ওর নাম জিসেলা।
অন্য মেয়েদের ওকে ওই নামে ডাকতে শুনেছি।
একদিন ও আমাকে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী?
বললাম, নক্ষত্র।
ইংরেজি অর্থটা বলবে?
বললাম, গ্যালাক্সি।
ওয়াও! দারুণ নাম! তুমি তো আকাশে জ্বলজ্বল করো। শোনো তোমার বাংলা নাম আমি উচ্চারণ করতে পারব না। তোমাকে আমি গ্যালাক্সি ডাকি?
ডাকো। ভালোই তো তুমি আমাকে একটি নতুন নাম দিলে। থ্যাঙ্কু জিসেলা। তোমার নামের অর্থ কী?
অর্থ—অর্থ— তারপর ঠোঁট উল্টে, চোখ বড় করে বলে, জানি না।
আমি হো-হো করে হেসে বলি, যার নামের অর্থ নেই তার আইডেনটিটি নেই। তুমি কোন দেশ থেকে এসেছো?
সুইজারল্যান্ড। আর তুমি?
বাংলাদেশ।
ওহ, বাংলাদেশ। শুনেছি অনেক বন্যা-সাইক্লোন হয়। খুব গরীব দেশ। জনসংখ্যা বেশি। যাই, ওই যে ওরা আমাকে ডাকছে।
ও আমার উত্তরের জন্য দাঁড়ায় না। আমার রাগ হয়। নিজের দেশ সম্পর্কে ওর মনোভাব জেনে আমি এত আহত হই যে, ওর সঙ্গে আর কথা বলব না বলে ঠিক করি।
আমি এখন জাপানের হিরোশিমায়। লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল, জাপান আয়োজিত ইয়ুথ এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে অংশ নিতে আমি এখানে এসেছি। পৃথিবীর পঁয়ত্রিশটি দেশ থেকে তরুণ-তরুণীরা এসেছে। বেশ একটি জমকালো মিলনমেলা। হিরোশিমায় শান্তিপার্ক আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহতদের স্মরণে তৈরি হয়েছে। আমি এখানে এসে আনন্দ পাই। মন খারাপ মনোভাব নিয়ে দূর-পাহাড়ের নীলাভ চূড়ার দিকে তাকিয়ে থাকি।
দু’দিন পর জিসেলা আমাকে দেখে এগিয়ে এসে বলে, আমি খেয়াল করেছি তুমি শান্তিপার্কে যেতে খুব পছন্দ করো গ্যালাক্সি।
হ্যাঁ, করি। ওখানে গেলে আমার যুদ্ধের ভয়াবহতার কথা মনে হয়। আর আমি প্রকৃতির কাছে ফিরে যেতে চাই।
আমারও এমন মনে হয় গ্যালাক্সি। আমিও নেচার খুব ভালোবাসি।
আমি ওর চকচকে সুন্দর চোখের দিকে তাকাই। ওর মুগ্ধতা আমাকে স্পর্শ করে। ও আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘোরায়। আমার মনে হয় ও আমার দৃষ্টি বুঝতে পেরেছে। ও বেশ লম্বা এবং ছিপছিপে। আমার মাথার ওপর দু’ইঞ্চি তো হবেই। আমি ওর উচ্চতা এনজয় করি। ও আবার মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করে, তোমার হবি কী গ্যালাক্সি?
ফটোগ্রাফি।
আমিও ফটোগ্রাফি ভীষণ পছন্দ করি। তোমার সঙ্গে আমার বেশ মিল। গ্যালাক্সি চলো শান্তিপার্কে গিয়ে বসি।
ও আমার হাত ধরে টানে। তারপর ঘাড়ে হাত রাখে।
এক সময় পনেরো দিনের প্রোগ্রাম শেষ হয়ে যায়। সবাই সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়। জিসেলা বলে, পৃথিবী বেশি বড় না। ঘুরেফিরে আবার আমাদের দেখা হতে পারে।
আমি ওকে আমার ই-মেইল আর বাড়ির ঠিকানা দিয়ে বলি, আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারো। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনই আমার দেশে আছে। সুন্দরবন। তুমি তো নেচার ভালোবাসো। বেড়াতে এসো।
ও প্রথমে উচ্ছ্বসিত হয়। ঘন ঘন মাথা নাড়ে। তারপর শুকনো মুখে বলে, তোমাদের দেশে গেলে ড্রাই ফুড নিতে হবে গ্যালাক্সি?
হ্যাঁ, হবে।
আমি রেগেমেগে উত্তর দেই। বিদায়ের সময় আনন্দ নিয়ে না ফিরে আমি ক্রোধ নিয়ে ফিরি। পাশাপাশি এও বুঝতে পারি যে, জিসেলাকে আমি ভুলতে পারব না। ওর চোখ আমার মুগ্ধতা। আমার দেশ নিয়ে ওর জিজ্ঞাসা আমার ক্রোধ। জীবনের জন্য দুটোই ভীষণ প্রয়োজনীয়। এই বিশ্বাস আমার ভেতরে দৃঢ় হয়।
দেশে ফিরে বছরখানেকের মাথায় বি.এ. পরীক্ষা দেই। বেশি ডিগ্রির জন্য প্রতিযোগিতা আমার পছন্দের বিষয় নয়। আমাকে সুন্দরবন টানছে। বাবার ব্যবসা হলো ট্রাভেল ট্যুর আয়োজন। পর্যটকদের গাইড হতাম আমি। ইদানীং বাবা দুটো ছোট শিপ কিনে সুন্দরবনে বেড়ানোর ব্যবস্থা করেছেন। আমি মহাখুশি। সুন্দরবন গিয়ে প্রকৃতির ছবি তোলার সুযোগ আমাকে পাগল করে দেয়। আমি ছয় মাসের বেশি সময় সুন্দরবনে কাটিয়ে দেই।
মাঝে মাঝে জিসেলা ই-মেইল করে। একদিন লেখে, জাপানে যত ছেলে-বন্ধু হয়েছিল, তার মধ্যে আমার কথাই ওর বেশি মনে হয়। আমি যেন ওকে রোজ ই-মেইল করি।
আমি ওকে সুন্দরবনের কথা লিখি। বাঘ-হরিণ-কুমির ইত্যাদি বড় প্রাণীর পাশাপাশি শামুক, ঝিনুক, প্রজাপতি, ঘাসফড়িং, ঘাসের কথা লিখি। এসব বর্ণনা ওকে মোহিত করে। ও আর জানতে চায় না যে আমার দেশটা কত গরীব। একদিন ই-মেইল আসে যে ও স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নিয়েছে। ওর খুব ইচ্ছে একদিন বাংলাদেশে বেড়াতে আসবে। আমি হাসি। ওর আগ্রহে মজা পাই। ও একদিন লিখল, সুন্দরবন না দেখলে ওর পৃথিবীর প্রকৃতি দেখা সম্পূর্ণ হবে না। কয়দিন পরে লিখল, ও রেইন ফরেস্ট দেখার জন্য ব্রাজিল যাচ্ছে। আমার ঈর্ষা হয়। আমি ওর ই-মেইলের উত্তর দেই না।
মাঝে দু’বছর পেরিয়ে গেছে।
আমি শুশুক নিয়ে মনোযোগী হয়ে পড়ি। নদীতে শুশুক দেখে আমার কৌতূহল হয়। আমি শুশুকের ওপর বই সংগ্রহ করি। বাইনোকুলার দিয়ে দূরের শুশুক দেখি। ক্যামেরা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি যে কখন লাফ দিলে একটা ছবি তুলতে পারব।
একদিন সাগরের মোহনায় বোটের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে পড়তে থাকি শুশুকের কথা : “সত্যিকারের নদীর ডলফিন সাগরের ডলফিনের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। এদের ঠোঁট লম্বা এবং চোখ খুব ছোট। নদীর ডলফিন শুশুকের দৃষ্টিশক্তি খুব দুর্বল। নদীর যে ঘোলা পানিতে এদের বসবাস সেখানে দৃষ্টিশক্তির খুব একটা প্রয়োজন হয় না। তাই দৃষ্টিশক্তির বদলে এদের ইকোলেকেশন শক্তি অত্যন্ত প্রখর। শরীরের দু’পাশের বড় পাখনা ও নমনীয় ঘাড়ের জন্য এরা সহজে চলাফেরা করতে পারে। শুশুক অনেক সময় কাৎ হয়েও সাঁতার কাটে। বড় পাখনার সাহায্যে এরা নদীর তলদেশ স্পর্শ করে পথ নির্ধারণ করে। শুশুক সমাজবদ্ধ প্রাণী নয়। সাধারণত এরা একা থাকতে পছন্দ করে। তবে অনেক সময় নদীর বাঁকে ও মোহনায় এদেরকে ছোট ছোট দলে দেখা যায়। কিছু প্রজাতির ডলফিন নদী ও সাগর উভয় স্থানেই দেখা যায়। এদেরই একটি হচ্ছে ইরাবতী ডলফিন। আমাদের দেশে এরা সুন্দরবনের মিঠা পানির নদী এবং বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলে বাস করে। এশিয়ার অনেক বড় নদীর উজানেও এদেরকে দেখা যায়, তবে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা নদীতে নয়। এমনও হতে পারে, সত্যিকারের নদী বিশেষজ্ঞ ‘শুশুক’-এর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না পেরে ইরাবতী ডলফিন এই নদীগুলো থেকে সরে গেছে। ” এটুকু পড়তে না পড়তেই নদীর জল ঝাঁপিয়ে চার-পাঁচটা শুশুক লাফ দেয়। আমি ঝটপট ছবি তুলি। আনন্দে বুক ভরে যায়। আর ইরাবতী ডলফিন, আমার মাথায় স্থির হয়ে যায়, ভাবি কী সুন্দর নাম!
ঢাকায় ফিরে ডলফিনের ছবি পাঠাই জিসেলাকে। ছবি পেয়ে ও আমাকে ফোন করে।
গ্যালাক্সি দারুণ ছবি পাঠিয়েছো।
নেচারকে খুঁজে পাচ্ছো ছবিতে?
আমি মুগ্ধ। আমি তোমার সঙ্গে নদীতে ঘুরে ঘুরে ডলফিন দেখতে চাই গ্যালাক্সি।
আমি বিস্ময় প্রকাশ করে বলি, তুমি আসতে চাও?
প্রবল আগ্রহ জিসেলার কণ্ঠে, হ্যাঁ আসতে চাই।
কবে আসবে আমাকে জানিও। আমি তোমার থাকার ব্যবস্থা করব। আর শোনো, ড্রাই ফুড আনার চিন্তা করো না যেন। এসে দেখ, দেশটা কেমন!
শুনতে পাই জিসেলার প্রাণোচ্ছল হাসি। আমি চুপচাপ ওর হাসি উপভোগ করি। আমার ভেতরটায় নদীর শীতল বাতাস ভরে যেতে থাকে। অনবরত মনে হয় বড় মনোরম জীবনের এই স্নিগ্ধতা। ওহ, পুরো মহাদেশ ছুঁয়ে আসা হাসির তরঙ্গ আমার সুন্দরবন ঘিরে থাকা নদীগুলোতে কল্লোলিত হয়।
হাসি থামলে ও বলে, গ্যালাক্সি একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
করো। হেসিটেট করছো কেন?
তুমি কি কাউকে ভালোবাসো গ্যালাক্সি?
আমি হা-হা করে হাসতে হাসতে বলি, প্রকৃতির প্রেমে ডুবে আছি। নারীকে ভালোবাসার সময় পাইনি।
নারীকে ভালোবাসবে না?
অবশ্যই বাসব। তেমন একজনকে, যার হাত ধরে দু’জনে প্রকৃতির মধ্যে হেঁটে যাব।
আবার হাসি। তারপর শুনতে পাই হাসিভরা কণ্ঠ, বাই গ্যালাক্সি।
ফোন কেটে যায়।
আমি ওর আসার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলি। বাংলাদেশকে নিয়ে যার এত উল্টো ধারণা, তার আসা বা না আসায় কী আসে-যায়। নিজের মুহূর্তিক আবেগের জন্য চুল টেনে ধরি। আবার নিজের জগতে ব্যস্ত হয়ে উঠি।
একদিন জিসেলার ফোন পাই। বলে, গ্যালাক্সি আমি ঢাকা এয়ারপোর্টে।
আমি বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠি, এয়ারপোর্টে?
আমি এসেছি। তোমাকে সারপ্রাইজ দেবো বলে আগে জানাইনি।
আমি ওকে আনতে এয়ারপোর্টে যাই। সবকিছুই ঠিকঠাক। ও দেখেশুনে বলে, এত সুন্দর দেশ। এত সুন্দর মানুষেরা। আমার খুব ভালো লাগছে।
আমাদের দিন পনেরো কেটে যায় সুন্দরবন এবং নদীতে। জিসেলার ভালোলাগার আবেশ ফুরোয় না। বলে, এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমি দেখিনি। কোনো চাকরি পেলে আমি এই দেশে কিছুকাল কাটিয়ে যাব।
জিসেলার মুগ্ধতা আমি টের পাই। ও একদিন বলে, চলো আমরা ডলফিন নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি বানাই। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেল দেখলে প্রচার করার জন্য পাগল হয়ে যাবে।
থ্যাঙ্কু জিসেলা, আমার দেশ নিয়ে তোমার রিয়ালাইজেশনের জন্য।
লজ্জা দিও না।
ও আমার দিকে না তাকিয়ে কথাটা বলে। আমি আমার স্বপ্নের কণ্ঠস্বর ওর মধ্যে ধ্বনিত হতে শুনি। বলি, তোমার এই ডকুমেন্টারি বানানোর আইডিয়া আজ রাতে সেলিব্রেট করব।
ও ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকায়। ওর উজ্জ্বল চোখ ঝকঝক করে। সুন্দরবনের ওপর থেকে বয়ে আসা বাতাস ওকে মোহনীয় করে দেয়। বলে, কীভাবে গ্যালাক্সি?
কটকায় নেমে বার-বি-কিউর আয়োজন করব। দেখবে, অন্ধকারে হরিণের চোখ কত জ্বলজ্বল করে।
আমিও রাতটা সেলিব্রেট করতে চাই।
জিজ্ঞেস করি, কীভাবে?
আমার ব্যাগে কন্ট্রাসেপটিভ আছে।
জিসেলা কন্ট্রাসেপটিভ!
ও মৃদু হেসে বলে, হ্যাঁ। আমি তো তোমার কাছেই এসেছি। আই লাভ ইউ।
গভীর রাতে জিসেলার শরীরে মুখ রেখে বলি, তুমিই আমার ইরাবতী ডলফিন।
বাংলাদেশ সময়: ১৮২০ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০১৫