর নজর দিল আলাদাভাবে, শেষে ডুবসাঁতার। কেউ থাকলে দেখতে পেত ডলফিনের মতো এঁকেবেঁকেকিভাবে একটা মানুষ পানি কেটে এগিয়ে যাচ্ছে। ওর কাঁধ আর বুকের অংশটা চওড়া, কিন্তু পেটের কাছটা বেশ সরু; একেবারে পারফেক্ট ‘ভি’ শেইপ, সাঁতারের জন্য দারুণ গড়ন। পেশিগুলোতে ক্লান্তি না আসা পর্যন্ত চালিয়ে গেল নৃ, চামড়ার নিচে রগগুলো ফুলে উঠল ওর। ততক্ষণে অদ্ভুত প্রশান্তিতে ছেয়ে গেছে প্রাণমন। স্ট্রেস কমাতে সাঁতারের জুড়ি নেই। স্কুটারে উঠে আঙুল চালিয়ে কপাল থেকে চুল সরালো নৃ, তারপর ইঞ্জিন স্টার্ট দিল।
নৃ এখন কক্সবাজারে, পনের দিনের শ্রান্তি ও বিনোদনের ছুটি নিয়ে বেরিয়েছে। ছুটিটা সরকারি কর্মকর্তারা তিন বছর পরপর পায়। প্রায় দেড় বছর পর সাগরে নেমেছে ও, আগেরবার শ্রীলংকার উনাওয়াটুনা বিচের পান্না সবুজ পানিতে নেমেছিল। সাগরের পানি ওর কাছে অপার আনন্দের উৎস, তবে ও একটু একাকী তট পছন্দ করে যা কক্সবাজারে পাওয়া মুশকিল। তাই ওয়াটার স্কুটার নিয়ে একটু নিরালায় চলে এসেছে ও। গত তিন দিন ধরে একই কাজ করছে, রোদে ফর্সা চামড়া পুড়ে খানিকটা তামাটে তবে চকচকে দেখাচ্ছে। এটাই এবারের মতো কক্সবাজারে ওর শেষ সাঁতার। আজ রাতেই ও রওনা দেবে রাঙ্গামাটি, তারপর বান্দরবান আর খাগড়াছড়ি। এবার পাহাড় আর সাগরে ছুটিটা কাটাতে চায় নৃ।
আজ নৈর্ঋত আসছে। বান্দরবানে পড়ে আছি, ভেঙে পড়া সেতু মেরামত চলছে আমার তত্ত্বাবধানে। নৃর সাথে আমার পরিচয় অনেক আগে, বুয়েটে পড়ার সময়। ও ছিল যন্ত্রকৌশলে আর আমি সিভিলে। দুজনেরই তিতুমীর হলে ব্যাপক যাতায়াত ছিল, সেই সূত্রে দেখাসাক্ষাৎ চলত। আলাদা প্রকৃতির মানুষ নৃ, চালাক আর বুদ্ধিমানের ভেতর যে বিশাল ব্যবধান তা ওর কাছ থেকে বুঝেছিলাম। ছেলেটার বহুমাত্রিকতায় মুগ্ধ না হয়ে পারিনি। সব বিষয়ে ব্যাপক কৌতূহল আর তীব্র বিশ্লেষণী ক্ষমতা ওকে আর বাকি সবার থেকে আলাদা করত। দারুণ ছবি আঁকার হাত ছিল ওর আর চমৎকার রবীন্দ্রসঙ্গীতও গাইতে পারত। আগাগোড়া রহস্যে ঘেরা চরিত্র মনে হতো ওকে আমার।
বহুদিন পর হঠাৎ দেখা পিএটিসিতে, বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে। ও তখন বিসিএস প্রশাসনে চলে গেছে আর আমি সড়ক ও জনপথ বিভাগের ইঞ্জিনিয়ার। চরম বৈচিত্র্যপিয়াসী নৈর্ঋত ঠিক পথই বেছে নিয়েছে হয়ত, বাংলাদেশের বিসিএস প্রশাসনের চাকরিটা বেশ বিচিত্র। প্রায় দেড় বছর পর আবার দেখা হবে, তবে ফেসবুক, মোবাইলে টুকটাক যোগাযোগ হতো। আমার বৌ পার্সি আজ রান্না করেছে, অনেকগুলো আইটেম। নৃ ওর ভীষণ প্রিয় মানুষ, আমাদের বিয়েতে একটা দারুণ উপহার পাঠিয়েছিল, দুজনের একটা কাপল পোর্ট্রেইট, ওর নিজের হাতে আঁকা, পুরাই মেসমেরিক। আমাদের ড্রইং রুমে ঝুলছে ওটা, সুতরাং প্রায়দিনই নৃকে মনে পড়ে; গিফটটা দেবার সময় ও বলেও ছিল তাই, ওকে ভোলার নাকি আর কোনও উপায় রইল না। নৃ সার্কিট হাউসে উঠতে পারত কিন্তু আমি জোর করে আমার বাসায় আনছি।
বাস থামল। বিআরটিসির এসি বাস, লাফ দিয়ে নামল নৃ, পিঠে একটা ব্যাগ মাত্র। আমাকে দেখে মুচকি হাসল ও। আমরা কোলাকুলি করে গাড়িতে উঠে পড়লাম। একটা ল্যান্ড রোভার ডিফেন্ডার সাফারি জীপ পেয়েছি আমি এখানে এসে, হাওয়ায় চুল উড়িয়ে রওনা দিলাম বাসার দিকে। নৃ এখানে অন্তত তিন চারদিন থাকবে বলে আশা করছি।
‘জীপটা তো দারুণ দেখছি!’—বেশ মজা পাচ্ছে নৃ।
‘হ্যা, ইঞ্জিনটাও ভালো, আগের অফিসারের আমলে এসেছে, সে বেশ যত্ন নিত। ’—স্টিয়ারিং বামে ঘুরিয়ে আরেকটা রাস্তায় ঢুকে বললাম আমি।
‘পাহাড়ি এলাকায় চলার জন্য পয়মন্ত, সাড়ে তিন হাজার সিসি, তাই না?’
‘বুঝলা কী করে?’
‘তোমার দরজার গোড়ায় একটা ডিক্যালে লেখা দেখলাম ডিসপ্লেসমেন্ট 3.5L ডিজেল, মানে সাড়ে তিন হাজার সিসির ডিজেল ইঞ্জিন, তাছাড়া জীপের সাইজ আর ইঞ্জিনের আওয়াজে কিছুটা আন্দাজ করা যায়। বাংলাদেশ সরকারের জাপানি গাড়ি ছেড়ে ব্রিটিশ গাড়ি কেনার আইডিয়াটা অদ্ভুত লাগছে। ’
‘এটা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের একটা প্রজেক্টের অনুদানের গাড়ি, আমাদের সরকারি না। ’
‘বুঝলাম, কিন্তু গাড়িটা আসলেই দুর্দান্ত, অফ রোডে ল্যান্ড রোভারের জুড়ি নাই। ভাবী কেমন আছে?’
‘তোমার জন্য একগাদা রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত’।
‘ওসবের কী দরকার ছিল? জানোই তো খাই আমি একটু কম। ’
‘এসব ভনিতা এখানে খাটিও না, বেচারি মন খারাপ করবে!’
‘সমস্যা নাই, সব আইটেমই চেখে দেখব। এবার একেবারে জেনুইন প্লেজার ট্রিপ, কোনও এক্সট্রা মাথাব্যথা নিচ্ছি না। ’
রাস্তার একদিকে পাহাড়, আরেকদিকে ঝোপঝাড়ে ছাওয়া ঢাল, দু’চোখ ভরে আসলো নৃর। একটা পাহাড়ি ময়না দেখে জানাল, সেটাই নাকি প্রথম খাঁচার বাইরে দেখা ময়না। পাহাড়ে রাস্তা বানানো বেশ দুরূহ, তবুও বাংলাদেশের ইঞ্জিনিয়াররাই কাজটা বেশ ভালোভাবেই করেছে। তবে তীক্ষ্ণ বাঁকের কাছে ঢালের দিকটায় উঁচু পাঁচিল থাকা দরকার, নৃর মনে হলো সেগুলোর হাইটটা একটু কম, একটা হেয়ার-পিন বেন্ডে পাঁচিলই ছিল না। ব্যাপারগুলো হালকা ডিসকাস করল আমার সাথে; আমি এসব বিষয়ে তেমন আগ্রহ বোধ করতাম না। ওকে জানালাম, দুটো ব্রিজ হঠাৎ ভেঙে পড়েছে, একটা বান্দরবনে, আরেকটা খাগড়াছড়িতে। আপাতত বেইলি ব্রিজ বানিয়ে যোগাযোগ চালু রাখা হয়েছে। উটকো ঝামেলা, অনেক ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে, এভাবে পরপর দুটো সেতু ধসে যাওয়াটা রীতিমত অবাক ব্যাপার। আমি নাশকতার কোনও চিহ্ন পাইনি, মনে হয়েছে নিম্নমানের কন্সট্রাকশনের ফল। প্রতিক্রিয়ায় নৃ সামান্য ভ্রু কুঁচকাল শুধু, জানালো নিউজে পড়েছে, তবে তেমন অস্বাভাবিক মনে হয়নি।
পরের ঘটনাটা ঘটল পরদিন সন্ধ্যায়। হেমন্তেই পাহাড়ে বেশ জাঁকিয়ে শীত পড়তে শুরু করেছে, সন্ধ্যাতেই বেশ কুয়াশা, থোকা থোকা মেঘের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে পাহাড়গুলোর কোলে। মুগ্ধ হয়ে আমরা সবাই পাহাড়ি সূর্যাস্ত দেখলাম, নৃ বলল, পাহাড়ে সূর্যাস্ত দেখলেই নাকি তার ড্রাকুলা বইয়ের ট্রান্সিলভানিয়ার বোর্গো পাসের কথা মনে পড়ে, বইটার অন্যতম চরিত্র জোনাথন হার্কার এমন এক সূর্যাস্তের সময় ড্রাকুলার প্রাসাদে যাচ্ছিল। পাহাড়ের ধার ঘেঁষে আমরা আসর জমিয়ে বসেছিলাম, নৃ গিটার বাজিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনাচ্ছিল, আমি আর পার্সি তন্ময় হয়ে শুনছিলাম। নৃর গলা অদ্ভুত সুরেলা, পাহাড়ি পরিবেশে মনে হলো অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে অস্ফুট কোনও প্রতিধ্বনি। আবেশে যখন ঘোরের মতো লাগছে, ঠিক তখুনি আমার মোবাইল বেজে উঠল।
চরম বিরক্ত হলাম সবাই, কিন্তু নিউজটা সবাইকে চমকে দিল এবার। মোহাইলং রোডে আরেকটা ব্রিজ আগাগোড়া ভেঙে পড়েছে! এবারেও অন্য কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। গান থামিয়ে নৃ জানাল, ব্রিজের ওপর যখন লোড পড়ে তখুনি সেটা কলাপ্স করার সম্ভবনা সবচেয়ে বেশি থাকে কিন্তু এগুলো কোন লোড ছাড়াই ধ্বসে যাচ্ছে, ব্যাপারটা খটকা লাগার মতো। আমি ভাবলাম, দৌড়াদৌড়ি আবার শুরু। এবার লোকেশনটা বেশ দূরে, প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার। আমি যথারীতি কিছু ইন্সট্রাকশন দিয়ে ফোনটা রেখে দিলাম। এ যে রীতিমত মহামারী!
‘সন্ধ্যাটা মাটি হয়ে গেল। তবে কাল স্পটে যাবার সময় আমায় একটু সঙ্গে নিও, ব্যাপারটা গোলমেলে মনে হচ্ছে। এক মাসে তিন তিনটে সেতু বিধ্বস্ত! যে দুটো সেতু তুমি দেখেছো সেগুলোর মোড অফ ফেইলিউর কেমন, খেয়াল করেছ?’—পিরিচে রাখা কাজুবাদাম মুখে নিয়ে চিবুতে চিবুতে বলল নৃ, গলাটা একেবারে শান্ত রেখে।
‘আগে ব্যাপারটা পাত্তা দেইনি, কিন্তু এখন মনে পড়ছে ব্রিজদুটো একই স্টাইলে ভাঙ্গা ছিল, মাঝামাঝি অংশটা পুরা ভাঙ্গা, রড, কংক্রিট সব সমেত ভেঙে পড়েছে নিচে, শুধু দু’কার্নিশে সামান্য একটু অংশ ঝুলে ছিল। ’
এবার নৃর ভ্রূ কুঁচকে গেল, ‘অদ্ভুত উৎপাত তো, এভাবে ব্রিজ ভাঙ্গে? আশপাশের লোকজন কী বলল?’
‘জায়গা দুটোই বেশ নির্জন, তেমন লোকজন নেই, তবে যারা ও পথে চলাফেরা করছিল তাদের একজন বলল ইটের খোয়া ঝুরঝুর করে ঝরে পড়লে যেমন সাউন্ড হয় তেমন কিছু শুনেছে... বিকট আওয়াজ নাকি শুনতে পায়নি কেউ। সামনে বিশাল খাদ দেখতে পেয়ে গাড়ি থামিয়ে দেখে ওই কাণ্ড! ব্রিজের নিচে সব ম্যাটেরিয়াল ঝুরো ঝুরো হয়ে পড়েছিল। রডগুলো অবশ্য মরচে পড়াই ছিল। ’
‘কংক্রিটের ভেতর থাকলেও পুরোন রডে অমন মরচে থাকে, তবুও ব্যাপারটা খুব বেশি মাত্রায় অদ্ভুত মনে হচ্ছে! ঢাকা থেকে টিম আসেনি?’
‘এসেছে, কিন্তু খুব এক্সপার্ট কেউ আসতে পারেনি, বলল, পুরানো সেতু, প্রায় একই সময় বানানো, রিইনফোর্সমেন্ট দুর্বল হয়ে কলাপ্স করেছে, আমরা আপাতত বেইলি ব্রিজ বানিয়ে দিয়েছি। ’
‘পুলিশে নালিশ করা হয়েছে?’
‘হয়েছে, দুর্ঘটনা বলে রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছে, কেইস ডিস্মিসড। ’
‘কাল দেখি, তৃতীয় ঘটনাটা থেকে হয়ত কিছু জানা যাবে, আবার কাকতালীয় হতে পারে। টিমের যুক্তিটাও তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ’
মোহাইলং যেতে বেশ কটা সেতু পড়ে। পাহাড়ি ব্রিজগুলো তৈরি হয়েছে পাকিস্তান আমলে। তবে পরে বাইরের দিকটায় সংস্কার হয়েছে। সেতুগুলোর ওপর উঠতেই পেটের ভেতরটা গুড়গুড় করতে শুরু করছে, এই বুঝি পড়ল ভেঙে। বেশিরভাগ সেতুগুলোতে কোনও ইন্টারমিডিয়েট কলাম নেই, শুধু দু’প্রান্ত দিয়ে দুই পাহাড়কে আঁকড়ে ধরেছে। শীতের শুরুতেই পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। কুয়াশায় দৃষ্টিসীমা ব্যাপক কমে এসেছে, তবুও বেশ বেগেই রওনা দিলাম গন্তব্যে। বাঁকগুলো বিপদজনক, সামনে বাংলাদেশের একমাত্র ফুল টানেল্ড হিল রোড, শুধুমাত্র মোহাইলং যেতে পড়ে। শিলাময় পাহাড়ের ভেতর দিয়ে রাস্তা বানাবার প্রয়োজনীয়তা একেবারেই না এড়ানো গেলে টানেলিং করতে হয়, এক্ষেত্রেও করতে হয়েছে; সামনে বিশাল পাহাড় পড়েছিল, ধার ঘেঁষে রাস্তা বানাতে প্রায় দেড় কিলো ঘুরতে হতো। প্রায় ৮০ মিটার লম্বা টানেলটা, লাইটিং সিস্টেমে সমস্যা থাকায় প্রায় অন্ধকার, গাড়ির হেডলাইট জ্বালতে হলো। কেমন যেন গা ছম ছম করে উঠল।
কাল রাতে নৃ নাকি ব্রিজ কলাপ্স নিয়ে কিছু পড়াশোনা করেছে ইন্টারনেটে, কোথাও এভাবে ব্রিজ ধসের কথা পায়নি। ধসে যাওয়া প্রায় সব ব্রিজই একটা প্রান্ত থেকে খসে পড়েছে, অন্য প্রান্ত ঝুলে থেকেছে। মাত্র দু’একটা ব্রিজ পুরোপুরি ধসে গেছে, যেমন নাইজেরিয়ার মুঙ্গেরে ব্রিজ, কিন্তু নিচে পড়ে একেবারে গুঁড়া হয়নি কোনটাই, প্রায় আস্তই রয়ে গেছে। কিন্তু এখানকার ব্রিজগুলো নাকি প্রায় গুঁড়ো হয়ে গেছে। ভয়ঙ্কর সুন্দর বাংলাদেশের এই পার্বত্য চট্টগ্রামে হঠাৎ কী শুরু হলো? গভীর ভাবনায় ডুবে গেল নৃ।
ঝামেলাবিহীন জীবনের প্রতি আমার টান চিরকালের। নির্ঝঞ্ঝাট জীবনের টানেই অন্য ক্যাডার বাদ দিয়ে সড়ক ও জনপথে ঢুকেছি, কিন্তু একটার পর একটা ঝামেলা আমাকে অতীষ্ট করে তুলেছে। ভেবেছিলাম নৃর সাথে মজায় কাটাব কয়েকটা দিন, কিন্তু আবার এই উটকো উপদ্রূপ।
একগাদা সর্পিল আঁকবাঁক পেরিয়ে স্পটে পৌঁছাতে লাগল প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা। পেছনে আরেকটা পিকআপে আমার সার্ভেয়ার টিম এসেছে। একবারে মাপজোখ করে মালসামান আনার অর্ডার দিয়ে দেব।
ব্রিজটা একেবারেই নেই। রাস্তাটা হঠাৎ পাহাড়ের ধারে এসে উধাও! দৃশ্যটা আসলেই ভয়ঙ্কর, নিচে পড়ে আছে কংক্রিটের অজস্র গুঁড়ো। নৃ খানিকক্ষণ হতবাক হয়ে দেখল, তারপর পাহাড়ের ধার ঘেঁষে নেমে পড়ল নিচে। আমি বলতে গেছিলাম সাপ খোপ থেকে সাবধান, কিন্তু দেখলাম এধারটায় কোনও ঝোপঝাড় নেই, শুধু নরম ধুলামাটি, নৃর পা দেবে যাচ্ছিল। প্রথমে সড়সড় করে এক পা দু’পা করে তারপর লাফিয়ে লাফিয়ে নামল ও। দেখাদেখি আমিও আমার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে নেমে পড়লাম। আশ্চর্য বিষয় এখানকার মাটি ভীষণ নরম কিন্তু শুকনো, খুব সূক্ষ্মভাবে চষা মনে হলো, অনেকটা উইএর ঢিবির মতো। আমি এমনটা কোথাও দেখিনি। আমার সার্ভেয়ার জানালো আগের ব্রিজগুলোতেও নাকি একই কেস, নিচের মাটি খুব নরম ছিল। আমি অবশ্য এসব বিষয়ে অত খেয়াল করিনি, কেননা ব্রিজে কোনও কলাম নেই, নিচের মাটির সাথে সম্পর্ক নেই, একেবারে ছোট ব্রিজ। আর ব্রিজের দু’প্রান্তের মাটিতে কোন সমস্যা দেখা যায়নি, ব্রিজটা ঐ দু’প্রান্তের সাথেই লাগানো থাকে।
ব্রিজটার নিচে একরাশ কংক্রিটচূর্ণ লম্বালম্বি স্তূপ হয়ে পড়ে আছে, মনে হচ্ছে ক্রাশ করা। এটাই সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার। কিভাবে সম্ভব এটা? ভেতরে রডগুলো জীর্ণ, মরচে পড়া আর টুকরো টুকরো। টুকরোগুলো বেশ ছোট আর সার্ফেসে ফাটলদেখা গেল। নৃ হাতে নিয়ে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করল, কয়েক টুকরা রাখল নিজের কাছে। তারপর হাঁটতে শুরু করল, পেছাতে পেছাতে ব্রিজের নিচ থেকে অনেক দূরে সরে গেল। অনেক ক’টা ছবি তুলল ও দূর থেকে, ওর মোবাইল দিয়ে। আরও আধা ঘণ্টা থাকলাম আমরা সাইটে, তারপর সার্ভেয়ারদের হাতে মাপজোখের কিছু ইন্সট্রাকশন দিয়ে রওনা দিয়ে দিলাম।
ফিরতি পথে সারাটা রাস্তায় নৃ বারবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। আমি এত ঝামেলা পছন্দ করি না, এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করি, কিন্তু একটা অশান্তি কুরে কুরে খেতে থাকল ভেতরটা।
‘কী মনে হচ্ছে? কোনও চক্রান্ত নাকি?’
‘নাশকতা হতেও পারে, নাও হতে পারে, তবে রহস্য একটা আছে, সেটা ন্যাচারাল হোক আর ম্যানমেইডই হোক। ’—ভ্রূকুটি করল নৃ।
‘ভাবতে থাকো, তোমার চিন্তার দারুণ খোরাক যোগালাম হে! কী বলো? ধন্যবাদ দাও আমাকে। ’—হে হে করে হেসে হালকা করার চেষ্টা করলাম পরিবেশ।
‘তা যুগিয়েছো বটে, কিন্তু আমার এবার এসবের একদম মানসিক প্রস্তুতি নাই, কেমন যেন ভেতর থেকে একটা বাধা ফিল করছি। ’
‘তাও আমি জানি তুমি ব্যাপারটায় মাথা না ঘামিয়ে থাকতেই পারবে না। ’
‘সমস্যা অনেক! ব্রিজগুলো কেন ভেঙে পড়ছে? কেউ আছে কি এর পেছনে? কী দরকার তার? কিভাবে ভাঙছে?—এগুলো মোটা দাগের প্রশ্ন। ’ যোগ করল নৃ।
‘আর চিকন দাগ?’—আমি মজা করলাম।
‘ব্রিজের নিচের মাটি নরম কেন? জানি না তুমি খেয়াল করেছো কি না, একটা বৃত্তাকার অঞ্চল জুড়ে মাটিটা নরম ছিল, গাছপালা নেই সেখানে, অথচ বৃত্তের বাইরে আবার ঝোপঝাড় শুরু। ওপর থেকে ব্যাপারটা পরিষ্কার ধরা যায়। ’
‘নাহ, অত খেয়াল আসলেই করিনি। তবে ব্রিজের নিচে তো একসময় পানি ছিল। সেজন্য নরম হতে পারে। ’
‘কিন্তু কিছু দূরে, সেই নরম ব্যাপারটা আর নেই। সেখানেও তো পানি ছিল। এখন শুকিয়ে খটখটে। আর বৃত্তাকার অঞ্চলটা একটা বড় প্রশ্ন!’
আমার মনেও সত্যি এবার সন্দেহ দেখা দিল। কিছু একটার গন্ধ পেলাম বলে মনে হলো। আমাদের পার্বত্য ইতিহাস খুব একটা সুখকর না। পাকিস্তান আমল থেকেই পাহাড়ি আদিবাসিরা স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে বিভিন্ন ঘটনা ঘটিয়েছে। কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের পর থেকে প্রচুর পাহাড়ি উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে হ্রদের বেড়ে যাওয়া পানির তোড়ে। তারপর প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সহযোগিতায় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে শুরু হয় সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধুর বাঙালি হয়ে যাবার ডাক ওরা মেনে নিতে চায়নি। সত্তর থেকে শুরু করে আশি, নব্বুইয়ের দশকের মাঝামঝি পর্যন্ত অশান্তির সাম্রাজ্য ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম। অবশেষে পার্বত্য শান্তিচুক্তির মাধ্যমে তার একটা আপাত যবানিকাপতন হয়, যদিও সেটার বাস্তবায়ন হয়নি বলে প্রয়াত মানবেন্দ্রের অনুসারীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রায়ই।
‘তবে কি কেউ পাহাড়ে যোগাযোগ বিছিন্ন করতে চাইছে?’—বললাম আমি।
‘সেটার সম্ভবনা সবচেয়ে বেশি। আর এই চিন্তা এখন অনেকের মাথাতেই চলে আসবে। ’
যা ভাবা তাই। সেদিনই আর্মি মোতায়েন হয়ে গেল স্পটে। আরও কয়েকটা অক্ষত ব্রিজেও। সরকারও খানিকটা নাশকতা সন্দেহ করেছে যদিও এখনও তেমন গা করছে না।
সেদিন সারারাত ধরে নৃর ঘরের বাতি জ্বালানো ছিল। সকালে ওর ঘরে ঢুকে দেখলাম যোগব্যায়ামের শীর্ষাসন করছে বিছানার ওপর। টেবিলের ওপর অনেক কাগজে ও প্রচুর আঁকিবুকি করেছে, আমার ল্যাপটপটায় ভাঙা ব্রিজটার একটা ছবি দেখা যাচ্ছে।
‘কেমন ঘুম হলো ফারহান? যে দুটো সেতু মেরামত হয়েছে সেগুলো কতদূর?’—সম্পূর্ণ দুরকমের প্রশ্ন একবারে করল নৃ।
‘প্রথম প্রশ্নটার জবাব তোমার দরকার নাই, আর, একটা সেতু বেশ কাছেই, তুমি এখানে আসার সময়ই ক্রস করেছো। ’
‘খেয়াল করিনি মনে হচ্ছে, আজ একবার যেতে পারলে খুব ভালো হতো। ’—ওর কণ্ঠে খানিকটা রিকুয়েস্টের আভাস।
‘খুব না ছুটি কাটাতে এসেছিলে, একেবারে অখণ্ড অবসর!’
‘মনের ভেতর খচখচানি রেখে কি আর রিলাক্স করা যায়? একটা কিছু ধরতে পেরেছি বলে মনে হচ্ছে, স্পটে গিয়ে একটু পরখ করতে হবে, নয়ত শিওর হওয়া যাবে না, খুব কমপ্লিকেটেড ব্যাপার আর আমিও এখন পর্যন্ত ব্যাপারটা পুরা বুঝতে পারছি না। একটা কাণ্ড দেখে যাও। ’—একটা কাগজ হাতে নিয়ে আমাকে ডাকল নৃ।
‘ব্রিজের দুই কার্নিশ খেয়াল করেছো? ভালো করে লক্ষ্য করো’—বলে ল্যাপটপে ব্রিজের একটা ভাঙা প্রান্তের ছবিতে জুম করল ও। প্যাটার্নটা অদ্ভুত। রেলিঙ দুটো চোখা হয়ে বেরিয়ে আছে, নিচের দিকটা ভাঙা, কিন্তু উপরের দিকটা ঠিক আছে।
‘বাকি অংশ স্পটে গিয়ে দেখতে হবে, তখন দেখা যাবে আমার আন্দাজ কিছু মিলে নাকি। চলো এখুনি বেরিয়ে পড়ি। ’
‘ব্রেকফাস্ট না করে কোথাও যাওয়া হবে না!’—দরজায় দাঁড়ানো পার্সি বলল। কিচেন অ্যাপ্রনে দারুণ দেখাচ্ছে ওকে। দেখা গেল ব্রেকফাস্টেই প্রায় ডিনারের মতো মেনু। খেতে খেতে আমাকে কয়েকটা কাগজ দেখাল নৃ।
‘এবার দেখ আমার একটা অবজারভেশন’—বলে নৃ নিজের একটা ড্রইং মেলে ধরল। ‘দেখ, ফারহান, নিচের ভেঙে যাওয়া অংশটার প্রান্তরেখা একটা বৃত্তীয় চাপের মতো। অর্থাৎ রেলিঙের মেম্বারগুলা পর্যন্ত ওই বৃত্তচাপ পর্যন্ত স্পর্শ করে ভেঙেছে। ’
আরেকটা কাগজ হাতে নিয়ে বলল ও, ‘এবার দেখ, এই ড্রয়িংটা’—পাশ থেকে আঁকা ভাঙা ব্রিজটার একটা ছবি দেখাল ও, ‘ভাঙা অংশের বৃত্তচাপ এক্সটেন্ড করে আমি বৃত্তটার পরিধি বের করেছি, তারপর দুটো জ্যা এঁকেছি, জ্যামিতি থেকে আমরা জানি, একই বৃত্তের জ্যাগুলোর লম্বদ্বিখণ্ডক বৃত্তের কেন্দ্রে মিলিত হয়। ছবির সাথে আসল ব্রিজের মাপের অনুপাত বের করলাম, তারপর হিসেব করে দেখলাম কেন্দ্রটা ব্রিজের নিচে ঠিক মাঝখানে মাটির প্রায়আড়াই ফুট নিচে। ’
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন্দ্রে কিছু আছে মনে হয়?’
‘সেটাই দেখার জন্য স্পটে যেতে হবে, কিছু খোড়াখুঁড়ি করতে হতে পারে। ’
‘তা হলে মোহাইলঙে যাওয়াই ভালো। কুন্টিংছড়িতে বেইলি ব্রিজ তৈরি হয়ে গেছে। অনেক কিছুই আর আগের মতো নাই। ’
‘ব্রিজদুটোর সাইজ কি এক?’—নৃ প্রশ্ন করল।
‘হ্যাঁ, প্রায় আইডেন্টিক্যাল। ’
‘চলো, তাহলে মোহাইলংই যাওয়া যাক। ’
>> বাকি অংশ পড়তে ক্লিক করুন >>
বাংলাদেশ সময়: ১৮২০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৬, ২০১৫