রবীন্দ্রনাথ-রচনাবলী কেবল বাঙালি-জীবনের সমগ্রতার আদর্শরূপ নয়, ভারতবর্ষীয় এমন কি বিশ্বসংস্কৃতিরও অনিবার্য অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। তাঁর সার্ধশত জন্মবার্ষিকী সামনে রেখে একজন বাঙালি হিসেবে এর চেয়ে তৃপ্তিকর অনুভূতি আর কিছু হতে পারে না।
রবীন্দ্রনাথ কতটা ভাবময় ও কতটা জীবনমুখী তার পরিচয় পাওয়া যাবে উপন্যাসে। কারণ উপন্যাস হচ্ছে সবচেয়ে জীবন ঘনিষ্ঠ শিল্পমাধ্যম। আর তাঁর ছোটগল্পই হচ্ছে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশই হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প। তাঁর কয়েকটি উপন্যাসের ওপর আজ আমি আলো ফেলতে চাই। কেননা, এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ এখনও কালাতিক্রমী। তাঁর জীবনঘনিষ্ঠতা ও শিল্পনির্মাণ-দক্ষতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যধ্যম উপন্যাস।
রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপন্যাস ‘করুণা’। উপন্যাসের উপকরণ নির্বাচনের প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম তিনটি উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্রের আদর্শ অনুসরণ করেছেন বলে অধিকাংশ সমালোচক অভিমত ব্যক্ত করলেও এ উপন্যাসের জীবন রোমান্সমুক্ত। ‘করুণা’র উপকরণ, বিষয় ও চরিত্র-পাত্রের আচার, আচরণ ও উচ্চারণ বিচার করে উনিশ শতকীয় বাঙালি নারী ও তার সামাজিক জীবনই আমরা খুঁজে পাই। আমরা জানি, যে নীতি ও আদর্শচেতনা বঙ্কিমচন্দ্রের অধিকাংশ উপন্যাসের শিল্পবিচ্যুতির কারণ, প্রথম উপন্যাস থেকেই রবীন্দ্রনাথ তা অতিক্রম করতে সমর্থ হয়েছিলেন। ‘বউ-ঠাকুরানীর হাট’ ও ‘রাজর্ষি’র ঘটনা ও চরিত্র—পাত্ররা ঐতিহাসিক কালের হলেও আদর্শ সন্ধানের প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথের জীবনদৃষ্টি সামন্ত মূল্যমান অতিক্রম করে গেছে। এসব উপন্যাসের শিল্পবিচ্যুতির মূলে কাজ করেছে রবীন্দ্রনাথের এ পর্যায়ের অতিসংবেদনশীল, আবেগশাসিত রোম্যান্টিক চিত্তবৃত্তি; নীতি বা আদর্শ নয়। এ দু’টি উপন্যাস পূর্বের ঐতিহাসিক উপন্যাসের আদর্শে রচিত এবং ঘটনাবিন্যাসও ইতিহাসের কাঠামোর মধ্যে বিধৃত। ইতিহাসের জীবন ও উদ্দীপনা উপন্যাসের ঘটনা ও চরিত্রের মধ্যে সঞ্চারিত হওয়ার কোনও পরিচয় পাওয়া যায় না। যে সমাজপ্রগতি ও রূপান্তরের পথপরিক্রমায় এবং স্বতন্ত্র জীবন-অভীপ্সায় এ পর্যায়ের রবীন্দ্রমানস গঠিত, তার কেন্দ্রস্থ সত্য বাংলার অসম্পূর্ণ রেনেসাঁসের অনুভবজাত দ্বন্দ্বময় জীবনচৈতন্য। ঐতিহাসিক উপকরণের মধ্যে ঐতিহাসিক মানব মানবী সন্ধান করেন নি রবীন্দ্রনাথ, তিনি আধুনিক মানুষের আত্মসন্ধান ও সত্তাসন্ধান রূপায়িত করেছেন। এ পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্য, চরিত্রের সম্পূর্ণতা নির্মাণ নয়—নিজ ক্ষত-বিক্ষত, রক্তাক্ত ও যন্ত্রণাকাতর জীবনার্থের মীমাংসাসূত্র সন্ধান। এই সন্ধানী পর্যবেক্ষণশীলতাই ‘চোখের বালি’-তে মনোবিশ্লেষণের জটিল শিল্পক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে।
‘চোখের বালি’ বাংলা সাহিত্যর প্রথম ‘আধুনিক উপন্যাস’। উনিশ শতকের শেষ দশকের যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এবং সমসাময়িক কালের জাতিক ও আন্তর্জাতিক সময়, সমাজ ও সংস্কৃতির অন্তরালস্থিত মানব-অস্তিত্বের সর্বগ্রাহী সমস্যাই প্রথম বাংলা সাহিত্যে ‘চোখের বালি’ উপন্যাসের মাধ্যমে শিল্পরূপ লাভ করে। বিনোদিনীর দ্বন্দ্বময় জীবনচেতনার মর্মমূলেও বিদ্যমান ছিল বাংলার অসম্পূর্ণ রেনেসাঁসের উপলব্ধিজাত অন্তর্জ্বালাময় রবীন্দ্রনাভূতি। আশা-মহেন্দ্র-বিহারি বিনোদিনীর জীবনসঙ্কট প্রথাগত সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের সঙ্গে প্রত্যাশিত সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভূত। ভিক্টোরিয় স্নিগ্ধতামণ্ডিত স্বপ্নলোক থেকে এ-উপন্যাসের মানব-মানবীরা বহু দূরবর্তী। যে ব্যক্তিসাতন্ত্র্যকামী জীবন-জিজ্ঞাসা আধুনিক মানুষের অস্তিত্বপরিচয়ের স্মারক, এ-উপন্যাসে তারই বহুমাত্রিক বিন্যাস ঘটেছে। প্রসঙ্গত বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষ’ (১৮৭৩) ও ‘কৃষ্ণকান্তের উইলে’র (১৮৭৮) সঙ্গে ‘চোখের বালি’র ঘটনাগত সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। ঘটনা আর বিষয়বস্তু যে সমার্থক নয়, উপন্যাস বিবেচনার সময় সে-সত্য আমাদের মনে রাখতে হবে। বঙ্কিমচন্দ্র যেখানে নীতিবোধ দ্বারা চালিত, রবীন্দ্রনাথ সেখানে ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ব্যক্তি, পরিবার সংস্কৃতি ও সমাজ—প্রথার দ্বন্দ্বে বিনোদিনী কিভাবে উপেক্ষিত বঞ্চিত বিকৃত ও মহৎ হয়ে বিকশিত হলো—তার স্বরূপ অঙ্কনে রবীন্দ্রনাথ অধিকতর উৎসাহী। বঙ্কিমচন্দ্র যেখানে গার্হস্থ্য রোমান্স রচনায় আগ্রহী, রবীন্দ্রনাথ সেখানে বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিত্বের জটিলতা ত্রিয়া-প্রতিক্রিয়া উদ্ঘাটনে মনোযোগী। বঙ্কিমচন্দ্র রোহিণী ও কুন্দনন্দিনীর খণ্ডজীবনের উজ্জ্বলতম মুহূর্তের বর্ণনাকে প্রাধান্য দিয়েছেন, আর রবীন্দ্রনাথ বিনোদিনীর সমগ্র জীবনের বহুবঙ্কিম ও বিস্ময়কর জটিলতার বিশ্লেষণে মনোনিবেশ করেছেন। এ উপন্যাসের ঘটনাবিন্যাস, চরিত্রায়ণ, দৃষ্টিকোণ ও পরিচর্যায় রবীন্দ্রনাথ বিংশ শতাব্দীর নতুন শিল্পরুচির মর্মমূল স্পর্শ করেছেন।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পটভূমিতে সংঘটিত ঘটনাবলি, ব্যক্তিজীবন-অভিজ্ঞতার রূপান্তর, সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী চিন্তার বিপরীতে সর্বজাতিক মানববোধে আস্থা রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ (১৯১০) উপন্যাসের মূল প্রেরণা হিসেবে ক্রিয়াশীল। বাঙালির জাতীয় চিন্তা-ধারায় গোরা নিয়ে আসে গণতন্ত্র ও মানবতন্ত্রের নতুন আলোকবর্তিকা। এই আলোকিত সম্ভাবনার পথ ধরেই বাংলা উপন্যাস বিশ্বসাহিত্যের রূপ ও রুচির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হলো। সময়, সমাজ ও জীবনের বিশাল প্রেক্ষাপট ‘গোরা’ উপন্যাসের বিষয় ও শিল্পরীতিকে নবতর তাৎপর্য দান করেছে। এ-উপন্যাসে জীবনবোধের বিপুলতা লিও তলস্তয়ের War and peace (১৮৬৫-৬৮) উপন্যাসের কথা মনে করিয়ে দেয়। জীবনার্থ সন্ধানের প্রশ্নে মীমাংসাপ্রবণ রবীন্দ্রনাথের শিল্পিসত্তা তত্ত্বাশ্রয়ী হলেও কোনও দ্বন্দ্বময় চারিত্রবৈশিষ্ট্যে রক্তাক্ত হয় নি। বরং তত্ত্বকে তিনি বিশ্বজনীন জীবনজিজ্ঞাসায় অভিব্যক্ত করেছেন। গোরা চরিত্রের অন্তর-বাহিরের দ্বন্দ্ব, রক্তক্ষরণ ও রূপান্তরের সমান্তরালে আনন্দময়ীর সর্বসংস্কারমুক্ত কল্যাণময়ী মাতৃবিগ্রহ রবীন্দ্রচৈতন্যের সমগ্রতাস্পর্শী সত্যস্বরূপকেই উন্মোচন করে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠে’র সংকীর্ণ ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী পুনর্জাগরণচিন্তার শিল্পপ্রতিবাদ হিসেবেও ‘গোরা’ নতুন বোধের দিগন্তরেখা স্পর্শ করেছে। প্রকৃতপক্ষে ‘হিন্দু ধর্ম থেকে সর্বাস্তিবাদী মানবধর্ম এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদ থেকে বিশ্বজাগতিকতাবাদ—রবীন্দ্রনাথের জীবনার্থ সন্ধানের দীর্ঘ গতিপথই ‘গোরা’ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট। রবীন্দ্রনাথের মতোই গোরার শুরু হিন্দু জাতীয়তাবাদে, সমাপ্তি বিশ্বমানবতায়। ’ ‘গোরা’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ বাঙালি ও ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে বিশ্বসংস্কৃতির শুভচেতনার সমন্বয় ঘটিয়েছেন।
বাংলা উপন্যাসের ঊর্মিমুখর বহমানতায় রবীন্দ্রনাথ পরীক্ষাপ্রবণ শিল্পসাধনার মাধ্যমে যোগ করেন আন্তর্জাতিক জীবনচেতনা ও প্রকরণ। তাঁর উপন্যাসে জীবন নবমাত্রায় তাৎপর্যপূর্ণ ও স্বতন্ত্র জিজ্ঞাসায় বিশেষিত। ক্রমপরিবর্তনশীল সমাজ ও সংস্কৃতির গতিধারা রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসে রূপায়িত হয়েছে। তাঁর জীবনবোধ ও শিল্পদৃষ্টির বৈশিষ্ট্য নিরূপণের প্রশ্নে নিম্নোক্ত সূত্রসমূহ অনুধাবনযোগ্য:
‘১. মানবজীবনের আন্তর্বৈশিষ্ট্য হলো আকাঙ্ক্ষা, আশঙ্কা, চিন্তা, অনুভূতি, আত্মসজাগতা ও অপরাপর মানুষ ও পরিস্থিতি সম্পর্কে অস্থির সচেতনতা; ২. মানুষের স্বতন্ত্র সত্তা ও তার নৈঃসঙ্গ্যবোধ ঐকান্তিক। মানুষের আত্মসত্তা-বিকাশের পথ রূঢ়, কঠোর, প্রতিবন্ধকতাময়—সে বিকাশপথে নৈঃসঙ্গ্য, একাকীত্ব তার অন্তর্শক্তি। মানুষের স্বতন্ত্র সত্তা হলো মানবজাতির সকর্মক উত্তরাধিকারী। ফলে ব্যক্তিসত্তা চেতনাময়তায়—অতীত ও বর্তমানে দ্বিখণ্ডিত। সুতরাং বর্তমান সচেতন ‘আমি’র সঙ্গে অতীতসত্তার ক্রমাগত দ্বন্দ্ব ও সমন্বয় অনিবার্য। বস্তুত এ-কারণেই মানজীবন তার ব্যক্তিসত্তা, সমকালীন বহির্জগৎ ও অতীতসত্তার পরস্পর সংঘাত ও সমন্বয়ে প্রাগ্রসর। এ-কারণেই রবীন্দ্র-অভিজ্ঞতায় জীবন হলো ব্যক্তিসত্তা ও তার নৈঃসঙ্গ্যবোধ, দ্বন্দ্ব ও বহমানতা, লোক ও লোকোত্তরের পরমার্থিক সমীকরণ। ’ সুতরাং অনিবার্যভাবেই উপন্যাসের আঙ্গিক-উদ্ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ পরিবর্তনের পথ ধরে অগ্রসর হয়েছেন। এর শিল্পশীর্ষে অবস্থান করছে ‘গোরা’ ও ‘চতুরঙ্গ’ (১৯১৬)। গোরার আত্মসন্ধান, সত্তাসন্ধান ও জাতিসত্তাসন্ধানের অন্তর্যাত্রা ও বহির্যাত্রার রূপায়ণে উনিশ শতকীয় ফর্মের মধ্যে যে গতি ও নতুনত্ব সঞ্চারিত হয়েছে, ‘চতুরঙ্গ’র প্রেক্ষাপট ও শিল্পরীতি তা থেকে স্বতন্ত্র।
কেবল জীবনদর্শনের প্রশ্নে নয়, প্রকরণগত দিক থেকেও ‘চতুরঙ্গ’ রবীন্দ্রনাথের নিরীক্ষামূলক শিল্পকর্ম। রবীন্দ্র-জীবনদর্শনের নিগূঢ় জটিল অভিপ্রায় এবং সময়, সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতার মর্মমূলস্পর্শী বিন্যাস এ-উপন্যাসকে করেছে কালাতিক্রমী। বিশ শতকের সূচনালগ্ন থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত কালপর্ব, এবং এ-সময়প্রবাহের জাতীয়-আন্তর্জাতিক সমাজচৈতন্য ও শিল্পরীতির বিবর্তন-বৈশিষ্ট্য উনিশ শতকীয় শিল্প-সমগ্রতাবোধের বিপরীত প্রান্তে অবস্থিত। মানব-অস্তিত্বের বিপন্ন-বিপর্যস্ত অনুভূতির তরঙ্গিত বেদনায় স্মৃতিময় একটি মুহূর্তের সমগ্রতা বা জীবনের অস্ত দিগন্তে দাঁড়িয়ে নীরব উপলব্ধির অন্তর্ময় সমগ্রতা ভিক্টোরীয় নান্দনিক মূল্যমান থেকে আয়ত্ত করা দুঃসাধ্য। ‘চতুরঙ্গ’র শচীশ-দামিনী-শ্রীবিলাসের সংকট, তাদের অস্তিত্ব-অভীপ্সার সাতন্ত্র্য, প্রত্যাশা ও অপ্রাপ্তির অন্তরালবর্তী রক্তিম মহাশূন্যতার মধ্যে আধুনিক জীবনচৈতন্যের সমগ্র রূপ বিধৃত।
এই একবিংশ শতাব্দীর মানবীয় সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের চরিত্র—পাত্রের অনেকাংশে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। ভাবময় হিসেবে বিবেচিত রবীন্দ্র-প্রতিভা কতটা বস্তুময় ও জীবন ঘনিষ্ঠ, এই সব উপন্যাস তার শিল্পসাক্ষ্য।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৮ ঘণ্টা, মে ৭, ২০১৫