ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সিমিন বেহবাহানির কয়েকটি কবিতা | ভাষান্তর : মঈনুস সুলতান

অনুবাদ কবিতা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৮ ঘণ্টা, মে ৬, ২০১৫
সিমিন বেহবাহানির কয়েকটি কবিতা | ভাষান্তর : মঈনুস সুলতান

ইরানের কবি সিমিন বেহবাহানির (১৯২৭- ২০১৪) জন্ম তেহরানে। তাঁর পিতা আব্বাস খলিলি ছিলেন লেখক ও সংবাদপত্রের সম্পাদক।

তাঁর জননী কবি ফখর আজমা আরগুন-ও যুক্ত ছিলেন সাংবাদিকতায়। নারীবাদী জেন্ডার বিশেষজ্ঞ হিসাবেও তিনি ছিলেন খ্যাতিমান। মাত্র বারো বছর বয়সে সিমিন বেহবাহানি রচনা করেন তাঁর প্রথম কবিতা। চৌদ্ধ বছর বয়স থেকে তাঁর কবিতাদি প্রকাশিত হতে থাকে পত্রপত্রিকায়। বিষয়বস্তুর দিক থেকে অত্যন্ত অধুনিক হলেও তিনি গজলের ধ্রুপদী প্রকরণকে প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করতে পছন্দ করতেন। জেন্ডারজনিত বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার এ কবির কবিতায় ইরানের সমকালীন সমাজ বাস্তবতা তীব্রভাবে প্রতিফলিত। বোদ্ধা সমালোচকরা তাঁকে বিশ শতকের ফার্সি সাহিত্যের প্রধান কবি হিসাবে বিবেচনা করে থাকেন।

সিমিন বেহবাহানি অনেক বছর ইরানের রাইটার্স এসোসিয়েশনের সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯ ও ২০০২ সালে পরপর দু’বার তিনি নোবেল পুরস্কারের জন্য নমিনেশন পান। ১৯৯৮ সালে তিনি হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচের তরফ থেকে লাভ করেন ‘হামেট গ্রান্ট’ পুরস্কার। ২০০৬ সালে নরোজিয়ান অথরর্স ইউনিওন তাঁকে ‘ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন’ পুরস্কারে সম্মানিত করে। তাঁর রচিত বিশটি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ১৯৫২ সালে প্রকাশিত ‘শেহ-তার এ শেকাস্ত’ বা ‘দ্যা ব্রোকেন লুট’ এবং ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত ‘চেলচেরাগ’ বা ‘শ্যান্ডেলিয়ার’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

২০১০ সালে ৮২ বছর বয়স্ক প্রায় অন্ধ কবি তাঁর প্রতিবাদী ভূমিকার জন্য কারারুদ্ধ হন। অবশেষে আন্তর্জাতিক মহলের চাপে তাঁকে মুক্তি দেয়া হলেও ইরান সরকার তাঁর পাসপোর্ট জব্দ করে। সে কারণে জীবনের শেষ দিকে আমন্ত্রিত হয়েও তিনি ভিন্ন ভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত নানা রকমের কবিসভা ও সেমিনারে যোগ দেয়া থেকে বঞ্চিত হন।

এখানে সিমিন বেহবাহানি’র চারটি কবিতা উপস্থাপিত হচ্ছে। কবিতাগুলো ফারজানে মিলানি’র ইংরেজি অনুবাদ থেকে ভাষান্তর করা হয়েছে। - অনুবাদক



গলার হার
___________________________________

      অত্যন্ত অসুখী দুশ্চিন্তায়—সতত উদ্বেগে সে উত্তেজিত
      চোখমুখচুল তার ঢাকা নেই কোনও চাদরে
      পরেনি নেকাব আজ,
      গ্রেফতারের সম্ভাবনায় আতঙ্কিত নয় সে নারী
      বিস্মৃত হয়েছে স্রেফ পর্দাপুশিদার সামাজিক রেওয়াজ।

      আঁখি দুটি তার দ্রাক্ষার গুচ্ছ থেকে আলাদা করা জোড়া আংগুর
      কালের নিষ্পেষণে নির্যাস নিঙড়িয়ে
      রক্তাক্ত মদিরা ভরা হয়েছে শতেক ব্যারোলে,
      সঙ্গীত থেকে যেন নির্বাসিত হয়েছে সুর।

      ক্রোধে উন্মাদ সে—নিজেরই কাছে অচেনা আগন্তুক
      অন্যদের কাছেও এ চেহারা-সুরত সমানভাবে অপরিচিত,
      আশপাশের জগত সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিস্মৃত
      কোনও কিছুতেই নয় সে আজ উৎসুক।

      বয়ে বেড়াচ্ছে গলায় সে অভিশাপ ও অশ্রুর যুগল হার
      কোনও এক সৈনিকের বুট জোড়াও ঝুলছে নেকলেস থেকে,
      জানতে চাই হে খানুম—কী সমাচার?
      হেসে জবাব দেয়, ‘হতভাগা ছেলেটি আমার
      বসে আছে কাঁধে দু’পা তুলে
      ধুলিমাখা বুট জোড়া তার এখনও সে নেয়নি খুলে। ’


আলোর মদিরা
___________________________________

      চোখ মুদেছে নক্ষত্ররাজি—এসো
      নিশিথের ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছে আলোর মদিরা—এসো
      অপেক্ষায় রাত্রির পানপাত্র ভরেছি আমার উদগত অশ্রুতে
      কুঁড়ি মেলছে প্রদোষ, প্রস্ফুটিত হচ্ছে ঊষা—তুমি এসো
      তোমার স্মৃতি নিহত নক্ষত্রের মতো সোনালি নকশা আঁকে
      আমার অন্তর্গত আকাশে—এসো
      অপেক্ষার বেদীতে বসে বসে বলছি
      আমার যন্ত্রণাদগ্ধ কথকতা দীর্ঘ রাতভর
      নিশিথের প্রকৃত কৃষ্ণাভা সহমর্মিতায় হয়েছে ধূসর
                                            তুমি শুনছো.. এসো
      আমার মৃত্যুর পর তুমি যদি আরেকবার আমাকে দেখতে চাও
      বুঝতে পারছো—এখনই সময়, সুতরাং এসো
      যদি আমি শুনি কারও পদশব্দ
      ধরে নেব এ মৃদু আওয়াজ তোমারই
      হার্টবিটের তীব্র স্পন্দন—এত জোরে তড়পাচ্ছে
      মনে হচ্ছে বেরিয়ে আসবে হৃৎপিণ্ড পাঁজর ছিঁড়ে.. এসো
      ভগ্নহৃদয় সিমিনের বুকে তুমিই অবশিষ্ট একমাত্র আশা
      গোছাও আমার দুর্ভোগের দুর্বিপাক.. তুমি এসো।


জননীর জলপাই শাখা
___________________________________

রেশমের উজ্জ্বল ফিরোজা কাফতান পরে নারীত্বের নীরব মহিমায় হাতে জলপাইয়ের একটি সবুজ শাখা নিয়ে তিনি এসে দাঁড়ান। ভাসছে তাঁর চোখে থরে বিথরে বেদনার বিপুল কাহিনী। দু’হাত বাড়িয়ে ছুটে গিয়ে আমি তাঁকে স্পর্শ করতেই মনে হলো—নাড়ী যেন স্পন্দিত হচ্ছে এখনও তাঁর ধমনীতে, এবং তাঁর শরীরও উষ্ণ জীবনের সঞ্চারণে; অবাক হয়ে বলি, ‘তুমি তো মৃত! অনেক বছর আগে না বিগত হয়েছো তুমি জননী!’ না, তাঁর শরীর থেকে ছড়ায় না আতর লোবানের খোশবু, দেহও জড়িয়ে নেই সফেদ কাফনে। আড়চোখে তাকাই, আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে জলপাইয়ের শাখা মৃদু হেসে তিনি বলেন, ‘নাও, শান্তির প্রতীক। ’ আমি সবুজপত্র ছুঁতে গিয়ে এক অশ্বারোহীর জোরালো পদাঘাতে থমকে ফিরি। আলোয়ানের ভেতর থেকে চকচকে ছুরিকা বের করে ঘোড়সওয়ার পুরুষ খপ করে জলপাইয়ের শাখাটি তুলে নিয়ে চেঁছে চেঁছে নিপুণ হাতে তৈরি করে সে লিকলিকে একটি বেত। তার স্থিতিস্থাপকতা যাচাই করতে করতে বলে, ‘পাপীদের সাজা দেয়ার জন্য চমৎকার হয়েছে বেত্রদণ্ডটি। ’ অশ্বারোহী এবার স্যাডেল ব্যাগ খুলে তাতে বেত্রদণ্ডটি ঢুকাতে গেলে.. ..দেখি! হা ঈশ্বর! থলের তলায় পড়ে আছে মুচড়ে গলাভাঙ্গা সুতলি দিয়ে বাঁধা মৃত একটি ঘুঘু। বিষণ্ন হয়ে আমার জননী হেঁটে যান দূরে। আমার দু’চোখ অনুসরণ করে তাঁকে। .. ..দেখি তাঁর পোশাকও বিবর্তিত হচ্ছে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় সামিল হওয়া শোকার্তদের কৃষ্ণাভ গাউনে।


চাই এক পেয়ালা পাপ
সে বললে, আমি যা চাই তা আসলে অপ্রাপ্য। - মৌলভী
___________________________________

আমি চাই এক পেয়ালা পাপ, গেলাস ভর্তি দুর্নীতি। কুচকুচে কালো অন্ধকার মেশানো কিছু কাদা যা থেকে বানানো যেতে পারে একটি মূর্তি। সে আকৃতিতে হবে মানুষের মতো। তার থাকবে কাঠের বাহু ও খড়ের চুল। তার মুখগহ্বর হবে মস্ত বড়। থাকবে না কোনও দন্তরাজি। চেহারাসুরতে প্রতিফলিত হবে কুৎসিত অভিব্যক্তি। প্রলোভন তাকে প্ররোচিত করবে তাবৎ নিষেধাজ্ঞা ভেঙ্গে ফেলতে। কুঁচকানো ললাটে তার তৈরি হবে একটি ‘লজ্জাজনক প্রত্যঙ্গ’। তার চোখ দুটি রক্তাভ শিখা যেন। একটি তাকিয়ে থাকবে সারাক্ষণ স্বর্ণের থলির দিকে। অন্যটি খুঁজবে শয্যায় মিথুনে মগ্ন হওয়ার ফিঁকির। মুখোশ পরিবর্তন করবে সে বর্ণচোরা গিরগিটির মতো আহরহ। পিছল ইল মাছের মতো তার হৃৎপিণ্ড হবে দুটি। সে বাড়তে থাকবে দৈত্যাকৃতির বৃক্ষশাখার মতো। তারপর সে আসবে আমার কাছে স্রেফ নিপীড়নের অসিলায়। তার বিভীষিকার বিরুদ্ধে আমি চীৎকারে প্রতিবাদ করব; এবং মানুষ নামের এক মন্সস্টার মূর্তি আমাকে শায়েস্তা করবে অশ্লীল খিস্তি খেউড়ে। আর আমি যখন তাকাব তার চোখে.. ..লাজুকভাবে নিষ্পাপ ভঙ্গিতে আমি নীরবে নিজেকে শাসন করতে করতে বলব—‘দ্যাখো মেয়ে, কিভাবে সারাটি জীবন তুমি কামনা করেছিলে ‘আদম’, আর এবার পাওনি কী—তুমি যা চেয়েছিলে। ’



বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৮ ঘণ্টা, মে ৬, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।