নভেরা আহমেদ আমাদের আধুনিক ভাস্কর্যের প্রতিকৃত। তার জন্মের সাল-তারিখ ঠিক পাওয়া যায়নি, তবে ধরা হয় তার জন্ম গত শতকের তিরিশের দশকে।
আমাদের দেশে আধুনিক ভাস্কর্যের সূচনা তার হাত দিয়েই। তার কাজের সঙ্গে আমাদের পুতুল বা লোকজ ভাস্কর্যের সংযোগ রয়েছে। দেশীয় রিয়েলেস্টিক ভাস্কর্যের সঙ্গে তার সংযোগ নাই, এমনকী ইউরোপীয় বাস্তববাদীদের সঙ্গে তার কাজের যোগাযোগ নাই। অবশ্য এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আগেই বলেছি, তার কাছে হেনরি ম্যুরের প্রভাব ছিল। তিনি নানাভাবে কেটে চেনে চেহারা দিতেন। ভাস্কর্যের কোণ, ফর্মটা ছিল তার নিজেস্ব। আর এসব ভাস্কর্যের সঙ্গে পুতুলের গড়নের সম্পর্ক ছিল। পাথরখণ্ড কেটে তিনি ভাস্কর্য তৈরি করেছেন। পাথরখণ্ড আরাধনার সঙ্গে সম্পর্কিত। তিনি নিবেদনের ভাস্কর্য বিমূর্ততায় উপস্থাপন করেছেন।
নভেরা অভিজ্ঞতার জন্য নানা সভ্যতা ঘুরে দেখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে গ্রিক, রোমানসহ আরও অনেক সভ্যতা। তিনি লন্ডনে পড়তে যান ১৯৫১ সালে এবং দেশে ফিরে আসেন ১৯৫৭ সালে। তিনি যখন লন্ডন যান, তখন বয়স খুব সম্ভবত ১৫। ওখানে পড়া শেষ করে ১৯৫৫-৫৬ সালের দিকে যান ফ্লোরেন্সে। সেখানে তখন থাকতেন হামিদুর রাহমান, মূর্তজা বশীর। যেহেতু তারা ফ্লোরেন্সে ছিলেন, ফলে নভেরাও সেখানে বছরখানেক অবস্থান করেন।
১৯৫৭ সালে বাংলাদেশে এসে শহীদ মিনারের কাজ শুরু করেন। শহীদ মিনারের কাজটা হামিদুর রাহমানের নামে ছিল, তার সঙ্গে প্রশাসনের যোগাযোগ থাকায় কাজটা তার নামেই বরাদ্দ হয়। তবে যেহেতু নভেরা আহমেদ ভাস্কর্য চর্চা করতেন, ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, তিনি এ কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আনা ইসলাম, শিল্পী শাহাবুদ্দিনের সঙ্গে কথা বলে এ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়।
শহীদ মিনারের কাজ ১৯৫৮ সালের দিকে এসে একটু পিছিয়ে যায়। আইয়ূব খানের সামরিক শাসনের ফলেই ব্যাপারটি ঘটে। সেসময় নভেরা আহমেদ তার ভাস্কর্যের বিশাল এক প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। এখন যেখানে পাবলিক লাইব্রেরি, সে জায়গাটা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ। এখানেই তার প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। যখন আমাদের এখানে ভাস্কর্য বিভাগ দাঁড়ায়নি, কোথাও তেমনভাবে ভাস্কর্য চর্চা হতো না। তখন ২০/২১ বছরের নভেরা আহমেদ বিপ্লব ঘটিয়ে দিলেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে তিনি তখন কোনও একটি পুরস্কারও পান। কিন্তু তার এই অর্জন নিয়ে হামিদুর রাহমান বা মূর্তজা বশীর, কেউ একটিমাত্র কথাও বলেননি। নভেরা আহমেদের সে কাজ এখনও পর্যন্ত কেউ অতিক্রম করতে পারেনি। তার কাজে আমাদের লোকজ অনেক বিষয় চলে আসে, দেশজ বিষয় তিনি তুলে আনেন।
তিনি পাঠের জন্য অনেক দেশ ভ্রমণ করেন। তার সঙ্গে পরিচয় হয় সমকালীন বিখ্যাত দুই ভাস্কর সেজার এবং জিয়াকোমেত্তিরের। শিল্পে এশীয় বৈশিষ্ট্য কী, তার অন্বেষণ তিনি করেছেন সারা জীবন। সে কারণে তার প্রিয় জায়গা ছিল ইন্দো-এশিয়া, বিশেষ করে কম্বোডিয়া। কম্বোডিয়ার অ্যাংকরবাট তিনি ভ্রমণ করেন ১৯৬৯ সালে। ১৯৭০ সালে তার একটা প্রদর্শনী হয় থাইল্যান্ডে। সেখানেই পরিচয় হয় স্বামী গ্রেগোয়া ব্রনসের সঙ্গে। তিনি ছিলেন রাশান।
গত বছর প্যারিসে নভেরা আহমেদের একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। এ প্রদর্শনীতে ১৯৬৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তার নানা কাজ স্থান পায়। এর মধ্যে অনেক পেইন্টিংও ছিল। এসব পেইন্টিং-এ বাংলাদেশের পাখি, প্রকৃতি, সমুদ্র সৈকত ইত্যাদি নানা বিষয় উঠে আসে।
বোধহয় দীর্ঘদিন পর এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে তিনি তার শেষ আয়োজন দেখিয়ে বিদায় নিলেন। আর আমাদের শিল্পের জন্য রেখে গেলেন এক বিপুল সৃষ্টিসম্ভার।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫০ ঘণ্টা, মে ৭, ২০১৫