কী করে যাবেন রাতে? হিমস্নিগ্ধ শিশিরেরা যেতেই দেবে না,
নগ্ন পদতল জুড়ে শীতার্ত পরশ তার মায়াবী জাদুতে বেঁধে রেখে
শোনাবে হাওয়ার গান কোন দূর আকাশের বুক থেকে ভেসে আসা বিনম্র সুরে,
প্রদোষ বিহারে যারা ধীর পায়ে হেঁটেছিল প্রান্তরের পথে
তাদের না ফেরা স্মৃতি কবেকার জল হয়ে ঘাসের মাথায় জমে আছে।
ভেজানো পায়ের সাথে লেগে থাকে অন্তহীন বিধূরতা সে কোন ঘ্রাণের,
নিঠুর রাগের মীড়ে বৈভরের পরাজয় সারসত্য অনাদি কালের
কঠিন প্রাচীর তুলে বলে কেঁদে, ভুলে যেতে চলে যাবে এতই সহজে?
ম্রিয়মাণ সন্ধ্যারা রাত্রির পাটাতনে এখন তো পড়েছে ঘুমিয়ে,
ক্লান্ত দিনের ছবি তারাও টাঙিয়ে দেয় নিস্তব্ধ ক্যানভাসে বিবর্ণ আবেগে,
সূর্যের আলো মরে বাসনারা ভূত হয়ে চোখ ঠারে তমস-তিমিরে,
অনাসক্ত প্রদীপের বিচ্ছুরিত কম্পমান শিখায় শিখায় পোড়া জীবনের ধূপ
প্রজ্বলন্ত করে তোলে কাহিনীর ভস্মরাশি শোক-তাপ হানা এই সংসারের কষ্টিপাথরে।
সেখানে বিছানো আছে মধুভাণ্ডে পড়ে থাকা গাঢ়তর মমতার ভগ্নাবশেষ,
বৈদেহী প্রলোভন জড়িয়ে জড়িয়ে রাখে ক্লান্তরতি অবসাদ বিপন্ন শয্যার,
সে মায়া ছিন্ন করে সহজ যাওয়াটা তাই কণ্টকিত হয়ে যাবে ভেতরের চাপে।
সবুজ বৃক্ষের পাতা মর্মরিত হয়ে ওঠে আকাশ-বীণার তারে দোল খেতে খেতে,
অপ্সরা স্বর্গের যেন মেনকা রম্ভা হয়ে নৃত্যরতা উর্বশীর পায়ের ঘুঙুর,
নূপুর নিক্কনে বাজা জ্বরতপ্ত বেহুলার ধমণিতে রক্ত ওঠা দীর্ঘ ছায়ারা
মেলে দেয় সুপুরীর ডানা মেলা না পাওয়ার বেদনা মাখানো লিপি মৃত্তিকার স্তনে,
শঙ্খমালা গান গায় ফেনপুঞ্জে তার রঙ মিশে যায় শৈশবের কলার ভেলায়।
সাহানার রাগিণীতে বর্ণিলতা ফুটে ওঠে—রাঙায় এ ধরণীর মত্ত সৌরভ,
মৃত সৈনিকের মতো অপাপবিদ্ধ সব ঝাউগাছ সারি সারি দাঁড়িয়ে নীরবে
বাক্সময় মৌনতায় অপার্থিব নিষেধাজ্ঞা সেঁটে দেয় হিম মাখা দেয়ালের গায়ে।
রাতের জোয়ারে ভাসে প্রমত্ত প্লাবন থেকে ছেনে আনা সৌরভ জুলেখা বিবির,
কোথায় সে জাদুদণ্ড?—খুঁজে ফেরে মায়াবিনী অদৃশ্য লোচন মেলে ধরে,
গভীর গভীরতর কুহকের জাল কেটে প্রতিস্পর্ধী জনতার ভ্রান্তি বিলাস
নিদান ঘোষণা করে রজঃস্বলা রমণীর কাছে গিয়ে বার বার নতজানু হয়।
তখন নূহের নাও পাল তুলে সাগরের লাল-নীল জলধির প্রলয় বাসরে
অশনি সংকেত ভেঙে মাস্তুলে উড়িয়ে দেয়—সে পতাকা পৃথিবীর সমান বয়সী,
রণরক্ত ফেটে গিয়ে বের হয় ঘুম ঘুম মানুষের অনাসক্ত হৃদয়ের নুন,
মৈথুনের ক্লান্ত স্বাদ বিস্ময় বিপন্নলোকে স্থির হয় কাউকেই না যেতে দিয়ে।
অন্ধকার সময়ের স্নায়ুতে স্নায়ুতে এসে বাসা বাঁধে ঘুণপোকা—হন্তারক কীট,
নৈঃশব্দের বুকে জুড়ে একটি জারুল গাছ নিঃসীমতা এঁকে এঁকে যায়,
বয়সী পাথরে জ্বলে হলুদ উন্মীলন আভাময় নিস্তরঙ্গ জোনাকীর টিপ,
ঝর্ণাধারার মতো কিশোরীর অভিসার গোপন লাটিম হয়ে পথের মায়ায়
মাটির ঘোড়াতে চড়ে অনর্গল বিভ্রমতা ক্রন্দন-মাখামখি সূর্যোদয় দেখে।
লুকানো গুপ্তধন খুঁজে ফেরা যাযাবর ঘুগড়ারা সর দাঁত ইঁদুরের সাথে
শুভ্র-সফর-স্নাত গোলাপবালার শোকে রীতি মেনে কালপুরষের
আশ্চর্য মলম কিনে মণিদীপদীপ্ত আলো ধরে রাখে চোখের সমুখে।
মুক্তা-মালা দিয়ে গাঁথা নক্ষত্র খচিত এই মুগ্ধ রাতে বাকহীন ধ্যানের পাহারা,
সরমা-অরুন্ধতী চেয়ে রয় নির্ণিমেষ অচ্ছোদ সরসী তীর জুড়ে,
হা হা রবে জলরাশি কুমারী প্রেমের মতো নীহারিকা পানে দ্রত ছোটে,
অতলান্ত স্তব্ধতায় বিশ্বসঙ্গীতের কোন ধ্বনি আসে গূঢ় অন্তরের।
যে সুষমা ঘিরে রাখে ধূলি ও মাটির গড়া জগতের প্রতিমা-প্রদীপ,
তারই মগ্ন-সমাহিত আস্তরণ লেগে আছে রূপালী নদীতে ফোটা ফুলের স্তবকে।
পবিত্র কাদায় তার স্বর্ণ-ফলক গাঁথা হিরণ্ময় চেতনার বোধ ও বোধিতে
জনম জনম ধরে আগত জন্মের কত শিলালিপি অক্ষয় কালের সুবাসে।
বিশাল অন্ধকার ঘনীভূত হয়ে আছে ছিদ্রহীন অনিঃশেষ মহাজাগতিক,
সীমাশূন্য তার রূপ অপার্থিব চেতনার চাদর বিছিয়ে রাখে চরাচরব্যাপী,
যেন কোনো জন্ম নেই—যেন কোনো মৃত্যু নেই—শুধু এক বোধির সাগর
হৃদয়ের মর্মমূলে জ্বেলে দেয় মোমবাতি—প্রশান্তির দীপশিখা চির প্রভাময়,
অনন্তের ধ্বনি আসে দূর কোন কাল থেকে মিশে যায় সে কোন সুদূরে
মহাকাল থানা পাতে—কণ্ঠলগ্ন প্রেম ইতিউতি চড়ুই পাখির
স্বপ্নিলমেঘে চড়ে সোনালি পালক পরে কেবলই হারাতে থাকে সুনীলে সুনীলে।
কী করে যাবেন রাতে? এই রাত মায়াময় জোসনা-ভাঙা মেঘে,
আলো ও ছায়ায় মেতে লুকোচুরি জীবনের ব্রত পাঠ করে,
খোলা মাঠ পেতে আছে তৃণাস্তৃত সবুজাভ আদিগন্ত বুকের চরাট,
হাওয়া আসে দক্ষিণের—কুসুমে কুসুমে ভরা যেন কোন অনাঘ্রাত প্রণয় ভ্রমর।
গাছেরা বলে না কথা—মৌনতাই ভাষা হয়ে গেঁথে দেয় বর্ণের মিছিল,
মহুয়া মদির ঘ্রাণে তোলপাড় মাদকতা উতলা পরাণে হানে অতনুর বাণ,
নদী-জলে ছায়া পড়ে—ভেঙে ভেঙে মূর্তি গড়ে—হয় ছত্রখান,
তবু তা হবে না শেষ যোজন যোজন ব্যাপী গল্প বলা রাত যেন শাহেরজাদীর।
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৩ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০১৫