১৯৮৪ (নাইনটিন এইটি ফোর)—বিখ্যাত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক, সাহিত্য সমালোচক ও সাংবাদিক জর্জ অরওয়েলের অমর গ্রন্থ। ১৯৪৯ সালে তার মৃত্যুর এক বছর আগে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।
___________________________________
শুরু থেকে পড়তে ক্লিক করুন
দ্বিতীয় খণ্ডের ৩১তম কিস্তি
___________________________________
অধ্যায় ৭ |
কান্নাভরা চোখে ফোঁপাতে ফোঁপাতে ঘুম ভাঙল উইনস্টনের। জুলিয়া গুটিসুটি হয়ে তার পাশে ঘুমিয়ে। ঘুমের ঘোরেই বলে উঠল, ‘কী হয়েছে?’
‘স্বপ্ন দেখেছি—’ বলতে ধরেই থেমে গেল সে। এমন জটিল স্বপ্ন শব্দে তুলে ধরা অসম্ভব। স্বপ্ন তো ছিলই, এর সঙ্গে যুক্ত হয় একটি স্মৃতি, যা ঘুমভাঙ্গার কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মনের মাঝে সন্তরণ শুরু করে।
চোখ বন্ধ করে চিৎ হয়ে শুয়ে রইল সে, তখনও যেন স্বপ্নের ঘোরেই আচ্ছন্ন। একটি সুবিস্তৃত উজ্জ্বল স্বপ্ন যা তার গোটা জীবনটাকেই ধারণ করে সামনে তুলে ধরেছে। গ্রীষ্মের বিকেলে বৃষ্টির পর দৃশ্যপট যেমন স্পষ্ট হয়ে ওঠে ঠিক যেন তেমনই। পুরোটাই ঘটে গেছে কাচের পেপারওয়েটের ভেতরে, আর এর উপরিতলটি যেন হয়েছিল আকাশের ছাদ। সেই ছাদের নিচে সবকিছুই যেন স্বচ্ছ মোলায়েম আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে আর সেখানে অতিদূরের বস্তুও স্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে চোখে। স্বপ্নমাঝে আরও এলো তার মায়ের ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখা বাহু, আর তার সঙ্গে মিশে গেল ত্রিশ বছর পরে খবরের ভিডিওচিত্রে দেখা সেই ইহুদি নারীর বাহুখানি যা টুকরো টুকরো হয়ে উড়ে যাওয়ার আগে বুলেটের আঘাত থেকে প্রাণপণে বাঁচাতে চেষ্টা করছিল ছোট্ট শিশুটিরে।
‘তুমি কী জানো’—বলল সে, ‘এখনও আমার মনে হয়, আমিই আমার মাকে হত্যা করেছি?’
‘কেন তুমি হত্যা করলে তোমার মাকে?’ ঘুমের ঘোরেই বলল জুলিয়া।
‘না ঠিক হত্যা নয়! শারীরিকভাবে হত্যা বলা যাবে না!’
স্বপ্নে এসেছিল মায়ের সঙ্গে তার শেষ দেখা হওয়ার দৃশ্যটিও। কিন্তু ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার কয়েক দণ্ডের মধ্যে ছোট ছোট ঘটনাকে ঘিরে সেই স্মৃতি তার মনে এসে পুরো দানা বাঁধলো। এ এমন এক স্মৃতি যা সে ইচ্ছাকৃত সচেতনতায় ঠেলে দূরে সরিয়ে রেখেছে অনেক বছর। তারিখটি ঠিক মনে নেই, তবে তখন তার বয়স দশ বছরের কম হবে না, হতে পারে বারো বছর বয়স তার তখন।
বাবা নিখোঁজ হন তারও কিছু আগে, কতটা আগে তা মনে নেই। তবে ভালো করেই মনে আছে, সে ছিল শোরগোলের এক অস্থির সময়। ভীতিকর বিমান হামলা, আর টিউব স্টেশনে আশ্রয় নেওয়ার ঘটনা ক’দিন পরপরই ঘটত। এখানে সেখানে ইট-পাথরের ধ্বংসস্তূপ, সড়কের কোণায় কোণায় অবোধ্য সব ঘোষণার পোস্টার সাঁটা, একই রঙের শার্ট পরে যুবকরা বেকারিগুলোর বাইরে বিশাল লাইন ধরে দাঁড়িয়ে, থেকে থেকে দূর থেকে ভেসে আসছে মেশিনগানের গর্জন... সর্বোপরি, এটাই বড় বাস্তবতা যে, পর্যাপ্ত খাবার ছিল না কারও। তার মনে আছে, অনেক দীর্ঘ বিকেল তার কেটেছে আরও ছেলেদের সঙ্গে ডাস্টবিনের ময়লা স্তূপ ঘেঁটে ঘেঁটে বাঁধাকপির পাতা থেকে ডাঁটা আর আলুর ছোবড়া কুড়িয়ে, কখনও পেয়ে যেত এক আধ টুকরো রুটি, সতর্কে ময়লা ছড়িয়ে তা খেত আর পথ দিয়ে কখন আসে কোনও ট্রাক তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত। গবাদির খাদ্যবাহী সেসব ট্রাক সড়কের এবড়ো থেবড়ো অংশে ঝাঁকি খেলে তা থেকে পড়ত খৈলের গুঁড়ো।
যখন তার বাবা নিখোঁজ হলেন, মাকে তার এতটুকু বিস্মিত বা বিচলিত মনে হলো না, দেখালেন না কোনও সহিংস শোকেরও প্রকাশ। কিন্তু হঠাৎই যেন পাল্টে গেলেন তিনি। যেন পুরোই এক নিষ্প্রাণ মানবী। উইনস্টনের তখন মনে হতো তার মা যেন কোনও কিছুর অপেক্ষায়, আর তিনি জানতেন নিশ্চিতভাবেই তা ঘটবে।
প্রয়োজনীয় সব কাজই করতেন মা—রান্না, ধোওয়া-মোছা, সারাই, বিছানা পাতা, ঝাড়-মোছ, আগুনের চুল্লি জ্বালানো—এসবই করতেন, কিন্তু অতি ধীর লয়ে, তাতে থাকত না সামান্য প্রাণের ছাপ। যেন চিত্রপটে আঁকা কোনও মানবীর শরীর ধীরে ধীরে নিজের স্থানে থেকেই নড়াচড়া করছে। তার বড় সুডৌল তনুখানি মনে হতো যেন প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে গেছে। কখনও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিছানায় অনড় বসে বসে তার ছোট বোনটির সেবায় কাটিয়ে দিতেন। ক্ষীণকায়, রোগাক্রান্ত অতি নীরব এক শিশু। বয়স দুই কি তিন হবে, শুকনো মুখখানি বানরের মতো দেখতে। কোনও কোনও দিন উইনস্টনকে কাছে টেনে নিতেন আর দীর্ঘ সময় ধরে তাকে বুকে চেপে ধরে রাখতেন, মুখে রা শব্দটিও থাকত না। ছোট হলেও, আর কিছুটা স্বার্থপরতার পরেও সে তখন বুঝত এই বুকে চেপে রাখার সঙ্গে ওই ঘটতে চলা ঘটনাটির সম্পর্ক রয়েছে যা তার মা তাকে মুখ ফুটে বলছেনই না।
দ্বিতীয় খণ্ডের ৩৩তম কিস্তির লিংক
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৮, ২০১৫
শিল্প-সাহিত্য
প্রতিদিনের ধারাবাহিক
১৯৮৪ | জর্জ অরওয়েল (খণ্ড ২ কিস্তি ৩২) || অনুবাদ: মাহমুদ মেনন
অনুবাদ উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।