আল-আইনে যে বাঙালির সাথেই দেখা হয়, সে-ই জিজ্ঞেস করে বড়ো পাহাড়ের উপর গিয়েছি কিনা। বলি, কোন পাহাড়?
: জেবেল হাফিত।
জেবেল মানে পাহাড়। হাফিত মানে কী জানি না। কিন্তু আল-আইন শহর থেকে সন্ধ্যে বেলা ঐ পাহাড়ের সারি সারি বাতি জ্বলতে দেখেছি। উঁচু পাহাড়ের গা ঘেঁষে যে রাস্তাটি পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে ঠেকেছে তার দু পাশে ল্যাম্পপোস্ট। দূর থেকে মনে হয় যেন কেউ ছোট ছোট মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখেছে পথ দেখাবার জন্যে। বাতিগুলো ক্রমাগত একটা বাঁকা পথ এঁকে পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে ঠেকেছে। রাতের বেলা পাহাড়টি যাতে কারও চিনতে ভুল না হয় সেজন্যে এই ব্যবস্থা।
৭ মে, ১৯৯৭। ঠিক হলো, বিকেলবেলা জেবেল হাফিতের চূড়ায় উঠব।
মুস্তফার গাড়িতে সওয়ার হলাম আমরা বেশ কজন। সস্ত্রীক ছানু, তার পুত্রকন্যা, আর মুস্তফার ছেলে তাহমিদ। কিন্তু যাত্রার শুরুতেই গাড়িতে বমি করে বসল ছানুর ৪ বছরের কন্যা সুমি। সিদ্ধান্ত হলো, ওকে নিয়ে বাবা মা ফেরত যাবে শহরে। কারণ এ যাত্রায় সোজা রাস্তায় বমি করলে পাহাড়ে উঠতে এই মেয়ে বারোটা বাজিয়ে দেবে। সুতরাং ব্যাক টু দ্যা হাউজ।
পাহাড়েরা বেশ প্রবঞ্চক হয়। দেখতে মনে হয় এইতো কাছেই, কিন্তু কাছে পৌঁছাতে কষ্টের শেষ থাকে না। জেবেল হাফিতই বা কম কীসে। আল-আইন শহরটাকে ছায়া দিয়ে রাখা এই পাহাড়টিকে বহুক্ষণ ধরে কাছে কাছে দেখেও প্রকৃত প্রস্তাবে তার কাছে পৌঁছাতে সময় লাগল তিরিশ মিনিটের মতো। মুস্তফা গাড়ির গতি কমিয়ে অটো গিয়ারের ডি ড্রাইভের পরিবর্তন আনলো। ডানপাশের পোস্টে তখন লেখা ১৬ কি.মি.। বোঝা গেল ১৬ কিলোমিটার ঢালু উঁচু পথ বেয়ে তবেই জেবেল হাফিত জয় করা যাবে।
জেবেল হাফিতের প্রাগৈতিহাসিক ভূমিকা অনেক। প্রত্নতত্ত্ববিদরা গত দশ বছর ধরে এ পাহাড়ের আনাচে কানাচে ঘাঁটাঘাঁটি করে পাঁচ হাজার বছরের পুরনো বাসন কোসনের সন্ধান পেয়েছেন। এগুলো এখন রাখা হয়েছে আল-আইন জাদুঘরে। জেবেল হাফিতের তলদেশের উত্তর ও পূর্ব দিকের কয়েকটি গুহায় অনুসন্ধান চালিয়ে কয়েকশ’ পাথরের থালাবাসন পাওয়া গেছে। এই থেকে অনুমান হয় যে, পাহাড়টির গুহায় ৫ হাজার বছর আগেও মানুষের বসবাস ছিল।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা কাজ শুরু করেছেন পঞ্চাশের দশকের শেষ থেকে। কিন্তু গত দশকের আগেও তারা তেমন কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক সন্ধান পাননি। সে তুলনায় গত এক দশকের আবিষ্কার প্রচুর। ধারণা করা হচ্ছে, ৭ হাজার বছর আগে এ অঞ্চলে গুহামানবেরা পাহাড়গুলোর পাদদেশে বসবাস করত।
মুস্তফাকে বললাম, জেবেল হাফিত যাচ্ছি ঠিক, কিন্তু বইতে পড়া গুহা-টুহার সন্ধান-টন্ধান পাব তো? মুস্তফা হাসে। বলে, ওসব এখন নাই। বদ্দুরা এখন আলিশান ভিলায় থাকে। গুহায় থাকা ছেড়ে দিয়েছে একশ’ বছর আগে। তবে কোথাও কোথাও গুহার পাশে কিছু সাবিহা (গ্রাম) দেখা যায়, সেখানে অবশ্য পুরনো দিনের মানুষেরা থাকে।
বলি, তাহলে আমাকে ওখানেই নিয়ে যাও।
মুস্তফা গাড়ির গতি না কমিয়েই হাসে। এ হাসির মানে হচ্ছে, সম্ভব না।
আমরা আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে জেবেল হাফিত মাড়াতে থাকি। এমন আঁকাবাঁকা পথে গাড়ি চড়া আমার কাছে নতুন মনে হয়নি। আমাদের সিলেটের জাফলং কিংবা রাঙামাটি যেতে ওরকম কত পাহাড় মাড়িয়েছি। কিন্তু এ দুয়ের মধ্যে বড় তফাৎ হচ্ছে প্রকৃতির রং। আমাদের গুলোও পাহাড়, এগুলোও পাহাড়। আমাদের পাহাড়ে বৃষ্টির পানি পড়ে জন্মেছে সবুজ বনানী, মনে হয় মাটির পাহাড়ের গায়ে সবুজের আলগা চাদর পরা অরণ্য। কিন্তু এখানে মাটি তো নয়, কঠিন পাথর। পৃথিবী সৃষ্টির সময় অগ্ন্যুৎপাতে যে কঠিন শিলারা আকাশের দিকে মুখ বাড়িয়ে পড়ে ছিল, প্রকৃতি তাকে অবহেলায়, অযত্নে নিরাভরণ রেখে দিয়েছে পৃথিবী সৃষ্টির চার হাজার কোটি বছর ধরে।
নির্মাণগত কাঠামোতে অবশ্য আছে পরিবর্তনের সুস্পষ্ট লক্ষণ। দু’ পাশে প্রশস্ত রিটেইনিং ওয়াল, দু’ পাশেই বাতির স্তম্ভ, যা একসাথে রাস্তাকেও আলোকিত করছে, আবার দূর থেকে এ প্রাগৈতিহাসিক স্থানকে পর্যটকের আকর্ষণ বিন্দুতে টানতেও দিক নির্দেশনা দিচ্ছে। প্রশস্ত পথ, পথের ধারে টেলিফোনের লাইন এবং বিশ্রাম নেবার বা ঢালু পাহাড়ে চড়তে জরুরি অবস্থায় গাড়ি পার্ক করা বা ঘুরিয়ে নেবারও ব্যবস্থা রেখেছে। এক সময় যা ছিল দুর্গম গিরি, আজ তা সুগম আর সহজ, প্রাণবন্ত। তবে মুস্তফা জানাল, এখনও এর সম্পূর্ণ নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। পাহাড়ের উপর কয়েকটি অট্টালিকা বানানো হচ্ছে, এখানেও পর্যটকদের জন্য অনেক ব্যবস্থা থাকবে।
জেবেল হাফিতের উপরে উঠে দেখা গেল ২/৩টা প্রাসাদ নির্মাণের শেষ পর্যায়ের কাজ চলছে। শ্রমিকরা বেশিরভাগই বাংলাদেশি। এই সুউচ্চ পাহাড়েও পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, টেলিফোন সবকিছুর ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে। যে দুটো প্রাসাদ দেখা গেল—তার একটি আল-আইনের শাসকের, অন্যটি অন্য কোনও শেখ সাহেবের। মাঝে মাঝে ইচ্ছা হলে তারা তাদের বন্ধুদের নিয়ে এখানে সময় কাটাবেন—এ ভেবেই প্রাসাদগুলো বানানো।
জেবেল হাফিতের চূড়ায় বেশ খানিকটা জায়গা সমতল করে চারদিকে রেলিং দিয়ে রাখা হয়েছে। যারা বেড়াতে আসেন তারা গাড়ি পার্ক করে রেলিংয়ের ধারে বেঞ্চিতে বসে দূরের শহর দেখেন। ইতোপূর্বে এতো উঁচু পাহাড়ে উঠিনি। আমিরাতের উচ্চতম পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বেশ শিহরণ বোধ করতে লাগলাম। শেষ বিকেলের মিষ্টি রোদ পাথরের পাহাড়ে তার লাল আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। প্রকৃতির আপন ইচ্ছায় রূপ নেয়া পাহাড়গুলোর এক একটিকে এক এক রকম মনে হয়। মনে হয় কোনও তূখোড় ভাস্কর অ্যাবস্ট্রাক্ট ফর্মে পাথরগুলো দিয়ে ভাস্কর্য বানিয়ে সাজিয়ে রেখেছে। উপর থেকে নিচে তাকালাম ভয়ে ভয়ে। আল-আইন শহরকে দেখা যায় পায়ের নিচে, ছোট্ট ছোট্ট ঘর, মিটি মিটি তারার মতো ল্যাম্পপোস্ট। হঠাৎ করে মুস্তফাকে অনুরোধ করে বসলাম, ভাই, তোমার মোবাইল থেকে আমি কি একটা লং ডিসট্যান্স কল করতে পারি?
মুস্তফা মোবাইলটা বাড়িয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বলে, ভাবীর কাছে ফোন করবেন? আগে বলেননি কেন?
বাংলাদেশের নাম্বার টিপলাম। হিসেব করে দেখলাম ঢাকায় তখন রাত আটটার কিছু বেশি। ফোন ধরলো জলী।
- জানো আমি এখন কোথায়?
: কোথায়?
- আমিরাতের সবচে উঁচু পাহাড়ের উপর থেকে তোমাকে ফোন করছি।
: ফাজলামো রাখো, পাহাড়ের উপরে ফোন পেলে কোথায়?
- এখানে পাহাড়ের উপরেও ফোনের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আমি ফোন করছি মোবাইল সেট থেকে।
: তোমার কোমরে ব্যথার কথা মনে আছে? তুমি পাহাড় চড়তে গেছো কেন?
- আরে না, গাড়িতে করে পাহাড় চড়ছি, কোমরের সমস্যা হবে না।
: তোমার যা ইচ্ছা করো। আমি জানি না। দু’ দিন পর দেশে এসে আবার বিছানায় পড়ে থাকলে আমি ফিরেও তাকাব না। তুমি তাড়াতাড়ি পাহাড় থেকে নেমে ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও।
বৌয়ের সাথে আলাপ করে মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমি যে অনুভূতির কথা বলতে চাইলাম—তা বোঝাতে পারলাম না। ফেরত পেলাম উপদেশ। উপদেশ শুনতে আমার ভালো লাগে না। আবার প্রকৃতি দেখার জন্য মনোযোগী হয়ে গেলাম।
ঘুরতে ঘুরতে একদিকে দেখলাম রেলিংয়ের মধ্যে একটা দরোজাও আছে। এই বেষ্টনীটি পার হয়ে পাহাড়টি থেকে বেরিয়েই দেখি, অনেক দেরি করেই এখানে এলাম। এর আগে অনেকেই এসে বসে আছে। এরমধ্যে তিন চারজন কালো ও শাদা চামড়ার পর্যটকের দল ছাড়া বাকি সবাই আরবি। একটা বড় পাথরের ওপর তিনজন বৃদ্ধ আরবি খোশগল্পে মেতে রয়েছে।
পাহাড় থেকে নিচের ছবি তোলা খুব কষ্টের। প্রথম কারণ, শেষ বিকেলের একটা ধোঁয়াটে আবরণ ইতোমধ্যেই তলার শহরটাকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে। খালি চোখেই বেশি কিছু দেখা যায় না। ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে অনেকটা হতাশ হয়ে বুড়োগুলোর ছবি তুলতে চাইলাম।
ক্যামেরা তাক করেছি বুড়োদের দিকে, অমনি একজন আমাকে উদ্দেশ্য করে কী যেন বললো আরবিতে।
ভয় পেয়ে গেলাম।
এ ভয় অমূলক নয়। গতকাল আল-আইনের ফান সিটিতে আমার একটি তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে ছবি তুলতে গিয়ে।
ফান সিটি বিশাল আয়তনের প্রমোদনগরী। শুধু শিশুদের জন্য নয়, বুড়োদের জন্যেও অনেক কিছু আছে। সস্ত্রীক ছানু ও তার বাচ্চাদের নিয়ে আমরা গিয়েছিলাম ফান সিটিতে। ছানুর ছেলেমেয়েরা খুব হৈ চৈ করছে, কিন্তু আমার কেন যেন ওসবে তেমন আগ্রহ নেই। একটি বেঞ্চে বসে আছি। সন্ধ্যা হয় হয় এমন সময়। হঠাৎ দেখি দুই আরব রমণী বোরকা খুলে ঘাসের ওপর বসে আছে এবং তাদের দুজনের পাশে বেবি চেয়ারে দুটো ফুটফুটে শিশু। আমরা মায়ের সাথে বাচ্চাদের অঙ্গাঙ্গীভাবে দেখে অভ্যস্ত। আমাদের দেশের শিশু পার্কে বাচ্চাদের বুকে জড়িয়ে মায়েরা ঘোরাঘুরি করে। কিন্তু এখানে, এই বাচ্চা দুটোকে পাশে এমন অযত্নে বসিয়ে রেখেছে দেখে আমার অন্যরকম মনে হলো। শুধু তাই নয়, মা দুজন দু’ হাতে দুটো সিগারেট ধরিয়ে নিজের মতো টেনে যাচ্ছেন। একটু হোঁচট খেলাম। মা, শিশু এবং সিগারেট—এ তিনের সমন্বয়টাকে ধরে রাখার জন্যে ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে ফ্লাসগান বসিয়ে চার্জ দিয়েছি। ফ্লাসগানে ব্যাটারি চার্জ হলে শব্দ হয়। ছানু সেই শব্দ শুনছে। যেই ক্যামেরা তাক করতে যাব, এমন সময় আমার হাত আটকে দিল ছানু। ‘খবরদার আরব মহিলাদের ছবি তুলবে না। খুব অসুবিধা আছে। ’
- কেন? কী হবে ছবি তুললে?
: কী হবে মানে? এখনই পুলিশ ডেকে আনবে। পুলিশকে তারা যা বোঝাবে তাই বুঝবে। পুলিশ তোমার কোনও কথা শুনবে না। সোজা গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে রেখে দেবে দুইদিন। এখানকার সব পুলিশ ক্যাম্পেই মাটির তলার জেলখানা আছে। আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনও সুযোগ পাবে না। কারণ, তুমি খারিজী।
ছানুর কথায় খানিকটা ভড়কে যাই। ক্যামেরা থেকে ফ্লাসগানকে বিচ্ছিন্ন করে ব্যাগের ভেতর পুরে দূরে দাঁড়িয়ে ওই মহিলাদের কর্মকাণ্ড দেখতে থাকি।
ছানু এসময় আমাকে আমিরাতের পুলিশ ও মহিলাদের বিষয়ে নানারকম জ্ঞান দিতে থাকে। এক দোকানদারের গল্প শোনায়। একদিন এক আরবি মহিলা ওই দোকানে এসেছে একটি বিশেষ পারফিউম কিনতে। ওই মহিলার অভ্যেস ছিল কয়েক পদের পারফিউম কিনে এক বোতলের ভিতর ঢুকিয়ে ককটেল বানানো। মহিলাটি দোকান থেকে পারফিউম কিনে দাম চুকিয়ে সালাম আলাইকুম বলে চলে যায়।
আসল ঘটনাটা ঘটে পরের দিন। অগ্নিমূর্তি ধারণ করে মহিলাটি বলে, গতকাল এই দোকান থেকে যে পারফিউম কিনে নিয়েছিল তা মেশানোর পর ককটেলের সুগন্ধ নষ্ট হয়ে গেছে। সুতরাং তার দাবি হচ্ছে, যতগুলো পারফিউম মিশিয়েছিল প্রত্যেকটির দাম ফেরত দিতে হবে এবং এখনই। দোকানদার পড়ল বেকায়দায়। মহিলাকে যতই বোঝানোর চেষ্টা করে যে, সে ভেজাল মেশানো পারফিউম বিক্রি করে না, প্রয়োজনে একই ব্রান্ডের অন্য কোনও পারফিউম চাইলে সে পরীক্ষা করে দেখাতে পারে। কিন্তু মহিলা তার বক্তব্যে অনড়। তার হাতে পরীক্ষানিরীক্ষা করার মতো সময় নেই। সে চায় ক্ষতিপূরণ এবং এক্ষুণি।
এরকম পরিস্থিতিতে ভিনদেশি একজন দোকানদারের করার কিছু নেই। সময়ক্ষেপণ দেখে মহিলা বলে, এক্ষুণি সমস্ত ক্ষতিপূরণ না দিলে সে পুলিশ ডাকবে এবং পুলিশকে বলবে যে, এই দোকানদারগুলো তার ইজ্জত লোটার চেষ্টা করেছিল। বলে সে দরজা লাগানোর দিকে হাত বাড়াল।
- পুলিশ কি এই মহিলার কথায় বিশ্বাস করবে?
: হানড্রেড পারসেন্ট করবে। পুলিশ কোনও সাক্ষী সাবুদ মানে না। সোজা গাড়িতে উঠিয়ে জেলে ভরে দেবে। আরবিদের সাথে মামলা করে কেউ জিততে পারে না। আর মহিলাদের ব্যাপারটা তো আরও আলাদা। তারা যা বলবে পুলিশ তাই বিশ্বাস করবে।
খানিকটা ভয় পেয়ে বেঞ্চের ওপর এসে বসে পড়লাম। এমন সময় ফর্সা, দীর্ঘাঙ্গী এক যুবক আমার সামনে এসে আরবিতে চেঁচামেচি শুরু করে দিল। কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। তাকে বললাম, ক্যান ইয়ু স্পিক ইন ইংলিশ?
আরও অধিক জোরে চিৎকার করে লোকটি বলে, ইয়েস, আই স্পিক ইংলিশ। হোয়াই ইয়ু টেক ফটো মাই ওয়াইভস?
তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম, আমি তোমার বৌদের কোনও ছবি তুলিনি। কিন্তু সে আরও রেগে যায়।
এমন সময় ছানু এসে আরবিতে কী কী সব বলল। লোকটি ঠাণ্ডা হয়ে ফেরত চলে গেল। যাবার সময় শাসনের ভঙ্গিতে আঙ্গুল উঁচিয়ে আমাকে ইংরেজিতে বলল, দোন্ত গো দেয়ার, দোন্ত লুক মাই ওয়াইভস।
এ ঘটনার পর ছানু আমাকে কঠিন ভাষায় সাবধান করে দিয়েছিল। বলেছিল, বদ্দুদের দিকে ক্যামেরা তাক করো না, আর ভুল করেও যদি মহিলাদের ছবি তুলতে যাও, তবে দেশে ফেরার আগ পর্যন্ত মাটির তলার জেলে সময় কাটিয়ে যেতে হবে। বলেছিলাম, বেশ তো ভালোই হয়, আমিরাতের জেলখানাটাও দেখা হয়ে যাবে।
ঠিক এই কারণে আরব বৃদ্ধদের কথা শুনে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ভয় কাটিয়ে দিল মিন্টু। মিন্টু স্কুলে আরবি শিখেছে। সে আরবিতে লিখতে ও পড়তে পারে, কথাও বোঝে। আমার ও তার বাবা ছানুর সাথে সব সময় ইংরেজিতেই কথা বলে। আমার কাছে এসে ওদের আরবি কথা ইংরেজিতে বুঝিয়ে দিল। বলল, চাচা ওরা বলছে এতো দূর থেকে ছবি তুললে ওদের চেহারা দেখা যাবে না, আপনি আরও কাছে যান।
আরো সাহস পেয়ে গেলাম। এরমধ্যে মুস্তফা আমাদের মাঝে এসে গেল। আমার ভাষাগত সব সমস্যা মিটে গেল। আরব বৃদ্ধদেরকে আমার সম্পর্কে অনেক কিছু বলল। সব শুনে তারা আমার সাথে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল।
এই সব আয়োজন থেকে ফিট দশেক দূরে একটা পাথরের ওপর একা একা বসে সূর্যাস্ত দেখছে এক আরবি তরুণ। সেও এসে যোগ দিল আমাদের মধ্যে। আমাকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, ইউ আরকিতেকত? ফতোগেরফার?
মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
এরমধ্যে মুস্তফার সাথে তার আরবিতে কী কী সব কথাবার্তা হলো। মুস্তফা আমাকে বলল, এই ছেলেটা তোমাকে সুন্দর আরেকটা পাহাড় দেখাতে চায়, তুমি কি যাবে?
ওর কথায় খানিকটা অবাক হয়ে যাই। তার সাথে সরাসরি কথা বলার চেষ্টা করি। তার নাম মোহসীন। বয়স ২০/২১ বছর হবে। পড়াশোনা করে দুবাই পুলিশ স্কুলে ফাইনাল ইয়ারে। সে যতটুকু ইংরেজি পারে, তাতে আমাদের মধ্যে ভাষার আদানপ্রদানে খুব অসুবিধা হলো না।
মোহসীন বলল, তোমার দেশে পাহাড় নাই? বলি, আমার দেশে পাহাড় আছে, নদী আছে, সাগর আছে, বিল আছে। কিন্তু এগুলোর মতো নয়। ‘তোমার কাছে কোনটাকে বেশি সুন্দর মনে হয়?’—মোহসীনের প্রশ্ন। বলি, দু দেশের প্রকৃতি দু রকমের। দুটোর সৌন্দর্য আলাদা। একটার সাথে অন্যটা মেলানো ঠিক হবে না। তবে পাহাড় প্রচুর দেখেছি, কিন্তু এমন পাথরের পাহাড় দেখিনি। আমার চমৎকার লাগছে। মোহসীন বলে, তোমার যদি সময় হয়, আমি তোমাকে আরেক শ্রেণীর পাহাড় দেখাতে নিয়ে যেতে পারি। সেখানে একটি ঝর্না আছে, ঝর্না থেকে নদীর উৎপত্তি হয়েছে। শুক্রবার ওখানে যাই। তোমার যেহেতু পাহাড় ভালো লাগে, তুমি খুব আনন্দিত হবে। বলি, ওটা কোথায়? সে বলল, ওমানের শেষ প্রান্তে। বললাম, আমার তো ওমানের ভিসা নাই, আমিরাতের ভিসা, যদি পুলিশ ধরে? মোহসীন হাসতে হাসতে বলল, মা ফী মুসকিলা—নো পরব্লেম। মাই ফাদার পুলিশ অফিসার, আই পুলিশ স্তুদেন্ট।
ঠিক হলো, কাল সকাল সাড়ে দশটায় মোহসীন আসবে মুস্তফার সিটি পারফিউমারি স্টোরে। সেখান থেকে আমরা রওনা দেব ওমানের পথে পাহাড় দেখার জন্য।
সূর্য ডুবে গেছে জেবেল হাফিতের তলায়। পাহাড়ের উপর থেকে সূর্য ডোবার দৃশ্য অনেকক্ষণ দেখা যায়। ঘন কুয়াশার মতো একটা আবরণ ঢেকে দিল পাহাড়তলের গার্ডেন সিটিকে। ল্যাম্পপোস্টগুলো থেকে সারি সারি আলোর কণা ফুটে উঠল। মনে হলো একটা বড় অপূর্ণতা রয়ে গেছে এই পাহাড়ের সৌন্দর্যে। মুস্তফার সাথে ঠিক হলো, দেশে ফেরার আগে যেকোন একদিন সূর্য ওঠার আগে আমরা এ পাহাড়ে এসে উঠব। পাহাড়ের চূড়া থেকে বালুরাশির ভেতর থেকে সূর্য উদয় হওয়ার দৃশ্য দেখব।
পরিকল্পনা ফাইনাল হয়ে গেল। আমাদের গাড়ি জেবেল হাফিতের ঢালু বেয়ে ধীরে ধীরে নিচের দিকে নেমে চলল। যাবার আগে একবার মোহসীনকে দেখতে চাইলাম। মোহসীন সেই আগের মতো একটা পাথরের ওপর বসে আছে। অন্ধকার হয়ত তার বেশি প্রিয়। মোহসীন ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
মোহসীনের সাথে একদিন
মোহসীনের সাথে আজ আমার দেখা হবার কথা সকাল দশটায়। মোহসীন বলেছিল, যদি কোনও কারণে মত পাল্টাই তবে সকাল সাড়ে নয়টার মধ্যে যেন তাকে জানিয়ে দিই। তার পক্ষ থেকে যদি কোনও সমস্যা থাকে—সেও সাড়ে নয়টার মধ্যে আমাকে জানাবে। সকাল পৌনে দশটা পর্যন্ত কোনও পক্ষ থেকে কোনও যোগাযোগ হলো না। পুরো ব্যাপারটা ছানুকে যখন বললাম, সে আমল দিল না। তার মতে, আরবদের তুমি চেনো না, ওরা যখন যা খুশি বলে বসে, পরে সব ভুলে যায়। শুধু শুধু তোমাকে ওসব বলেছে। বাদ দাও ওর কথা, আজ কোথায় যেতে চাও, বলো।
বলি, ছেলেটাকে আমার সেরকম মনে হয়নি। ঠিক আছে, ওকে ফোন করে দেখো তো, কী বলে।
ছানু ফোন করল মোহসীনকে। তারা দুজন আরবি কথা বলে ফোন রেখে দিল। ছানু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ও এখন বাসা থেকে বেরিয়েছে, দশ মিনিটের মধ্যে আমার বাসার নিচে আসবে। সে তৈরি।
বলি, তাহলে তো হলোই, চলো নিচে নামি।
ছানু খানিকক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর বলল, ঠিক আছে, আমিও নামছি। যদি যেতেই হয়, তোমাকে একা ছাড়ব না, আমিও যাব।
ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁতে না ছুঁতেই মোহসীনকে দেখা গেল গাড়ি নিয়ে এসে হাজির। ছানু কথা বলল আরবিতে। আমাকে অনুবাদ করে বোঝাল, ও খুব লজ্জিত যে ওদের ল্যান্ডরোভার গাড়িটা আনতে পারেনি, ছোট গাড়ি নিয়ে এসেছে। বললাম, তাতে কী, এ গাড়িতে সমস্যা কোথায়? মোহসীন বলল, আমরা যে পথে যাব, সেখানে রাস্তা ভালো নেই, তোমার খুব আরাম হবে না। বলি, ‘মা ফী মুসকিলা। ’ মোহসীন হেসে ওঠে আরবিতে কী যেন বলে। আমি ইংরেজিতে বলি, ওই একটি বাক্য ছাড়া আর কোনও আরবি বাক্য বলতে পারি না। মোহসীন আবার হাসলো শব্দ করে। প্রায় চিৎকার করে ‘মা ফী মুসকিলা’ বলে দরোজা খুলে দিল। আমাকে বসতে বলল সামনে, তার পাশে। ছানু বসেছে পেছনের সিটে।
আল-আইনের ভেতরে ওমানের বুরেইমি শহরটি ঢুকে আছে। আল-আইন থেকে দুবাই যেতে বুরেইমি পার হয়ে যেতে হয়। আমিরাতের নাগরিকেরা ওমানের এ অঞ্চল দিয়ে যাওয়া আসা করতে পারেন, কিন্তু গাড়ি থেকে নামতে পারেন না। ওমানের এ অঞ্চলের নাগরিকেরা দুটো পাসপোর্ট ব্যবহার করেন। একটি ওমান, অপরটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের। আমার পাসপোর্টে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ১৪ দিনের ট্রানজিট ভিসা, ছানুর ভিসা আমিরাতের। সেক্ষেত্রে পুলিশি ভয় খানিকটা বুকের মধ্যে পুষে মোহসীনের গাড়ির সওয়ার হলাম আমরা দুজন।
আল-আইন পার হয়ে বুরেইমিতে গাড়ি থামাল মোহসীন। হঠাৎ কিছু না বলে এক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ঢুকে গেল। আমিও গেলাম পিছু পিছু। কয়েকটা ফিল্ম কেনা হলো। মোহসীন দুই বাক্স জুস কিনল রাস্তার পানীয় হিসেবে। এক বাক্সে দশ প্যাকেট জুস। তার একার জন্য তো বটেই, তিন জনের জন্যেও এই পরিমাণ যথেষ্ট। আমার দিকে তাকিয়ে বলে, আর কিছু আমার লাগবে কিনা। লজ্জায় পড়ে যাই। এমনিতে তার গাড়ির তেল পুড়িয়ে আমাকে তাদের পাহাড় দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে, তার ওপর বিশ প্যাকেট আমের রসই তো অনেক বেশি। আর কী নেব। ভদ্রতা দেখানোর জন্য বললাম, দামটা আমি দিই?
মোহসীন প্রায় রাগ করার ভঙ্গিতে বলল, কেন? তুমি তো আমার অতিথি। আজকের সব খরচ আমার।
কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের গাড়ি শহর অঞ্চল ছেড়ে মরুভূমির ভেতর দিয়ে চলা শুরু করল। বললাম, আমরা কোথায় যাচ্ছি? মোহসীন বলে, এই রাস্তা যেখানে গিয়ে শেষ হবে, সেখানে।
এরকম লং ড্রাইভে আলাদা উত্তেজনা কাজ করে। কোথায় যাচ্ছি, জানি না। যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, সেটা সে রকম গাড়ি চলার মতো রাস্তা নয়। আমিরাতের সড়কগুলোর মতো ওমান এখনও ততটা উন্নত হয়নি। মরুভূমির ভেতর দিয়ে বালু আর পাথরের টুকরা বিছানো পথ। ছোট রাস্তা। এই পথ দিয়ে গাড়ির চলাচল প্রায় নেই বললে চলে। মোহসীন বলল, এই রাস্তাগুলো ছিল মূলত বেদুইনদের চলার পথ। উট নিয়ে এইসব পথে আগের মানুষেরা চলত। উল্টা দিক থেকে গাড়ি ক্রস করতে হলে একটা গাড়িকে রাস্তা থেকে সরে যেতে হয়।
এ রকম রাস্তায় এর আগে যাওয়া হয়নি। ডানে বাঁয়ে বালুর সমুদ্র। সামনে, বেশ দূরে, সারি সারি পাহাড়। ধূসর বর্ণের। মোহসীনকে বললাম, এই পথ নিশ্চয়ই ওই পাহাড়ে গিয়ে শেষ হয়েছে।
মোহসীন বলে, আমরা শেষ পর্যন্তই যাব। আমি নিশ্চিত, মরুভূমির ওপর দিয়ে যেতে তোমার ভালো লাগবে।
মোহসীন যেখানে গিয়ে গাড়ি থেকে নামল, তা আমাকে অভিভূত করল না। ছোট্ট একটা ঝর্নাধারা। পাথরের ওপর দিয়ে খুব স্বচ্ছ, ঠাণ্ডা পানির প্রবাহ। দু’ পাশে অবশ্য পাথরের পাহাড়। একটা দুটো স্বল্পদীর্ঘ গাছ। ১০/১২ ফুট উঁচু হবে, তার বেশি নয়। মোহসীন বলে, কেমন লাগছে?
বলি, বেশ সুন্দর। কিন্তু আমাদের জাফলং বা মাধবকুণ্ডের কাছে এটা কিছুই না।
মোহসীন মন খারাপ করে ফেলল। সে বলল, চলো, ৪০ কিলোমিটার দূরে আরেকটি ঝর্নাধারা আছে, সেটা নিশ্চয়ই তোমার ভালো লাগবে। আমি আসলে সেখানেই যেতে চেয়েছিলাম—মাঝপথে এই জায়গায় নামলাম।
আমরা রওনা দিলাম ওমানের মাহদা অঞ্চলের দিকে।
১৬০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চলতে থাকে। দূরে একটা দুটো উট দেখা যায়। একবার মোহসীন বলে উঠল, ওই উটগুলো খুব খারাপ, ওরা মানুষ মেরে ফেলে।
‘মানুষ মারে কীভাবে?’
মোহসীন এবার আর কথা বলে না। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করি, ‘উটেরা মানুষ মারে কীভাবে?’
মোহসীন আরও জোরে গাড়ি চালায়। কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর হঠাৎ একটা পাহাড়ের মোড় ঘুরিয়ে গাড়িটা ব্রেক করে। আমাকে বলে, নামুন, আপনাকে একটা জিনিস দেখাব।
নেমে গেলাম। সাথে ছানুও।
মোহসীন বলে, একমাস আগে, আজকের দিনে, আমার বাগদত্তাকে একটা উট মেরে ফেলল।
চাচাতো বোনের সাথে মোহসীনের বিয়ে ঠিক করা হয়েছিল।
মেয়েটিকে তার পছন্দ ছোটবেলা থেকে। ঠিক হয়েছিল এ বছর জুলাই মাসে তার পরীক্ষা শেষ হলে দুজনের বিয়ে হবে।
এক মাস আগে এই দিনে মেয়েটিকে নিয়ে সে এই ঝর্না দেখতে এসেছিল। সাথে ছিল চাচা চাচী আর ওই চাচাতো বোন। ঝর্না দেখে আল-আইন ফেরার পথে এই জায়গায় সে যখন গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিল, তখন হঠাৎ করে একটা উট তার গাড়ির সামনে এসে পড়ল। গাড়ি চালাচ্ছিল খুব জোরে। পাহাড়ের বাঁক ঘুরিয়েই যখন দেখল উটটি রাস্তায়, তার গাড়ির সামনে, তখন শক্ত ব্রেক ধরা ছাড়া তার উপায় ছিল না। কিন্তু তাতেও রক্ষা হলো না তার গাড়িটির। উটের সাথে ধাক্কা লেগে গাড়িটি উল্টে যায়। মেয়েটি বসেছিল তার ডানপাশের সিটে। তাকে রক্ষা করা গেল না। স্পট ডেড।
খুব দ্রুত ঘটনাটির বর্ণনা দিয়ে মোহসীন নিচের বালুর দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।
মোহসীনকে সান্ত্বনা দেবার মতো ভাষা আমার জানা নেই। যে ভাষায় তার সাথে আমার ভাব বিনিময় হচ্ছে, সেই ভাষায় এসব পরিস্থিতিতে বেশি কিছু বলাও যায় না। আমিও তার সাথে খানিকক্ষণ চুপ করে রইলাম।
মোহসীন গাড়িতে উঠে পড়ল। সাথে আমিও। এতক্ষণ পর সে গাড়ির ক্যাসেট প্লেয়ারের বোতামে টিপ দিল। একটা আরবি গান। ধুমধারাক্কার মতো। বেশ মজাই পাচ্ছিলাম। কিন্তু তার ধারণা হলো, আমার হয়ত ভালো লাগছে না। মোহসীন পাল্টিয়ে আবুদাবি রেডিওর ইংরেজি গানের চ্যানেল অন করে দিল।
দীর্ঘক্ষণ পরে বললাম, তুমি কি প্রায়ই এখানে আসো? মোহসীন বলে, ‘না, আগে একবারই এসেছিলাম আমার প্রেমিকাকে নিয়ে। আজ এলাম শেষবার। আর আসব না।
- কেন?
: আমি সহ্য করতে পারব না, রাস্তাটি দেখলেই আমার তার কথা মনে পড়ে যাবে।
- তবে আজ এলে কেন?
আজকের দিনটির জন্য। গত মাসের ৮ তারিখে চলে গেল এখান থেকে। আজ জায়গাটা দেখে গেলাম।
ওর কথা শুনে আমার প্রতিক্রিয়া অন্যরকম হলো। এতক্ষণ মনে হয়েছিল, আমাকে দেখানোর জন্য এখানে নিয়ে এসেছে। কিন্তু এখন দেখছি, বিষয়টা সেরকম নয়। প্রেমিকার বিষণ্ণ স্মৃতির সাথে আমার আগমন নিতান্তই কাকতালীয় ঘটনা। আমার মনে হলো, তাকে আর ঘাঁটানো ঠিক না। বললাম, চলো আমরা আল-আইন চলে যাই, আর কোথাও যাব না। মোহসীন চিন্তিত স্বরে বলল, কেন? কেন যাবে না। এর কারণ ব্যাখা করতে ইচ্ছা হলো না। মুখে বললাম, তোমার মনটা খারাপ, এসময় তোমাকে আর ঘোরাতে চাই না।
কিন্তু মোহসীন মুখের অভিব্যক্তি পরিবর্তন করে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, ও কিছু না, আমরা এখন আরও বড় একটা পাথরের পাহাড়ের দিকে যাচ্ছি। ওটা তোমার ভালো লাগবেই।
অনেক পথ মাড়িয়ে পাহাড়ের গা ঘেঁষে আরেক জনপদে এসে হাজির হলাম। মোহসীনকে বললাম, তোমাদের এখানকার একটা নিখাদ গ্রাম দেখতে চাই। কিংবা ধরো গুহা-টুহা, যেখানে গরীব মানুষজন থাকে।
মোহসীন হাসে। বলে, সে রকম অবস্থা এখন নাই। বললাম, আমরা বইতে পড়েছি, আরবের লোকেরা গুহার ভেতরে বাস করত।
: তখন আমাদের তেল ছিল না, স্বর্ণ ছিল না, মানুষজন দরিদ্র ছিল।
আমি তাকাই মোহসীনের দিকে। মোহসীন কিছুক্ষণ কোনও শব্দ করে না। বেশ পরে, গাড়ি চালাতে চালাতে বলে, দেখি, তোমাকে একটা গ্রামে নিয়ে যাওয়া যায় কিনা। কিছু দূর গাড়ি চালিয়ে মোহসীন একটা ছোট রাস্তার ভেতর ঢুকে গেল। একটা পাহাড়ের পাশে গাড়ি থামিয়ে বলে, নামো, এটা একটা গ্রাম।
গ্রাম সম্পর্কে আমার ধারণা ভিন্ন। তাই আমি নামতে ইতস্তত করছি। ধূ-ধূ মরুভূমির মাঝে ধূসর বর্ণের কিছু ঘাস। অল্প উঁচু দু’ চারটি খেজুর গাছ। এর মাঝখানে একতলা পাকা বাড়ি একটা দুটো। এই হচ্ছে গ্রাম।
কিন্তু গাড়ি থেকে নেমে আমার চোখ টানল একটি উপত্যকা। এ উপত্যকায় খেজুর গাছের ছাউনির নিচে অনেক ছাগল প্যাঁ পোঁ করছে। একটা গাছ, তার নিচে চাদর বিছিয়ে বসে আছে এক বৃদ্ধ। মাথায় পাগড়ি।
মোহসীনকে বলি, ওই বুড়োর সাথে আমি কথা বলতে চাই। মোহসীন আমাকে দূরে দাঁড় করিয়ে লোকটির কাছে গেল। দুজন পরস্পরের নাক লাগিয়ে সম্ভাষণ জানাল। আরবিতে কথা হলো পরস্পরের। তারপর আমাকে নিয়ে তার কাছে গেল। এর মধ্যে বুড়ো আরেকটা চাদর বিছিয়ে বসতে দিল।
এই গাছতলায় বসতে যে কারও প্রশান্তি লাগার কথা।
বুড়োটির ব্যাপারে কৌতূহলী হয়ে পড়ি। ওর নাম আলী বিন সাইদ। বয়স কত, তিনি নিজেই জানেন না। তবে আমাদের অনুমান আশির উপর। বিয়ে করেছেন দুটো। ছেলেমেয়েরা সবাই শহরে থাকে। দুটো বৌ থাকে দূরের পারে বাড়িতে। তিনি কারও কাছে থাকতে পছন্দ করেন না।
না ছেলেমেয়ে, না বৌ। তার কতগুলো ছাগল আছে, সেগুলো চরান, ওগুলোর সাথেই একটা ভাঙা ঘর, যার বেড়া ও ছাদ খেজুর গাছের পাতা দিয়ে বানানো, সেখানেই থাকেন। এখানেই তার খাবার আসে বৌদের কাছ থেকে।
আলীর সাথে আমার কথাবার্তা বেশিদূর এগোতে পারে না। প্রথম কারণ দুজনের মাঝখানে যে দোভাষী, সেই মোহসীনও সব ইংরেজি বোঝে না, এর ওপর মোহসীনের কথা হলো, এই লোক যে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছে, সে ভাষাটি মোহসীন নিজেই ভালোভাবে বুঝছে না।
আলীর আস্তানায় একটা নোংরা প্লেটে ঢাকনা দিয়ে রাখা খেজুর এবং একটা ফ্লাস্ক আছে। ফ্লাস্কের মধ্যে ‘ঘাব’। মোহসীন বলল, এটাকে আরবি কফি বলে, তুমি খাবে?
দেখলাম, এক ধরনের চা পাতার নির্যাস, রং প্রায় কালো রঙের। একটা ছোট্ট কাপে দেয়া হলো সামান্য কফি। সবার আগে আমাকে। ইতস্তত না করে এক চুমুকে শেষ করে দিলাম। কোনও স্বাদ পেলাম না। আমার পর ওই কাপ বাড়িয়ে দেয়া হলো ছানুর দিকে। সে বাংলায় বলল আমাকে, ওসব খেয়েছি, আমি খাব না। সেই কাপ চলে গেল মোহসীনের হাতে। ও খুব যত্ন করে খেলো।
নোংরা প্লেটে অনেক খেজুর। পাশ দিয়ে মোটামুটি মাছি ভন ভন করছে। আলী আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন প্লেট। একটা খেজুর মুখে দিলাম। খেজুরের সাথে বালিও মেশানো আছে। কষ্ট করে একটা খেলাম। আলী গাছ দেখিয়ে কী যেন আরবিতে বলল। মোহসীন বুঝিয়ে দিল। এটা ওই গাছের খেজুর।
লোকটির ঐশ্বর্য আছে, বোঝা গেল। কিন্তু সে কিছুই ভোগ করতে চায় না। তার ছেলেরা চেয়েছিল এই পুরোনো বাড়ি ছেড়ে শহরে চলে যেতে, যেখানে বড় ভিলায় তারা থাকে। কিন্তু আলী যাবেন না। তাঁর কথা, আমি এইখানেই মরতে চাই। এই জায়গার মতো শান্তি শহরের বাড়িতে নেই।
আমার ক্রমাগত প্রশ্ন বৃদ্ধকে বিব্রত করে তুলল। এর মধ্যে আমি ক্যামেরা বের করে কয়েকটি ছবি তুলতে গেলাম। কিন্তু আলী চান না তার ছবি তুলি। নিষেধ করলেন। কারণ জানতে চাইলেন। কিন্তু তাকে সন্তুষ্ট করা গেল না। একসময় আরবিতে চিৎকার শুরু করে দিলেন এবং বসা অবস্থা থেকে দাঁড়িয়ে একটা লাঠি হাতে নিলেন।
মোহসীন আমাকে আগলে নিয়ে বলল, চলো, তাড়াতাড়ি বেরোই, ছবি তোলার জন্য এই লোক ক্ষেপে গেছে তোমার ওপর।
আমরা দ্রুত জায়গা ছাড়লাম। কিন্তু লোকটির কথা ভুলতে পারলাম না। তাকে আমার রহস্যময়ই মনে হলো। কিন্তু কেন? তার ক্ষেপে যাবার কারণটি আমার বোঝা হলো না। গাড়িতে উঠে এসে তাকিয়ে রইলাম তার আস্তানাটির দিকে। জানি, এই জনমে আর কখনও তার সাথে আমার দেখা হবে না।
মোহসীনকে জিজ্ঞেস করলাম, ওই লোক এমন আচরণ করল কেন? মোহসীন হাসে। বলে, লোকটি এমনিতেই বদমেজাজি। এই কারণে বৌ ছেলে-মেয়েরা তাকে আলাদা করে দিয়েছে। তোমার ওপর ক্ষেপেছে ছবি তোলার জন্য। সে চায় না, তার ছবি অন্য কেউ দেখুক।
এই বেদুইন বৃদ্ধকে ফেলে রেখে আমরা গেলাম কঠিন পাহাড় দেখতে। ওমানের মাহদা রাজ্যের শেষ প্রান্তে। সারি সারি পাহাড়। শিলা পাথরের পাহাড়। পৃথিবী সৃষ্টির পর যে কঠিন রূপান্তরিত শিলা ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে বালুরাশিতে পরিণত হয়েছে, তারই অবশিষ্টাংশ এখনও আছে পাঁচ হাজার কোটি বছর ধরে এইখানে। এ পাহাড়গুলোর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ক্ষুদ্র স্রোতস্বিনী। স্বচ্ছ, ঠাণ্ডা পানি। এ দুর্গম গিরিপথে খুব কম পর্যটকের আসা হয়। জনমানবহীন পাহাড়ের একটি শক্ত টিলার উপর উঠে বসে পড়লাম। তার অমসৃণ গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে মনে হলো, হয়ত এই পাথর এইমাত্র কোনও মানবের প্রথম স্পর্শ পেল।
নিচে নেমে গেছে মোহসীন। আমার সাহস হলো না। যদি উঠতে না পারি? মোহসীন উপরে ওঠে। হাতে একটা ভিস্তি। এর একটা আরবি নাম আছে, কিন্তু আমার সেটা মনে নেই। ছাগলের আস্ত চামড়া দিয়ে বানানো একটা জলাধার। অন্য কোনও জায়গা থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে এসে আটকা পড়েছিল কোনও এক পাথরের গায়ে। মোহসীন বলে, এইগুলো দিয়ে আগের বেদুইনরা পানি খেতো। যখন মাইলের পর মাইল উঠের পিঠে চড়ে তপ্ত মরুভূমি পার হতো, তখন সঙ্গে থাকত এই ভিস্তি। এইটাই ছিল জীবন ধারণের প্রধান খাবার।
এখন সেই সময় নেই। রাস্তার পাশে সরকারি নিয়ন্ত্রণে বসিয়ে রাখা হয়েছে ঠাণ্ডা পানির কল। টিপ দিলেই পানি আসে। মোহসীনের দাদারা উটে চড়ে যখন এ পাহাড়ে আসতেন, তখন ওই ছাগলের চামড়া দিয়ে বানানো ব্যাগটা ভরে পানি নিয়ে আসতেন জীবন বাঁচাতে। এখন মোহসীন আসে ল্যান্ডরোভারে করে। তার গাড়ির পেছনের সিট ভরা থাকে বোতল ভরা ঠাণ্ডা পানি, নানা জাতের ফলের রসের ব্যাগ। মোহসীন হয়ত তার দাদার জীবন যাপনের ওই তথ্যটিও জানে না। কারণ, ইতিহাস পড়া বা পড়াশোনার মতো পরিবেশ তাদের এখন মাত্র তৈরি হচ্ছে, ধীরে ধীরে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, মে ২৮, ২০১৫