ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

মৃতের আবেগ | রাজিউল হাসান

গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪১ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০১৫
মৃতের আবেগ | রাজিউল হাসান ব্যাকগ্রাউন্ড স্কেচ : ফ্রিদা কাহলো

বাড়ির উঠোনটার ঠিক মাঝ বরাবর চাদরে ঢাকা। ভেতরে আমাকে গোসল করানো হচ্ছে।

এটা আমার দাদাবাড়ি। ছোটবেলায় এই উঠোনে কত খেলেছি; কৈশোরে, যৌবনের প্রারম্ভে কত গল্পে মেতেছি, তার জাগতিক হিসাব আজ ধর্তব্যের বাইরে। সেঝো চাচার বিয়ের সময় আমি এইচএসসিতে পড়ি। বৌভাতের দিন ঠিক এই জায়গাটাতেই আমি আর বাবা পাশাপাশি বসে রান্নাবান্না তদারকি করেছিলাম। ছোট ফুপুর বিয়ের দিনও এখানেই পাশাপাশি বসেছিলাম আমরা।

বাবামায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ার পাশাপাশি দাদার পরিবারে আমার জেনারেশনে আমিই সবার বড়। সব মিলিয়ে আদরটা ছিল অন্যরকম। আমাকে ঘিরে পরিবারের স্বপ্ন-প্রত্যাশাও ছিল আকাশচুম্বি। আজ সবই কান্নার জলে ধুয়ে যাচ্ছে। চারজনে মিলে আমার শেষ গোসলের কাজটা নির্ভুল ও সূচারুভাবে সম্পন্ন করার চেষ্টা করছে। দেহ বেয়ে প্রতিটা জলকণার সঙ্গে ধুয়েমুছে ধরণীর সঙ্গে মিশে যাচ্ছে আমার ওপর অর্পিত সকল দায়িত্ব, আমাকে ঘিরে সকল প্রত্যাশা। গতপরশুও যে আমি হাসতাম, কথা বলতাম, কষ্টে নীরব হতাম, রাগে লাল হতাম—আজ সে আমি চির নীরব। আমাকে চির নিদ্রায় শায়িত করতে সকল আয়োজন সম্পন্ন হচ্ছে।

একটু আগে মায়ের কাছ থেকে ঘুরে এসেছি। সারাজীবন যে মাকে শক্ত মানুষ হিসেবেই চিনে এসেছি, আজ সে কান্নায় ভেসে উন্মাদিনীর মতো বুক চাপড়াচ্ছে। তার আশপাশ ঘিরে বসে আছে দাদী, ফুপু, চাচীরা। কেউ কাউকে সান্ত্বনা দিতে পারছে না। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে? এদের সবার কাছেই আমি ছিলাম অতি আদরের। এরা সবাই আমাকে ঘিরে স্বপ্ন দেখত। এতগুলো মানুষের স্বপ্ন একা আমার মৃত্যুতে ভেঙ্গে যাবে, কখনও বুঝতেই পারিনি।

বাবাকেও দেখে এলাম। চুপচাপ বসে আছেন। ডায়বেটিস, হাইপ্রেশারের রোগী তিনি। ভারী মানুষ। ভারী মানুষগুলোর আবেগগুলোও ভারী হয়। সহজে প্রকাশ করতে পারে না। নিজের দেহের গণ্ডি থেকে মুক্ত হওয়ার পর আমি বাকি সবার গোপন-প্রকাশ্য আবেগ খুব সহজেই অনুভব করতে পারছি। বাবার বুকটা ভেঙ্গে যাচ্ছে, গলার কাছে দলা পাকিয়ে সন্তানহারা কষ্ট দম বন্ধ করে দিতে চাইছে। কাঁদতে চাইছেন, কিন্তু পারছেন না। তাকে ঘিরেও চাচারা-আত্মীয়রা বসে আছেন। কারও মুখে কোনও শব্দ নেই। বাড়িজুড়ে শুধু কান্নার রোল। কান্নাও যে একধরনের সঙ্গীত, আগে কখনও টের পাইনি।

বাবার সঙ্গে সম্পর্কটা বন্ধুর মতো ছিল। পাশাপাশি গল্পে মেতে হাঁটার সময় অচেনা অনেকেই বয়সের গণ্ডি উপেক্ষা করা দু’জন বন্ধু হিসেবে আমাদের আবিষ্কার করত। আমাকে ঘিরে বাবার প্রত্যাশা ছিল সবসময়ই উচ্চপর্যায়ের। ফাইভের বছর যখন বৃত্তি পেলাম, সেসময় থেকেই আমাকে নিয়ে তিনি স্বপ্ন বোনা শুরু করেন। ছেলে সরকারি কর্মকর্তা হয়ে একদিন দেশ সামলাবে—এই ছিল তার চাওয়া। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে শত চেষ্টা করেও আমার কপালে সরকারি চাকরি জুটল না। তখন থেকেই বন্ধুত্বের সম্পর্কে শীতলতার পলি জমতে শুরু করে। দুই বছর বেকার থাকাকালে দিনে দিনে এই শীতলতা জমাট বেঁধেছে। তারপর হঠাৎ একদিন আমার চাকরি হলো। বেসরকারি একটা স্কুলে। প্রফেশনটা বাবার পছন্দ ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন, সরকারি চাকরি না জুটলেও অন্তত ব্যাংকে যেন চাকরি করি। কিন্তু আমার এসব পছন্দ হতো না। মানুষের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলাম আমি।

বাবা এই নিন্মমধ্যবিত্ত জীবন পছন্দ করেননি। নিজে নিন্মমধ্যবিত্ত জীবন কাটিয়ে তিনি হাড়ে হাড়ে বুঝে গিয়েছিলেন, এর কষ্ট কী। আর তাই তিনি কখনওই চাননি তার সন্তানও তার মতোই জীবন কাটাক। কিন্তু আমি ছিলাম আমার জীবন চলার পথ পছন্দে অটল। সুখি দেশের সংজ্ঞা নির্ধারণে জাতিসংঘ একটা দেশের জনগণের জীবনমান, জিডিপি, সামাজিক সহযোগিতা আর জীবন চলার পথ পছন্দের স্বাধীনতাকে মূল উপকরণ হিসেবে দেখে। আমি সুখি হতে চেয়েছিলাম। আর তাই জীবন চলার পথ আমি নিজেই পছন্দ করতে চেয়েছিলাম। ফলশ্রুতিতে বাবামায়ের সঙ্গে দূরত্বটা ক্রমেই বাড়তে বাড়তে যোজন যোজন দূরে ছিটকে পড়েছিলাম আমরা। এখানে প্রভাবক হিসেবে আরও কাজ করেছিল পাড়াপ্রতিবেশী। তাদের সন্তানরা কে কী করছে, কত সফল, মাস শেষে কত টাকা রোজগার করে, তার গল্প না করলে যেন তাদের ঘুম হতো না। আর এসব গল্প ঘুম হারাম করে দিত আমার বাবামায়ের। অন্যের সন্তানের সঙ্গে তুলনা করে তারা যখন নিজের সন্তানকে ভূতলে আবিষ্কার করতেন, তখন মনের সুখ উবে যেত তাদের। আর এসব কারণে নিজেরা মানসিক চাপে থাকার পাশাপাশি প্রতি মুহূর্তে এটা সেটা বলে আমাকেও মানসিক চাপে রাখতে কার্পণ্য করত না তারা। আজ সব চাপ থেকে আমি মুক্ত। অসুস্থ প্রতিযোগিতার এই পৃথিবী থেকে আমি মুক্ত। এখন যেমন কোনও দায়িত্ব নেই, ঠিক তেমনি ধরাবাঁধা কোনও জীবনও নেই আমার। পাশাপাশি সুখি হবার চেষ্টারও কোনও তাগাদা নেই। তবু কেন যেন বাবামায়ের জন্যে খুব খারাপ লাগছে।

বড় হয়ে যাওয়ার পরও মা আমাকে কাছে পেলেই মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন। সবকিছুতেই তাড়াহুড়ো থাকলেও খাওয়ার ক্ষেত্রে আমি ছিলাম চরম ধীর। দেখা যেত, খেতে বসে ধীরগতির কারণে প্লেটের খাবার প্লেটেই শুকিয়ে যাচ্ছে। মা’র এই দেরি পছন্দ ছিল না। তাই তিনি মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন। বাসায় গেলে আমাকে কখন কী খাওয়াবেন, তা নিয়ে তিনি ছিলেন সবসময়ই ব্যস্ত। তবে এর সঙ্গে সমানতালে চলত বকাঝকাও। জীবনে সফল হতে পারছি না, কাপড়চোপড় ঠিকভাবে যত্ন করি না, নিজের যত্নও করি না, শরীরে সিগারেটের গন্ধ কেন—কত যে পয়েন্ট ছিল মায়ের বকা দেওয়ার, হিসেব করে শেষ করা যাবে না। এভাবেই আমার ছুটির দিনগুলো কেটে যেত। ছুটি শেষে কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার পর আমার অনুপস্থিতিতে মায়ের মনে আমার চিৎকার-চেঁচামেচিগুলো মেঘ জমাত। অভিমানী হয়ে উঠতেন মা। যোগাযোগ কম করতেন। নিজে কষ্ট পেতেন, আমাকে কষ্ট দিতেন। বাবাকেও উৎসাহিত করতেন তার অভিমানের সঙ্গী হতে। আজ সকল মান-অভিমানের হিসাব চুকিয়ে আমি বিদায় নিচ্ছি।

এবার তিনদিনের ছুটিতে বাড়ি এসেছিলাম। যথারীতি বকাঝকার মাধ্যমে মায়ের ভালোবাসার প্রকাশ, বাবার নীরবতা আর নববিবাহিতা স্ত্রীর নীরব ভালোবাসা দেহ-মনে মেখে গত পরশুই ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলাম। আমার প্রতি চরম অসন্তুষ্ট হওয়া সত্ত্বেও বাবা এবারও আমাকে বাসে তুলে দিয়েছিলেন। এই কাজে তিনি কোনওদিন ব্যতিক্রম করেননি। বাড়ি পৌঁছুনোর দিন আমার অপেক্ষায় বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা আর ফেরার দিন আমাকে বাসে তুলে দিয়ে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ছিল তার প্রিয় কাজ। কী শান্তি পেতেন এসব করে কোনওদিনও বুঝিনি। সেদিনও বুঝলাম না। বাসে ওঠার আগ মুহূর্তে জীবন সম্পর্কে আরও সিরিয়াস হওয়ার পরামর্শ দিলেন বাবা। এখন স্ত্রীর দায়িত্বও কাঁধে চেপেছে স্মরণ করিয়ে দিলেন। নীরবে বাবার কথা শুনছিলাম অন্যদিকে তাকিয়ে। বিদায়ের মুহূর্তে আমি কখনও বাবার মুখের দিকে তাকাতে পারিনি। আমার কখনও তাদের থেকে দূরে থাকতে ভালো লাগেনি।

যতই বকাঝকা করুক, যতই রাগ হোক আমার—আমার সমস্যায় সমাধানকারী হিসেবে তাদেরকেই সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছি। কিন্তু তাদের হাজারটা প্রশ্নের উত্তর করতে ভালো লাগত না আমার। তাই অনেক সময়ই সমস্যা চেপে যেতাম। নিজে সমাধান করার চেষ্টা করতাম। কখনও পারতাম, কখনও সমস্যাটাকে জটিল করে তুলতাম। এমন না যে আমি দায়িত্বজ্ঞানহীন ছিলাম। আমারও একটা স্বপ্ন ছিল। তার পেছনেই আমি ছুটছিলাম। সফল হলে আমার ওপর আর কারও কোনও অভিযোগ থাকত না। কিন্তু একটা দুর্ঘটনা সবকিছু ওলটপালট করে দিয়ে গেল।

বাসটা তখন মধুপুর অতিক্রম করে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে উঠেছে। ঝড়ের বেগে সামনে বাড়ছে। আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনছি। হঠাৎ প্রচণ্ড ঝাঁকি শুরু হলো। প্রচণ্ড শব্দে আর বাসের ভেতরের আর্তচিৎকারে কান পাতা দায়। কিন্তু সেদিকে কোনও খেয়াল নেই আমার। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছোরার মতো চোখা ধাতব কিছু একটা আমার বুকের ভেতর দিয়ে ঢুকে পেছনের চেয়ারে গিয়ে গেঁথে গেল। ছোরাটা ঢোকার সময় আগুনে ছেঁক লাগার মতো অনুভূতি হলেও মুহূর্তেই ব্যথাটা মারাত্মক আকার ধারণ করল। প্রচণ্ড ব্যথায় দম বন্ধ হয়ে আসলো। চিৎকার করতে চাইলাম। পারলাম না। গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। দম আটকে গেছে। বাসটাতে তখনও দুনিয়া কাঁপানো ঝাঁকি চলছে। বিশ্বাস হচ্ছিল না, আমার দেহ ভেদ করে কিছু একটা ঢুকে গেছে। নিজের চোখে নিজের রক্তে ভেসে যেতে দেখলাম দেহের নিন্মাংশ। জানালার কাচগুলোও খুব সম্ভবত ভেঙ্গে গুঁড়ো হয়ে গেছে। ভাঙ্গা কাচগুলো আমার নাকে-মুখে-চোখে আঁচড় কেটে যাচ্ছে। কিন্তু বুকে গেঁথে যাওয়া ধাতব ছোরার ব্যথার কাছে ওসব কিছুই না। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছিল। হাত দিয়ে ধরতে চাইছিলাম ধাতব ছোরাটা। পারছিলাম না। একটা সময় বাসের ঝাঁকি বন্ধ হলো। উঠে দাঁড়াতে চাইলাম। পারলাম না। শক্তি নেই দেহে। আশেপাশে রক্তাক্ত মানুষগুলো স্তূপের মতো হয়ে গেছে। কেউ কাতরাচ্ছে, কেউ নিথর বসে আছে। ধীরে ধীরে সারা শরীর অবশ হয়ে আসতে শুরু করল আমার। চেনা পৃথিবীটা আঁধারে ঢেকে যাচ্ছিল খুব দ্রুত। দম নিচ্ছিলাম খুব কষ্টে। মুখের ভেতর নোনাস্বাদের তরল উপচে পড়ছে। হঠাৎই মনে হলো অনেকদিন বাবা মাকে হাসতে দেখিনি। তাদের হাসতে ভুলে যাওয়া চেহারা চোখে ভাসল। সবসময় চুপচাপ থাকা স্ত্রীর মুখটাও ভেসে উঠল। কারণে অকারণে হেসে গড়াগড়ি খাওয়ায় তার কোনও সমস্যা ছিল না। তাকে হাসতে দেখলে আমারও খুব ভালো লাগত। এরপরই নিজের নিথর দেহটাকে বাসের সিটে গাঁথা অবস্থায় হালকা ঝুঁকে ঝুলে থাকতে দেখলাম আমি।

প্রথমে বিশ্বাসই হলো না, দেহের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে গেছি আমি। নিজের চোখে নিজের দেহকে নিথর পড়ে থাকতে দেখলাম। অবিশ্বাসের ঘোর কাটাতেই হয়ত হাত বাড়ালাম প্রাণহীন দেহটার দিকে। ধরতে পারলাম না। আমি আর মানুষ নেই। দেহহীন আত্মায় পরিণত হয়েছি। মৃত্যু আমার মধ্যে বিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে। ঘটনা বুঝতে বাস থেকে বেরিয়ে এলাম। দুটো বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। অপর বাসটিতেও মৃত্যুর হাহাকার। কেউ কাতরাচ্ছে, কেউ পড়ে আছে নিথর। মানুষ জমতে শুরু করেছে আশপাশে। বেশ কিছুক্ষণ পর গগনবিদারী চিৎকারে অ্যাম্বুলেন্স, পুলিশের গাড়ি ও ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ছুটে আসতে দেখলাম।

বাস থেকে নামিয়ে মৃতদেহটাকে যখন অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে, এক ছুটে বাড়ি চলে এলাম। দেহহীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দূরত্ব আমার কাছে পলকে অতিক্রম করার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাড়িতে তখনও খবরটা আসেনি। দুপুরের খাওয়া প্রায় শেষ। বাবামা আর স্ত্রী এক সঙ্গে খেতে বসেছে। বাবার প্রিয় বেড়ালটা ক্রমাগত মিউ মিউ করে যাচ্ছে। কী একটা প্রসঙ্গে তিনজনই হাসছে। (আমি না থাকলে বাবামা হাসেন তাহলে!) খাওয়া শেষ করে বাবা টিভি ছেড়ে শুয়ে পড়লেন। সড়ক দুর্ঘটনার খবরটা দেখানো শুরু হলো, ঠিক তখনই বাবার মোবাইল ফোনটাও বেজে উঠল। উঁকি দিয়ে দেখলাম, আমার নাম্বার থেকেই কল করা হয়েছে। রিসিভ করে বাবা ‘হ্যালো’ বলতেই অন্য মানুষের গলা তার শ্রবণেন্দ্র্রীয়তে গিয়ে আঘাত হানল। বাকিটুকু শোনার শক্তি তখন আর নেই হয়ত তার। সন্তানের মৃত্যু সংবাদটা তার কানে যেন অনল বর্ষণ করল। হাত থেকে খসে পড়ল ফোনটা। ডুকরে কেঁদে উঠলেন। মা খাওয়া ফেলেই বাবার কাছে ছুটে এলেন। আমার স্ত্রীও ছুটে আসলো। ওদের দুজনের ওপর তখন অনিশ্চিত ভয় ভর করেছে। বাবা কোনওরকমে শুধু বলতে পারলেন, ‘রাশেদ নেই!

পরের দৃশ্যটা আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। মা, স্ত্রী একসঙ্গে চিৎকার দিয়ে উঠল। ওদের কান্না আমাকে এমনভাবে আঘাত করল, ইচ্ছে হচ্ছিল এখনই ফিরে গিয়ে দেহে প্রবেশ করি। চোখ মেলে পৃথিবীকে জানিয়ে দেই, আমি মরে যাইনি! কিন্তু সে ক্ষমতা আমার নেই। আত্মা একবার দেহ থেকে বেরিয়ে পড়লে তা আর ঢুকতে পারে না। বাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে পড়লাম আমি। মরে গেছি, এই কষ্টের চেয়ে আমার বুকে তখন বাবামা-স্ত্রীর কষ্টটা বেশি বাজছিল। দলা পাকিয়ে কষ্ট উগরে আসছিল। কিন্তু কাঁদতে পারছিলাম না। আত্মার ভেতর নোনাজলের আধার থাকে না।

আমার দেহটাকে গোসল করানো হয়ে গেছে। এখন ওটা বাড়ির উঠোনে সাদা কাফনে মুড়িয়ে খাটিয়ায় শোয়ানো অবস্থায়। নাকে তুলো গুঁজে দেওয়া হয়েছে। মুখটা উন্মুক্ত। খাটিয়ার দুই পাশে আগরবাতি জ্বালানো হয়েছে। শেষ দেখা পর্ব চলছে। এরপরই আমাকে কবরের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে।

খানিক আগে স্ত্রীর কাছে গিয়েছিলাম। তাকে ঘিরেও মানুষজন। আমি পৃথিবীর থেকে বিদায় হওয়ার আগেই তাকে সাদা শাড়ি পরানো হয়েছে। নাক থেকে খুলে নেওয়া হয়েছে নাকফুল। একটা মৃত্যুর ঘটনাই তাকে বিধবায় পরিণত করেছে। আসলে মৃত্যু না এলে একের সঙ্গে অন্যের জীবন কতটুকু জড়িয়ে থাকে—বোঝা যায় না। আজ বুঝতে পারছি, এক আমার বিদায়ে কতগুলো জীবনে ঝড় উঠেছে! সবে সংসারের স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছিলাম স্ত্রীকে নিয়ে। এমনিতেই সে পরীর মতো সুন্দর, যেদিন আমরা দেখতে গেলাম ওকে—নীল সেলোয়ার কামিজ পরা ছিল—দেখেই মাথা ঘুরে যায় আমার। বাবামারও ওকে খুব পছন্দ হয়। অনিশ্চিত জীবনের দোহাই দিয়ে যে আমি বিয়েই করতে চাচ্ছিলাম না, সেই আমি বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে উঠলাম ভেতরে ভেতরে। ওকে হারানোর ভয় আমাকে পাগল করে তুলেছিল। দেখার এক মাসের মধ্যেই আমাদের বিয়ে হয়ে গেল। অতিরিক্ত পর্যায়ের কম কথা বলা একজন মানুষ। তবে কারণে অকারণে হাসত খুব। ভেতরের আবেগটা ঠিকই অনুভব করতে পারতাম। মাঝেমধ্যে সে এমন কিছু কথা বলে বসত—অবাক হয়ে তার ভেতরকার আমার প্রতি গভীর ভালোবাসা আবিষ্কার করতাম তখন।

শুনলাম, সরকার দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারকে দুই লাখ করে টাকা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বেঁচে থেকে পরিবারের জন্য কিছু করতে না পারলেও মরে গিয়ে তাদের খানিকটা আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করতে পেরেছি ভেবে ভালো লাগছিল। কিন্তু যখনই আবার মনে হলো, এই দুই লাখ টাকায় আসলে কিছুই হবার নয়—তখন খুবই খারাপ লাগল। সরকার নির্ধারিত আমার জীবনের দাম দুই লাখ টাকা মাত্র। কুরবানির হাটে চার-পাঁচ লাখ কিংবা তার চেয়ে বেশি দামের গরু ওঠে। বিক্রিও হয় দেদারছে। প্রতি কুরবানির ঈদে টেলিভিশন খুলে এবছরের সবচেয়ে দামী গরুর দাম জেনে নিতাম। এখন মনে হচ্ছে না জানলেই ভালো ছিল।

খাটিয়ার চারপাশ জুড়ে এখন আমার একান্ত আত্মীয়-স্বজনরা। মা একদম মুখের কাছে বসে আছেন। বাবা তার বিপরীত পাশে। আমার মুখে বারবার হাত বুলিয়ে চুমু খেয়ে আদর করছেন মা। শেষ কবে এভাবে আমাকে আদর করেছিলেন—ভুলে গেছি। কান্নায় বুক ভেসে যাচ্ছে মা’র। বাবাও ডুকরে কাঁদছেন। তিনিও আমার চোখে-মুখে হাত বোলাচ্ছেন। মায়ের পাশেই বসে আছে স্ত্রী। তার শব্দহীন কান্না গাল বেয়ে বুকে গিয়ে পড়ছে ঝর্ণাধারার মতো। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে কাটে। পরে মা-স্ত্রী-দাদী-ফুপু-চাচীদের সরিয়ে দেয় বাকিরা। এবার আমাকে কাঁধে নেওয়া হবে। যে চারজনের কাঁধে আমার খাটিয়াটা উঠবে, তাদের নেতৃত্বে দিচ্ছেন আমার বাবা স্বয়ং। পৃথিবীতে নাকি সবচেয়ে ভারী বস্তু বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ। আজ সে ভারী বস্তুটি বহন করতে হচ্ছে তাকে। কলমা পড়তে পড়তে খাটিয়াটা তুলে নেওয়া হলো। বাবা কাঁদতে কাঁদতে তুলে নিলেন আমাকে। বুঝতে পারছি, পা দুটো তার পাহাড়সম ভারী হয়ে আসছে। চলতে চাইছে না। তবু চলতে হবে। আমিও উঠে দাঁড়ালাম।

বাড়ির কাছেই আমাদের পারিবারিক কবরস্থানে দাদার কবরের পাশে আমার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছে। লাশবাহী দল এখন কবরের পাড়ে। দুজন ভেতরে নেমে পড়েছে। কাফনে মোড়ানো আমার দেহটা মাত্রই ধরল তারা। আস্তে আস্তে শুইয়ে দিল আমাকে। সঙ্গে সঙ্গে কিসের টানে যেন আমি, মানে আমার আত্মাও কাফনে মোড়ানো লাশটার পাশে আটকে গেল। তিনবার আমার মুখ উন্মুক্ত করে পৃথিবীকে শেষবার দেখার সুযোগ দেওয়া হলো। এরপরই কাফনের প্রান্ত মুড়িয়ে বেঁধে আমাকে একা রেখে উঠে গেল তারা। আমারও খুব উঠে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। উঠে একলাফে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে বাবা আমাকে আটকাও। আমি তোমাদের ছেড়ে কোথাও যেতে চাই না। তোমাদের ছাড়া একা থাকতে পারব না আমি। আমি তোমাদের খুব ভালোবাসি। নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। আমি কোনওদিন তোমাদের ভাবনা ছাড়া একটা নিঃশ্বাসও নিইনি। আমার সব স্বপ্নেই তোমরা ছিলে। আমি তোমাদের ছাড়া থাকতে পারব না, বাবা। আমাকে এভাবে একা করে দিও না!’ সত্যি বলতে আমার খুব কান্না পাচ্ছিল।

কবরে বাঁশ বসানো শেষ হয়। ফাঁক দিয়ে পৃথিবীর আলো এখনও আমার কাছে আসছে। চাটাই বসানো হলো এই মাত্র। খুব ক্ষীণ হলেও এখনও দেখতে পাচ্ছি আলো। কিন্তু প্রিয় মুখগুলো আর সামনে নেই। বাবার ডুকরে কাঁদার শব্দ আসছে আমার কাছে। বাড়ির কাছে কবরস্থান হওয়ায় ভেতরের মেয়েদের কান্নার শব্দও শুনতে পাচ্ছি। এর মধ্যে কোনটা আমার মায়ের, কোনটা স্ত্রীর—এখন আর আলাদা করতে পারছি না।



বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।