সিএনজি থেকে নেমে প্রায় আধভেজা হয়ে এসে কাস্টমার সার্ভিস সেন্টারে ঢুকল জয়। বাইরে তখন মেঘের বিগড়ে যাওয়া মেজাজের প্রবল দাপট।
জয় সোজা হেঁটে এসে দুই নম্বর কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়েছে। কাচের পাল্লার দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে সোজা হেঁটে সার্ভিস কাউন্টার পর্যন্ত আসলে দুই নম্বর কাউন্টারই সামনে পড়ে। দুই নম্বর কাউন্টারে ডেস্কের দিকে একেবারে ঝুঁকে পড়ে কাজ করতে থাকা মেয়েটাকে দেখে তৎক্ষনাৎ চমকে উঠল জয়। মিথিলা! চমকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই সচেতন হয়ে উঠল সে। ভেজা শরীরের রিনরিনে অনুভূতিটুকু এক ধাক্কায় উবে গেল। এক এবং তিন নম্বর কাউন্টারের অবস্থান দুই নম্বর কাউন্টারের দুই পাশে। মিথিলাকে চিনতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই দ্রুত দুই পাশের কাউন্টার দুইটার দিকে চোখ ঘোরালো জয়। দুইটা কাউন্টারই খালি এবং উপরে কাউন্টারের নম্বর ভাসা ডিজিটাল ডিসপ্লেতেই লাল রঙের ইংরেজি অক্ষরে লেখা ‘ক্লোজড’ শব্দটা নির্দিষ্ট সময় পরপর ওঠানামা করছে। অর্থাৎ, দুই নম্বর সার্ভিস কাউন্টারেই আপাতত কাজ সারতে হবে! অসম্ভব! আসন্ন অপ্রস্তুত অবস্থাটা তৎক্ষণাৎ চিন্তা করতে পেরে দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই জয় শুনল,
‘কিভাবে আপনাকে হেল্প করতে পারি, স্যার?’
দ্বিধান্বিত মুখটা কাউন্টারের দিকে ঘুরিয়ে এক নিঃশ্বাসে সে বলল, ‘আমার একটা মোবাইল হারিয়ে গেছে। সিমটা আবার তুলতে চাচ্ছি। ’
‘এজন্য স্যার, টোকেন কাউন্টার থেকে সিম রিপ্লেসমেন্টের জন্য একটা টোকেন নিতে হবে, এবং টোকেনে যে সিরিয়াল আসবে সে সিরিয়াল পর্যন্ত আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে। ’—ডেস্কের ওপর ছড়ানো জরিপের ফর্মের মতো কতগুলো কাগজে চোখ বোলানোতে ব্যস্ত থেকেই এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলল মিথিলা। একবারের জন্যও জয়ের দিকে সে চোখ তুলে তাকাল না। আশ্চর্য! কাস্টমার সার্ভিসে কাজ করতে থাকা একজন মানুষ কিভাবে সার্ভিস গ্রহণের জন্য আসা একজন কাস্টমারের সঙ্গে এরকম অসম্পূর্ণ মনোযোগ থেকে কথা বলে? পেশাগত মূল্যবোধ বলতে কি কোনও বিষয় এদের মধ্যে নেই? নাকি জয়ের জন্যই শুধু এই ব্যতিক্রম?
হয়ত ভেজা টি-শার্ট ঠিক করতে করতে বে-খেয়ালে হেঁটে আসার সময়ই মিথিলা দেখে ফেলেছিল তাকে। আর সঙ্গে সঙ্গে সেও সচেতন হয়ে গিয়েছিল। এজন্যই একবারের জন্যও সে ডেস্ক থেকে চোখ তোলে নি। আর অন্তত ন্যূনতম পেশাগত মূল্যবোধের কারণেই যোগাযোগের অসম্পূর্ণতা রেখে হলেও সে জয়ের সাথে কথা বলেছে এবং প্রয়োজনীয় তথ্যটুকু জানিয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয় চিন্তাটাই ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ধরে নিয়ে দ্রুত দু’পা চালাল জয়। দরজা পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে কাচের পাল্লা ঠেলে বাইরের দিকে গলা বাড়াল সে। হেমন্তের বেপরোয়া বৃষ্টির আঘাত বুক পেতে সহ্য করছে নিথর শহুরে রাস্তা। রাস্তার এপাশে একটাও রিকশা-সিএনজি নেই। ঠিক ওপাশে আট-দশজন লোক গুটিয়ে ফেলা একটা ফলের দোকানের ওপর টানানো একটা ত্রিপলের নিচে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে মাথা বাঁচানোর চেষ্টা করছে কোনওরকমে।
ওভারব্রিজ পর্যন্ত হেঁটে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভিজে একশেষ হওয়া ছাড়া আর কোনও পথ দেখল না জয়। এটুকু জায়গা ভিজে যাওয়ার মতো ইচ্ছাও আসলো না ভেতর থেকে। কে জানে, অবচেতনে উঁকি দিতে থাকা ক্রমাগত মানুষকে জানার নেশাটুকুই হয়ত নিয়ন্ত্রণ করে ফেলল তাকে।
ফিরে এসে টোকেন কাউন্টার থেকে সিম রিপ্লেসমেন্টের জন্য একটা টোকেন নিল সে। টোকেনে সিরিয়াল নম্বর আসলো ১৫১। ওয়েটিং চেয়ারে বসার আগে কাউন্টারের ডিসপ্লের দিকে তাকিয়ে দেখল সে। ১৩৪ নম্বর সিরিয়াল চলছে। বসতে হবে আরও অনেকক্ষণ। ওয়েটিং চেয়ারের বিপরীত দিকের দেয়াল ঘেঁষা ফ্ল্যাট টিভিতে ঘুরেফিরে তিন-চারটা কর্পোরেট বিজ্ঞাপনই দেখানো হচ্ছে । এরমাঝে একটা বিজ্ঞাপন আবার জয়ের নিজের বানানো। নব্বই সেকেন্ডের একটা বিজ্ঞাপন চিত্র। গ্রামের সহজ-সরল জীবনধারায়ও কিভাবে এই নির্দিষ্ট কোম্পানির টেলিকম সার্ভিস অপরিহার্য হয়ে উঠেছে তারই মোটিভেশনাল দৃশ্যকল্প। একটু পরপরই নিজের বানানো বিজ্ঞাপন চিত্রটা দেখে অস্বস্তিতে দুমড়ে যাওয়ার অবস্থা হলো তার।
একে তো বৃষ্টির দিন, তাও আবার সার্ভিস সেন্টারের পুরোটাই এয়ার কন্ডিশন্ড। এরমাঝেও পুরো শরীরে ঘেমে ওঠার একটা অনুভূতি হলো জয়ের। সৃজনশীল মানুষদের এই একটা সমস্যা—নিজের কষ্টের সৃষ্টিগুলোকে একসময় সস্তা এবং অসম্পূর্ণ মনে হয়। নিজের চোখের সামনে বারবার চলতে থাকা নিজের বানানো বিজ্ঞাপনচিত্রটাকে স্রেফ লোক ঠকানো একটা কাজ বলে মনে হতে লাগল জয়ের কাছে।
জয়ের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, এরকম হয়। পড়াশোনা শেষ করা টগবগে তরুণদের একদল প্রথমদিকে ব্যাপক মাত্রায় সমাজসচেতন থাকে। বেকার অবস্থায় সন্ধ্যার পর সন্ধ্যা, রাতের পর রাত শোষণমূলক কর্পোরেট পলিসির সমালোচনা আর সরকারি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনা নিয়ে তর্ক করতে করতে মুখে ফেনা তোলে। দিনে দিনে সিগারেটের ব্র্যান্ড বেনসন থেকে ডারবিতে নামে। চায়ের টঙে বাকির খাতা ভারী হতে থাকে। ক্রমান্বয়ে এদেরই অনেকে একসময় সরকারি চাকরির জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে, আর একটা কর্পোরেট কাজ তো একসাথে ‘রথও দেখলাম, কলাও বেচলাম’-এর মতো। বাস্তবতার এই রূঢ়তা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে কি?
আত্মসমর্থনমূলক চিন্তাটুকু করে শেষ করার আগেই দুই নম্বর কাউন্টার থেকে মিষ্টি নারীকণ্ঠ ভেসে আসে, ‘সিরিয়াল নাম্বার একশো একান্ন’...
দুই নম্বর কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়াল জয়। হারানো সিমের নম্বরটা জানতে চেয়ে ল্যাপটপে তথ্যগুলো চেক করে দেখতে দেখতে মৃদু হেসে মিথিলা বলে, ‘খুব অ্যামবিশাস একজন চোর মনে হচ্ছে! এতবড় একজন সেলিব্রেটির মোবাইল চুরি করা অনেক বড় অ্যামবিশানের ব্যাপার!’
‘মোবাইলটা চুরি হয় নি। হারিয়ে গেছে। আর আমি মোটেও সেলিব্রেটি না। “সেলিব্রেটি” শব্দটাতে আমার মাথা ধরে। ’—মানিব্যাগ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র আর ছবিটা বের করে দিয়ে বলে জয়।
‘ওহ, সরি! শব্দটা ‘লিজেন্ড’ হবে। এই ফর্মটা পূরণ করতে হবে। ’—ফর্মটা জয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে মিথিলা। শেষ কথাগুলো উৎসাহমূলক নাকি বিদ্রূপাত্মক—মিথিলার মুখ দেখে কিছুই বুঝতে পারল না জয়। গলার স্বরে দুটোকেই সম্ভাবনাময় বলে মনে হলো তার কাছে।
মেয়েদের মধ্যে অনেকেই আছে যারা বিপরীত লিঙ্গের মানুষদের দুর্বলতা বুঝে নিয়ে সবসময় উল্টো কাজগুলো করে—নিজেদের প্রতি তাদের আকৃষ্ট করে রাখার জন্য। মিথিলা যে এখনও এদেরই অন্তর্ভুক্ত—এ তিনবছরের আকাশ-পাতাল পরিবর্তনের কারণে এতক্ষণ সেটা বুঝতেই চায় নি জয়। ব্যাপারটা বুঝে ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই ভেজা শরীরে সার্ভিস সেন্টারে ঢোকার পরের পরিস্থিতিটুকুর ব্যাখ্যা পেয়ে গেল সে।
ফর্মটা পূরণ করে সিম রিপ্লেসমেন্টে নির্ধারিত টাকাটা দিল জয়। এরইমাঝে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি রেখে মূল পরিচয়পত্রটা জয়ের কাছে ফিরিয়ে দিল মিথিলা। সাথে ফর্মটার একটা কার্বন কপি, মানি রিসিপ্ট আর নতুন সিম।
‘আর বলবেন না, টানা আট ঘণ্টা বসে থাকতে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসে। আপনারা কত জায়গায় ঘুরেন, কত মানুষের সাথে মেশেন। মজার লাইফ!’—বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মিথিলা।
‘আজকের শিফ্ট কয়টা পর্যন্ত?’—মোটামুটি বিদায় নেওয়ার প্রস্তুতি হিসাবে একটা কিছু কথা জুড়ে জয়।
‘পাঁচটা পর্যন্ত। আ...রো...ও দ...শ মিনিট! শেষের দিকের সময়টুকু এত বিরক্তিকর লাগে! উফফ!’
দীর্ঘ বিরতির পরে ঘনিষ্ঠজনদের সাথে দেখা হলে মানুষ বিভিন্নভাবে একজন আরেকজনের পরিবর্তনটুকু জানতে চেষ্টা করে। এটা সহজাত। নিজের মানসিক অবস্থার সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে জয় বলে,
‘আচ্ছা, বৃষ্টি থেমেছে। আমি ওভারব্রিজের কাছে অপেক্ষা করছি। ’
‘না, না। অপেক্ষা করতে হবে না। লোকজন ডিস্টার্ব করবে তো আপনাকে!’
‘এখানে কেউ ডিস্টার্ব করে নি। ওখানেও করবে না। আমাকে কেউ চেনে না। ’—নিজেকে নিজেই কটাক্ষ করার সুরে কথাগুলো বলে বেরিয়ে আসে জয়।
বৃষ্টি শেষে ওভারব্রিজের কাছের ফুটপাতের দোকানগুলো আবার বসতে শুরু করেছে। কয়েকটা ফলের দোকান। কতগুলো কাপড়ের দোকান। ভাজা ছোলা-বাদামের ভ্যান। জুতা সেলাইয়ের মুচি। একটা ভাসমান চা-সিগারেটের দোকান। কাছেই রাস্তার ঢালে আধডোবা হয়ে কাত হয়ে পড়ে থাকা একটা রিকশা। ফুটপাত ঘেঁষা ময়লা পানির স্রোত। পুরো ঢাকা শহরের মিলিত প্রশান্ত দীর্ঘশ্বাস। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে সবকিছুকে আবার নতুন করে দেখার চেষ্টা করে জয়। হঠাৎ করে একটা ছন্দপতন ঘটার পরে কী করে আবার সবকিছু শুরু হয়। স্বাভাবিকভাবে আগের উদ্যম নিয়ে সবকিছু শুরু করা যাচ্ছে কি? না, যাচ্ছে না। অনিচ্ছাকৃত বিরতিটার পর নতুনভাবে সবকিছু শুরু করতে গিয়ে সবগুলো কাজেই কেমন যেন একটা গুমোট ধরা ক্লান্তি আর দায়সারা ভাব। কাজগুলো করে বাঁচতে হবে তাই সবাই করছে। কাজগুলোর পেছনে ক্লান্তিকর দায়বদ্ধতা ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পায় না জয়।
দূর থেকে হালকা বেগুনি রঙের টপটা দেখে মিথিলাকে চেনা যায়। রোগা পা দুইটার শৈল্পিক পদক্ষেপে এগিয়ে আসে সে। আকাশ এখনও মেঘলা থাকায় তার গায়ে জড়ানো বেগুনি রঙটার আলাদা কোনও তাৎপর্য ফুটে ওঠে না। সকালে রোদ ছিল, তখন হয়ত রঙটার আলাদা দ্যোতনাও ছিল। এখন রোদ নেই, রঙটা ফিকে হয়ে এসেছে। মিথিলার চোখে-মুখেও ক্লান্তির ছাপ।
‘চা খাবেন?’—ভালোমতো কাছে আসার আগেই কেমন যেন অপ্রস্তুতের মতো বলে ওঠে মিথিলা।
নিজের পরিচিত পরিবেশে অনেক কঠিন পরিস্থিতিকেও সহজে সামলে চলা যায়। এতক্ষণ নিজের কাজের ভেতরে থাকার কারণেই হয়ত জয়ের সামনে মিথিলার এই অপ্রস্তুত ভাবটা বেরিয়ে আসে নি। এখন এসেছে।
‘হ্যাঁ, খাব। চলো, ওইদিকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাই। ’—শান্ত গলায় বলল জয়।
রাস্তার পাশের ভাসমান চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে চা খায় দুজনে। রাস্তায় যানবাহনগুলোর ক্যাকাফোনি বাড়ে, আশেপাশে মানুষের ভিড় আর হট্টগোল। নিচের দিকে ফাটল ধরা কাচের কাপটাতে কয়েকটা নিঃশব্দ চুমুক দেওয়ার পর স্থির গলায় জয় বলে, ‘আমি জানতাম না, তুমি এখানে কাজ করো। ’
নিচের দিকে তাকিয়ে বলতে গেলে গুনে গুনে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিল মিথিলা। নিচের দিকে তাকিয়েই সে বলে, ‘জানলে?’ সিমের কাগজপত্র ভরতি খামটা যে হাতে ছিলো সে হাতটা দিয়ে কোমরে ধরে দাঁড়িয়ে সহজ হওয়ার চেষ্টা করে জয়,
‘আসলে আমার সিম তোলাটা জরুরি ছিল। আর এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম, তাই’...
‘আমি আছি জানলে আপনি কখনওই আসতেন না, এই তো?’—ভ্রু জোড়ার মাঝখানের দূরত্ব কম এবং ভ্রুসন্ধির ঠিক মাঝখানে ছোট্ট বেগুনি টিপ। নিচের দিকে তাকিয়ে থাকায় জয়ের কাছে কাপের বেষ্টনির বাইরের মিথিলার মুখমণ্ডলের এই অংশকে পৃথিবীর সবচেয়ে স্নিগ্ধ ও সমৃদ্ধ শিল্পকর্ম বলে মনে হয়। কথার খেই হারিয়ে ফেলে জয়,
‘বিয়ে করছো কবে?’
‘ওমা! আপনি জানেন না, আমার বিয়ে হয়ে গেছে?’—পরম সত্য বলার মতো করে চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে বলে মিথিলা। নিজের উল্টো আচরণরীতিতে আবার ফিরে গেছে সে। জয় বুঝতে পেরে মনে মনে হেসে ওঠে। কিন্তু চোখেমুখে প্রকাশ না করে বলে, ‘তুমি যে এখনও বিয়ে করো নি, সেটা তো ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে!’
চোখ দুটো ছোট করে অবিশ্বাস প্রকাশ করে মিথিলা, ‘একটু পরই ও আসছে । ওর সঙ্গে আপনাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। ’ আর হাসি চেপে রাখতে পারে না জয় । হু হু করে হাসতে হাসতে চায়ের বিলটা আর কাপটা ফেরত দিয়ে বলে,
‘চলো, সামনে আগাই। ’
‘আপনি আমাকে নিয়ে মজা করছেন এখন?’
‘না! অবশ্যই না! তোমাকে নিয়ে মজা করব কেন? চলো, সামনে আগাই। জায়গাটা খালি করে দেই। ’
কোনওমতে বাইরের হাসি থামায় জয়। ভেতরে ভেতরে সঙ্গীতের রেশের মতো হাসির রেশ তরঙ্গায়িত হতেই থাকে। ইন্টারনেটে সাবেক প্রেমিক-প্রেমিকার খোঁজ-খবর সবাই রাখতে চায়। সরাসরি যোগাযোগ না থাকলেও বিয়ে সম্পর্কিত খবরাখবর এমনিতেই পাওয়া যায়। আর মেয়েরা তো সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে স্বামীর সঙ্গে অন্তত একটা যুগল ছবি হলেও আপলোড করবে। সে স্বামী সিনেমার হিরো বা রামছাগল, সমাজকর্মী বা চাউলের আড়ত্দার যে-ই হোক। আর এরকম উল্টো আচরণের মেয়েরা এ কাজটা আরও বেশি করে দুটো উদ্দেশ্যে—স্বামীকে দেখানোর জন্য, দেখ, তোমাকে নিয়ে আমি কত্ত সুখি! আর সাবেক প্রেমিক বা প্রেমিকদের দেখানোর জন্য, দেখ, তোমাকে ছাড়া আমি কত্ত সুখি! প্রকৃতপক্ষে সুখি হোক বা না হোক।
মুখ ভরে আবার হাসি বেরিয়ে আসার মুহূর্তেই ঘুরে গিয়ে ওভারব্রিজের মোড় থেকে ফুটপাতে উঠে যায় জয়। পেছনে পেছনে আসে মিথিলা।
‘কী করে আপনি এত কনফিডেন্টলি বললেন, আমি এখনও বিয়ে করি নি? আমাদের বিয়ের প্রায় চারমাস হতে চলল!'’
‘আরে, এটা তো খুবই সিম্পল হিসাব। একজন ম্যারেড উইমেন তার এক্স-বয়ফ্রেন্ডের সাথে তার হাজব্যান্ডকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একসাথে চা খাবে আর এতক্ষণ ধরে গল্প করবে—এটা কোনও লজিক হলো!’
মিথিলা চুপসে যায়। সত্যি হলে বেশ জটিল এবং ফালতু একটা ব্যাপার হতো। বাচ্চাদের মতো দুই দাঁতের পাটি এক করে হেসে সে বোঝাতে চায়, আসলে সে ইচ্ছা করেই জয়ের সঙ্গে এতক্ষণ মজা করেছে। এরপর সাথে সাথে সে প্রসঙ্গ পালটে ফেলে,
‘তো, আপনার সিনেমা কবে দেখার সৌভাগ্য হবে?’
‘অতই যদি সহজ হতো, তাহলে তো রহিম-করিম সবাই অন্তত নিজের লাইফ নিয়ে একটা করে সিনেমা বানিয়ে ফেলত!’
বিয়ের প্রসঙ্গে ভান করে ধরা খাওয়ার পর থেকে মিথিলার মধ্যে হঠাৎ করেই এক রকমের তাড়া চলে এসেছে। ঘন ঘন রাস্তায় বাসের দিকে তাকাচ্ছে এবং এরইমাঝে একবার ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোন বের করে সময়ও দেখে নিয়েছে। কিছু একটা ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক গলায় হঠাৎ অরেকটা বিচ্ছিন্ন প্রশ্ন করে সে,
‘সিগারেট খান না?’
‘হ্যাঁ, খাই তো!’—জয় সহজ জবাব দেয়।
‘দেখে অবশ্য তা মনে হয় না। ’—পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে আপাদমস্তক জয়ের ওপর চোখ বুলিয়ে গলার স্বর টেনে টেনে বলে মিথিলা।
‘মানে! কী মনে হয়?’—রোজ এতগুলো করে সিগারেট খায় সে। চেহারায় কি এতটুকুও ছাপ পড়ে নি? খুবই অবাক হয় জয়।
‘মনে হয়, খালি সিগারেটই না। আরও অন্যকিছুও খান... এই ধরেন, গাঁজা-টাজা!’
হাসতে হাসতে এবার একেবারেই লুটিয়ে পড়ার অবস্থা হয় জয়ের।
‘না, ওরকমের অন্যকিছু খাই না আমি। ’
‘আমাকে বাসে উঠতে হবে!’—হাসির রেশটা আর বেশিক্ষণ রাখতে দেয় না মিথিলা। ওভারব্রিজের মোড়ে এসে থামা মিরপুরের দিকের একটা বাসের উদ্দেশ্যে প্রায় ছুটে আগায় সে,
‘চলে যাচ্ছি, ভালো থাকবেন। ’
‘হ্যাঁ, অবশ্যই!’...
জয়ের কথাটা শেষ হতে না হতেই দ্রুত ভিড় ঠেলে বাসের ভেতর হারিয়ে যায় মিথিলা। মিথিলা চলে যাচ্ছে, ব্যাপারটা জয় ভালো করে বুঝে ওঠার আগেই পেছনে লাইন ধরা এক সারি বাস আর লেগুনার আড়ালে হারিয়ে যেতে থাকে বাসটা।
দূর রাস্তার দিকে তাকিয়ে বুক কাঁপিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জয়। তিন বছর নিতান্ত কম সময় নয়। এ দীর্ঘ সময়েও তেমন কোনও পরিবর্তনই আসেনি মেয়েটার মধ্যে। আগের সময়গুলোর কথা মনে করতে গিয়ে বুকের ভেতর পাখির ডানা ঝাপটানো টের পায় জয়। ভালোমতো চেষ্টা করলে হয়ত রিলেশনটাকে ঠিকঠাক করা যাবে আবার। কিন্তু অপ্রত্যাশিত বৃষ্টির শেষে আবার নতুন করে শুরু করতে যাওয়া কাজগুলোর মতোই যদি ক্লান্তিকর আর দায়সারা হয়ে ওঠে সবকিছু? না, এই ক্লান্তি আর দায়সারা ভাবটাকেও দূর করা যাবে। পরক্ষণেই আবার মনে হয়, না, এত সময় কোথায় হাতে? শহুরে যান্ত্রিক বাস্তবতা ভালোবাসার জন্য জমা রাখা টুকরো টুকরো সময়গুলোকে লিটমাস পেপারের মতো চুষে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাছাড়া, দীর্ঘসময়ের বিরতি, দীর্ঘসময়ের নতুন নতুন অভ্যাস!
আচ্ছা, আমি তোমাকে খুব মিস করি! ‘মিস’ কথাটার সাথে অভ্যস্ত হওয়ার আগে কী বলত মানুষ? ‘তোমার কথা খুব মনে পড়ে’, ‘তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করে’, ‘তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করে’—নাহ! কোনও কিছুতেই ‘মিস’ শব্দটার সমান গভীরতা খুঁজে পায় না জয়। দীর্ঘদিনের অনভ্যাসে পুরনো অনেক আবেগের গভীরতা কমে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
একেবারে মাথা উল্টে আকাশের দিকে তাকায় জয়। ধীরে ধীরে আবারও ভারী হচ্ছে আকাশটা। আবারও বৃষ্টি নামবে। কারও আবশ্যিক কাজগুলোতে আবারও অপ্রত্যাশিত বিরতি। একটানা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা দুটোয় ব্যথা ধরে গেছে। দ্বিতীয়বার বৃষ্টি নামার আগেই কোথাও একটু বসা দরকার।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৮ ঘণ্টা, মে ৯, ২০১৫