পুবের এক বন্ধু আমাকে চিঠি লিখে বিশেষ অনুরোধ করেছিলেন বলেই দেখা করতে গিয়েছিলাম ভালোমানুষ ও বাক্যবাগীশ বুড়ো সিমন হুইলারের সঙ্গে। বন্ধুর অনুরোধে আমি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম আমার সেই বন্ধুর বন্ধু লিওনিডাস ডব্লিউ স্মাইলির সম্পর্কে।
সিমন হুইলারকে পেয়ে গেলাম অ্যাঞ্জেলের খনি-শ্রমিকদের পুরনো ক্যাম্পের এখানে-সেখানে একটি একটি করে ইট খসে পড়তে থাকা পানশালার পানকক্ষে। তিনি চুলোর পাশে বসে ঝিমুচ্ছিলেন। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম তিনি বেশ মোটাসোটা টাক-মাথার এক বুড়ো। তার প্রশান্ত চেহারায় লেগে রয়েছে মন-কাড়া নম্রতা ও সরলতা। তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং আমাকে স্বাগত জানালেন। আমি তাকে বললাম, খ্রিস্টের বাণী প্রচারক তরুণ যাজক লিওনিডাস ডব্লিউ স্মাইলি নামে এক লোকের সম্পর্কে কিছু প্রশ্নের জবাব জানতে আমার এক বন্ধু তার কাছে আমাকে পাঠিয়েছে। ছোটবেলায় আমার সেই বন্ধু তার সঙ্গ খুব কামনা করত। সে শুনেছে এক সময় এই অ্যাঞ্জেলের ক্যাম্পেই থাকতেন তিনি। আমি আরও বললাম, জনাব হুইলার যদি এই রেভারেন্ড লিওনিডাস ডব্লিউ স্মাইলি সম্পর্কে কিছু বলতে পারেন তবে আমি তার কাছে অনেক কৃতজ্ঞ ও ঋণী থেকে যাব।
সিমন হুইলার আমাকে এক কোণায় ঠেলে নিয়ে গেলেন এবং তার চেয়ার এগিয়ে দিয়ে আমাকে তাতে বসালেন। এরপর তিনি পরের অনুচ্ছেদে বর্ণিত একঘেয়ে কথার ঝাঁপি খুললেন। কক্ষণো হাসলেন না, ভুরু কচলালেন না। যেভাবে শুরু করেছিলেন—কণ্ঠস্বরের কোনও পরিবর্তন না করে সেভাবেই কথাগুলো বলে যেতে থাকলেন। সন্দেহের কোনও অবকাশই রাখলেন না তার উৎসাহে কোনও ঘাটতি রয়েছে। কিন্তু খুব উৎসাহ নিয়ে বলতে থাকা তার অফুরান কাহিনী-বর্ণনা শেষমেশ মাঠেই মারা গেল! তিনি তার কল্পিত কাহিনীকে খুব চাতুর্যের সঙ্গে যতই দারুণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এর দুই নায়ককে সবচেয়ে সেরা মেধার মানুষ বলে দাঁড় করাতে চান না কেন, আমার কাছে তা খুবই হাস্যকর ও মজার মনে হচ্ছিল। এক বিচিত্র ও অবিশ্বাস্য গল্প ফেঁদে তিনি যে মানুষটিকে এক মহান চরিত্র হিসেবে দাঁড় করাতে চাইছিলেন আমার কাছে তা একেবারেই অসম্ভব-অবাস্তব মনে হচ্ছিল। আগে যেমনটি বলছিলাম—আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম রেভারেন্ড লিওনিডাস ডব্লিউ স্মাইলি সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন কিনা এবং তার উত্তরে তিনি নিচের কথাগুলো বলেছিলেন। আমি তাকে তার মতো করে বলে যেতে দিলাম এবং একবারের জন্যও থামালাম না :
এক সময় এখানে জিম স্মাইলি নামের এক কাঠুরে থাকত। ’৪৯ সালের শীতে বা ’৫০ সালের বসন্তেও হতে পারে—ঠিক মনে করতে পারছি না। একবার মনে হচ্ছে এটা ঠিক, তো আবার মনে হচ্ছে ওটা। নিশ্চিত করে বলতে পারছি না, তবে এটুকু মনে আছে—সে যখন এই ক্যাম্পে এলো তখনও বড় নালাটি কাটা শেষ হয়নি। কিন্তু সে যা-ই হোক না কেন, যে কোনও ব্যাপারে সবসময় বাজি ধরত বলে সে ছিল এখানকার সবচেয়ে রহস্যময় মানুষ। আপনি তখন তাকে কখনও দেখলেই দেখতে পেতেন সে কারও না কারও সঙ্গে বাজি ধরছে। আর যখনই দেখত পেরে উঠছে না তখনই সে পক্ষ বদল করত। যেভাবেই হোক, বাজি ধরতে পারলেই সে বর্তে যেত। কিন্তু এটা বলতেই হয়—সে ছিল খুব ভাগ্যমান, অসাধারণ রকমের ভাগ্যমান। প্রায় সবসময়ই সে বাজিতে জিতে যেত। সব সময়ই সে বাজি ধরার জন্য তৈরি হয়ে থাকত এবং সুযোগের অপেক্ষায় থাকত।
এমন কোনও ব্যাপারই উল্লেখ করা যাবে না, যার ওপর ওই কাঠুরে বাজি ধরত না এবং এইমাত্র যা বলছিলাম, আপনি আপনার পছন্দমতো যে কোনও পক্ষ বেছে নিতে পারতেন। যদি কোনও ঘোড়দৌড় থাকত তো নির্ঘাত তাকে দারুণ উচ্ছ্বাসে মেতে উঠতে দেখতেন বা ঘোড়দৌড় শেষে তাকে ভেঙে পড়তে দেখতেন। যদি কোনও কুকুরের লড়াই থাকত তো সে সেখানে বাজি ধরত, যদি কোনও বিড়াল-দৌড় থাকত তো সেখানে সে বাজি ধরত; যদি কোনও মোরগের লড়াই থাকত তাহলে সেখানেও সে বাজি ধরত; এমনকি, কোনও বেড়ার ওপর যদি দুটি পাখি বসে থাকত তা হলেও সে বাজি ধরত—কোন পাখিটি আগে উড়ে যাবে; বা যদি কোনও ক্যাম্প-মিটিং থাকত তো সে সেখানে পারসন ওয়াকারের ওপর বাজি ধরতে নিয়মিত উপস্থিত থাকত, তার বিচারে যে ছিল সেখানকার শ্রেষ্ঠ অনুপ্রেরণাদাতা এবং সেজন্যই সে ছিল একজন ভালো মানুষ।
সে যদি কোনও লম্বা পা-ওয়ালা পোকা স্ট্র্যাডল-বাগকে কোথাও যাওয়ার জন্য চলতে শুরু করতে দেখত তবে সে আপনার সঙ্গে বাজি ধরত পোকাটি যেখানে যাচ্ছে সেখানে যেতে তার কতটুকু সময় লাগবে, এবং আপনি যদি তার সঙ্গে বাজি লাগতেন তো সে হয়ত সেই স্ট্র্যাডল-বাগের পিছু পিছু মস্কো পর্যন্তও যেতে রাজি থাকত, তবুও সে দেখে ছাড়ত পোকাটি কতদূর যায় এবং কতক্ষণ সে পথে থাকতে পারে। এখানকার অনেক ছেলেই স্মাইলিকে দেখেছে এবং তারা আপনাকে তার সম্পর্কে বলতে পারবে। আরে গেল যা! বিশ্বাস হচ্ছে না? তাদের কথার সঙ্গে আমার কথা মিলিয়ে দেখুন—কোনও পার্থক্য খুঁজে পাবেন না।
বাজি ধরার বেলায় সে কোনও ধরনের বিপজ্জনক পথ বেছে নিতেই পিছপা হতো না। একবার পারসন ওয়াকারের স্ত্রী বেশ কিছুদিন ধরে ভীষণ অসুস্থতায় ভুগছিল, এবং হাবভাবে মনে হচ্ছিল তারা তাকে সারিয়ে তুলতে পারবে বলেই মনে করছিল; কিন্তু একদিন সকালে সে এলো এবং স্মাইলি তাকে জিজ্ঞেস করল তার স্ত্রী কেমন আছে আর সে বলল, ঈশ্বরের কৃপায় তার স্ত্রী তুলনামূলকভাবে ভালো আছে, চাঙ্গা হয়ে উঠছে এবং ঈশ্বরের আশীর্বাদে আরও সেরে উঠবে এবং সে কিছু চিন্তা করতে পারার আগেই স্মাইলি বলে উঠল, ‘বেশ, আমি আড়াই ডলার বাজি ধরতে প্রস্তুত সে কোনওভাবেই সেরে উঠবে না। ’
এই স্মাইলির একটি মাদি ঘোড়া ছিল, ছেলেপেলে যেটিকে পনেরো মিনিটের ঘুড়ি বলে ডাকত। কিন্তু তা কেবলই মজা করার জন্য, কারণ আপনি তো জানেন সেটি আসলে তার চেয়েও দ্রুত ছিল এবং খুব ধীরে দৌড়ালেও আর সবসময় শ্বাসকষ্টে ভুগলেও বা অসুস্থ থাকলেও বা ক্ষয়রোগ বা সে ধরনের কিছুতে ভুগলেও এই ঘুড়ি দিয়ে সে বাজির টাকাও জিতে যেত। অন্য ঘোড়াগুলো তাকে দুই শ বা তিন শ গজ আগে রেখে দৌড় শুরু করত, এবং মাঝপথেই তাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যেত, কিন্তু সবসময়ই ঘোড়দৌড়ের শেষ প্রান্তে এসে এটি চরম উত্তেজিত এবং বেপরোয়া হয়ে উঠত, এবং তিড়িং তিড়িং করে লাফিয়ে দুই পা ফাঁক করে এবং দেহের চারপাশে পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে, কখনও শূন্যে পা চালিয়ে, কখনও বা একপাশের বেড়ার ওপর ভর রেখে এবং লাথির ঘায়ে ধুলো উড়িয়ে হৈ-হুল্লোড়ের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়ে এবং তার হাঁচি-কাশির দমক আরও বেড়ে যেত বলে নাকের ফুটো আরও বড় বড় করে ভোঁশ ভোঁশ করে দম ফেলতে ফেলতে সে সবসময়ই—আপনি তাকে তুচ্ছ ঠাওরানোর আগেই—এক গলা আগে থাকতেই বিজয়স্তম্ভে পৌঁছে যেত।
আর তার ছিল ছোট্ট একটা মদ্দা কুকুরছানা, যেটিকে দেখে আপনি হয়ত ভাববেন এক পয়সাও দাম নেই এটির, কিন্তু এটিকে চারপাশে ঘুরঘুর করতে দিন এবং তখন দেখবেন এটি ভীষণ বদমেজাজির মতো কুতকুত করে তাকাচ্ছে। এটিকে সামলানো ছিল খুবই কঠিন। সব সময় চুপিসারে কোনও কিছু নিয়ে সটকে পড়ার ধান্ধায় থাকত। কিন্তু যেই না এটির ওপর টাকার বাজি ধরা হতো ওমনি এটি অন্য কুকুর হয়ে যেত; তার নিচের চোয়াল স্টিমবোটের সামনের গলুইয়ের মতো ঠেলে বেরিয়ে আসতে শুরু করত এবং দাঁতগুলো ঠেলে বেরুত আর ভয়ঙ্কর অগ্নিকুণ্ডের মতো সেগুলো ঝাঁ-ঝাঁ করতে থাকত। একটি কুকুর হয়ত এটিকে আঁকড়ে ধরতে পারত এবং তার ওপর ভীষণ তর্জন-গর্জন করে মহা আস্ফালন জুড়ে দিতে পারত। তাকে কামড়াতে পারত আর দুই কি তিনবার এটিকে তার কাঁধের ওপর দিয়ে ছুঁড়েও দিতে পারত।
এই মদ্দা কুকুরছানাটির নাম ছিল অ্যান্ড্রিউ জ্যাকসন। সে কক্ষণো লড়াই শুরুই করত না—যতক্ষণ না তার মালিক সন্তুষ্ট হতো। তখন মনে হতো এটিকে নিয়ে আর কোনও আশা-ভরসাই নেই, এবং প্রতিপক্ষ তখন বাজির দর কেবল দ্বিগুণ দ্বিগুণ বাড়াতেই থাকত—যতক্ষণ তার ট্যাঁকে টাকা থাকত; আর তার পরেই হঠাৎ এটি সেই অন্য কুকুরটিকে তার পেছনের পায়ের অস্থিসন্ধি দিয়ে খুব চেপে ধরে মজা করত এবং চেপে ধরেই থাকত যাতে সেই কুকুরটি চিবুতে না পারে। বুঝতেই তো পারছেন—স্রেফ মজা করার জন্য চেপে ধরা। এভাবে সে ততক্ষণ পর্যন্ত চেপে ধরে থাকত যতক্ষণ না তাদের ঘিরে পাঁড় মাতালেরা ভিড় জমাত—তাতে যদি বছরখানেকও লেগে যেত তো তাই সই। স্মাইলি সব সময়ই সেই কুকুরটির ওপর বাজি ধরে জিতে যেত।
তো একদিন হলো কী, সে পিছনের পা নেই এমন একটি কুকুরকে বর্ম পরিয়ে সাজিয়ে আনল, কারণ এর পেছনের পা গোলাকার করাত দিয়ে কেটে নেয়া হয়েছিল। বাজির ব্যাপারটা যখন যথেষ্ট এগিয়ে গেছে এবং এজন্য সব টাকা-পয়সাও দেয়া হয়ে গেছে এবং সে তার পোষাপ্রাণীর খাঁচার হুড়কোটা খুলে মিনিটখানেকের ভেতরেই সে টের পেল কিভাবে তার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে এবং অন্য কুকুরটি দরজায় এসে যেভাবে তার দিকে তেড়ে এলো সে এতটাই ঘাবড়ে গেল যে কুকুরের লড়াই লাগিয়ে বাজি জেতার জন্য এরপর থেকে সে আর কোনও চেষ্টাই করত না এবং তাকে খুব খারাপভাবে এর জন্য খেসারত দিতে হয়েছিল।
কুকুরছানাটি স্মাইলির দিকে এমনভাবে তাকাল, যেন সে বলতে চাইছিল—তার হৃদয় ভেঙে খানখান হয়ে গেছে, এবং এটা তারই দোষ যেহেতু লড়ার জন্য এমন একটি কুকুরই সে আনিয়েছে যেটির পেছনের পা নেই—যা তার লড়াই করার নির্ভরতা, এবং তখন সে তার একটি অঙ্গ কেটে ফেলল আর পড়ে গিয়ে মরে গেল। খুব ভালো কুকুরছানা ছিল এই আন্ড্রিউ জ্যাকসন এবং বেঁচে থাকলে তার যে মেধা ছিল তাতে খুব ভালো নাম কামাতে পারত এবং আমি জানি তার খুব গুণ ছিল, কারণ সেই পরিস্থিতিতে সে যেভাবে লড়ত তাতে এটির গুণপনার ব্যাপারে কোনও সন্দেহেরই অবকাশ ছিল না। তার সেই শেষ লড়াইটা নিয়ে যখনই আমি ভাবি তখনই যেভাবে এটির করুণ পরিণতি হয়েছিল তা আমাকে খুব দুঃখ দেয়।
তো বেশ, সেই বছর স্মাইলির ছিল র্যাট-ট্যারিয়ার নামের বেশ কয়েকটি কুকুর, বাচ্চা মোরগ ও মদ্দা বেড়াল এবং এই ধরনের আরও অনেককিছু—যা আপনি গুনে শেষ করতে পারবেন না এবং আপনি তার জন্য এমন কিছু পাবেন না যাতে সে বাজি ধরতে পারত না। একদিন সে একটি ব্যাঙ ধরল এবং বাড়িতে নিয়ে এলো আর বলল, এটিকে সে শিক্ষা দিতে চায়। আর তাই মাস তিনেক সে আর কিছুই করল না—কেবল বাড়ির পেছনের উঠোনে এটিকে লাফানোর সবক দেয়া ছাড়া। আর সত্যি বলতে কী, সে তা শিখিয়েও ছেড়েছিল।
সে এটির পেছনে ছোট্ট একটি গুঁতা মারত আর পরক্ষণেই ব্যাঙটিকে দেখতে পেতেন হাওয়ায় উড়ছে ঠিক একটি শূন্যে ছুড়ে মারা চিনি-ময়দা দিয়ে বানানো ডো-নাট পিঠার মতো। হাওয়ায় এটি একটি ডিগবাজি খেত বা লাফটা জবরদস্ত হলে বেশ কয়েকটা ডিগবাজি খেয়ে একটি বেড়ালের মতো চার পায়ে থপ করে পড়ে বসে পড়ত ঠিকঠাকমতো। সে এটিকে লাফিয়ে উঠে মাছি ধরার এমন শিক্ষাই দিতে থাকত যে প্রতিবার লাফিয়ে উঠে একটি মাছি দেখতে পেলেই সেটিকে থপ করে ধরে ফেলতে পারত।
স্মাইলি বলত, একটি ব্যাঙের চাই কেবল একটু শিক্ষা এবং যে কোনওকিছুর মতোই সেই শিক্ষা সে বেশ ভালোভাবেই দিতে পারত আর আমি তার সে কথা বিশ্বাসও করতাম। কেন? কারণ আমি এখানে, এই মেঝেতে তাকে ড্যানিয়েল ওয়েবস্টারকে ছেড়ে দিতে দেখেছি। ড্যানিয়েল ওয়েবস্টার হচ্ছে সেই ব্যাঙটির নাম। তো আমি তাকে এই মেঝেতেই ড্যানিয়েল ওয়েবস্টারকে ছেড়ে দিয়ে গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠতে শুনেছি—‘মাছি, ড্যানিয়েল, মাছি!’ এবং আপনি তখন থাকলে চোখের পলক ফেলারও আগে দেখতে পেতেন ব্যাঙটি সোজা লাফিয়ে উঠেছে এবং খপ করে একটি মাছি সাপের মতো মুখে পুরেই শক্ত মেঝেতে থপ করে বসে পড়েছে ঠিক এক দলা শক্ত কাদার মতো, এবং উদাসীনভাবে পেছনের পা দিয়ে এমনভাবে মাথার একপাশ চুলকাচ্ছে যেন তার কোনও ধারণাই নেই—সে যা করছে তা অন্য কোনও ব্যাঙের পক্ষে করে দেখানো সম্ভব নয়।
আপনি কখনও তার মতো এমন বিনয়ী ও অকপট কোনও ব্যাঙ দেখতে পাবেন না—কারণ ঈশ্বর এইসব গুণ কেবল তাকেই দিয়েছিলেন। আর যখন একটি চমৎকার ও খাঁটি লাফ দেয়ার সময় আসত তখন এটি মরণপণ করে লাফ দিয়ে এতদূর পর্যন্ত যেতে পারত যে, তার জাতের কোনও প্রাণীর পক্ষে এক লাফে অতটা দূরত্ব অতিক্রম করা সম্ভব নয়। বুঝতেই পারছেন, তার সবচেয়ে বড় গুণটাই ছিল মরণপণ লাফ দেয়া; আর যখন সেই সময়টা আসত স্মাইলি লাল হয়ে ওঠার সুযোগটা বেশ ভালো করেই নিত এবং তার কাছে যত টাকা থাকত তার সব নিয়ে সে এটির ওপর বাজি ধরত। স্মাইলি তার এই ব্যাঙটিকে নিয়ে দারুণ গর্বিত ছিল, আর তার অমন গর্ব করার যথেষ্ট কারণও ছিল, যেহেতু কাঠুরেরা তখন ঘুরে বেড়াত এবং সব জায়গায় তাদের দেখতে পাওয়া যেত আর তারা সবাই বলত—স্মাইলি এমনই একটি ব্যাঙ ধরেছে যা তারা আগে কখনও দেখেনি।
তো বেশ, স্মাইলি এই ব্যাঙটিকে জাফরি-কাটা ছোট্ট একটি বাক্সে রাখত এবং কখনও কখনও সে এটিকে এই বাক্সে পুরে নিয়ে শহরতলীতে যেত এবং এটির ওপর বাজি ধরত। একদিন ক্যাম্পে নতুন আসা এক অচেনা কাঠুরে বাক্সটা স্মাইলির কাছে এনে বলল :
‘তোমার এই বাক্সটাতে কী ভরে রেখেছ?’
স্মাইলি কিছুটা উদাসীনভাবে বলল, ‘এটি একটি টিয়ে হতে পারত, বা হতে পারত একটি ক্যানারি গায়ক পাখিও, কিন্তু এটি স্রেফ একটি ব্যাঙ। ’
সেই কাঠুরে তখন বাক্সটি হাতে নিয়ে একবার এদিক, একবার সেদিক উল্টে-পাল্টে খুব ভালো করে তাকিয়ে দেখে বলল, ‘আরে, তাই তো দেখছি! তো এটি কী এমন মহৎ কাজে লাগে?’
‘শোনো তাহলে’—তেমন কোনও উৎসাহ না দেখিয়ে সহজ ও অসতর্কভাবে স্মাইলি বলল, ‘একটি ব্যাপারে এটি খুব ভালো, আমাকে বলতেই হচ্ছে—এই গোটা ক্যালাভেরাস এলাকায় কোনও ব্যাঙই লাফিয়ে এটিকে হারাতে পারবে না। ’
কাঠুরিয়া তখন আবারও বাক্সটা হাতে তুলে নিল এবং অনেকক্ষণ ধরে খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বাক্সটি স্মাইলির কাছে ফেরত দিয়ে খুব চিন্তা করে বলল, ‘আচ্ছা! কিন্তু আমি তো কোনও কারণ দেখতে পাচ্ছি না যে এই ব্যাঙটি অন্য ব্যাঙের চেয়ে কোনও দিক দিয়ে ভালো হতে পারে। ’
‘তোমার তা মনে হতেই পারে’—স্মাইলি বলল, ‘তুমি হয়ত ব্যাঙদের খুব ভালো বোঝ, বা হয়ত তুমি এগুলোকে বোঝই না; তোমার হয়ত অভিজ্ঞতা রয়েছে, অথবা তুমি হয়ত একেবারেই আনাড়ি। তা সে যাই হোক, আমি আমার মতটা জানালাম এবং এটি যে ক্যালাভেরাস এলাকার যে কোনও ব্যাঙকে লাফিয়ে হারিয়ে দিতে পারবে সে ব্যাপারে আমি চল্লিশ ডলার বাজি ধরতে রাজি। ’
কাঠুরে মিনিটখানেক ভাবল এবং তারপর আরও দরদমাখা গলায় অনেকটা দুঃখের সঙ্গেই বলল, ‘তা বেশ, আমি তো এখানে নতুন আর আমার কোনও ব্যাঙও নেই; কিন্তু আমার যদি কোনও ব্যাঙ থাকত তা হলে আমি ঠিকই তোমার সঙ্গে বাজি ধরতাম। ’
স্মাইল তখন বলল, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, তুমি যদি এক মিনিট আমার বাক্সটা ধরো তো আমি গিয়ে তোমার জন্য একটি ব্যাঙ ধরে আনি। ’ সেই কাঠুরে বাক্সটি তার হাতে নিল আর স্মাইলির চল্লিশ ডলারের সঙ্গে তার চল্লিশ ডলার রেখে অপেক্ষা করতে থাকল।
এভাবে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষায় থেকে নিজের মনে সে খুব ভাবল, এবং তারপর ব্যাঙটিকে বাক্স থেকে বের করল আর খুব জোরজবরদস্তি করে এটির মুখ হাঁ করাল আর একটি চা-চামচ এনে খুব ভয়ে ভয়ে ব্যাঙটির মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দিতে থাকল এবং থুতনি পর্যন্ত তা সেঁধিয়ে দিয়ে এটিকে মেঝেতে ছেড়ে দিল। এদিকে স্মাইলি জলাভূমিতে গিয়ে কাদার ভেতর অনেকক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করল এবং শেষমেশ একটি ব্যাঙ ধরে নিয়ে এলো আর কাঠুরের হাতে সেটি তুলে দিয়ে বলল :
‘এবার তুমি যদি প্রস্তুত হয়ে থাকো তাহলে এই ব্যাঙটিকে ড্যানিয়েলের পাশে রাখো, এটির সামনের পা ড্যানিয়েলের সামনের পা বরাবর রাখবে এবং আমি লাফ শুরু করার ঘোষণা-শব্দ উচ্চারণ করব। ’ এরপর সে বলল, ‘এক, দুই, তিন—লাফাও!’ এবং সঙ্গে সঙ্গে সে আর কাঠুরে ব্যাঙ দুটির পেছনে আলতো করে টুসকি মারল। নতুন ব্যাঙটি লাফ মারল, কিন্তু ড্যানিয়েল কেবল একটি খিঁচুনি দিল এবং একজন ফরাসির মতো শুধু কাঁধ কাঁপাল। আর কোনও নড়াচড়া করতে পারল না। একটি কামারের নেহাইয়ের মতো এটি শক্ত হয়ে পড়ে রইল এবং একটুও নড়তে পারল না, যেন তাকে নোঙর দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। স্মাইলি খুব অবাক হয়ে গেল এবং ভীষণ মুষড়ে পড়ল। কিন্তু আসল ব্যাপারটা সম্পর্কে কোনও ধারণাই করতে পারল না। কিছুতেই কোনও ধারণা করতে পারল না।
কাঠুরে ডলারগুলো নিয়ে নিল এবং চলে যেতে শুরু করল। দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সে তার কাঁধের ওপর দিয়ে বুড়ো আঙুল ঝাঁকিয়ে ড্যানিয়েলের দিকে দেখিয়ে মহাজ্ঞানীর মতো বলল, ‘দেখলে তো! এটি যে অন্য যে কোনও ব্যাঙের চেয়ে ভালো তার তো কোনও আলামতই দেখছি না আমি!’
স্মাইলি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকাল। ড্যানিয়েলের দিকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে থাকল। শেষমেশ বলল, ‘আমি খুব আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি জাতটার কী হয়েছে যে ব্যাঙ এমন অদ্ভুতভাবে পড়ে থাকে? নিশ্চয়ই কোনও না কোনওভাবে কিছু একটা ব্যাপার ঘটেছে যার জন্য এটিকে এমন ঢুলুঢুলু লাগছে। ’ এরপর সে ড্যানিয়েলের ঘাড়ের কাছের চামড়া ধরে তুলে বলল, ‘ধামার বেড়ালগুলোকে আর দোষ দেয়া কেন!’ এরপর সে ব্যাঙটিকে উল্টো করে ধরল এবং এটি বড় করে দুটি ঢেকুর ছাড়ল। আর তখনই স্মাইলি ব্যাপারটি দেখতে পেল, এবং সে ভীষণভাবে খেপে গেল আর সেই কাঠুরের পিছু ধাওয়া করল। কিন্তু কখনওই সে আর ওই কাঠুরেকে ধরতে পারেনি। এবং—[গল্পের এই জায়গায় এসে সিমন হুইলার শুনতে পেলেন বাইরের উঠোন থেকে কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে এবং তিনি কী চাওয়া হচ্ছে দেখার জন্য উঠে দাঁড়ালেন] চলে যেতে যেতে আমার দিকে ফিরে বললেন : ‘যেখানে আছেন ঠিক সেখানেই বসে থাকুন নতুন মানুষ, বিশ্রাম করুন, আমি এক সেকেন্ডের জন্য একটু যাচ্ছি। ’
কিন্তু, আমি মনে করি না তার চলে যাওয়ায় ভবঘুরে মজার এই জিম স্মাইলির যে চলমান কাহিনীতে ছেদ পড়ল তা পুরোটা শুনলেও রেভারেন্ড লিওনিডাস ডব্লিউ. স্মাইলির ব্যাপারে খুব একটা বেশি তথ্য জানতে পারব। তাই চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। ফিরে আসতে থাকা এই মিশুক হুইলারের সঙ্গে দরজাতেই আমার দেখা হয়ে গেল এবং তিনি আমার কোটের বোতামের ঘর ধরে থামিয়ে আবার শুরু করলেন : ‘তো বেশ, সেই বছর স্মাইলি একটি একচোখা গরু জোগাড় করেছিল, যেটির কোনও লেজ ছিল না, ছিল স্রেফ কলার মতো ছোট্ট একটি কাটা লেজ, এবং’
‘ওহ্, রাখুন তো আপনার স্মাইলি আর তার হতভাগা গরুর কথা!’ ভালো মানুষের মতো বিড়বিড় করে এ কথাটুকু বলে আমি এই বৃদ্ধ ভদ্রলোককে বিদায় সম্ভাষণ জানালাম এবং চলে এলাম।
___________________________________
মার্ক টোয়েন : মার্ক টোয়েনের প্রকৃত নাম স্যামুয়েল ল্যাঙ্গহোর্ন ক্লিমেন্স। জন্ম : নভেম্বর ৩০, ১৮৩৫, মৃত্যু: এপ্রিল ২১, ১৯১০, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। দুনিয়াজুড়ে খ্যাতিমান এই লেখকের উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে—‘দ্য অ্যাডভেঞ্জার অব টম সয়্যার’, ‘দ্য অ্যাডভেঞ্জার অব হাকেলবিরি ফিন’, ‘লাইফ অব দ্য মিসিসিপি’ ইত্যাদি।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫০ ঘণ্টা, মে ৯, ২০১৫