ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

কমলা দাসের একগুচ্ছ কবিতা | ভাষান্তর: রায়হান রাইন

অনুবাদ কবিতা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫৭ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০১৫
কমলা দাসের একগুচ্ছ কবিতা | ভাষান্তর: রায়হান রাইন

কমলা দাস (১৯৩৪—২০০৯ খ্রি.): জন্ম ভারতের দক্ষিণ মালাবারে। থাকতেন মুম্বাইয়ে।

পিতার ওয়ালফোর্ড ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির চাকুরিসূত্রে শৈশবে ছিলেন কলকাতায়। মালয়ালম ভাষার দৈনিক মাথুরাভূমির ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। মাধবীকুট্টি ছদ্মনামে লিখতেন। লিখেছেন কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস ও আত্মজীবনী। লিখতেন মলয়ালম ও ইংরেজি ভাষায়। এই দু’ভাষাতে তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে আছে—কুহকিনী (১৯৬৪), কলকাতার গ্রীষ্মকাল (১৯৬৫), বংশধর  (১৯৬৭), পুরনো খেলাঘর ও অন্যান্য কবিতা (১৯৭৩), কেবল হৃদয় জানে কী করে গান গাইতে হয় (১৯৯৬) ইত্যাদি। ছোটগল্পের সংকলনের মধ্যে আছে পতিতা পদ্মাবতী ও অন্যান্য গল্প (১৯৯২)। তাঁর উপন্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম বাসনার বর্ণমালা (১৯৭৭) এবং আত্মজীবনী আমার কাহিনী (১৯৭৬)। কাব্যগ্রন্থ কুহকিনী’র জন্য পেয়েছিলেন এশীয় কবিতা পুরস্কার, কলকাতার গ্রীষ্মকাল কাব্যগ্রন্থের জন্য পান কেন্ট পুরস্কার, মলয়ালম ভাষায় লেখা ছোটগল্প সংকলন শৈত্য’র জন্য পেয়েছিলেন কেরালা সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার।


আমার দাদীমার বাড়ি
___________________________________

      একটি বাড়ি আছে এখন অনেক দূরে যেখানে একদা
      আমি ভালোবাসা পেয়েছিলাম.... সেই নারী মারা গেলেন,
      বাড়িটি নিঃশব্দের দখলে গেল, সাপ ঘুরে বেড়াত
      বইপুস্তকের ভেতর যেগুলো পড়ার উপযুক্ত বয়স তখন
      আমার ছিল না, আর রক্ত আমার চাঁদের মতো হিম হয়ে গেল।
      কত না বার সেখানে যাবার কথা
      ভাবি, জানালাগুলোর অন্ধ চোখের ভেতর দিয়ে উঁকি দেব বলে
      কিংবা কেবল শুনব জমে যাওয়া বাতাসের স্বর,
      কিংবা আদিম হতাশায় তুলে নেব একমুঠো আঁধার
      এখানে নিয়ে আসতে যা আমার শোবার ঘরের
      দরজার পেছনে শুয়ে থাকবে নিমগ্ন
      কুকুরের মতো... তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না, প্রিয়,
      পারবে কি যে, আমি ওই রকম একটি বাড়িতে থাকতাম এবং
      গর্বিত ছিলাম, পেয়েছিলাম ভালোবাসা... যে-আমি
      হারিয়ে ফেলেছি পথ এবং অপরিচিতের দরজায় এখন
      ভিক্ষা চাই ভালোবাসা, অন্তত অল্পকিছুর বিনিময়ে হলেও?

(My Grandmother’s House: Summer in Calcutta)


শীতকাল 
___________________________________

      ছিল নতুন বৃষ্টি আর লতাগুল্মের
      নরোম অঙ্কুরের গন্ধ এবং তার উষ্ণতাই ছিল
      শিকড় হাতড়াতে থাকা মাটির উষ্ণতা... এমন কি এই আমার
      আত্মা, ভাবি, অবশ্যই সে-ও তার শিকড় ছড়ায় অন্য কোনওখানে
      আর, আমি তার শরীরকে সোহাগ করেছিলাম কোনও লজ্জা না পেয়ে,
      শীতের সন্ধ্যাগুলোতে যখন হিম বাতাস
      চাপা হাসির শব্দ করছিল জানালার শাদা শার্সির কাচে।

(Winter: Summer in Calcutta)


উদ্ভট সব সৃষ্টি
___________________________________

      কথা বলে সে, রোদে-পোড়া গাল
      আমার দিকে ঘুরিয়ে, তার মুখ, এক তিমির
      গিরিখাদ, যেখানে অসমান দাঁতের
      শাদা রেখা চিকচিক করে, তার ডান হাত
      আমার হাঁটুতে, আমাদের মন যখন
      ভালোবাসার দিকে দৌড়যাত্রার জন্য প্রস্তুত;
      কিন্তু, তারা কেবলি ঘুরে বেড়ায় বাসনার
      নর্দমার ওপর...। ক্ষীপ্র আঙুলের
      এই লোকটি কি অন্য কোনওকিছুকেই
      এতটা জীবন্ত মুক্ত করতে পারে না
      ত্বকের অলস ক্ষুধাগুলো ছাড়া? কে সহায়
      হতে পারে এই আমাদের যারা দীর্ঘকাল
      বেঁচে থেকেও ব্যর্থ হয়েছি প্রেমে? হৃদয়,
      এক খালি পাত্র, দীর্ঘ সময় ধরে
      অপেক্ষমান, নিজেকে ভরিয়ে তোলে
      নিঃশব্দের কুণ্ডলীকৃত সাপগুলোকে দিয়ে..।
      উদ্ভট এক সৃষ্টি আমি। কেবল আমার
      মুখটাকে বাঁচাতে, সময়ে সময়ে, আমি
      জাহির করি, এক চূড়ান্ত, বর্ণশোভিত কামনা।

(The Freaks: Summer in Calcutta)


দেখার আয়না
___________________________________

      তোমাকে ভালোবাসবে এমন একটা লোক পাওয়া খুব সহজ
      কেবল সৎ থাকো একজন নারী হিসেবে তোমার
      চাওয়ার ব্যাপারে, তাকে সঙ্গে নিয়ে নগ্ন দাঁড়াও আয়নার সামনে
      যাতে সে নিজেকে দেখতে পায় অপেক্ষাকৃত শক্তিমান হিসেবে
      এবং তা বিশ্বাস করতে পারে, আর তোমাকে যেন দেখায় অনেক বেশি
      কোমল, তরুণতর, রমণীয়... প্রশংসার
      ব্যাপারটা মাথায় রাখো। তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নিখুঁতত্বের
      কথাটা উল্লেখ করো, শাওয়ারের নিচে তার চোখজোড়া যে
      লাল হয়ে যাচ্ছে, বাথরুমের মেঝেতে তার লাজুক হাঁটা,
      তোয়ালে পড়ে যাওয়া, আর ঝাঁকানো ভঙ্গিতে
      তার প্রস্রাব করা। খুঁটিনাটি সব ভালোলাগার অনুষঙ্গ
      যা তাকে বানিয়ে তোলে পুরুষ আর তোমার একমাত্র মানুষ।
      উপহার দাও সবকিছু, দাও তাকে যা তোমাকে নারী বানায়, দীর্ঘ
      চুলের ঘ্রাণ, স্তনের মাঝে থাকা ঘামের মুখোশ,
      রজঃস্রাবের উষ্ণ আঘাত, আর তোমার অন্তহীন
      নারীর সব ক্ষুধাগুলো। আর হ্যাঁ, ভালোবাসার জন্য
      একটা লোক পাওয়া খুব সোজা, তবে পরে
      মুখোমুখি হওয়া লাগতে তাকে ছেড়ে থাকার ব্যাপারটির।
      যখন তুমি ঘুরে বেড়াচ্ছো, যাপন করছো
      এক জীবনহীন বাঁচা, অপরিচিত মানুষের সঙ্গে
      দেখা হচ্ছে, চোখগুলো তোমার ছেড়ে দিয়েছে অন্বেষণ,
      তোমার কান যা কেবল শোনে তোমার নাম ধরে তার শেষবারের ডাক
      আর তোমার শরীর তার স্পর্শে যা ছিল দীপ্তিমান
      ঘষামাজা পিত্তলের মতো, এখন যা নোংরা এবং পরিত্যক্ত।

(The Looking Glass: The Descendants)


শুঁয়াপোকা
___________________________________

      সূর্যাস্তের সময়, নদীতীরে, কৃষ্ণ শেষবারের মতো
      মিলিত হলেন এবং চলে গেলেন...
      ওই রাতে পতির আলিঙ্গনের ভেতর, রাধা এতটাই
      নির্জীব ছিলেন যে কৃষ্ণ তাকে জিগ্যেস করলেন, ঘটনা কী,
      আমার চুম্বনে কি মনখারাপ হয় তোমার, প্রিয়? রাধা উত্তর করলেন,
      না, একদম না, আমি আসলে ভাবছিলাম একটা মৃতদেহের
      কেমন লাগে যখন তাকে শুঁয়াপোকা কামড়ায়?

(The Maggots: The Descendants)


পাথর যুগ
___________________________________

      অনুরাগ-অন্ধ স্বামী, আমার মনের ভেতর প্রাচীন দখলদার,
      বুড়ো নাদুস-নুদুস মাকড়সা, বুনে চলেছ বিভ্রান্তির জাল,
      দয়ার্দ্র হও। আমাকে রূপান্তরিত করো তুমি পাথরের পাখিতে,
      গ্রানাইটের এক ঘুঘু, শ্রীহীন করে তোলো আমার চারপাশ,
      আর পড়ো যখন, আমার দাগপড়া মুখে আঘাত করে বসো
      অন্যমনস্কভাবে। চেঁচিয়ে কথা বলে ভোর হবার আগেই তুমি
      ভেঙে গুঁড়িয়ে দাও আমার ঘুম। আমার স্বপ্ন দেখতে থাকা চোখে
      ঢুকিয়ে দাও আঙুল। আর হ্যাঁ, দিবাস্বপ্নের ভেতর,
      শক্তিমান পুরুষেরা ছায়া ফেলে তাদের, শাদা সূর্যের মতো
      মিশে যায় আমার দ্রাবিড় রক্তের ভেতর, স্রোতগুলোকে গোপনে
      বইয়ে দেয় পবিত্র শহরগুলোর নিচ দিয়ে। তুমি যখন ছেড়ে যাও,
      আমি আমার ভাঙাচোরা নীল গাড়িটাকে চালাই আরও নীল সমুদ্রের
      ধার দিয়ে। অন্যের ঘরের দরজায় করাঘাত করতে আমি এলোমেলো
      চল্লিশ কদম দৌড়াই। পড়শীরা দেখে, যদিও দরজার ছিদ্রপথ দিয়ে,
      তারা আমাকে বৃষ্টির মতো আসতে
      আর যেতে দেখে। আমাকে জিগ্যেস করো, সকলে, জিগ্যেস করো কী
      দেখতে পায় সে আমার ভেতর, জিগ্যেস করো কেন তাকে ডাকা হয় সিংহ,
      মুক্তমনা, আমাকে জিগ্যেস করো কেন তার হাত ফণা তোলা সাপের
      মতো দোলে আমার জংঘা আঁকড়ে ধরার আগে। জিগ্যেস করো কেন
      একটা পতিত, বিশাল গাছের মতো, সে ধপাস করে পড়ে আমার স্তনের ওপর,
      আর ঘুমায়। জিগ্যেস করো আমাকে, জীবন কেন এতো ছোট, আর ভালোবাসা স্বল্পায়ু
      তারও চেয়ে, জিগ্যেস করো পরমানন্দ কী জিনিস আর কী মূল্য দিতে হয় তার জন্য..।

(The Stone Age: The Old Playhouse and Other Poems)


বৃষ্টি
___________________________________

      আমরা খুব ব্যতিব্যস্ত হয়ে ছেড়ে গেলাম সেই পুরানা
      জবুথবু বাড়িটি যখন আমার কুকুরটি সেখানে মারা গেল,
      তাকে সমাধিস্ত করে, দুবার মাত্র
      গোলাপ ফোটানো গাছটিকে শিকড়শুদ্ধ
      উপড়ে এবং সেটাকে আমাদের বইপুস্তক,
      জামাকাপড় আর চেয়ারগুলোর সঙ্গে গাড়িতে তুলে নিয়ে।
      আমরা এখন একটা নতুন বাড়িতে থাকি,
      এবং, ছাদ দিয়ে জল চুইয়ে পড়ে না, কিন্তু, যখন
      বৃষ্টি হয় এখানে, আমি দেখি সেই শূন্য বাড়িটি
      ভিজে যাচ্ছে খুব, আমি শুনি বৃষ্টি পড়ছে
      যেখানে এখন শুয়ে আছে আমার কুকুর ছানাটি,
      একা..

(The Rain: Only The Soul Knows How to Sing)

___________________________________

আরও পড়তে পারেন
___________________________________

**মঈনুস সুলতানের অনুবাদে সিমিন বেহবাহানির কবিতা

** সৈয়দ তারিকের অনুবাদে
হাইনরিশ হাইনেনের কবিতা

** হায়াৎ মামুদের অনুবাদে ফেদেরিকো গার্থিয়া লোরকার কবিতা

** জুয়েল মাজহারের অনুবাদে মাহমুদ দারবিশের কবিতা

** বর্ণালী সাহার অনুবাদে পাবলো নেরুদার কবিতা

** সৈয়দ তারিকের অনুবাদে বরিস পাস্তেরনাকের কবিতা



বাংলাদেশ সময়: ১২৫৮ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।