ঘরে ঢুকে জরিনা ঢক ঢক করে গ্লাসের পুরো পানি শেষ করে ফ্যালে। তারপর ভেজা কাপড় পাল্টে নেয়।
ওদের বস্তি ছাড়িয়ে পানি আনতে কম পথ হাঁটতে হয় নাকি? সামনের দোকান-পাট পার হয়ে ছোট্ট বাজারটা, তারপরও বেশ কিছু পথ হেঁটে তবে তো পানির সন্ধান! জরিনা এতদূর প্রতিদিনই যায়। টলমলে পানির ডোবায় গোসল সারে, পাশের টিউবঅয়েল থেকে খাবার পানি নেয়, তারপর একহাতে কলস আর অন্যহাতে আশপাশ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া খড়কুটো যা পায়, তাই নিয়ে এভাবে প্রতিদিন ভেজা কাপড়ে আঁটসাট হয়ে ছপছপ শব্দ তুলে ঘরে ফেরে জরিনা।
জরিনার মনটা আজ ভালো নেই। ওর হাতের দুলতে থাকা পাখাটা থেমে যায়। বস্তিতে আসার পর আজ এই প্রথম ঘরে চাল নেই, তেল, নুন কিচ্ছু নেই। সকালে বিনে পয়সার পানি ছাড়া কিচ্ছু পড়েনি পেটে। এ কয়দিন, বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার সময় যা আনতে পেরেছিল, তাই দিয়ে চালানো হয়েছে। আজ ভাণ্ড ফতুর, সুতরাং উপোষ ছাড়া উপায় কী! কলিম সারা রাতের ডিউটি শেষ করে ফিরেছিল সূর্য ওঠার আগেই। ও দশদিন হয় নাইট গার্ডের চাকরিটা পেয়েছে। সারা রাত জেগে থেকে পাহারা দিতে হয় অফিস। কলিম ফিরেই আবার বেরিয়েছে দুরবস্থার কথা জেনে। কিন্তু কোথায় পাবে পয়সা? বেতন তো সেই মাসের শেষে!
জরিনার বুকের ভেতরটায় আজ হু হু করে ওঠে কী এক যন্ত্রণায়। বাবা-মা, ভাইবোনদের অনুপস্থিতিটা আজ উথলে পড়া জোয়ারের মতো নাড়া দিয়ে ওঠে। কতদিন হয় ও ঢাকায় এসেছে? একমাস হয়ে এলো বুঝি! অথচ এরই ভেতর জরিনার ছুটে যেতে ইচ্ছে করে গ্রামের ছায়া-ঘেরা মাটিতে। উঠোন থেকে নেড়ে দেয়া ধান ঝেড়ে ঘরে তোলা, সন্ধ্যায় গোয়াল-ঘরে গরুগুলো ছোট ভাইটা এনেছে কিনা, তার খোঁজ-খবর নেয়া, সারাদিনের কাজ শেষে বাড়ির পেছনের পুকুরে গোসল করা—একে একে সব স্মৃতি জরিনার চোখের সামনে সিনেমার পর্দার মতো ভেসে ওঠে। ভেসে ওঠে উন্মাতাল যুবক কলিমের ছবি। গ্রামের মোড়লের ডান হাত রহিমুদ্দিনের ছেলে কলিম, যে কিনা টো টো করে ঘুরে বেড়াত সারা গাঁয়ে, এগাছের সে গাছের আম, কাঁঠাল, নারকেল পেড়ে খেত দল বেঁধে, সেই দামাল ছেলেটাকে কী করে যে জরিনা ভালোবেসেছিল ভাবতেই পারে না। উত্তাল যৌবনের স্রোতে ভেসে একরাতে ঠিকই চলে গিয়েছিলো কাজী বাড়ি। তারপর শেষ রাতের ট্রেনে চেপে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে রাজধানীর এই বস্তিতে। পাশের গ্রামের রুস্তম, ঢাকায় রিক্সা চালায়, নবদম্পতি প্রথমে এসে ওর ঘরেই উঠেছিল। তারপর রুস্তমের ঘরের পাশেই আরও একটি ছাপরা ঘর তুলেছে।
এই মুখ নিয়ে জরিনা কী করে ফিরে যাবে বাবা-মার কাছে! আদর্শ স্কুল মাস্টার বাবা কি এত সহজেই মেনে নেবেন তাকে? আর এতদিনে গ্রামে কি এই নিয়ে হৈচৈয়ের কিছু বাকি আছে? অথচ জরিনা সব জলাঞ্জলি দিয়ে কিসের মোহে যে কলিমের জীবন সাথী হয়েছে, ও এখনও তা বুঝে উঠতে পারে না। শুধু বোঝে এইটুকুই, এর নাম ভালোবাসা।
বস্তির পাশ দিয়ে গলির মতো রাস্তা গেছে একটা। ভাঙা-চোরা ইটের খোয়া আর জায়গায় জায়গায় বিটুমিন পিচঢালা রাস্তাটা কিছুদূর গিয়ে টঙ্গী ডাইভারসন রোডের সাথে মিশে গেছে। রাস্তার ধারের একটা কাঁঠাল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে পাশের ঘরের টেপীর মা কার সাথে যেন ঝগড়া করছে অশ্লীল ভাষায়। জরিনা ঘরের দরজার খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে থেকে সেদিকেই তাকিয়ে থাকে। তারপর একসময় রিক্সার ক্রিং ক্রিং শব্দে সম্বিৎ ফিরে পায় জরিনা। রিক্সাটা জরিনার ঘরের কাছে এসে থেমে যায়। রুস্তম এসেছে। নিত্যদিনই ও এসময়টাতে ফিরে আসে। নিজের রিক্সা বলে বাঁধাহীন নিয়মে চলে। দুপুরে চারটা ডাল ভাত রেঁধে খেয়ে দেয়ে আবার বের হয় খুশিমতো। বিয়ে-থা করেনি, ছিমছাম ঝামেলাহীন জীবন। কী প্রশান্তি রুস্তমের! কলিমেরও তো এমন হতে পারত, যদি না জরিনাকে বিয়ে করত! বেচারা কলিম, সারাটা রাত কাটে নিদ্রাহীন, সে তো জরিনার সুখের জন্যেই!
রুস্তম রিক্সাটা রেখে জরিনার ঘরের পাশে এসে দাঁড়ায়। পলিথিনে ঢাকা ঘরের চালের ওপর হাত রেখে উদাসী জরিনার দিকে তাকায়। কপালের জমে থাকা ঘাম মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করে, ‘বাবি (ভাবী) কী করতাছো?’
জরিনা গম্ভীর হয়ে বসে থাকে। কোনও কথা বলে না। একবার দুচোখ তুলে রুস্তমকে দেখে। তারপর গায়ের শিথিল কাপড় ঠিকঠাক করে নিয়ে নড়েচড়ে বসে। অসহায় দৃষ্টি ছুঁড়ে দ্যায় ঘুপটি মেরে থাকা গাছগাছালির দিকে।
রুস্তম অবাক হয়ে বলে, ‘কী অইছে? কলিম মারছে নাহি? ও হালায় মারবই তো! হালার রকম সকম দ্যাকতাছি কয়দিন দইরা...’ বকবক করতে করতে হঠাৎ থেমে যায় রুস্তম। জরিনার দিকে তাকায়। অসহ্য গরমে জরিনার নাক, কপাল, গলায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে চিকচিক করছে মুক্তার মতো। পিঠ ছাপিয়ে ভেজা চুল মাটি পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে আছে। রুস্তমের চোখে ভরা যৌবনের শ্যামলা চেহারার জরিনাকে আজ বেশ আকর্ষণীয় মনে হয়। এধরনের যুবতী মেয়েদের যে বস্তিতে একা থাকা মোটেও নিরাপদ নয়, এই উপলব্ধিটা রুস্তমের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
জরিনা নিরুত্তাপ তখনও। রুস্তমের কাছে ব্যাপারটা গোলমেলে মনে হয়। ও জরিনার পিঠের পাশ দিয়ে দরজার ভেতর মাথাটা গলিয়ে দিয়ে ঘরের ভেতরটা অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি দিয়ে দেখে। ঘরের এক কোণায় পানির কলস, তার পাশে বেড়ার ধার ঘেঁষে মোড়ানো বিছানা, অপর পাশে কারুকাজ করা টিনের সুটকেস, মাটির সানকী, গ্লাস, রশিতে ঝোলানো লুঙ্গী, ময়লা গেঞ্জি, ছাপা শাড়ি, লাল রঙের ব্লাউজ। রুস্তম নজরে পড়ার মতো কিছুই দেখে না।
জরিনার চোখে বানের মতো জল এসে গেছে ততক্ষণে। রুস্তম তখন কী যেন একটা কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায়। সহজ সরল মেয়েটির ওপর কিসের এক মায়া এসে ভর করে। ও ধীর গলায় বলে, ‘বাবি বাত চড়াও নাই এহনও?’
‘চাইল নাই’—জরিনার হিমশীতল কণ্ঠ।
রুস্তম তখন সান্ত্বনার স্বরে বলে, ‘অ, এই কতা! ঠিক আছে বাবি, কুনো অসুবিদা নাই, আইজ আমিও রানতাছি না। হইঠাল থাইকা বাত কিন্যা আনমু। তুমি আর আমি আইজ মিল্যা মিশ্যা খামু। ’ একটু দম নিয়ে আবারও বলে, ‘চিন্তা কইরো না বাবি, আমি ঐ হালার কলিম্যারে দেইহা ছারমু! বউ ফালাইয়া যে কই থাহে বুজামু হালারে’—বলতে বলতে রুস্তম মাঝেমধ্যেই যে কাজটা করে থাকে, আজও সেভাবেই খুব কাছাকাছি হয়ে জরিনার চিবুকে হাত রেখে অভয় দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু জরিনার কাছে আজ ব্যাপারটা সাহেবদের বাসার ঘটনার মতো মনে হতেই রুস্তমের হাতটা সরিয়ে দেয় এক ঝটকায়। দুদিন আগে টেপীর মা’র যখন অসুখ ছিল, তখন তার বাসন মাজা, কাপড় ধোয়ার কাজগুলো করে দিতে গিয়েছিল জরিনা। অথচ বাসার সাহেবটি খালি বাসা পেয়ে ওকে প্রায় বিছানায় নিয়ে গিয়েছিল। ঠিক রুস্তমের মতো করেই চিবুকে হাত রেখেছিল শয়তানটা। ঘটনাটার কথা মনে পড়তেই জরিনা আজ শরীরটাকে পিছিয়ে নিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘অইছে যান এহন! অত দরদ দেহান লাগব না। ’ ঝাঁজ মেশানো তীর ছুঁড়ে ও ঘরের ঝাঁপ ঠেলে বন্ধ করে দ্যায়। রুস্তম থ হয়ে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে নিজের ঘরে চলে যায়।
শুয়ে থেকেও স্বস্তি পায় না জরিনা। বুকের ভেতরটায় শুধু অস্থির অস্থির লাগে। রুস্তমকে অমনভাবে অপমান করাটা কি ঠিক হলো? কলিমের অনুপস্থিতিতে সে-ই তো একমাত্র ভরসা। গতরাতের কথা মনে হয়। ওর একাকী রাত কাটানোর কথা কারা যেন টের পেয়েছিল। আর তারই সদ্ব্যবহার করতে এসেছিল। ঘরের চারদিকে শুধু খামচাখামচি করেছে কুকুরের মতো। ফিঁসফিঁস করে দর কষাকষিও করেছে। জরিনা তখন অজানা ভয়ে শিউরে উঠেছে থেকে থেকে। শেষে চিৎকার করে রুস্তমকে ডেকে আনাতেই না পালিয়েছে তারা। বাকি রাতটুকু তো রুস্তম ওর ঘরের পাশে বসেই কাটিয়েছে। অথচ এই লোকটার মনেও কি সাহেবদের মতো ইচ্ছে-টিচ্ছে থাকতে পারে! ভেবে কুল পায় না জরিনা।
দুপুর পেরিয়ে যায়। কলিম আসে না তবু। ঘুম কামাই দিয়ে কোথায় যে ঘুরছে কে জানে! রুস্তমের কাছ থেকে কটা টাকা ধার নিলেই হতো! অথচ তা করবেন না গুণধর সাহেব, দাম কমে যায় নাকি!
জরিনা পাশ ফিরে শোয়। পাখা দিয়ে জোরে বাতাস করে গায়ে। গা থেকে কাপড় সরিয়ে ফ্যালে। ঘামে ভেজা ব্লাউজটাও খুলে রাখে। নিজেকে একবার দেখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। নিজ দেহের লাবণ্য ও যৌবনের অনুভূতি তাকে পুলকিত করে তোলে। কলিমের সান্নিধ্য পেতে ইচ্ছে করে। অথচ চাকরিটা পাবার পর থেকে কলিমেরও যে কী হয়েছে, রাতে কাজ আর দিনে ঘুম ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। লোকটা কি এইভাবে একেবারেই শান্ত হয়ে গেল? জরিনা এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে একসময়।
জরিনার যখন ঘুম ভাঙ্গে, সন্ধ্যেটা তখন যাই যাই করছে। রাস্তার পাশের চায়ের দোকানগুলো থেকে গানের রেকর্ড বাজছে। আশপাশের ঘরগুলোতে দিনের শেষের ব্যস্ততা। কারও দুধের বাচ্চা কাঁদছে । জরিনার ঘরে তখন আধো আলো আধো অন্ধকার।
উঠে বসে জরিনা। সহসা দেখে ঘরের দরজা একেবারেই খোলা। কলিম এসেছিল কি তবে? জরিনা গায়ের কাপড় জড়িয়ে ঘর থেকে বের হবার মুহূর্তেই নজরে পড়ে ঢাকা দেয়া বাসন। ও এবারে নিশ্চিন্ত হয়। রুস্তম খাবার দিয়ে গেছে। ঘুমিয়েছিল বলে ডাকেনি। আর তখুনি এক অদ্ভুত লজ্জা এসে ভর করে জরিনার। তবে কি রুস্তম ওর খোলামেলা দেহ, নগ্ন বক্ষ এসব দেখে গেল? ছিঃ ছিঃ , ও কী করে রুস্তমের কাছে গিয়ে দাঁড়াবে এখন? এক ধরনের অস্বস্তি নিয়ে জরিনা ঘরের বাইরে আসে এবং ফের ঘরে ঢুকে পানির বদনাটা নিয়ে বের হয়।
এক সময় রুস্তম আসে ক্লান্ত দেহ নিয়ে। রিক্সাটা ঘরের পাশে রেখে হাত-মুখ ধোয়। জরিনা ওর ঘরের দরজায় বসেছিল, রুস্তম ওকে দেখে গামছা দিয়ে শরীর মুছতে মুছতে ওর দিকেই আসে এবং জিজ্ঞেস করে, ‘বাবি, বাত খাইছো?’ জরিনা ম্লান হেসে মাথা নীচু করে থাকে। রুস্তম আবার কথা বলে, ‘কলিম আইছে?’
জরিনার তখন কী যে হয়! পাহাড় সমান ব্যথা এসে ওকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে যায়। কাঁদস্বরে বলে, ‘না, হেই বিয়ানে গেছে, এহনো কুনো খুজ নাই!’ বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে ফ্যালে। আঁচলে দুচোখ মোছে। পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে মাটি খুঁচিয়ে তোলে। রুস্তম তখন ভাবতে থাকে। গতরাতের ঘটনাটা মনে পড়ে। জরিনা একাকী কী করে বস্তি পাড়ায় থাকে? বস্তিতেও যে কত রকমের বাজে কাজ চলে, একথা কি জানে জরিনা? অথচ কলিমটা কী করছে আজকাল! আর ভাবতে পারে না। জরিনাকে জিজ্ঞেস করে, ‘কাইল তো পাহারা দিলাম, আইজ রাইতে থাকবা ক্যামনে?’ জরিনা কথা বলে না। রুস্তম আবার প্রশ্ন করে, ‘আইচ্ছা বাবি, কলিম কুন অফিসে কাম করে কইতে পারো?’ জরিনা সেটা কী করে জানবে? ও মাথা নেড়ে ‘না’ সূচক ইঙ্গিত করে।
‘আমি জানি’—রুস্তমের গলার স্বর ধীর এবং শান্ত, ‘হে তো এহন হেই জাগাতেই আছে। ডিউটির সময় অইয়া গেছে না!’ শেষের কথাটি বেশ তিরস্কারের সাথেই বলে রুস্তম।
লম্বা করে একটা দম নেয় রুস্তম। কিছুক্ষণ আগে একটা সিগারেট জ্বালিয়েছিল, ওটা এতক্ষণে প্রায় নিঃশেষ হয়ে ছোট হয়ে এসেছে, রস্তম ওতে জোরে একটা সুখটান দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফ্যালে আবারও ভাবে কিছুক্ষণ। এইভাবে কয়েক মুহূর্ত চিন্তায় ডুবে থেকে শেষে বলে, ‘যাইবা আমার লগে তার অফিস দেখতে?’ তারপর ক্রোধে গিজ গিজ করতে করতে নাটকীয় ভঙ্গিতে উচ্চারণ করে, ‘খু-উ-ব সুন্দর অফিস, আমিও খুজ পাই নাই আগে। ’
শুনে জরিনা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, যেন অকুল পাথারে হারিয়ে যাওয়া জাহাজের কুল খুঁজে পাওয়া। ও যাবে ওর প্রাণের মানুষকে দেখতে।
রুস্তমের রিক্সাটা ছুটে চলে পঙ্খীরাজের মতো। আরোহী জরিনা। রিক্সাটা কাওরান বাজার রেলগেটের কাছে এসে থেমে যায়। রুস্তম নামে, জরিনাকেও নামতে ইশারা করে। রিক্সাটাকে রাস্তার পাশের একটা গ্যারেজের কোণে রেখে রস্তম জরিনার এক হাত আগলে ধরে রেললাইনের ওপর গিয়ে ওঠে। তারপর হন হন করে ছুটে চলে ওরা। এসময় এশার নামাজের আজান শোনা যায়। জরিনার বুকটা ধুক ধুক করছে দ্রুততালে। কখন পৌঁছবে সে স্বামীর অফিসে? ওকে দেখে কলিম চমকে যাবে না তো?
‘বাবি আমরা আইসা গেছি’—ফিঁসফিঁসিয়ে বলে রুস্তম। জরিনা থমকে দাঁড়ায়। রুস্তমকে অনুসরণ করে। রুস্তম রেললাইন থেকে এবারে নেমে পুব দিকে হাঁটে। কিন্তু জরিনা কোনও অফিস দেখে না। ও এবার অবাক হতে থাকে। ভয়ে সংকুচিত হতে শুরু করে ধীরে ধীরে। রুস্তমের কি তবে অন্য কোনও মতলব আছে? জরিনার বুকে সংশয়।
এখানে শুধু বস্তি। জরিনারা যে বস্তিতে থাকে তাঁর চেয়েও খারাপ। ঘরগুলোর ভেতর থেকে টিমটিমে বাতি জ্বলছে। কারও বাচ্চা কাঁদার শব্দ। কেউ রাঁধছে বাইরের উনুনে। রুস্তম নিঃশব্দে একটা ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। পেছন থেকে জরিনাকেও টেনে নিয়ে যায়। জরিনার তখন হাত কাঁপছে। কাঁপছে সারা দেহ। রুস্তম ঘরটার কাছে পৌঁছে বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে আগে উঁকি দিয়ে কিছুক্ষণ দেখে নেয়। তারপর জরিনাকে ফিঁসফিঁসিয়ে বলে দেখার জন্যে। জরিনা নিঃশব্দে তাই করে এবং মুহূর্তের মধ্যেই কী যে হয় তার! আগুন ঝরা চোখে বেড়ার কাছ থেকে ও ক্ষণকালের মধ্যেই সরে আসে। পা কাঁপে ওর। কিসের এক দাবদাহ জ্বলজ্বল করে চোখে। জরিনা একবার স্থির দৃষ্টিতে রুস্তমকে দ্যাখে। তারপর ওর এক হাত প্রচণ্ড ক্ষিপ্রতায় মুষ্টিতে চেপে ধরে জরিনা নিজ গন্তব্যের দিকে ছুটে যায়।
রিক্সায় বসে জরিনা আবারও ঐ দৃশ্যটার কথা ভাবে। পরনারীর সাথে গায়ে গায়ে জড়ানো কলিম! জরিনার সাথে যেমন করে জড়িয়ে জড়িয়ে নিবিড় মুহূর্তে তলিয়ে যেত ঠিক তেমন। দৃশ্যটি ওকে কেন দেখতে হলো ভিন্ন এক যুবতীর সাথে? মেয়েটি কি তবে শেফালী? ওদের গ্রামের সবচেয়ে সুন্দরী কিশোরী ছিল শেফালী। গরীব বাবা-মার ঘরের চঞ্চলা রূপবতী শেফালী তখন কলিমকেই পাগলের মতো ভালোবাসত। কিন্তু কলিম ব্যাপারটিকে সেসময় পাত্তাই দেয়নি। কারণ কলিমের মনটা তখন পড়ে থাকত জরিনার জন্যে। অথচ মোড়লের ছেলে একরাতে সেই মেয়েটিকে নিয়ে জোর করে ব্যাভিচারে লিপ্ত হলে পরদিনই সারা গায়ে জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। শেষে বাচারি শেফালী চোখের জল ফেলতে ফেলতে হঠাৎ একদিন সবার অজান্তে গ্রাম থেকে পালিয়ে যায়। জরিনার চিনতে ভুল হচ্ছে না। এখন ঠিক ঠিক বুঝতে পারছে ওই মেয়েটিই শেফালী। কিন্তু কলিম ওর খোঁজ পেল কিভাবে? কলিম কি তাহলে জরিনাকে আর ভালোবাসে না? একটা দমকা হাওয়া এসে জরিনার চুলগুলোকে উড়িয়ে দিয়ে যায়। জরিনা আর ভাবতে পারে না।
ঘরে গিয়ে জরিনা হাতের চুড়ি ভাঙে একে একে সব। কপালের টিপ মুছে ফ্যালে মুখের থুতু দিয়ে। তারপর মেঝেতে গোছানো বিছানায় পড়ে গড়াগড়ি যায়। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। আশপাশের ঘরগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে তখন। রূপকথার নিঝুমপুরী যেন গোটা বস্তিটা। বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা ডাক। দূরের একটা ঘর থেকে রমজান পাগলার গোঙানির আওয়াজ। জরিনার কান্না হেচকি দিয়ে দিয়ে থেমে আসে একসময়। কিন্তু চোখে তার ঘুম আসে না। মগজের স্নায়ুগুলো শুধু লাফালাফি করে প্রতিহিংসায়।
জরিনার মাথায় হঠাৎ কী যেন খেলে যায়। ওর সারা শরীর নাড়া দিয়ে ওঠে দ্বিগুণ ক্ষোভে, প্রতিবাদে। ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ও। রুস্তমের ঘরের দরজাটা এক ধাক্কায় খুলে ফ্যালে প্রচণ্ড শক্তিতে। রুস্তম জেগে ছিল তখনও। ও জরিনার ক্ষিপ্র মূর্তি দেখে চমকে ওঠে। ক্ষীণ আলোয় জরিনার দেহ থেকে একে একে সব কাপড় খুলে যাওয়া দেখে রুস্তম। উন্মাতাল নগ্ন জরিনা তখন রুস্তমের ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে আর্তনাদ করে ওঠে, ‘আমি শোধ নিবার চাই রুস্তম বাই! আমারে ঠেইলা দিও না! আমি শোধ নিমু! প্রতিশোধ!’
শুয়ে থাকা রুস্তম এক ঝটকায় জরিনাকে বুকের ওপর থেকে সরিয়ে দেয়। এরপর বিছানা থেকে নিজেও সরে এসে হাঁটু গেড়ে বসে। রুস্তম তখন জিঘাংসা, রিরংসা, আকাঙ্ক্ষা আর হতাশার এক মিশ্র প্রতিচ্ছবি দেখে জরিনার চোখে মুখে। এই প্রথম নারীদেহের নগ্নতা দেখে সে। রুস্তমের বিছানায় চিত হয়ে নেতিয়ে পড়ে আছে জরিনা। নগ্ন সুডৌল উঁচু বক্ষ ঘন ঘন নিঃশ্বাসের সাথে ওঠানামা করছে। রুস্তমকে কাছে পাবার আকুলতা নিয়ে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে জরিনা। মুহূর্তেই রুস্তমের সারা শরীর জুড়ে এক অজানা শিহরণ চনমন করে ওঠে। ওর কী করা উচিত এখন? ও কি জরিনার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ওকে সাহায্য করবে? তাতে সেও তো শারীরিক ক্ষুধা মেটানোর এক নতুন অভিজ্ঞতার আস্বাদ পাবে! রুস্তমের বুকের ভেতর ঢিবঢিব করতে থাকে। কিন্তু মুহূর্তেই ওর মগজের স্নায়ুগুলো আবার ভিন্ন দিকে ধাবিত হয়। খুব চাপা স্বরে ও তখন হিসহিসিয়ে ওঠে, ‘তুমার কি মাথা খারাপ অইছে? এইডা কী করতে চাইতাছো? কলিম না তুমার বিয়া করা স্বামী?’
জরিনা তখন বসে থাকা রুস্তমকে আবারও দুহাত দিয়ে হেঁচকা টানে ওর বুকের কাছে নিয়ে আসে। রুস্তমের গালে, মুখে, নাকে নারী বক্ষের নরম-উষ্ণ উঁচু অংশের স্পর্শ লাগতে থাকে। ওর শরীরে তখন আবারও শিহরণ দেয়। এবারে যেন বিদ্যুতের ঝলকানির মতো শরীরের উত্তাপও বেড়ে যায়। সেই সাথে শ্বাস প্রশ্বাসের ওঠানামাও বেড়ে যায়। কিন্তু আবারও বিবেকের দংশন! কোনদিকে যাবে রুস্তম? জরিনার সান্নিধ্যে নাকি বন্ধুর স্ত্রীকে যথাযথ সম্মানের সাথে দেখভাল করার দায়িত্ব পালন?
এরই মধ্যে জরিনা রুস্তমের পিঠে দুহাতের স্পর্শ দিতে থাকে। কখনও চুলে, কখনো গলার আশপাশে নারী দেহের নরম আঙুলের স্পর্শ রুস্তমকে ক্রমশই অথৈ সাগরে তলিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। জরিনার ফিঁসফিঁস কণ্ঠ বেজে উঠে তখন, ‘শেফালীর সাতে যার এত ঢলাঢলি, আমি মইরা গেলেও তো তার ঘর আর করতাছিনা না! এইডাই আইজকা ফাইনাল রুস্তম বাই। তুমি আমারে ফিরাইয়া দিও না দয়া কইরা!’
কিন্তু রুস্তম এবারও মুহূর্তের মধ্যেই যেন প্রচণ্ড এক শক্তিতে নিজেকে দমন করতে সক্ষম হয়। জরিনার দেহ-স্পর্শ থেকে নিজেকে ক্ষিপ্র গতিতে মুক্ত করে বিছানা থেকে উঠে সোজা দাঁড়িয়ে যায়। তারপর ধীর কণ্ঠে বলে, ‘তুমি আইজ রাত ভইরা চিন্তা করো জরিনা, তুমি আসলে কী করতে চাও! মাথা গরম কইরা কিছু করা ঠিক না, আমি তো পাশেই আছি, চইলা যাইতাছি না তো!’
রুস্তম সহসা জরিনাকে আর ‘ভাবী’ সম্বোধন করতে পারে না। আপনাতেই মুখ থেকে ‘জরিনা’ নামটিই উচ্চারিত হয়ে যায়। সত্যিকার অর্থে রুস্তমের তখন আর কোনও কিছুই ভাববার সময় নেই। একটা কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি সে আজ। এই পরীক্ষায় তাকে পার হতেই হবে। ও এক ঝলকে ঘরের দরজা খুলে হুড়মুড় করে বেরিয়ে যায়।
আকাশের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে কয়েক খণ্ড মেঘ স্থির জমাট হয়ে ছিল বিকেলের দিকে। তা এতক্ষণে আরও বড় ক্যানভাসে সারা আকাশ ছেয়ে ফ্যালে। মুহূর্তেই শীতল দমকা হাওয়া এসে অবাধ্যের মতো বস্তির ফাঁক ফোঁকর দিয়ে ঢুকে পড়ে। সেই সাথে ধুলো বালির অশান্ত ঝাপটা। বিদ্যুৎ চমকায় থেকে থেকে। মেঘে মেঘে ঘর্ষণ—বৃষ্টি বর্ষণের কথা জানিয়ে দেয় দীর্ঘদিন পর।
একটা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে শ্রান্ত, ক্লান্ত, নিঃসাড় জরিনা তখন চিত হয়ে পড়ে থাকে ভাবলেশহীন বরফ-ঠাণ্ডা মাছের মতো। দেখে ঘরের চাল। চালের ফুটো। আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি। নেতিয়ে পড়া জরিনার দুচোখ বুঁজে আসে ঘুমে। ঝরঝর করে কয়েক ফোঁটা জল চোখের দু’ধার দিয়ে নেমে এসে কানের পাশ ঘেঁষে বিছানায় গিয়ে পড়ে। দুহাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে ওঠে নগ্ন জরিনা।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৪ ঘণ্টা, মে ৪, ২০১৫