ঢাকা, শনিবার, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

বৃষ্টির জন্মভূমি | ধ্রুব এষ (কিস্তি ২)

ধারাবাহিক উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৩ ঘণ্টা, জুন ১৮, ২০১৫
বৃষ্টির জন্মভূমি | ধ্রুব এষ (কিস্তি ২) অলংকরণ : মাহবুবুল হক

প্রথম কিস্তি পড়তে ক্লিক করুন

২.
ঝুমম্ম্ম্ম বৃষ্টি।
কতক্ষণ হলো?
তেইশ-চব্বিশ মিনিট।


তিনশ’ আটষট্টি কিলোমিটার দূরের সেই শহরে একটা নাম আছে এই বৃষ্টির। ছাগলতাড়ানো বৃষ্টি।
তাও ভালো।

ঢাকায় কেউ ছাগল তাড়াক না তাড়াক অল্প শীতল হলো নগরী। টেলিভিশনে নিশ্চয় এখন দেখাচ্ছে। দৈনিক পত্রিকা কি ছাপা হয়ে গেছে? সাড়ে এগারোটা-পৌনে বারোটায় দৈনিক বাংলা এলাকায় গেলে পরদিনের দৈনিক পত্রিকা দেখা যায়। বাসে দেশের বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছে। নগর সংস্করণে শুধু ছাপা হবে তাহলে, গভীর রাতে বৃষ্টি, জনজীবনে স্বস্তি।

ছাদে থাকা যায়নি বৃষ্টিতে। চিলেকোঠায় উঠেও না।
ঘরে বসে বৃষ্টি দেখতে হয়েছে। জানালার এক পাট খুলে। সা সা সা সা। বৃষ্টি আর হাওয়ার চোটপাট। বিদ্যুৎ চমকালে দেখা যাচ্ছিল।
বৃষ্টি নেই আর।
তবে আবার হবে।
এই মাত্র আবার বিদ্যুৎ চমকাল।
সরে বসল। সে।
দেখছে না বা দেখবে না অবশ্য কেউ।
ঘর অন্ধকার।
সে কী করছে? বসে আছে শুধু?
শুধু শুধু?
না।
ওত পেতে আছে।

উল্টোদিকের হাউজিং কমপ্লেক্সের একটা ফ্ল্যাট এখনও ঘুমায়নি। ছয়তলায়, এদিকের। এই ফ্ল্যাট আরো রাত করে ঘুমায়। আজব টাইপের কিছু দৃশ্যের জন্ম দিয়ে। এমনিও আজব। ফ্ল্যাটে একটা এন্টিক এনালগ টেলিফোন আছে। ভারমিলিয়ন রেড রঙের। জানালার পাশে রাখা বলে দেখা যায়।

জানালা খোলা। পর্দা সরানো।
ক্রিরিরিং! ক্রিরিরিং!
ফোন বাজছে।
এত রাতে!
ক্রিরিরিং! ক্রিরিরিং!
ক্রিরিরিং! ক্রিরিরিং!
ধরছে না কেন কেউ?

সাদা ছাগলটা এসে না ধরলে হয়। বিচিত্র জিনিস। ট্যালকম পাউডারের মতো সাদা। চিবুকে গোটি। ডার্কগ্লাস পরে, যখন ঘুমায় মনে হয় তখনও। রঙচঙে টি-শার্ট এবং বারমুড়া পরে। স্পাইক করা চুল। বয়স কত হবে? বেয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ। একমাত্র পুংলিঙ্গ ফ্ল্যাটের।

ক্রিরিরিং! ক্রিরিরিং!
সবুজ একটা রং ঝিলিক দিয়ে উঠল।
আজব ফ্ল্যাটের ভেতরের ঘরের দরজায়।
টিয়ারং সবুজ।
লো নেক একটা স্লিভলেস গেঞ্জি আর স্কিন কালারের টাইটস পরেছে মেয়েটা? নাকি ইয়ে... কিছু পরেনি?
ব্রা-র স্ট্র্যাপ দেখা যাচ্ছে। পার্পল রঙের।
সকালে এই মেয়েটা ‘বারিস্তা’য় ছিল। কারওয়ান বাজারে। নপ (Nop) লেখা সাদা টি-শার্ট আর রঙিন লেগিংস পরে ছিল। কফি খাচ্ছিল। একা।
নিশ্চিত এই মেয়েটাই।
জানালার পাশে দাঁড়াল মেয়েটা।
ফিগারের প্রোফাইল। সবুজ রঙের বুক।
রিসিভার ওঠাল।
‘হ্যালো?... হোয়াট? ইউ লুসিফার...!’
লাইন কেটে গেল মনে হয়।
বাজে একটা কথা বলল মেয়েটা। স্ল্যাং। সাংঘাতিক স্ল্যাং। কিন্তু সে যা বলল তা কী সে করতে পারবে? হা! হা! হা! কে ফোন করেছিল? কোনো একটা ছেলে?

রিসিভার রেখে কিছুক্ষণ এদিকে তাকিয়ে থাকল মেয়েটা। অন্ধকার দেখল? দেখল বা দেখল না। ঘুরে লাইট নিভিয়ে দিল। অন্ধকার হয়ে গেল দৃশ্যের জানালা। আজ আর কিছু দেখা যাবে না! ঠিক আছে, কাল দেখা যাবে। না হলে পরশু। না হলে তরশু।

পাখি শিস দিল। টুইট! টুইট!
ফোনের রিংটোন।
কে?
না দেখে ধরল।
‘হ্যালো। ’
‘কী করো-ও?’
এই হাসকি কে?

চেনাশোনা কেউ না। চেনাশোনার মধ্যে হাসকি তিনজন। উস্কানিমূলক শামায়লা হাবিব, বন্ধুপত্নী বিন্দুবাসিনী এবং নরকঙ্কাল কমরেড পাশা। হাড়সর্বস্ব বলে নরকঙ্কাল কিন্তু কমরেড পাশা কেন কমরেড, পরিচিত কেউ অবগত না। কমিউনিজমপন্থী না কমরেড। কমিউনিস্টদের দেখতে পারে না। তাহলে কেন? অত্যুৎসাহী ছেলেপুলেরা উইকিপিডিয়ায় সার্চ দিয়ে দেখেছে, গুগল ইঞ্জিনে সার্চ দিয়ে দেখেছে। কোনো তথ্য নেই—মহান কমরেড পাশা কী রূপে কমরেড হইলেন?

‘অ্যাই-ই-ই-ই!’
‘অ। হ্যাঁ। কী?’
‘কী-ই-ই মানে? তুকি কী মরো?’
কথা ফাম্বল হচ্ছে। তুমি ‘তুকি’ হয়ে গেছে, ‘করো’ হয়ে গেছে ‘মরো’।
সে কী মরে?
কী বলবে হাসকিকে?
বলল, ‘সিনেমা দেখি। ’
‘সিনেমা দেখ-ও? এমা! এত রাতে কী সিনেমা দেখো?’
‘এত রাতে কী সিনেমা দেখা যায়, সোনা?’
‘কী-ই সিনেমা?’
‘পর্নো ফিল্ম। পর্নো ফিল্ম দেখি। ’
‘কী-ই-ই?’
‘পর্নো, ব্লু ফিল্ম। নটি আমেরিকা। ছয় নম্বর ভলিউম। আমেরিকান ব্ল্যাক একটা ছেলে আর হোয়াইট একটা মেয়ে। ’
‘কী-ই-ই? অ্যাই! আপনি কে? হু আর ইউ? হু আর ইউ?’
‘বাংলায় কথা বল ছাগলি কোথাকার!’
‘কী? কী? কী?’
‘তুই কে লো?’
‘কী-ই-ই? অ্যাই ইয়ের বাচ্চা!’
‘কিয়ের বাচ্চা, হ্যাঁ? দ্য কাউ ইজ আ ডমেস্টিক অ্যানিম্যাল, ইট হ্যাজ ফোর লেগস অ্যান্ড ওয়ান টেইল, দেয়ার ইজ আ টাফ্ট অব হেয়ার অন দ্য এনড অব ইটস টেইল, ফিমেল কাউ হ্যাজ সিক্স ওলানস...। ’
‘শুয়োরের বাচ্চা!’
হাসকি কী?
তিনটা অপশন এলো মাথায়।
১. আধা উন্মাদ
২. ইনসোমনিয়াক
৩. ড্রাগ এডিক্টেড
তিনটাই হতে পারে। কাকে কল দিয়েছিল আহলাদী? বয়ফ্রেন্ড?
সেভ করে রাখল নাম্বারটা।
এখন?
ঘুমিয়ে পড়বে?
না। গান শুনবে।
থ্রি জি সিম। ইন্টারনেট আছে। যে কোনো গান শোনা যায়। ‘লাইফ গোজ অন ব্রা’ শুনবে? বিটলসের গান। ও ব্লা ডি ও ব্লা ডা লাইফ গোজ অন ব্রা! মানে কী এ কথার?



বাংলা সিনেমার একটা গান সার্চ দিল। কলকাতা না, ঢাকাই সিনেমার। পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগের সাদাকালো সিনেমা। নায়করাজ রাজ্জাক অভিনীত, পরিচালিত এবং প্রযোজিত, ‘অভিযান’। গানটা গেয়েছিলেন রুনা লায়লা। স্কুল লাইফে শুনেছে রেডিওতে। ‘বিজ্ঞাপন তরঙ্গ’ অনুষ্ঠানে। এতদিন পর মনে পড়ল হঠাৎ।

ইউটিউব এক তাজ্জবের দুনিয়া।
পাওয়া গেল গানটা।
ডাউনলোড করে শুনল।
গান তো না এ উতুপুতু
নাচ তো না এ নুতুনুতু
ভেবে কোনো লাভ নেই
কারো কোনো কাজ নেই
আহারে পুতুপুতু...
কথাগুলো কী! শব্দগুলো!
উতুপুতু! নুতুনুতু! পুতুপুতু!
গান শেষ হলো আর মনে হলো পাশের ঘরে কেউ হাঁটছে।
কে? বউ!
উঠে পড়েছে?
কখন?
এতক্ষণ ধরে যা যা ঘটেছে, দেখেছে? আইহোল দিয়ে?
উতুপুতু!
নুতুনুতু!
পুতুপুতু!

পাশের ঘরটা তাদের বেডরুম। এসি চলছে বলে দরজা আটকানো। ফ্লোরে কার্পেট আছে। কেউ হাঁটলে তার মৃদু পায়ের শব্দ এ ঘর থেকে পাওয়ার কথা না। তাও একবার যখন মাথায় ঢুকেছে, সন্দেহ নিরসন করা দরকার। বইয়ের র‌্যাক থেকে একটা টিকটিকি ডাকল। টিক! টিক! টিক! জ্ঞানী টিকটিকি। বইয়ের র‌্যাকে থাকে।

কিন্তু বেডরুমের দরজা খুলছে না!
মানে কী এর?
লকড হয়ে গেছে?
আরো একটা বাজে চিন্তা এলো মাথায়।
বউ লক করে দিয়েছে?
বাজে চিন্তা না, অবাস্তব চিন্তা।
আবার লক ঘুরাল। ধাক্কা দিল দরজায়।
লকড হয়ে গেছে দরজা!
চাবি?
ভেতরে।
বেডসাইড টেবিলে।
এখন উপায়?
বউকে ডাকলে বউ শুনবে?
ডাকল।
‘ইলা! ইলা!’
পাগলামি হচ্ছে। কী এসব?
বউ কেন দরজা খুলবে?
আবার লক ঘুরাল এবং ডাকল, ‘ইলা!’
ভেতর থেকে লক খুলে দিল বউ?
আজগুবি চিন্তা!
লক উল্টো ঘুরাচ্ছিল এতক্ষণ। খুলে গেছে ঠিক করে ঘুরাতেই।

অন্ধকারে বউ ঘুমাতে পারে না। বেডরুমে মৃদু নীল আলো জ্বলছে। কার্পেটের ঝাঁ ঝাঁ লাল রং তাতে কেমন বাসি জবাফুলের মতো দেখাচ্ছে। সবসময় দেখায়? দেখায় নিশ্চয়। আগে খেয়াল করে দেখেনি। কত কী মানুষ খেয়াল করে দেখে না। মোস্ট পিপল সি বাট ডোন্ট অবজার্ভ। হা! হা! হা!

নিচু খাট, নিচু সাইড টেবিল। ঘরে ঢুকে ডানদিকের দেয়ালে একটা আয়না, ছয় ফিট-চার ফিট। বামদিকের দেয়ালে একটা ফ্ল্যাটস্ক্রিন টিভি। বাষট্টি ইঞ্চি।
আয়নায় খাটসমগ্র দেখা যায়।
আয়নার ভেতর আরেকটা বেডরুম। নিচু খাট, নিচু সাইড টেবিল। সাইড টেবিলে তার চাবির রিং এবং টিভির রিমোট।
আরে দরজা বন্ধ করেনি!
এসির সব ঠাণ্ডা চলে যাচ্ছে বাইরে!
দরজা বন্ধ করল।
বউকে দেখল।
অফ হোয়াইট লিনেনের কাফতান পরে আছে বউ।
তার মুখে মৃদু নীল আলো পড়েছে।
মনে হচ্ছে মৃদু নীলরঙের বউ।
আহারে!

৩য় কিস্তির লিংক



বাংলাদেশ সময়: ১৪২২ ঘণ্টা, জুন ১৮, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।