ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

নজরুলের কারাবাস ও অনশন ধর্মঘট | মাশহুদা আখতার

বিশেষ রচনা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫২ ঘণ্টা, মে ২৭, ২০১৫
নজরুলের কারাবাস ও অনশন ধর্মঘট | মাশহুদা আখতার

অনেক সময় চিন্তাবিদ, দার্শনিক কিংবা মহান কবিদের ক্ষমতাধর শাসকগোষ্ঠী, রাজা বা শোষকদের নিষ্ঠুর বৈরীতা বা রক্তচক্ষুর মোকাবিলা করতে হয়েছে। আমরা জানি, বহু সুপরিচিত কবির অনেক মহান সৃষ্টি সংশ্লিষ্ট দেশের শাসক কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়েছে।

হোমারের কালজয়ী সৃষ্টি ওডিসীর পঠন নিষিদ্ধ ছিল। চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াসের মতামত, তাঁর সময়ের তাঁর দেশের শাসকগোষ্ঠী আক্রমণ করেছিলেন। নিঃসন্দেহে আমরা যদি আরেকজনের নাম এই তালিকায় যোগ না করি তা অসম্পূর্ণ থাকবে। তিনি আর কেউ নন, সকল রকম শোষণের বিরুদ্ধে অশেষ নির্ভীক কণ্ঠস্বর আমাদের জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

ভারতীয় উপমহাদেশে কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি লিখিত দলিলের মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি উত্থাপন করেছিলেন। নজরুল তাঁর ‘রুদ্রমঙ্গল’ (১৯২৬)-এ প্রকাশিত ধূমকেতুর পথ রচনায় লিখেছেন, “একটিমাত্র টুকরো ভারতীয় ভূমিও বিদেশীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে না। ভারতীয়দের পরিচালনার দায়িত্ব ভারতীয়দের হাতে থাকবে। এ বিষয়ে কোনও বিদেশির অধিকার নেই আমাদের নির্দেশ করার। যারা ভারতের রাজা বা স্বৈরশাসক হয়েছে এবং এই ভূমিকে শ্মশানে পরিণত করেছে, তাদের তল্পি-তল্পাসহ সাগর পাড়ি দেয়ার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। ”

ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার নজরুলের স্বাধীন কণ্ঠস্বর, নির্ভীক মনোভাব এবং কর্মকাণ্ডকে সন্ত্রাসী বা জঙ্গি চরমপন্থী তৎপরতা আখ্যা দেয়। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে গণজাগরণের জন্য এত তীব্র ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে আঘাত করার মতো কেউ ছিল না। ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে নজরুলের মতো এমন বিদ্রোহীর আর কোনও দৃষ্টান্ত ছিল না। ফলে, তৎকালীন সরকার তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিল। অত্যাচার ও নির্যাতনের যে অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছিল, তাঁকে সহজেই বিশ্ব সাহিত্যে সবচেয়ে বিদ্রোহী কবি বলে আখ্যা দেয়া যায়।

অবিভক্ত ভারতে ব্রিটিশ সরকার নজরুলের বেশ কিছুসংখ্যক বই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। কিন্তু এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ভিন্নমত লক্ষণীয়। হায়াৎ মামুদ নজরুলের ৭টি নিষিদ্ধ বইয়ের নাম উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতানুসারে বইগুলো হলো যুগবাণী(১৯২২), বিষের বাঁশি(১৯২৪), ভাঙ্গার গান(১৯২৪) দুর্দিনের যাত্রী(১৯২৬), রুদ্রমঙ্গল(১৯২৬), প্রলয়শিখা(১৯৩০), চন্দ্রবিন্দু(১৯৩০), (নজরুল, বাংলা একাডেমি)।

পরবর্তীকালে কবি নজরুলের ৯০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলা একাডেমি ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’ (মে, ১৯৮৯) জার্নাল প্রকাশ করে। এখানেও কবি নজরুলের ৭টি নিষিদ্ধ বইয়ের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়।

সমালোচক শিশির কর তাঁর ‘নিষিদ্ধ নজরুল’ গ্রন্থে নজরুলের প্রকৃতপক্ষে নিষিদ্ধ ৫টি বইয়ের নাম উল্লেখ করেন। এবং তিনি তাঁর দাবির সমর্থনে পর্যাপ্ত তথ্য দেন। যুগবাণী (প্রকাশিত হয় অক্টোবর, ১৯২২) নিষিদ্ধ হয় ২৩ নভেম্বর ১৯২২, বিষের বাঁশি (প্রকাশিত হয় আগস্ট, ১৯২৪) নিষিদ্ধ হয় ২২ অক্টোবর, ১৯২৪, ভাঙ্গার গান (প্রকাশিত হয় আগস্ট, ১৯২৪) নিষিদ্ধ হয় ১১ নভেম্বর, ১৯২৪, প্রলয়শিখা (প্রকাশিত হয় জুলাই, ১৯৩০) নিষিদ্ধ হয় ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৩০, চন্দ্রবিন্দু (প্রকাশিত হয় সেপ্টেম্বর, ১৯৩১) নিষিদ্ধ হয় ১৪ অক্টোবর ১৯৩১।

কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর প্রথম গ্রন্থ অগ্নিবীণা প্রকাশের ঠিক চার সপ্তাহ পর ঔপনিবেশিক পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হন। অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয় ২৪ অক্টোবর ১৯২২। কবি গ্রেফতার হন ২৩ নভেম্বর ১৯২২। তাঁর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল, তিনি ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা লিখেছিলেন যা ধূমকেতুতে প্রকাশিত হয়েছিল। ১৬ জানুয়ারি ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে কবির ১ বছরের জেল হয়।

কবিকে দু’বার কারাবরণ করতে হয়েছিল। প্রথমবার ১৬ জানুয়ারি ১৯২৩ সালে। ১৪ এপ্রিল তিনি আলীপুর জেল থেকে কলকাতার হুগলি জেলে স্থানান্তরিত হন। তখন তিনি অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। এর কারণ ছিল ব্রিটিশ জেল সুপারের দুর্ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।

হুগলি জেল সুপার মি. আর্সটেন কয়েদিদের নিপীড়নের বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করতেন যেন তারা সরকারের প্রতি অবনত হয়। কিন্তু যখন কয়েদিগণ নজরুলের নেতৃত্বে তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন, আর্সটেন তখন তাদের ওপর আরও বেশি চাপ প্রয়োগ করেন। তখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার নজরুলের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা দায়ের করে এই মর্মে যে নজরুল জেল কোড ভঙ্গ করেছেন।

যখন কাজী নজরুল ইসলামের অনশন ধর্মঘট ৩৮ দিনে উপনীত হয়, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সমর্থনে এগিয়ে আসেন। রবিঠাকুর একটা ছোট চিঠিতে নজরুলকে অনুরোধ করেন, “অনশন ধর্মঘট পরিত্যাগ করো, আমাদের সাহিত্য তোমাকে দাবি করে। ” কিন্তু টেলিগ্রামটি নজরুলের কাছে পৌঁছেনি। ইচ্ছাকৃতভাবে কারা কর্তৃপক্ষ টেলিগ্রামটি কবিগুরুর কাছে ফেরত্‍ পাঠায়। ৩৮ দিনের অনশনের পর কেবলমাত্র কবির শাশুড়ি বিরজা সুন্দরী দেবীর অনুরোধে তাঁর হাতে লেবুজল পান করে নজরুল অনশন ভঙ্গ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ১৯২৩ সালের ডিসেম্বর কবি কারামুক্ত হন।

কারাবাসের সময় নজরুল বহু গান ও কবিতা রচনা করেছেন। এসময় নজরুল কোর্টে একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন যা পরবর্তীকালে রাজবন্দীর জবানবন্দী শিরোনামে প্রকাশিত হয়।

২৫ অক্টোবর, ১৯৩০। ব্রিটিশ সরকার কাজী নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে এবং ৬ নভেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি জারি করে। তবে, দ্বিতীয়বার তাঁকে জেলে যেতে হয়নি গান্ধী এবং আরউইনের মধ্যে চুক্তির কারণে।

কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা, গান, উপন্যাস, ছোটগল্প এবং নাটকে নির্যাতন, দাসত্ব, সাম্প্রদায়িকতা, সামন্তবাদ এবং ঔপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ ছিল। যতক্ষণ না কবি শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, কোনও অন্যায় নির্যাতন তাঁর বিদ্রোহী কণ্ঠরোধ করতে পারে নি। তিনি সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন।

বিভিন্ন সময় তাঁর বই নিষিদ্ধ হওয়ায় তাকে চরম আর্থিক সংকটে পড়তে হয়েছে, তবু তিনি তাঁর আদর্শের সাথে আপোস করেননি। তিনি সকল অসাম্য এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিজেকে পথিকৃত্‍ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর আজীবন সংগ্রাম, নির্যাতনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অত্র অঞ্চলের মানুষের কাছে সংগ্রামের প্রতীক হয়ে আছে। তাই বাংলাদেশ সরকার যথার্থই ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবিকে কলকাতা থেকে বাংলাদেশে এনে জাতীয় কবির মর্যদায় অধিষ্ঠিত করেন।



বাংলাদেশ সময়: ১৩৫২ ঘণ্টা, মে ২৭, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।