সেদিন কাজ থেকে বাসায় ফিরে কম্পিউটারের টেবিলে বসেছিলাম। অনেকদিন হয় ফেসবুকে ঢুকি না।
চেয়ারটায় নড়েচড়ে বসে আবারো ম্যাসেজটার দিকে চোখ বুলাই। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না দীর্ঘদিন পর এইভাবে বকুলদের সাথে আবারও যোগাযোগ হবে। হ্যাঁ, শুধু বকুল নয়, ‘বকুলদের’ বলতে আমি ওর একমাত্র মেয়ে বহ্নির কথাও বলতে চাইছি। ’৮৭ সালে দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেবার পর বছরখানেক আমার বন্ধু শরীফের সাথে মোটামুটিভাবে নিয়মিতই যোগাযোগ ছিল এবং সেই সুবাদে বকুলদের খোঁজখবরও পেয়ে যেতাম। কিন্তু এরপর হঠাৎ করেই বিচ্ছিন্ন সবাই। বকুল বা শরীফ কারো কোনো খবরই আর পাওয়া যায়নি এই দীর্ঘ সময়ে। অথচ বহ্নির ব্যাপারটা নিয়ে আমার কৌতূহল ছিল প্রচণ্ড রকমের। বিশেষ করে এই পঁচিশ বছরের ব্যবধানে স্বদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ওর এখনকার অনুভূতিগুলো কিভাবে নাড়া দিচ্ছে, তা জানার আগ্রহটা আমার ভেতরে উদগ্রীব থেকেছে মাঝেমধ্যেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বয়সের সাথে সাথে ওর বয়সও আজ চল্লিশ ছুঁয়েছে, অথচ কেমন আছে মেয়েটা এখন? নিশ্চয়ই স্বামী-সন্তান নিয়ে ঘর সংসারি হয়েছে!
“বাবা তোমার পিসিটা লাগবে এখন। আমার ল্যাপটপ সামহাও ওয়ার্ক করছে না। লটস অব হম ওয়ার্ক টু ডে। ক্যান ইউ ফিনিশ প্লিজ!” বলতে বলতে আমার বড় মেয়ে তিয়াশা উপরতলার ঘর থেকে অস্থির হয়ে হুড়মুড় করে নিচে নেমে আসে। তিয়াশা শ্যাম্বলী চার্টার হাই স্কুলের ইলেভেন গ্রেডের ছাত্রী। যেদিন হোমওয়ার্কের চাপ বেশি থাকে, সেদিনই ও অস্থির থাকে এরকম। পড়াশোনার সব পাট চুকিয়ে বিছানায় যেতে যেতে রাত একটা-দুইটা হয়ে যায় সেসময়।
আমি “একটু দাঁড়াও হানি” বলে চট করে ফেসবুক থেকে বেরিয়ে ইমেইলে ঢুকে বকুলের অ্যাড্রেসে আমার সেলফোন নাম্বারটা দিয়ে বের হয়ে আসি। তারপর স্টাডি রুম থেকে বেরিয়ে পাশের লিভিং রুমের সোফায় গা এলিয়ে দিই। দেয়ালে আটকে থাকা ফ্ল্যাট টেলিভিশনে তখন ঢাকার একটি চ্যানেলে বাংলা সংবাদ হচ্ছিল। স্যাটেলাইট সিস্টেমের বদৌলতে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেলই আজকাল সরাসরি দেখতে পাই। দেশে ভোর রাত বলে প্রচারিত খবরগুলির সবই বাসি বলে মনে হচ্ছে। তবু চেয়ে থাকি টিভির পর্দায়, কিন্তু ভাবনাটা পড়ে থাকে বহ্নি বকুলদের মাঝে।
“কী ব্যাপার! স্যারকে আজ চিন্তিত মনে হচ্ছে?” আমার স্ত্রী রেহানা কিচেন আঙ্গিনা থেকে থালা-বাসনগুলো পরিস্কার করতে করতে প্রশ্ন করে। ও প্রায় ঘণ্টা তিনেক আগে কাজ থেকে ফিরেছে। সিংকে পানি পড়ার শর শর শব্দের ভেতর থেকেও তাঁর কণ্ঠের গুনগুন গানের সুর শোনা যাচ্ছিল। ওর মনটা যেদিন প্রফুল্ল থাকে, সেদিন এভাবেই ওর দেহ-মনে প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সেও পঁচিশ বছরের তারুণ্যের উচ্ছ্বাস প্রকাশ পেতে থাকে। আর আমাকে তখন নাম ধরে না ডেকে ‘স্যার’ বলতেই পছন্দ করে। আজও তাই হচ্ছে। তবে আমার আনমনা ভাবটা ওকে কিছুটা হলেও ভাবিয়ে তোলে।
“ইমেইলে কারো কোনো খারাপ খবর? নাকি ফেসবুকে কোনো সুন্দরী ললনা ডেটিংয়ের অফার দিচ্ছে?” আমার জবাবের অপেক্ষা না করে রেহানা দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করে মুখ টিপে হাসতে থাকে।
আমি ম্লান হেসে কয়েক মুহূর্ত ওর দিকে তাকিয়ে থাকি, তারপর মাথার কাঁচা-পাকা চুলে হাতের আঙুল চালিয়ে “নাহ, সব ঠিকই আছে, এম্নি” বলে সোফা থেকে ওঠে ধীর পায়ে কিচেনের পাশ দিয়ে চার ধাপ সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে লন্ড্রি ও বাথ রুমের পাশ ঘেঁষে ফ্যামিলি রুমে চলে যাই। রেহানা তখন নিঃশব্দে ফ্রিজ থেকে মুরগির তরকারি বের করে মাইক্রো ওয়েভ ওভেনে ঢুকিয়ে দেয়। ডিনারের ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে প্রতিদিনের মতো।
ফ্যামিলি রুমে আমার ছোট মেয়ে পারিশা সিনেমা হলের পর্দার মতো বিশাল টিভি পর্দায় ডিজনি চ্যানেল দেখছিল ভীষণ মনোযোগের সাথে। ফিফথ গ্রেডে পড়ে বলে তিয়াশার মতো অতো বেশি হোম ওয়ার্ক থাকে না তার। তাই স্কুল থেকে ফেরার পর সুযোগ পেলেই কিছুক্ষণ ডিজনির ছবি দেখা ওর একটা অভ্যাস। আমি সোফায় মেয়েটির পাশে বসতেই বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। পারিশা অতি উৎসাহ নিয়ে এক লাফে সোফা থেকে ওঠে গিয়ে সামনের জানালার ব্লাইনডগুলো—কোণায় ঝুলে থাকা কাঠিটায় এক মোচড়ে ঘুরিয়ে ফাঁক করে দেয়। ও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বৃষ্টির ভারী বর্ষণ দেখতে থাকে। বৃষ্টির সাথে সাথে দমকা হাওয়ায় আশ পাশের উঁচু গাছ-গাছালির ডাল-পালা-পাতাগুলো অস্থির আনন্দে শন শন শব্দ করছিল মাঝে মধ্যেই। আমার তখন দেশের গ্রামের বাড়ির বৈশাখের ঝড়ো হাওয়ার পাতা ঝরার স্মৃতি মনে হতে থাকে। মনে পড়ে আম কুড়ানোর স্মৃতি।
“বাবা, আমাদের এখানে আজ বৃষ্টি, বাট নর্থ সাইডের নিউইয়র্কে এখন স্নো পড়ছে! ইটস ইন্টারেস্টিং,তাই না বাবা!” পারিশা আমার পাশে এসে বসে কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করে।
এরই মধ্যে আমার ভাবনাটা আবারো বহ্নি -বকুলদের মাঝে ফিরে যায়। পারিশাকে ‘হুম’ উচ্চারণ করে বলি, “যাও তো, তোমার মাকে হেল্প করো, প্লিজ!”
পারিশা চলে যায় রেহানার কাছে। বাইরে বৃষ্টির ঝর ঝর ধারার ভেতর দিয়ে ঘন হয়ে থাকা অন্ধকার ভাবটাও কমে আসছিল। তবে সন্ধ্যে হওয়ারও বেশি বাকি নেই। আর আমার চেতনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে তখন পঁচিশ বছর আগের ছিয়াশি সালের সেই দিনটির স্মৃতি সিনেমার ফ্লাশ ব্যাকের মতো ছুটে আসে। ঠিক ঠিক মনে পড়ে সেই দিনটির প্রতিটি ক্ষণ!
সেদিন শরীফ বলেছিল, “এই, আজ আমি অফিসে যাচ্ছি না, বসকে বলিস শরীর খারাপ। ” আমি ঝটপট টেবিল থেকে কলমটা পকেটে পুরে দরজা পর্যন্ত যেতেই শরীফ সেদিন আবারও বলেছিল, “আর শোন, বিকেলে তোকে নিয়ে যাব এক জায়গায়, তাড়াতাড়ি ফিরিস!”
“কোথায় শুনি!”
“গেলেই দেখতে পাবি, আগে আয় না!”
আমি আবাক হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম সেদিন শরীফের মনটা ঝরঝরে দেখে। ও তো সাধারণত এমন থাকে না! ম্লান হেসে দরজা পার হয়ে যেতে যেতে বলেছিলাম, “ঠিক আছে। ”
ঘরের বাইরেই ছিল গলিপথ। পাশে পান-সিগারেটের একটা দোকান। এখনো পরিষ্কার মনে পড়ে, রাস্তায় নেমে দোকান থেকে একটা স্টার সিগারেট কিনে কেবল জ্বালিয়েছি, ঠিক তখুনি শরীফ আবারও ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। ও রাস্তার ওধার থেকেই প্রায় চেঁচিয়ে বলেছিল, “তোকে একদিন বকুলদের কথা বলেছিলাম না, ওর খোঁজ পেয়েছি, বুঝলি? আজ ওখানেই যাব কিন্তু!” আমি কথাগুলো শুনতে শুনতে ধেয়ে চলছিলাম আটটা বেজে গেছে বলে। বাস ধরতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে!
শরীফের কথামতো যথাসময়েই অফিস থেকে ফিরে এসেছিলাম সেদিন। ফিরে এসে দেখি শরীফ তৈরি হয়ে বসে আছে। রাজ্যের ভাবনা ওর চোখে মুখে। ও বিছানায় বসা ছিল, আমাকে দেখে উঠে বলে, “এসে গেছিস? খেয়ে নে শিগগির, রহিমের মা টেবিলে ভাত রেখে গেছে। ” হ্যাঁ, শরীফকে সেদিন বেশ বিচলিতই দেখাচ্ছিল। এতদিন পর দেখা পাওয়া! কিন্তু এভাবে হুট করে যাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে?
ঢাকা শহর এখন অনেক বদলে গেছে। দেশে বেড়াতে গেলে কিছুই চেনা যায় না। অথচ আজ বিকেলের এই বৃষ্টিধারার ছন্দোময় শব্দমালার ভেতর দিয়ে আমেরিকার মাটিতে পড়ে থেকেও সেদিনের ঢাকার চিত্রগুলো জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠছে। স্পষ্ট মনে পড়ে, আমরা সেদিন আবু জর গিফারী কলেজের পাশ ঘেঁষে মৌচাক মার্কেটের সামনে দিয়ে মালিবাগ মোড়ের দিকে হাঁটছিলাম। শরীফ আগে, আমি পেছনে। অগ্রহায়ণের বিকেল প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। মিঠে কড়া রোদ এসে লাগছিল আমাদের পিঠে। ফুটপাতে মানুষের ভিড়। রাস্তায় বাস-রিক্সার অস্বস্তিকর শব্দ।
শরীফ যে একটু খামখেয়ালি ও জেদী স্বভাবের, ততদিনে একসাথে একই অফিসে চাকরি করে, একই ঘরে ভাড়া থেকে তা আর বোঝার বাকি ছিল না কিছু। ও যা ভাবে, করে বসে তাই। কিন্তু ওর সাথে অমন একটা জায়গায় চেনা নেই, জানা নেই, আমি যাই কী করে?
বিপণী বিতানগুলোর পাশে একটা ‘ভক্স ওয়াগন’ দাঁড়িয়ে থেকে চলার পথটাকে আটকে রেখেছিল, গাড়িটাকে পাশ কাটিয়ে জোরে পা ফেলে শরীফের কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টা করতেই সামনে ক্যাঁচ করে প্রচণ্ড ব্রেক চেপে একটা টয়োটা করলা এসে থামে। আমি ‘ধুত্তরি’ শব্দ করে আরো জোরে প্রায় লাফিয়ে গিয়ে শরীফের পিঠে শার্ট ধরে হেঁচকা টান দিই। শরীফ থমকে গিয়ে আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আমি ইতস্তত করে বলি, “দ্যাখ, আমার পক্ষে ওখানে যাওয়া ঠিক হবে না। ”
শরীফ সেদিন অদ্ভুতভাবে অফিসের বসের ভঙ্গিতে তাকিয়েছিল আমার দিকে। এরই মধ্যে মোড়ে একটা নয় নাম্বার বাস এসে থামে। শরীফের সাথে সাথে আমিও তখন দৌড়াই। তারপর বাসে উঠে বাম পাশের মহিলাদের আসনের পাশে ওপরের লোহার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে যাই। আর শরীফ মহিলা আসনে কেউ নেই দেখে ওখানেই বসে পড়ে। ও তখন বলে, “চল ই না, আগে তো যাই। ”
শরীফ পকেট থেকে সিগারেট বের করে একটা আমাকে দেয়। সিগারেটটা জ্বালিয়ে লম্বা টানে ধোঁয়া ছাড়তেই জায়গাটা ঘোলাটে হয়ে যায়। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকা এক বয়স্ক ভদ্রলোক এতে চোখ-মুখ বিকৃত করে অস্বস্তি বোধ করলেন। আমি সিগারেটটা না জ্বালিয়ে ফিস ফিস করে বলি, “সিগারেটটা বাস থেকে নেমে ধরালে হতো না!” শরীফ কিছুই বলে না। একসময় আধপোড়া সিগারেটটা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে শরীফ ধীর কণ্ঠে বলে, “জানিস, আনোয়ারকে মিলিটারিরা বকুলের চোখের সামনেই গুলি করে মেরেছিল। বেচারী!” একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে শরীফ। আমি কিছুই বলি না। ও এরপর নিজে নিজেই আরো কী সব বলে যায়, বাসের শব্দে আমার কানে আর কিছুই পৌঁছে না।
বাসটা ততক্ষণে গুলিস্তান এসে যায়। আমরা নেমে পড়ি। তারপর নবাবপুর রোড ধরে সোজা হাঁটতে থাকি দক্ষিণে। হাঁটতে হাঁটতে শরীফ বলে, “কালই খবর পেলাম বকুল কলতাবাজার থাকে। একটা স্কুলে মাস্টারি করে।
“এত খবর পেলি কী করে?”
“পেয়ে গেলাম ওর স্কুলের এক টিচারের কাছ থেকে। আলাপে আলাপে ভদ্রলোক জানালেন এক মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী চাকরি করেন তাঁদের সাথে। ”
আমরা বংশাল রোডের মোড় পর্যন্ত আসতেই শরীফ একটা পানের দোকানের সামনে হঠাৎ দাঁড়ায়। দোকানের কোণের রশিতে জ্বলতে থাকা আগুন থেকে আরেকটা সিগারেট ধরায়। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর বলে, “জানিস সজল, প্রত্যেকের জীবনেই খুব গোপন কিছু দুঃখ থেকে যায় এবং তাতে মানুষ কষ্ট পায়। কাউকে বলতেও পারে না, সইতেও পারে না। ”
আমরা একসময় জজকোর্টের সামনে দিয়ে আজাদ সিনেমা হল অতিক্রম করে হাঁটতে থাকি। পুরনো মডেলের একটা বাস কচমচ শব্দ করতে করতে অসংখ্য যাত্রী নিয়ে চলে যায়। অনেকেই এই বাসগুলোকে মুড়ির টিন বলেও ডাকে। বাসের ভেতর থেকে কন্ডাকটারের ‘সদরঘাট-সদরঘাট’ হাঁকাহাঁকিও তীব্রতর থেকে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। এক তরুণ যুবা ফিটফাট বাবু সেজে আমাদের পিছু নিয়েছিল, মূলত সুযোগ খুঁজছিল হলের সামনের প্রচণ্ড ভিড়ে আমাদের পকেটটা মেরে দেয়ার। ততক্ষণে ছেলেটা কেটে পড়ে আমাদের কারো পকেটেই ওয়ালেট নেই দেখে। ব্যাপারটা টের পেয়ে আমি নিঃশব্দে হাসি একা একা।
শরীফ বলে, “আমরা এবার বাঁ দিকে যাব। ”
আমি শরীফকে অনুসরণ করি। চাপা গলিপথ ধরে এগুতে থাকি। ও বাসার নম্বর খেয়াল করতে করতে এগিয়ে যায়। “দেখিস তো ৮৮ নাম্বার পেলেই বলবি” বলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খুঁজতে থাকে বাসাটা এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তা পাওয়া যায়। আঙুল দিয়ে আমিই দেখিয়ে দিই। শরীফ স্যাঁতস্যাঁতে গলির আরো একটু ভেতরে গিয়ে নম্বর-প্লেটটার নিচে দরজার কড়া নাড়ে দু’তিনবার। এসময় এক টোকাইমতো বালক দুর্গন্ধময় সরু ড্রেন ও আশপাশে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছিল কাঁধে থলে ঝুলিয়ে। ছেলেটা আমাদের দেখে একটু দূরে সরে যায়।
শরীফ আবারও কড়া নাড়ে একটু জোরেই। আমি আস্তে করে বলি, “হয়তো কেউ নেই!”
শরীফ শান্ত চোখে আমার দিকে তাকায় একবার। তারপর আবারও শব্দ করতে যাবে, ঠিক তখুনি ভেতর থেকে সাড়া পাওয়া যায়, “কে?”
“আমি!” বলে আমার দিকে তাকায় শরীফ।
আস্তে আস্তে দরোজাটা ফাঁক হয়, তারপর পুরোটাই খুলে যায়।
“আপনি!” বিস্ময় মাখানো উচ্চারণ। অফ হোয়াইট রঙের শাড়ি পরা অল্প বয়েসি এক মহিলা। মাথায় আধো আঁচল। শান্ত চাহনী। শুকনো মলিন মুখাবয়ব। বয়স উনত্রিশ কি ত্রিশ বড়জোর, আমার বয়সের কাছাকাছি হবে হয়ত।
শরীফ তন্ময় হয়ে শুধু দেখতে থাকে। সহসা সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলে, “কালই খবর পেলাম তোমার। এখানে থাকো, তাও জানলাম। ”
“আসেন শরীফ ভাই, ভেতরে আসেন!” আমার দিকে এরই ফাঁকে এক পলকে তাকিয়ে ম্লান হেসে আমাকেও ‘আসেন ভাই’ বলে আহবান জানায় মহিলা। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে শরীফ বলে, “ও আমার ফ্রেন্ড, সজল আশরাফী। কলিগ, একই সাথে থাকি। ”
বুঝলাম ইনিই বকুল। ম্লান হেসে আমাকে সালাম জানায় বকুল। বসার ঘরে গিয়ে চেয়ার দেখিয়ে বসতে বসতে বলে ও ভেতরের ঘরে চলে যায়। পাশের ঘরের পর্দাটা হাওয়ায় একটু নড়ে যেতেই একটা ওড়নার কোণা দেখা যায়। তারপরই কোমল মিহি কণ্ঠ, “কে মা!”
“তোমার চাচা হন, তোমার বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। একই সাথে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন উনারা। তোমাকে বলিনি একদিন সেই গল্প?”
“ও হ্যাঁ, বলেছিলে। ওই গোঁফওয়ালা ভদ্রলোকটিই বুঝি!”
“হ্যাঁ। ”
“আজই এলেন! আগে কেন দেখিনি?”
“আমরা তো কাউকে কোনোদিন আমাদের খোঁজ খবর দেইনি মা! কী করে জানবেন এখানে থাকি আমরা?”
দুটি মানুষের কথোপকথন চলে খুবই নিচু স্বরে, কিন্তু চারদিকের সুনসান নীরবতায় শোনা যায় সবই। তারপর একসময় ফিঁসফিঁস কথাবার্তার শব্দ, অস্পষ্ট এবং একসময় তা আবারও ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে যায় যেন পাখির পালকের মোলায়েম আন্তরিকতাময় কণ্ঠস্বর, “ঠিক আছে মামনি, আমি চুলোয় চা বসাচ্ছি, তুমি ওদিকে যাও। ”
একটা সদ্য বেড়ে ওঠা কিশোরী পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে সামনের বারান্দা পার হয়ে ছোট্ট উঠোন দিয়ে সম্ভবত রান্না ঘরের দিকে যায়।
শরীফ আস্তে করে বলে, “বকুলের সেই মেয়েটা বোধ হয়। ”
এরপর অনেক সময় অতিক্রান্ত হয়েছিল সেদিন। মাগরিবের আজান হলো আশপাশের মসজিদগুলো থেকে। অসংখ্য কাক এবাড়ি ও বাড়ির ছাদে, ড্রেনের কোণে কা কা রবে হুলস্থুল পাকিয়ে রাখল কিছুক্ষণ। পুরো মহল্লাটি যেন এইভাবে সন্ধ্যে হবার সাথে সাথে সরব হয়ে উঠেছিল। অথচ বকুল ফিরে আসছিল না। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট, এইভাবে পনেরো মিনিট পার হয়ে যায়। আমাদের ততক্ষণে অস্বস্তি শুরু হয়। বকুল কি ইচ্ছে করেই এড়িয়ে থাকছে? আমাদের মতো ওরও কি অস্বস্তি হচ্ছে? নাকি আমার উপস্থিতির জন্যেই সংকোচ? শরীফের কাছে শুনেছি, ও ভালোবাসত বকুলকে। কিন্তু সেটা ছিল একতরফা নীরব। বকুলকে জানাতে সাহস পায়নি দীর্ঘদিন। অথচ ক্লাস টেনে পড়া কিশোরী বকুলের প্রাইভেট টিউটর ছিল বলে শরীফ খুব সহজেই বকুলকে ওর মনের কথাটি জানাতে পারত। কিন্তু শরীফ যখন তার মনের কথাটি বকুলকে বলতে যাবে, তখনই জানতে পারে যে বকুল ভালোবাসে শরীফেরই বন্ধু আনোয়ারকে। একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে গ্রামের আর সব কিশোর যুবকদের মতো শরীফ ও আনোয়ারও যুদ্ধে গিয়েছিল একসাথে।
তবে যাবার মুহূর্তের ঘটনাটি ছিল খুবই বেদনাদায়ক। তখন ছিল এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়। দেশের সব শহরগুলো তখন পাক হানাদার বাহিনী জ্বালাও-পোড়াও, ধরপাকড়ের মাধ্যমে দখল করে নিয়েছিল। এরপর ধীরে ধীরে কিছু বাঙালি দালালদের সহযোগিতায় এরা মাঝে মধ্যে গ্রামগুলোর দিকেও হানা দিতে শুরু করে। এরই মধ্যে আনোয়ার যুদ্ধে যোগ দেয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করে ফেলেছিল। তাই দেশ ছাড়ার আগে ওদের দুজনের মধ্যকার বিয়ের শুভ কাজটি শেষ করতেও বকুলকে বারবার তাগাদা দিতে থাকে। যদিও বকুলের বাবা পনেরো বছরের এত কম বয়সী মেয়েকে বিয়ে দিতে মোটেও রাজি হচ্ছিলেন না, তবুও যুদ্ধকালীন সময়ের অজানা আশংকার কথা ভেবে সেই সন্ধ্যায় একটা সুন্দর মুহূর্তে বর-কনের বিয়ের আয়োজন হয়েছিল। বেশ কয়েকটি পরিবারও এসেছিল নেমন্তন্ন খেতে। এরপর বাসর রাতের মাহেন্দ্রক্ষণে যাবার জন্যে দরজা বন্ধ করতেই হঠাৎ মুহুর্মুহু গুলির শব্দে গোটা গ্রামটি অস্থির হয়ে ওঠে। ‘পাক বাহিনী, পাক বাহিনী! পালাও পালাও’ রবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে চারদিক। আনোয়ার সেরাতেই বকুলকে শুধু “ভালো থাকো বকুল, সাবধানে থেকো। যুদ্ধ শেষে দেশ মুক্ত করে আবার ফিরে আসব” বলে বিয়ের লেবাস পাল্টে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল।
এরই ফাঁকে বিদ্যুৎ চলে যায়। হয়ত লোড শেডিং। পুরনো ঢাকার এই এক ফ্যাসাদ। কতক্ষণ যে এরকম থাকে কে জানে? না, বাঁচা গেল। বাতি জ্বলে উঠেছে আবার। কিন্তু অস্বস্তি থেকেই যায় মনের মধ্যে।
ওই অস্বস্তিকর পরিবেশ থেকে সেদিন কি আমার উঠে চলে আসা উচিৎ ছিল? কিন্তু শরীফ যদি মাইন্ড করে, এই ভয়ে স্পষ্ট মনে পড়ে, সেদিন বকুলদের ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও বেরোইনি। চেয়ারে বসে তখন শুধু ঘরের চারদিকে ইতিউতি চোখ রাখছিলাম। দেয়ালে ঝোলানো রঙিন ক্যালেন্ডার দেখছিলাম। দরজার ঠিক উপরে স্যাঁতস্যাঁতে চুন খসে যাওয়া বিবর্ণ দেয়ালে ছিল একটা ছবি। বাঁধানো ফ্রেমে আটকানো। তারুণ্যের উচ্ছলতায় পরিপূর্ণ চেহারা। ছবিটা কার?
শরীফ ঝিম ধরা লাটিমের মতো বসেছিল, আমি ওর কোমরের কাছে আঙুলের খোঁচা দিতেই একটু চমকে গিয়ে নড়ে ওঠে। ওকে ছবির দিকে ইশারা করি। শরীফ হালকা স্বরে বলে, “আনোয়ারের ছবি। ” তারপর সেও অবাক হয়ে দেখতে থাকে ছবিটা। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে ছবিটার কাছাকাছি হয়।
পাশের ঘরের পরেই সম্ভবত আরো একটা ঘর আছে। সেখান থেকে বুড়ো মানুষের খুক খুক কাশির শব্দ আসছিল। রান্নাঘরে কাপ প্লেটের টুং টাং আওয়াজ। মেয়েটা খুব যত্ন করে চা তৈরি করছিল নিশ্চয়ই! কী নাম মেয়েটার? আর ওই বয়স্ক মানুষটি?
“একটু দেরি হয়ে গেল! কিছু মনে করবেন না সজল ভাই” বকুল অবশেষে ম্লান হেসে ঘরে ফিরে আসে। শরীফকে তখন ছবিটার পাশে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “ওটা আর কী দেখবেন শরীফ ভাই! মেরিড লাইফের অভিজ্ঞতা আর নাই-ই বা পেলাম, তবুও তো ও-ই আমার হাজব্যান্ড। ওকেই তো আমি কবুল বলে গ্রহণ করেছিলাম সেদিন। ” বলতে বলতেই দুচোখ বেয়ে জল ঝরতে থাকে বকুলের। তারপর চোখ মুছে বলে, “বহ্নি তো ওকেই বাবা বলে জানে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবেই মেয়েটা নিজেকে গর্বিত মনে করে। ছোটবেলায় ও তো একদিন বলেই ফেলেছিল, ‘মা আমাকে একটা পিস্তল কিনে দেবে?’ যে মিলিটারিটা আমার বাবাকে মেরেছে, আমি ওকে গুলি করে মেরে আসব। ”
শরীফ তার চেয়ারে ফিরে আসে। বকুল ততক্ষণে আমাদের সামনের চেয়ারটায় মুখোমুখি হয়ে বসে। শরীফ তখন বকুলকে স্থির চোখে দেখতে থাকে এবং নিঃশব্দে ওর কথাগুলো শুনতে থাকে। তারপর বলে, “কিন্তু আনোয়ার যে শেষ পর্যন্ত—”
“আপনিও কি রহমত মোল্লার সাজানো সেই গল্প বিশ্বাস করেন শরীফ ভাই?” শরীফের কথা শেষ হতে না হতেই বকুলের আর্তি ঝরে পড়ে, “মেজরের রুমে ও-ই তো ছিল সেদিন! আর তাই সেই সুযোগে গ্রামে এসে রটিয়েছে আমি মেজরের বেডরুমে যেতে রাজি হওয়াতেই নাকি আনোয়ার আমাকে তালাক দিয়েছিল। অথচ কী দোষ ছিল আমার! সেদিনের দুর্বিষহ ঘটনার জন্যে কি সত্যি সত্যি আমিই দায়ী ছিলাম? অন্তত আনোয়ার তো আমাকে ভুল বোঝেনি! আর ওরও তো কিছুই করার ছিল না সেসময়। আমি শুধু ওকে বাঁচানোর একটা শেষ সম্ভাবনা দেখেছিলাম। তাই শেষ সুযোগ হিসেবে শরীরের বিনিময়ে একটা জীবন বাঁচানোর যুদ্ধে নেমেছিলাম শুধু। ”
সমাপনী কিস্তি পড়তে ক্লিক করুন
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪০ ঘণ্টা, জুন ২২, ২০১৫