সমরেশ মজুমদারের এই উপন্যাসটি ছাপা হয় বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এর ঈদ আয়োজন ২০১৪-এর ই-ম্যাগাজিনে। অনলাইনে এতো বিপুল আয়োজনে প্রকাশিত ই-ম্যাগাজিন এটাই প্রথম।
___________________________________
প্রথমবার ঘটনাটা ঘটেছিল মাসখানেক আগে। ঘটে যাওয়ার পর খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল অতনু। কোনো ব্যাখ্যা নেই, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে অনেকক্ষণ দেখে কোনো পরিবর্তন খুঁজে পায়নি। অথচ তার মতো একজন সাধারণ যুবক যে কি-না কম্পিউটার বিজ্ঞানের মিস্ত্রী থাকায় আশি হাজার টাকায় চাকুরি করে, তার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঘটে গেল। ট্যাক্সিতে চেপে অফিস থেকে ফিরছিল একটু তাড়াতাড়ি, যেন রাত না হয়, সেদিন সবে সন্ধ্যে নেমেছে। বেলেঘাটায় একটা রাস্তায়, ট্যাক্সিওয়ালা শর্টকাট করবে বলে, গাড়ি ঢোকাতেই অতনুর মনে পড়ল চন্দনদার কথা। বহুদিন যোগাযোগ নেই। এই রাস্তায় থাকেন। মনে পড়তেই ট্যাক্সিওয়ালাকে বাড়ির সামনে থামতে বলল সে। একটু অপেক্ষা করতে বলে সে ট্যাক্সি থেকে নেমে বেল বাজাল। চন্দনদার স্ত্রী বেলা বউদি দরজা খুলে চিৎকার করে উঠল, আরে তুমি? পথ ভুলে এলে—এই দ্যাখো, কে এসেছে? ভেতর থেকে চন্দনদার গলা ভেসে এলো, ‘কে এলো। ’
‘অতনু ঠাকুরপো। এসো এসো। তোমায় দেখে কী ভালো লাগছে। ’
‘কেমন আছো তোমরা?’
‘ভালো। আগামীকাল গোয়ায় বেড়াতে যাচ্ছি। এসো। ’
বেলা বউদি বসার ঘরে নিয়ে যেতেই অতনু দেখতে পেল, চন্দনদা টেবিলে তাস বিছিয়ে খেলছেন। পায়ের শব্দে মুখ তুললেন। হাসি মুখ। কিন্তু এ কী! অতনু অবাক হয়ে দেখল চন্দনদার মুখের ওপর কালো পর্দা ঝুলছে। তার কাঁধ, হাত, বুক স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে কিন্তু মুখ কালো পর্দার আড়ালে। একটু লক্ষ্য করতেই নাক, চোখ, চিবুক, কপাল ঝাপসা দেখা গেল, অর্থাৎ কালো ছায়াটা মুছল না।
‘আয়, বোস। তারপর কী মনে করে? চাকরি করছিস বলে ভুলে গেলি’ মজা করে কথা বলতে অভ্যস্ত চন্দনদা, এখনও সেইরকম বললেন।
আবার তাকাল অতনু। বেলা বউদির মুখ পরিষ্কার, কিন্তু চন্দনদার মুখ ঝাপসা। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার কি শরীর খারাপ?’
‘কোন দুঃখে শরীর খারাপ হবে রে? রোজ তিন কিলোমিটার হাঁটি। ’
‘আপনার প্রেসার ঠিক আছে তো?’
‘কী বলতে চাইছিস স্পষ্ট করে বল তো!’
‘চন্দনদা, আপনাকে দেখে আমার ভালো লাগছে না। বউদি বলল, কাল আপনারা গোয়ায় বেড়াতে যাচ্ছেন, তার আগে একবার ডাক্তারকে দেখিয়ে যান।
‘দূর। এতদিন পর এসে কি পাগলামি করছিস। ’ চন্দনদা বিরক্ত হলো।
বেলা বউদি বললেন, ‘অতনু যখন বলছে তখন একবার ডাক্তারের কাছে গেলেই তো হয়। তোমার যে বয়স হয়েছে তা মাথায় রেখো। ’
কিছুক্ষণ অন্য কথা বলে, অজুহাত দেখিয়ে চা না খেয়ে ফিরে এসেছিল অতনু। আর রাত দশটায় খবরটা এলো, চন্দনদা নেই। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক, ডাক্তার ডাকার সময় পাওয়া যায়নি।
হতভম্ব হয়ে বসেছিল অতনু। দু’দিন পর বেলা বউদির ফোন এলো, কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞাসা করলেন, আমরা তো কেউ বুঝতে পারিনি, তুমি কী করে বুঝলে?’
উত্তর দিতে পারেনি অতনু। কিন্তু বারবার মনে হয়েছে তখনই যদি চন্দনদাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হতো তাহলে তিনি বেঁচে যেতেন। কিন্তু আর কেউ চন্দনদার মুখে সেই ছায়াটাকে দেখতে পেল না, সে কী করে পেল? তখন মনে হচ্ছে ওটা নিশ্চয়ই মৃত্যুর ছায়া। ধ্যাৎ, এটা কি সম্ভব? নৈতিক গপ্পো নাকি। মৃত্যুর আগে তার ছায়া নেমে আসে মানুষের মুখে? পাগলও শুনে হাসছে। তারপর থেকেই অভ্যেসটা তৈরি হয়ে গেল অতনুর। একা থাকলেই আয়নায় নিজের মুখ দ্যাখে। নিজের চোখ, চোখের তারা কিন্তু কোনো অস্বাভাবিকত্ব নজরে পড়ে না।
দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটেছিল এক রবিবার বিকেলে। গড়িয়াহাটার মোড়ে পুরনো গানের সিডি কিনতে গিয়েছিল সে। ছুটির দিনের এই সময়ে মানুষেরা কেনাকাটা করতে বেরিয়েছে। কারো মুখে হাসি, কেউ স্বাভাবিক, কেউ গম্ভীর, কেউ বিরক্ত হয়ে হাঁটছে। মুখগুলো দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল এঁদের প্রত্যেকের নিজের নিজের সমস্যা আছে, যা ওরা খুব গুরুত্ব দিয়ে ভাবে। আর এই দেখতে গিয়ে সে একটি মুখ কাছে আসতেই চমকে উঠল। চন্দনদার মুখের ওপর যেমন কালো ছায়া ঝুলছিল এঁর মুখেও অবিকল তাই দেখতে পাচ্ছে সে। অতনু ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, ‘এক্সকিউজ মি!’
‘বলুন?’ ভদ্রলোক তাকালেন কিন্তু ওঁর চোখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না অতনু।
‘আমার নাম অতনু। আপনার সঙ্গে পরিচয় নেই। আপনি কোথায় থাকেন?’
‘ডোভার লেনে, কেন?’
‘আপনাকে অনুরোধ করছি, তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরে গিয়ে ডাক্তার দেখান। ’
‘আরে! খামোকা ডাক্তার দেখাতে যাব কেন? কী হয়েছে আমার? আর আপনি কে? গায়ে পড়ে উপদেশ দিতে এসেছেন কেন?’ ভদ্রলোক রেগে গেলেন।
সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন ছেলে এগিয়ে এলো। একজন জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে কাকাবাবু?’
ভদ্রলোক পরিচিত ছেলেকে দেখে আরও জোর পেলেন। তার অভিযোগ জানালেন।
অতনুকে ভর্ৎসনা করল ওরা। কোনোরকমে চেলে এলো সে। কিন্তু পরের দিন খবরের কাগজের পঞ্চম পাতায় চোখ রাখতেই সে চমকে উঠল। ভদ্রলোক মারা গেছেন। এটা খবর নয়। খবর হলো, মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে গড়িয়াহাটার মোড়ে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি আগ বাড়িয়ে এসে তাকে ডাক্তার দেখাতে বলেছিলেন। সেই সময় ভদ্রলোক সম্পূর্ণ সুস্থ থাকায় উপদেশটি আমলে নেননি। সাংবাদিক লিখেছেন, ওই অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি ফুটপাতে তাকে দেখে কী করে মৃত্যুর আগামবার্তা পেলেন?
ঢোঁক গিলল অতনু। অফিসে গিয়ে শুনল এ ব্যাপারটা নিয়েই সবাই কথা বলছে। মৃত্যু আসছে তা কোনো মানুষ আগাম ঘোষণা করতে পারে? এক্ষেত্রে ঘোষণা করা হয়নি বটে কিন্তু ডাক্তারের কাছে যেতে বলা হয়েছে, সেটা তো ঘুরিয়েই বলা। কেউ বলল, ‘এটা একটা কাকতালীয় ঘটনা। কোনো মানুষের পাগলামি ছাড়া কিছু নয়। ’
এই দুটো ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর অতনুর অস্বস্তি বেড়ে গেল। কেউ কথা বললে তার মুখের দিকে তাকালে ভয় হয় তার। যদি কালো ছায়া দেখতে পায়। কিন্তু সে নিজেকে বোঝাল, না। ভয় পেলে চলবে না। যদি কালো ছায়া দেখতে পায় তাহলে এবার থেকে জোর করে লোকটিকে নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়ে ডাক্তারকে বলবে পরীক্ষা করে ফেলতে। হয়ত তার ফলে লোকটি বেঁচে যাবে।
বাড়িতে মা ছাড়া কেউ নেই। সকালে উঠে মায়ের মুখ পরিষ্কার দেখলে আনন্দ হয়। আজ মা বললেন, ‘সামনের রবিবার বিকেলে বাড়িতে থাকিস। ’
‘কী ব্যাপার?’
‘তোর বড়মামা এক ভদ্রলোককে নিয়ে আসবেন। ’
‘আবার ঝামেলা করছো। এর আগেরবার ভদ্রলোক এক মেয়ের ছবি দিয়ে গেল। সেই ছবি দেখে তুমিই নাকচ করে দিয়েছিলে। আর কেন?’
‘এবার তাই আগেই তোর বড়মামাকে দিয়ে ছবি আনিয়েছি। পয়সাকড়ি যাক। আর কতদিন আমি সংসার আগলে রাখব?’ মা চলে গেলেন পাশের ঘরে।
দ্বিতীয় কিস্তি পড়তে ক্লিক করুন
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৫ ঘণ্টা, জুন ১০, ২০১৫
শিল্প-সাহিত্য
সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস | হাসপাতাল কত দূরে (কিস্তি ১)
ধারাবাহিক উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।