ভাষার ভেতরে কবির আত্মাটাই সংগুপ্ত থাকে কিংবা ভাষা নিয়েই মুদ্রিত হন কবি। ভাষা ও প্রকরণ সূত্রেই চিহ্নিত হয় কবি ও কবিতার প্রকৃতি।
বাঙালিত্বের সবটুকু রঙ নিয়ে নির্মিত হয়েছে কবি নজরুলের কাব্যভাষা। এই ভাষার উৎসে আছে লেটো দলের হয়ে সংগীত চর্চার প্রস্তুতি। বাঙালির লৌকিক জীবনের বিশ্বাস ও জীবনচর্চাকেই কবি বাণীময় করে প্রকাশ করেছেন। সেখানে কৃষ্ণ ও মুহম্মদকে নিয়ে রচিত আখ্যান সবাই মন দিয়ে শোনে। বাংলা কবিতায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম মূলত এই বৃহৎ বাঙালির আত্মার ধ্বনিকে কাব্যভাষায় পরিণত করেছেন। তিনি বর্তমানের কবি হতে চেয়েছেন। যুগের মন ও বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক রূপের ভেতরে তৈরি হয়েছে নজরুলীয় ভাষারূপ। রবীন্দ্র বলয়ের সূক্ষ্ম রোমান্টিক আবহের ভেতরে থেকেও মাটিবর্তী জীবন ঘনিষ্টতাই কবির ভাষাকে স্বাতন্ত্র্য মণ্ডিত করেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুলের কবিতা প্রসঙ্গে বলেছেন, “...কৃত্রিমতার ছোঁয়াচ তাকে কোথাও ম্লান করেনি, জীবন ও যৌবনের সকল ধর্মকে কোথাও তা অস্বীকার করেনি। মানুষের স্বভাব ও সহজাত প্রকৃতির অকুণ্ঠ প্রকাশের ভিতর নজরুল ইসলামের কবিতা সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে তার আসন গ্রহণ করেছেন। বিদগ্ধ বাগবিন্যাসের যেমন মূল্য আছে, সহজ সরল তীব্র ও ঋজু বাক্যের মূল্যও কিছু কম নয়। ... তীব্রতাও রসাত্মক হলেই কাব্য হয়ে ওঠে যেমন উঠেছে নজরুলের বেলায়। .... কাব্যে অসির ঝনঝনা থাকতে পারে না, এসব তোমাদের আবদার বটে। সমগ্র জাতির অন্তর যখন সে সুরে বাঁধা, অসির ঝনঝনায় যখন সেখানে ঝংকার তোলে, ঐকতান সৃষ্টি হয়, তখন কাব্যে তা প্রকাশ করবে বৈকি! আমি যদি আজ তরুণ হতাম তাহলে আমার কলমেও ওই সুর বাজত। জনপ্রিয়তা কাব্য বিচারের স্থায়ী নিরিখ নয়, কিন্তু যুগের মনকে যা প্রতিফলিত করে, তা শুধু কাব্য নয়, মহাকাব্য। ”
যুগমন ও যুগযন্ত্রণার ভেতরে নজরুলের জন্ম। বাংলা কবিতায় বিশ শতকের জেনারেশনে বসে নজরুল কোনও সম্প্রদায়ের কবি হতে চান নি। তবে, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিতে বাঙালি মুসলমানেরও যে নিজস্ব ঘরানার উত্তরাধিকার আছে এটা প্রথম অনুভব করেছিলেন তিনি। সময় সূত্রের দীর্ঘ পরম্পরায় কাল থেকে কালে জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংস্কৃতিগত কিংবা ভাষাগত রূপ ও রূপান্তর ঘটে—নজরুল তা জানতেন। সেই রূপ ও রূপান্তরকে অস্বীকার করলে আত্মপরিচয়কেই অস্বীকার করা হয়। নজরুল সেই আত্মপরিচয় অনুসন্ধানী বাঙালি কবি। ধর্ম কিংবা সম্প্রদায় একটি জনগোষ্ঠীতে সংস্কৃতি প্রাচীর কিংবা ভাষা প্রাচীর তৈরি করতে পারে—এটা তিনি বিশ্বাস করতে পারতেন না। যে অন্ধতা এই প্রাচীর নির্মাণে সহায়তা করে নজরুলের কবিতা তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করে। বিশ শতকের হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ও বিভাজিত সংস্কৃতিতে নজরুলের কবিতা মূলত অবিভক্ত আত্মপরিচয়ের আয়না।
হিন্দু-মুসলিম পুরাণের কাহিনী ও ঐতিহ্যকে একত্রে মিলিয়ে কাব্য পরিবেশন করেছেন তিনি। মানুষের জন্য কবিতা, চিন্তা ও মনের মুক্তির জন্য কবিতা—এটাই ছিল নজরুলের কাব্যদর্শন। তিনি যখন কবিতা লিখছেন হিন্দু-মুসলিম বিরোধ তখন চরমে। ১৯২৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কবির মনে গভীর প্রভাব ফেলে। কবিতায় তিনি হিন্দু-মুসলিম পুরাণের কাহিনী ও ঐতিহ্যকে পরিবেশন করে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়তে চেয়েছেন। এই একত্রীকরণে কোনও যান্ত্রিকতা ছিল না; ছিল সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। একটা নান্দনিক দৃষ্টিতে দুই ধারার সম্প্রদায়কে কবি একটা প্রবাহে মিলিয়ে দিয়েছেন। নজরুলের কবিতা দুই সম্প্রদায়ের মিলনের একটা সেতু। ধর্মকে বরাবর তিনি ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবেই দেখেছেন। তাই কবিতায় তিনি শুধু অসাম্প্রদায়িক নন; ধর্মনিরপেক্ষও। বাঙালি সমাজে গুপ্ত স্রোতের মতো প্রবাহিত ধর্মনিরপেক্ষ বোধটাকে তিনি কাব্যে ও ব্যক্তিজীবনে স্থান দিয়েছেন। আমরা জানি তিনি বিয়ে করেছেন ব্রাহ্ম পরিবারে। কবির প্রথম ছেলের নাম খালেদ অরিন্দম। দ্বিতীয় ছেলের নাম কাজী সব্যসাচী; যার ডাকনাম ছিল সানিয়াত সেন। তৃতীয় ছেলের নাম কাজী অনিরুদ্ধ; যার ডাকনাম লেলিন। জন্মের সাথে সাথে মারা যাওয়া এক ছেলের নাম রেখেছেন কৃষ্ণ মোহাম্মদ।
গদ্যে কিংবা কবিতায় পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত আত্মাভিমানী, পলায়নপর বাঙালি মুসলমানদের নবজাগরণ কামনা করেছেন তিনি। কিন্তু অতীতবাদীতা নয়; রেনেসাঁস কিংবা এগিয়ে যাওয়াতেই আস্থা ছিল তাঁর। সময় ও সমাজই সমাজ সংস্কারকের জন্ম দেয়। কিন্তু বাঙালি মুসলমান সমাজে বিদ্যাসাগর-রামমোহনের মতো সমাজ সংস্কারক আবির্ভূত হয়নি। নজরুল সমাজ সংস্কারক ছিলেন না, ছিলেন কবি। এই কবিতা দিয়েই তন্দ্রাচ্ছন্ন বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠীকে আকর্ষণ করেছিলেন কবি। ম্রিয়মাণ লিরিকের পরিবর্তে আপন জনসংস্কৃতির ভেতর থেকেই উঠিয়ে এনেছেন জাগরণের লিরিক। এই কবিতাগুলোর একদিকে দায় ও আদর্শ, অন্যদিকে আছে প্রথা ও অন্ধতার বিরুদ্ধে দ্রোহ। এই প্রসঙ্গে আহমদ ছফা বলেন, “তাঁর একক চেষ্টায় মুসলিম সমাজের ভেতরে যে ভাবাবেগ তিনি জাগাতে পেরেছিলেন, যে আত্মবিশ্বাসের আগুন জ্বালিয়ে তুলতে সফল হয়েছিলেন, সেক্ষেত্রে তার সঙ্গে অন্যকোনও মুসলিম চিন্তাশীল ব্যক্তির তুলনা হয় না। এই সমাজটিকে ভেতর থেকে বিকশিত করে তোলার জন্য একজন আত্মভোলা খেয়ালি, দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রামরত কবির পক্ষে যতটুকু দায়িত্ব গ্রহণ করা উচিত ছিল, তার চাইতে অনেক গুরুদায়িত্ব তিনি পালন করে গেছেন। ”
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজসৃষ্ট কলকাতা কেন্দ্রিক বাংলা ভাষার বিপরীতে নজরুলীয় ভাষা। আলালী কিংবা বঙ্কিমী রীতিই বাংলা ভাষার শেষ ও একমাত্র ভাষা নয়। হাজার বছরের মিলিত ভাষাস্রোতের রূপ ও প্রকৃতিকে কবি ঠিকই চিনেছিলেন। ভাষার মাধ্যমে সময়, সমাজ ও জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয় ফুটে ওঠে। পুঁথি সাহিত্যের ভাষা কখনওই আরবি-ফারসি ভাষা নয়—এটি বাংলা ভাষাভাষি দলিত ও বিত্তহীন একটি জনগোষ্ঠীর অনুভূতির রূপ ও সৃজন। কবি নজরুরের এই কৃতিত্বকে প্রথম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেছেন আহমদ ছফা। তিনি বলেন, “নজরুল পুঁথি সাহিত্যের প্রাণের আগুনটুকু গ্রহণ করেছেন, তার জীর্ণ কঙ্কাল বহন করেন নি। তাই নজরুল সাহিত্যে পুঁথিসাহিত্যের জীবাশ্ম দৃষ্টিগোচর হলেও, সেই ভাষা কাঠামো খুঁজে পাওয়া যাবে না। ... নজরুলের কাছে বাঙালি মুসলমান সমাজের অন্যতম প্রধান ও প্রণিধানযোগ্য ঋণ এই যে, নজরুল তাদের ‘ভাষাদীন পরিচয় ঘুচিয়ে দিয়ে তাঁদের সামাজিক ভাষাকে সাহিত্য সৃষ্টির ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দান করলেন এবং স্বীকৃতি অর্জন করে দিলেন। আর নজরুলের কাছে সমগ্র বাঙালি সমাজের ঋণ এই যে, নজরুল বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যকে বাংলার হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করে, নব বিকাশধারায় ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে অনেক দূর পর্যন্ত গাঁথুনি নির্মাণ করেছিলেন। ”
কবি বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, “নজরুল ইসলাম নিজে জানেননি যে তিনি নতুন যুগ এগিয়ে আনছেন, তাঁর রচনায় সামাজিক-রাজনৈতিক বিদ্রোহ আছে, কিন্তু সাহিত্যিক বিদ্রোহ নেই। ” বুদ্ধদেব বসু সমাজ ও রাজনীতিগন্ধী কবিতাকে অপছন্দ করতেন—পছন্দ না করার নন্দনতাত্ত্বিক চেতনা থেকেই একথা বলেছেন। বরং সমাজ ও রাজনীতি যে কবিতার উপাদান হতে পারে নজরুল তাই দেখিয়েছেন। সমাজে লুক্কায়িত মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভাষা ও ঐতিহ্যকে তিনি পুনরুদ্ধার করেছেন। রাজনৈতিক ভাবে পরাজিত একটি একটি ভঙ্গুর, বিলুপ্ত ভাষা ও সংস্কৃতিকে কবিতায় ধারণের তৌফিক ও হিম্মত দেখিয়ে নজরুল বাংলা কবিতায় নতুন যুগের সূচনা করেছেন। তাঁর কাব্যে স্বজাতি ঐশ্বর্য আছে স্বজনপ্রীতি নেই। আসলে নজরুলকে সাহিত্যে ঘোষণা দিয়ে বিদ্রোহ করতে হয়নি। ভাষা ও বক্তব্যে তিনি স্বাভাবিক ভাবেই রবীন্দ্রনাথের বলয় থেকে দূরে ছিলেন। নজরুলের বিদ্রোহ হচ্ছে চেতনাগত বিদ্রোহ। হিন্দু-মুসলিম মিলনের মধ্যদিয়ে তিনি জাতীয় ঐক্য ও সংহতির ডাক দিয়েছেন। কাল পরম্পরায় জাতীয় ঐক্যের এই অনুভবই কবির চেতনাগত বিদ্রোহ।
নজরুলের সম্পাদনায় বের হলো কৃষক শ্রমিকের পত্রিকা ‘নাঙল’। ১৯২৫ সালের ডিসেম্বরে কবি ধারাবাহিক ভাবে ‘সাম্যবাদী’ নামে একটি কবিতা লিখলেন। শ্রেণী বৈষম্য আর সম্পত্তিবানদের সরাসরি আক্রমণ করা হয় এই কবিতাগুলোতে। আমরা জানি ১৯২৬ সালের দাঙ্গা কবিকে বিচলিত করে। তাই কৃষ্ণনগরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে উদ্বোধনী গান রচনা ও গাইবার জন্য যখন কবিকে অনুরোধ করা হলো কবি লিখলেন ‘কাণ্ডারি হুশিয়ার’ কবিতাটি।
দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশিথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার!
*
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,
কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!
“হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কাণ্ডারী! বলো, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!
*
ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান,
আসি’ অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন বলিদান?
আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ?
দুলিতেছে তরী ফুলিতেছে ফল, কাণ্ডারী হুঁশিয়ার।
নজরুল ভবিষ্যতের নবী হতে চাননি। বর্তমানের কবি হতে চেয়েছেন। তিনি সচেতন ভাবেই বলেন, ‘দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি তাই যাহা আসে কই মুখে। ’ কালোত্তীর্ণ হওয়ার চেয়ে কবির কাছে জরুরি ছিল যুগ ও গোষ্ঠীর সংকট। তিনি হিন্দু মুসলমানের গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করতে চেয়েছেন। সাম্প্রদায়িক হানাহানিতে আহত হয়েছেন। সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে মিলন চেয়েছেন। কিন্তু সমকালের অনেক লেখক শিল্পীই কিন্তু এই মিলন চাননি। ১৯২৬ সালের আগস্টে বাঙালির সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সাম্প্রদায়িক সমস্যা সম্পর্কে লেখেন: “হিন্দুস্থান হিন্দুর দেশ। সুতরাং এ দেশকে অধীনতার শৃঙ্খল হইতে মুক্ত করিবার দায়িত্ব একা হিন্দুরই। মুসলমান মুখ ফিরাইয়া আছে তুরস্ক ও আরবের দিকে,—এ দেশে চিত্ত তাহার নাই। ...মুসলমানের সংখ্যা গণনা করিয়া চঞ্চল হইবারও আবশ্যকতা নাই। সংখ্যাটাই সংসারে পরম সত্য নয়। ইহার চেয়েও বড় সত্য রহিয়াছে যাহা এক দুই তিন করিয়া মাথা-গণনার হিসাবটাকে হিসাবের মধ্যে গণ্য করে না। ”
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এই আক্রমণ প্রসঙ্গত বাঙালি মুসলমানের ফরায়েজি আন্দোলনের প্রতি। কিন্তু শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যখন পঞ্চাশ বছর বয়সে এ ধরনের অগণতান্ত্রিক আক্রমণাত্মক কথা লিখছেন নজরুলের বয়স তখন ২৭। গণবাণী পত্রিকায় কবি তখন লেখেন:
মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান
মুসলিম তার নয়ন মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।
এক সে আকাশ মায়ের কোলে
যেন রবি শশী দোলে,
এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ীর টান।
এক সে দেশের খাই গো হাওয়া, এক সে দেশের জল,
এক সে মায়ের বক্ষে ফলে এক ফুল ও ফল।
এক সে দেশের মাটিতে পাই
কেউ গোরে কেউ শ্মশান ঠাঁই,
মোরা এক ভাষাতে মা’কে ডাকি, এক সুরে গাই গান।
চিনতে নেরে আঁধার রাতে করি মোরা হানাহানি,
সকাল হলে হবে রে ভাই ভায়ে ভায়ে জানাজানি
কাঁদব তখন গলা ধ’রে,
চাইব ক্ষমা পরস্পরে,
হাসবে সেদিন গরব ভরে এই হিন্দুস্থান। (হিন্দুস্থান)
পাঠক ও সমালোচকদের একরৈখিক, অমনোযোগী, ভারসাম্যহীন এবং প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গির ফলে ‘বিদ্রোহী কবি’ আখ্যায় নিনাদিত নজরুল। অথচ বাঙালির জাতিগত ঐতিহ্যের সবটুকু আকৃতি ও রঙ, মন ও মনন, মিথ ও ইতিহাস, বিশ্বাস ও অনুভূতি নিয়ে কাব্য চর্চা করে গেছেন নজরুল। প্রশ্ন হতে পারে জাতিগত চেতনা কী বস্তু? বলতে পারি, জাতিগত চেতনা একটা জাতির ফুঁসফুঁস। সময়ের সাথে সময়ের সেতু তৈরিতে সহায়ক এই জাতিগত চেতনা। নিত্য যাপিত জীবনে পরমসহিষ্ণুতা, উদারতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, অসম্প্রদায়িকতা, মানবিকতা, আত্মস্বার্থের বাইরে এসে অপূর্ব সহজতায় হাসতে পারা—মহৎ বাঙালির একটা সমন্বিতরূপ নজরুলের কবিতা। প্রকৃত অর্থেই তিনি ‘খাঁটি বাঙালি কবি’। একটা অবিচল রোমান্টিক ধারায় লোকায়ত বাঙালির স্বর ও স্বভাবকেই লিখে গেছেন। শিল্পীর স্বাধীনতা শিল্পীর মনে। সাম্রাজ্যবাদী পৃথিবীতে আমরা সবাই দাস ও পরাধীন। তাই ব্রিটিশের পক্ষে যুদ্ধ করা এই কবি বলেন, “এদেশ ছাড়বি কিনা বল,/ নইলে কিলের চোটে হাড় করিব জল। ”
কবি নজরুলের কবিত্বসত্তার একপ্রান্তে গণমানুষ, অন্যপ্রান্তে মনমানুষ। প্রেম ও অসাম্প্রদায়িকতার মিলন সেতুতে ধ্বনিত হচ্ছে অভিন্ন বাঙালি মানস। বাংলা কবিতায় নজরুল নিয়ে এলেন জাতীয় চেতনার বাণীময় রূপ। কবিতায় রাজনৈতিক চেতনা ও সামাজিক চেতনা দেখে বাংলা কবিতার পাঠক স্তব্ধ ও উল্লসিত। সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে বিশের দশকের কবিদের মধ্যে তাঁর জ্ঞান ও অনুভব সবচেয়ে গভীর ও তীব্র। ‘কামালপাশা’, ‘আনোয়ার পাশা’ ‘সাম্যবাদী’, ‘রুদ্রচণ্ডী’ ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’ শিরোনামে কবিতা লেখা যে সম্ভব সেটা নজরুল দেখালেন।
কবিতায় রাজনীতি কিংবা বাঙালির জাতীয় মানসের স্পষ্টরূপ নজরুলের কবিতা। নজরুলের এই কাব্যচর্চাকে কেউ কেউ উপরতলীয় মানবতাবাদ বলেন। কিন্তু কালের এই নিষ্পেষণ ও রাজনীতি বাঙালীয় চেতনাতেই নজরুলের কবিতায় উঠে এসেছে। কবি প্রশ্ন রেখেছেন, “দেখিনু সেদিন রেলে/ কুলি বলে এক বাবুসা’ব তারে ঠেলে দিল নিচে ফেলে। / চোখ ফেটে এলো জল,/ এমনি করিয়া জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?”
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৫ ঘণ্টা, মে ২৭, ২০১৫