আলাদিন একটু পর হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মারবে নুসরাতের মাথায়।
এখন সকাল।
হংরাজ লঞ্চ সকাল সকালই ঘাটে ভিড়েছিল। যাত্রীরা ভীত ছিল। প্রচণ্ড ভয়ে ঘাটে নেমে অনেকেই হড়হড় করে বমি করেছে। বাচ্চারা কেঁদেই যাচ্ছিল। নরক অবস্থা। নদীতে তেমন একটা ঢেউ হয়নি। ঝড়ো হাওয়াও ছিল না। বৃষ্টি হয়েছে যা একটু। যাত্রীরা কেন এমন আতংকিত হয়েছে কে জানে! এ রুটে যারা নিয়মিত যাতায়াত করে তাদের এত অল্পতে আতংকিত হবার কথা না।
এই লঞ্চেই এসেছে আলাদিন। মানুষ হিসেবে সে ভীতু। জলে ভীষণ ভয়। মাটিতে পা রেখেই শান্তি। অনেকদিন বাঁচার ইচ্ছে আলাদিনের। এত তাড়াহুড়ো করে মরার ইচ্ছে নেই।
লঞ্চ থেকে নেমেই নুসরাতের বাড়িতে চলে এসেছে আলাদিন। সকাল সকাল আলাদিনকে দেখে অবাক হয়েছে নুসরাত। গত ছয় মাস ধরে লোকটা আসা যাওয়ার মাঝেই থাকে। নুসরাতের স্বামীর সাথে চুটিয়ে আড্ডা দেয়। নুসরাতের বাচ্চাটার জন্য এটা ওটা কিনে নিয়ে আসে।
প্রথমদিকে নুসরাত অল্প বিরক্ত হতো। আসতে নিষেধ করলেও আলাদিন শুনত না। একসময় হাল ছেড়ে দিয়েছে নুসরাত। সে জানে আলাদিন ভীতু বটে কিন্তু একইসাথে নাছোড়বান্দা। এই নির্বিষ লোকটাকে দিয়ে কোনো ক্ষতি হবে না। আর যেহেতু তার স্বামী আলাদিনের সঙ্গ পছন্দ করছে তাই তাকে নিয়ে আর খুব বেশি ভেবে লাভ নেই। বাড়িতে এলেই আলাদিন অনেক কিছু নিয়ে আসে। উপহার আর কি। এসব খারাপ তো নয়।
আলাদিন আসে আর যায়। নুসরাতের স্বামীর সাথে সন্ধ্যার দিকে আড্ডা দেয়। রাত অবধি চলে আড্ডা। প্রায় প্রতিদিনই বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসে আলাদিন। গলা অব্দি গিলে জোর গলায় কথা বলতে থাকে আলাদিন আর নুসরাতের স্বামী হাবিব।
আলাদিনের সাথে প্রেম ছিল নুসরাতের। ছোট্টবেলার প্রেম। সেই একদম ল্যাদা ছিল তখন থেকে। আলাদিনের বাবার তখন রড সিমেন্টের ব্যবসা। শেখেরটেক ছয় নম্বরে চারুলতা ফ্যাশনের অপোজিটে দেড়শ’ স্কয়ার ফিটের ছোট্ট একটা দোকানে বসত আলাদিনের বাবা হাবিব সাহেব। তিনি তখন সাহেব ছিলেন না। কাস্টমাররা তাকে বলত হাইববা অথবা হাবি মিয়া।
হাবিব সাহেব ব্যবসাটা বুঝতেন। বাবার কাছ থেকে কিছু পাননি। শূন্য থেকে শুরু করেছেন। অল্প বয়সে বিয়ে করেছিলেন। কঠিন দায়-দায়িত্ব ছিল মাথার ওপর। হালকা-পাতলা রাজনীতি করতেন। এই রাজনীতিটা তার জীবন বদলে দিয়েছে। তিনি রাজনীতি নিয়ে থিতু হননি। ওসব তার পোষায় না। তিনি বলতেন, ‘ধুর, রাজনীতি ফাজনীতি বুঝি না। ট্যাকাই মরণ। ট্যাকাই জীবন। ’
এই যে টাকার প্রতি তার লোভ, ভালোবাসা এর জোরেই তিনি অনেক দূর গিয়েছেন। রাজনীতির প্রভাব খাটিয়ে একের পর এক কাজ এনেছেন। জমে উঠেছিল রড-সিমেন্টের ব্যবসা। এলাহি কারবার বলা চলে। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে এলাকা ও এলাকার বাইরের সব রাস্তা-কালভার্ট-বিজ্রের রড-সিমেন্ট তিনি সাপ্লাই দিয়ে কোটি কোটি টাকা বানিয়েছেন।
টাকা একবার আসা শুরু করলেই আসতেই থাকে। হাবিব সাহেব টাকার মূল্য বুঝতেন। পাঁচ বছরের উপার্জন দিয়ে আরামে জীবন পার করে দেওয়া যেত। কিন্তু হাবিব সাহেব নতুন নতুন ব্যবসায় হাত দিয়েছেন। আলাদিনের মনে পড়ে তার বয়স যখন দশ কি বারো তখনই তার বাবা ব্যবসার ব্যাপার স্যাপার তাকে বোঝানোর চেষ্টা করতেন। বলতেন, ‘ট্যাকা কঠিন জিনিস। তারে চুপচাপ রাইখা দিতে হয় না। ট্যাকার পাখনা আছে। উড়াল দিব। ট্যাকা খাটাইতে হইব। ট্যাকা দিয়া আরো ট্যাকা আনতে হইব। তইলেই না জীবন স্বার্থক। ’ আলাদিন এসব বোঝেনি। টাকা নিয়ে তার মাথা ব্যথা নেই। সে তার বাবার বড় হওয়া দেখেছে। ভেসপা থেকে বিএমডব্লিউ নিয়ে ঘুরে বেড়ানো সবই তার চোখের সামনে হয়েছে। ইট-বালু-সিমেন্ট থেকে শুরু করা ব্যবসা গার্মেন্টস অব্দি গিয়েছে।
হাবিব সাহেব নারায়ণগঞ্জে দুর্গের মতন বাড়ি বানিয়েছেন। তিনি সেখানেই থাকতেন। পড়াশোনা বেশি করেননি তাই বেশি জানেওয়ালা লোকজন এড়িয়ে চলতেন। তার ব্যবসায় এসব লোকের দরকার ছিল না। নিজের ব্যবসার সবকিছু নিজেই দেখাশোনা করতে পছন্দ করতেন হাবিব সাহেব। দান-খয়রাত পছন্দ ছিল না। তিনি বলতেন, ‘কাম করো মিয়ারা। ক্ষেমতা থাকলে আমার ফেক্টরিতেই চাকরি পাইবা। আর না হইলে না খাইয়া মরণ। আমার ট্যাকা আছে মানেই কি হুদামুদা সবাইরে বিলামু?’
হাবিব সাহেব পরিবারকে সময় দিতে পারতেন না। পরিবার বলতে শুধু আলাদিনই ছিল। আলাদিনের গরীব মা সারাদিন ঘ্যানঘ্যান করত। হাবিব সাহেব তাকে টাকাপয়সা দিয়ে ভাগিয়েছেন। তালাক দিয়েছেন। একজন উত্তরাধিকার দরকার তাই আলাদিনকে রেখে দেওয়া হয়েছিল। হাবিব মিয়া আর বিয়ে করেননি। নারী জাতির প্রতি তার আকর্ষণ কম বলেই জানত সবাই। সবাই এনিয়ে প্রশংসাও করত। যত মহাপুরুষই হোক না কেন নারীকে এড়ানো সহজ কথা নয়। হাবিব সাহেব তাই তো সফল হয়েছেন। লোকজন এই ধনী ব্যবসায়ীকে নিয়ে এমন করেই ভাবত।
সব ভাবনা বদলে যায় হাবিব সাহেব খুন হবার পর। রাতারাতি তিনি ভালো মানুষ থেকে ভিলেনে পরিণত হন। জানা যায় তিনি ব্যাংকে টাকা রাখতে পছন্দ করতেন না। ট্যাক্স ফাঁকি দেবার জন্য অল্প কিছু টাকা রাখতেন ব্যাংকে। বাকি সব তার দুর্গের মতন বাড়ির সিন্দুকগুলোয়। মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষ জানতে পারে এসব। সিন্দুক ভর্তি টাকার অপূর্ব সুন্দর ছবিও দেখতে পায় সাধারণ জনগন। রক্ত মাখা লাশ তার পাশে টাকার বান্ডেল। টাকার এমন সুন্দর ছবি সচরাচর দেখা যায় না। টাকা সুন্দর, হোক না সে সামান্য রক্ত মাখানো তাও।
নারী জাতির প্রতি লোকটার ভয়ংকর আকর্ষণের ব্যাপারেও জানাজানি হয়ে যায়। ফ্যাক্টরির অসহায় নারীদের সুযোগ নিতে তিনি ভুলতেন না। এসব চলত গোপনে। তিনি দারুণভাবেই সব গোপন রাখতে পেরেছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।
ধনী নারীদের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল না। তাদের না ঘাটানোর আরও একটি কারণ হলো এসব মেয়েরা বিপদজনক হয়। সব ফাঁস করে দেবার ভয় দেখাতে পারে। তাদের ভয় ডর কম। শরীর নষ্ট করলেও সমস্যা হয় না। অশিক্ষিত, গরীব মেয়েমানুষের ক্ষেত্রে এসব সমস্যা ছিল না। টাকা দিয়ে, জীবন আর সমাজের ভয় দেখিয়ে তাদের আটকে রাখা গিয়েছিল সহজেই।
মৃত্যুর পরেই যতসব ঝামেলা শুরু হয়। ফরফর করে সব ঘটনা বলতে শুরু করে মেয়েগুলো। মিডিয়া সুন্দর করে সেসব অনেক বেশি রং চড়িয়ে মানুষের সামনে নিয়ে আসে। সবাই জেনে যায় হাবিব মিয়ার রঙচঙে জীবনের গল্প।
আলাদিন এসব জানত। সে তার বাবাকে কাছে পায়নি। কাছে পায়নি মাকেও। বাবা ব্যস্ত থাকতেন কাজে। আর মাকে তো তাড়িয়েই দেওয়া হয়েছিল। নিষেধ ছিল বাসায় আসা। মাসোহারা পেয়ে মা আর আসার সাহস করতেন না। ইচ্ছেও হয়ত ছিল না। ছেলেকে নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই বলেই আলাদিনের ধারণা।
ছোটবেলা থেকেই আলাদিন একা। বড় হয়েছে কাজের লোকদের কাছে। নিজেকে গুটিয়ে রাখতেই ভালো লাগে ছেলেটার। কারো সাথে মিশতে ইচ্ছা করত না। চুপচাপ একাই ভালো। মানুষের মাঝে আসলেই লজ্জা যেন। এক কাজের বুয়া তাকে উদ্দেশ্য করে মাঝে মাঝে মজা করে বলত, ‘আলাদিন ভাইজানের মাইয়া মাইনষের লাহান শরম। ছ্যা। ’ আলাদিনের এসব শুনে মন খারাপ হতো। সে আরো বেশি বাইরের দুনিয়া থেকে লুকিয়ে রাখত নিজেকে। একা একটা ঘরে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত পার করতে তার খারাপ লাগত না।
ভালো লাগলেও উপায় ছিল না ঘরে থাকার। স্কুল, কলেজে যেতেই হতো। সেখানে সবাই মজা করত তাকে নিয়ে। স্কুল কামাই আর কতদিন! সব সহ্য করত আলাদিন। সব যন্ত্রণা। এই মস্ত পৃথিবীতে নিজেকে তার বেমানান মনে হতো। এই জায়গাটা যেন তার নয়। এখানকার সবকিছুই কেমন যেন চাঁছাছোলা।
নুসরাতের সাথে আলাদিনের পরিচয় কলেজে পড়ার সময়। নুসরাতের টাকার প্রতি লোভ। এটা ওটা কেনার শখ। আলাদিনকে ধনী ছেলেপেলেদের সাথে পড়ানোর ব্যাপারে আপত্তি ছিল হাবিব সাহেবের। কমদামি স্কুল, কলেজেই গিয়েছে আলাদিন। নুসরাত নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা। শখ পূরণের উপায় ছিল না মেয়েটার। নুসরাত তাই গোবেচারা আলাদিনের বন্ধু হয়। তাদের প্রেম হয়। প্রেম বলতে আলাদিনের নুসরাতের জন্য এটা ওটা কিনে দেওয়া আর আলাদিনের সাথে থেকে নুসরাতের সময় পার করা এই তো।
নুসরাতের কথা শোনার ধৈর্য প্রবল। চুপচাপ আলাদিন নুসরাতকে পেয়ে কথা শুরু করে। দুনিয়ার কথা। এত কথা জমা ছিল তার ভেতর কে জানত!
অদ্ভুত ব্যাপার হলো ছেলের হাতখরচের ব্যাপারে দিলদরিয়া ছিল হাবিব মিয়া। অতটুকুনই যেন ছিল পিতার দায়িত্ব, পুত্রের জন্য আদর। টাকা পেত বলেই নুসরাতকে দিত আলাদিন। টাকা দিয়ে তার কাজ কী!
তা প্রেম হয়ে গেল। হয় এসব। একটা বয়সে হরমোন টরমোনের কারণে আবেগ নাকি বেশি থাকে। নুসরাতই বলেছিল, ‘আলাদিন একসাথে আছি সারাজীবন। নো টেনশন। ’ একসাথে থাকার ইচ্ছে হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। টাকা পয়সার ঝামেলা নেই, যখন যা ইচ্ছে কিনে নেওয়া—এ নিশ্চয়তা ক’জন দিতে পারে শুনি?
প্রেম হলেও বিয়েটা আর হলো না। নুসরাত বড় হলো কিন্তু আলাদিন আর বড় হলো না। সেই এক বাচ্চাদের মতন আচরণ। সারাদিন এটা ওটা গল্প বলা। কোনো আদর সোহাগ নেই। ছেলে আর মেয়েদের মাঝে ওসব না হলে চলে নাকি! অনেকবার আলাদিনের ঠোঁটে চুমু খেয়েছে নুসরাত। আলাদিনের কোনো বিকার ছিল না। কেমন শীতল সব। অল্প কাপড় পড়েও আসা হয়েছিল সামনে। লাভ হয় নি। এসব নিয়ে আলাদিনের ভাবনা নেই।
জীবন নিয়ে বাজি ধরতে রাজি নয় নুসরাত। সে বুঝেছে টাকাই সব নয়। শরীরেরও চাহিদা আছে। সুন্দরী মেয়েদের পাত্রের অভাব হয় না। এক সরকারি চাকরি করা ইঞ্জিনিয়ার তাকে বিয়ে করে। ভালোই কামায় তার বর। ঘুষ নিয়ে একদম রমরমা অবস্থা। বিয়ের এক বছরের মাথায় একটা বাচ্চাও নিয়ে নেয় নুসরাত। সুখের সংসার। আলাদিনকে মনে রাখার সময় নেই। আলাদিন মনে রাখার মতন কিছু না।
নুসরাতের বর বিয়ের বছর বরগুনা ছিল তারপর বদলী হয়ে ভোলায় আসে। ভোলায় বসেই পত্রিকায়, টিভিতে জানা যায় আলাদিনের বাবার খুন হবার খবর। তার ব্যবসায় অংশীদার হওয়া লোকগুলো বিরোধের কারণে তাকে খুন করে। নোংরা কাহিনীগুলো বের হয়ে আসে। শুনে গা রি রি করে ঘৃণায়। তখন প্রসঙ্গক্রমে আলাদিনের কথা মনে পড়ে।
এজন্য না যে বেচারা বাবাকে হারিয়ে কী বিপদেই না আছে এখন—বরং এই জন্য যে, ছেলেটার অনেক টাকা সে টাকা কিভাবে খরচ হবে সেসব ভেবে। নুসরাতের পেটে আবার বাচ্চা আসে। নুসরাতের বর বাচ্চা আনার ব্যাপারে খুব পটু। নুসরাত প্রথম দিন দেখেই বুঝেছিল। নুসরাত ভালো আছে। খুব। এই ভালো থাকার পরিমাণটা আরো বাড়িয়েছে আলাদিন।
আলাদিন ভোলায় এসেছে খুব বেশিদিন হয়নি। সকালবেলা একদিন বাজারের দিকে যাচ্ছিল নুসরাত। বাসার কাঁচা বাজার সব নুসরাতই করে। দোকানদারের সাথে দরদাম করতে ভালোই লাগে। এমনই দরদাম করার সময় দূর থেকে তার ওপর নজর রাখা এক লোকের দিকে চোখ পড়ে। নুসরাত চালাক মেয়ে। তার বুঝতে দেরি হয় না যে এটা আলাদিন। সে অবাক হয়। কদিন ধরে নজর রাখছে কে জানে! আলাদিনের বয়স বেড়েছে। দাড়ি-গোফের জঙ্গলে ঢেকেছে মুখ তবুও চেনা যায়। কেমন এক অদ্ভুত সরলতা আছে তার চোখে। এই সরলতা এড়িয়ে যাওয়া যায় না।
নুসরাত জানতে চাওয়ার আগেই আলাদিন বলেছে সব। বলেছে তার বাবার নোংরামির কথা, মানুষের নোংরামির কথা। সব সামাল দিয়েছে সে। ব্যবসা সামলেছে। ব্যবসার অংশীদারদের হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে। ব্যবসা বড় করার চেষ্টা করছে। সব বলেছে আলাদিন। বলেছে, ‘ক্লান্ত লাগে নুসরাত। গল্প করার কেউ নাই বুঝলা। আমি বড় একা। ’
নুসরাতের সাথে অনেক আলাপ হয়েছিল সেদিন। একসাথে খেয়েছে। ঘুরে বেড়িয়েছে। নুসরাত আরো জানতে পেরেছে ভোলায় একটা ব্রিজ হবে। সেই ব্রিজের ইট-সিমেন্ট সাপ্লাইয়ের কাজ পেয়েছে আলাদিন। অনেক টাকার কাজ। নুসরাত লোভী হয়। টাকার প্রতি লোভ তার চিরদিনের।
আলাদিনকে বরের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় একদিন। বরকে আগেই চিনত আলাদিন। ইট-সিমেন্টের কাজটা পাবার জন্য অল্প কিছু ঘুষ দিতে হয়েছে। আলাদিন আজকাল এসব বোঝে। খুব ভালো বোঝে।
নুসরাতের বর আলাদিনের ভালো বন্ধু হয়ে যায়। যখনই নুসরাতের বাসায় আসা হয় আলাদিন বাদাম, শুকনো লঙ্কা, শিমের ডাল, কুমড়া, বিরুইর ডাল, তিত করলা, মিষ্টি কুমড়া, আম, কাঁঠাল এসব নিয়ে আসে। ভোলায় সবকিছুই যেন সস্তা। মেয়েরা উপহার পেলে খুশি। নুসরাতও আলাদিনের বাসায় আসা যাওয়াটা মেনে নেয়। বিরক্তির জায়গা এসে দখল করে ভালো লাগা। আলাদিন তার ভালো চায়। এটা ওটা নিয়ে আসে। বিনিময়ে নুসরাত তার সাথে গল্প করে। ব্যস, অপরাধ তো নয়।
ভালোই কাটে দিন। তারপর একদিন খবর আসে নুসরাত চলে যাবে বাগেরহাটে। তার বরের বদলির চাকরি। বাগেরহাটে টাকা-পয়সা আয় করবার সুযোগ আরো বেশি। নুসরাত খুশি হয়। বরের উন্নতিতে তার মুখে হাসি ফোটে। আলাদিনকে কিছু জানানো হয় না। জানানোর প্রয়োজন মনে করে না কেউ। আলাদিন কে?
আলাদিন জেনে যায়। সে এখন বড় ব্যবসায়ী। আর ছোট্টটি নেই। বোকা নেই। সে গোপনে বদলি ঠেকানোর চেষ্টা করে। লাভ হয় না। দেরি হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে টাকা থাকলেও অনেক কিছু করা সম্ভব না।
আলাদিনের মন খারাপ হয়। ভীষণ মন খারাপ হয়। আলাদিন ঢাকায় যায়। মন ভালো করবার চেষ্টা করে। কাজ হয় না। তারপর হংসরাজ লঞ্চে চেপে এক সকালে চলে আসে ভোলা। ব্যাগের ভেতর ঢাকা থেকে নিয়ে আসা একটা হাতুড়ি শুধু। নুসরাতের বাসায় যাবার সময় তার প্রিয় আনারস কিনে নিয়ে যাওয়া হয়। চোখে পিচুটি নিয়ে নুসরাত বাড়ির দরজা খোলে।
তার বর লক্ষ্মী। সকালে ফ্রিজ থেকে পাউরুটি আর কলা বের করে খেয়ে চলে যায় অফিসে। নুসরাতকে বিরক্ত করে না। বাড়ির কাজের মেয়েটা দরজা আটকায়। নুসরাত ঘুমায় সময় নিয়ে। পেটে বাচ্চা। এই সময়ে ঘুম, খাওয়া-দাওয়া ঠিকঠাক মতন হওয়া দরকার।
আলাদিনকে দেখে একটু বিরক্ত লাগে। ঘুম ছেড়ে উঠতে হলো তাই। অন্যকোনো কারণ নেই।
চোখের পিচুটি ধুয়ে নিয়ে আলাদিনের সামনে বসে। আলাদিন নুসরাতকে দেখে। কি সুন্দর! কাজের মেয়েটা আনারস কেটে নিয়ে আসে। নুসরাত খায়। আলাদিন খায় না। নুসরাত খায়, কাজের মেয়েটা খায়, নুসরাতের বাচ্চাটা খায়। তারপর হুঁশ হারায়। গভীর ঘুমে ডুবে যায়। আলাদিন খুশি হয়। আনারসে যে ঘুমের ওষুধ মেশানো হয়েছে সেটা কাজ করল দেখে ভালো লাগে।
আলাদিন হাতুড়ি দিয়ে বাড়িটা মেরেই বসে। হুঁশ নেই এটা আরো ভালোভাবে নিশ্চিত হবার জন্য নুসরাতের মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে আলাদিন। একটা-দুটো এভাবে আঘাত করতেই থাকে। তারপর থেতলানো মাথার নুসরাতকে নিয়ে বের হয়। কেরোসিন ঢেলে বাড়িতে লাগানো হয় আগুন। নুসরাতের বাচ্চাটা আর কাজের মেয়েটা ভেতরে। ওরা পুড়ুক। পুড়ে ছাই হোক। কোনো প্রমাণ থাকল না।
নুসরাতের দেহটা নিজের গাড়িতে ওঠায় আলাদিন। তারপর যায় হংসরাজ লঞ্চের দিকে। আজ সন্ধ্যায় লঞ্চ আবার রওনা দেবে ঢাকার উদ্দেশ্যে। নুসরাতকে ঢাকায় নিয়ে যাবে আলাদিন। এখন থেকে নুসরাত শুধু তার। শুধু তার।
২.
এই তো সন্ধে এখন। মরে যাওয়া নিস্তেজ আলো লেপ্টে আছে আকাশে। হংসরাজ ছাড়ার কথা এসময়। ছাড়ছে না।
আলাদিন মালিক তবুও কেউ তার কথা শুনছে না। হংসরাজের ছোট্ট একটা কেবিনে নুসরাতকে বুকের মধ্যে নিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে আলাদিন। রক্ত চারপাশটায়। শুকিয়ে গেছে।
কেবিনে ঢোকার পর থেকে আলাদিন অনেক গল্প করেছে নুসরাতের সাথে। গল্প করছে। এই তো চেয়েছিল সে। তবুও কেন জানি শান্তি পাচ্ছে না। নুসরাতের কাচ ভাঙা হাসিটা মিস করছে। মেয়েটা তার গল্প শুনে হাসত। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হাসি। মনে হতো সে হাসিতে কাচ ভাঙছে। আহারে সুন্দর। এই সুন্দরেই বেঁচে থাকতে হয়। বেঁচে থাকার ইচ্ছে জাগে। আলাদিনের অনেকদিন বাঁচার ইচ্ছে।
সে উপায় নেই। পুলিশ ঘিরে ফেলেছে লঞ্চ। মাইকিং করা হচ্ছে। তাকে কেবিন থেকে বের হতে বলা হচ্ছে। জড়ো হয়েছে রাজ্যের লোকজন। তারা আলাদিনের শাস্তি চায়। সবাই টের পেয়েছে তার কথা। খুব তাড়াতাড়ি জানাজানি হয়েছে। কেবিনের দরজা ভাঙার চেষ্টা চলছে। এভাবে চায়নি আলাদিন। কেউ তাকে ভালোবাসলো না। সেই শৈশব থেকে শুধু ঘৃণা করেই গেল। কেউ কি আলাদিনের জন্য একটু মন খারাপ করবে? দুঃখ করবে? তার কষ্টটা বুঝবে? তার গল্পটা শুনতে চাইবে?
আলাদিনের কেউ নেই। আলাদিনের কেউ কখনোই ছিল না। আলাদিনের মতন অমানুষদের জন্য কেউ থাকে না।
আলাদিন পকেট থেকে দেশলাই বাক্সটা বের করে। কেরোসিন দিয়ে ভেজায় নিজের আর নুসরাতের শরীর। নুসরাতকে কাছে টেনে বলে ‘ভালোবাসি। শোনো অনেক গল্প আছে। মন দিয়ে শুনবা কিন্তু। আচ্ছা?’—এরপর আগুন জ্বালায়। জ্বলতে থাকে সবকিছু। বাইরে থেকে লোকজন শুনতে পায় আলাদিনের চিৎকার। শরীর পোড়ার যন্ত্রণা ভয়ংকর। কি অদ্ভুত আলাদিনের প্রেম। কি ভীষণভাবে নিজেকে শেষ করে দেওয়া। আলাদিন পুড়ুক। পুড়ে পুড়ে মরুক। জীবিত থাকাকালেও তো কম পুড়তে হয়নি তাকে?
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪১ ঘণ্টা, জুন ৪, ২০১৫