১.
অছিম উদ্দিন গত দেড়বছর নিজের ওপর খুব বিরক্ত। এখন যেন কোনো কিছুই তার নিয়ন্ত্রণে নেই।
সকাল বেলা গরুর দুধ দোহানোর সময় বিড়বিড় করে বলছিলেন, “গরুর মালিক কইছিল চাইর শের করি দুধ দিব। অঁন হাই দেড় শের। গরুটা কিনার সময়-ই কইছালাম, ঠইগজি। বাছুরগা দিন দিন ল্যাকল্যাইক্কা অই যাইতেছে। ” বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন অছিম।
এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। বড় ছেলে বিএ পাশ করে বাড়ির পাশে দোকান দিয়েছে। আর ছোট ছেলে অ্যাডভোকেট। বিয়ে করেছে শহরে। কাজের প্রয়োজনেই স্ত্রী সন্তানসহ শহরে থাকেন। স্ত্রী অজিফা বেগম অসুস্থ। হাঁটতে পারেন না। ঘরবইঠা। ঘরে বসে বসে নামাজ আর কোরআন পড়ে সময় কাটান। তাই অছিম উদ্দিনের কষ্ট অনেক বেশি। বিভিন্ন কাজে এখন আর কারো সহযোগিতা পান না। এমনকি নিজের ভাতও নিজে নিয়ে খেতে হয়। ভোর পাঁচটা থেকে শুরু করে রাত দশটা পর্যন্ত চলে জীবন সংগ্রাম। এমন হাঁড়ভাঙ্গা কষ্ট করে অছিম উদ্দিন কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। বর্তমানে এ সম্পত্তি থেকে যা আয় হয়, ব্যয়ও তার কম নয়। গত দেড় বছর তিনি সম্পত্তি বাড়াতে পারছেন না। সংসার আর সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ করতে করতেই আয় ব্যয় সমান হয়ে যায়। তাই জীবন সায়াহ্নে এসে এক প্রকার হতাশ জীবন কাটছে তার।
২.
কয়েক বছর আগেও শহর থেকে পরানপুর গ্রামে যেতে ঊনিশটি সাঁকো পার হতে হতো। একটু প্রভাবশালীদের বাড়ির পাশের সাঁকো পাকাপোক্ত থাকলেও গরীব এলাকার সাঁকো থাকত নড়বড়ে। দুই পাশে দুইটি বাঁশ কেচকি দিয়ে পাটের রশি কিংবা জিআই তার দিয়ে বাঁধ দেয়া হতো। ওই বাঁধের উপর শুকনো খড় অথবা কচুরিপানা দিয়ে একটার পর একটা বাঁশ দেয়া হতো। ধরনিতে ব্যবহার হতো মুলি বাঁশ। প্রথম প্রথম সাঁকো পার হওয়ার সময় বুকে কাঁপন ধরে না এমন লোক নেই বললেই চলে। যদিও তখন যাতায়াতের ভালো মাধ্যম ছিল নৌকা। একটা সময় গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারে একটি করে নৌকা থাকত। যাদের নৌকা কেনা বা তৈরি করার সামর্থ্য ছিল না, তাদের যাতায়াতের জন্য অন্তত কলা গাছের ভেলা ছিল। অবশ্য এখন নৌকা দুয়েকটা চোখ পড়লেও ভেলা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আর সাঁকো তো দূরের কথা চব্বিশ ঘণ্টায় দশটি রিক্সা চলে না, সে রাস্তাও পাকা। ঊনিশ সাঁকোর স্থলে কোথাও ব্রিজ, কোথাও কালভার্ট আবার কোথাও মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। ওই সড়ক এখন পুরোটাই পাকা। সরকারের একজন মন্ত্রী নিজের এলাকা হিসেবে প্রচুর কাজ করেছেন। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ। চলে পাখা, লাইট, টিভি, ফ্রিজ ইত্যাদি।
অজপাড়া গাঁয়ের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ জ্বলবে এটা গত কয়ক বছর আগেও ছিল কল্পনাতীত। এত সহজে মানুষ বিদ্যুৎ পেল সেদিকে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। যেন এটাই হওয়ারই ছিল। তাছাড়া বিদ্যুৎ গ্রাহক তথা গ্রামবাসী বলাবলি করছে, বিদ্যুৎ দিল কই? প্রতি মিটার বাবদ দিতে হয়েছে পনের হাজার টাকা। তাছাড়া টাকা দিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার করি। প্রতিমাসে বিল পরিশোধ করতে হয়। অথচ চব্বিশ ঘণ্টায় বিদ্যুৎ থাকে সর্বোচ্চ আট ঘণ্টা।
তার উপর বৈদ্যুতিক সর্ট সার্কিট থেকে মাঝে মাঝে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। গত দেড় বছরে পরানপুর গ্রামে হাফডজন ঘরে আগুন লেগেছে। এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার জন্য বিদ্যুৎকে দায়ী করে গ্রামের অনেকেই। আবার কেউ কেউ এসব কথায় বিশ্বাসী নয়। তাদের মতে একশ’ একটা পাপ করলে ঘরে আগুন লাগে। সে হিসেবে বিদ্যুতের কোনো দোষ নেই। যাই হোক, আট মাস আগে অছিম উদ্দিনের খড়ের গাদায় আগুন লেগে প্রায় পাঁচ হাজার টাকার খড় পুড়ে যায়। এটা অবশ্য বিদ্যুতের আগুন নয়। শত্রুতা বশত ক্ষতি করেছে গ্রামের কিছু বদ প্রকৃতির লোক। এর কয়েকদিন পরেই পুকুরে বিষ ঢেলে অন্তত বিশ হাজার টাকার মাছ নিধন করেছে। কে বা কারা এসব করছে অছিম উদ্দিন বুঝতেই পারছেন না। সপ্তাহ খানেক আগে বড় ছেলের দোকানের তালা ভেঙে ২১ ইঞ্চি টিভিসহ নগদ টাকা চুরি করে নিয়ে গেছে।
তাই মেজাজ খুব উগ্র অছিম উদ্দিনের। এ নিয়ে প্রতিদিন কয়েকশ’ গালি শুনতে হয় অজিফা বেগমকে। গাভি দুধ কম দিচ্ছে তাও চেঁচামেচি স্ত্রীর সাথে। পুকুরে মাছ মারা যাচ্ছে, খড়ের গাদায় আগুন, ধমক দেয়ার একটাই জায়গা। শুধু ছেলেদের শিক্ষিত করার পেছনে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন আর অন্তত আরো এক হালি পোলাপান না নেয়াই অজিফা বেগমের বড় দোষ। অছিম উদ্দিন রাগান্বিত হয়ে বলেন, “বেশি করি হোলা মাইয়া লইলে আইজ্জা এইচ্চা অইতো না। কেউ বাড়ি থাইকতো, কেউ চাকরি কইরতো কেউ হড়ালেয়া কইরতো। আর অঁন একজন বাইত থাকি যেই ব্যবাসা করে নিজের ফকেট খরচ অয় না। হেতের দুই মাইয়া আর বউরে চালাইতে অয় আঁর। আরেক হোলা অ্যাডভোকেট হেকট্রিস করে। মাস শেষে বাড়ির নাইরকেল বেচার টেয়া লই চেম্বার খরচ দেয়। মক্কেল ছাড়া উকিল। দরকার কিতা আছিল হড়ালেয়া করনের? জমিজমার দিকে খেয়াল রাইখলেও তো মাসে বালা টেয়া আইতো। অতচ আইজ বাড়িত্ মানুষ নাই। শহরে যাই ভাড়া বাসায় উইঠছে। আঁর দু’গা ঘর খালি ফড়ি থাকে, এত্তবড় বাড়ি, মানুষ নাই, চাইর দিক শুধু খা খা করে”...
৩.
অছিম উদ্দিনের ছোট ভাই রশিদ উদ্দিন। চার ছেলে দুই মেয়ে তার। গ্রামে এখনো দুই বছরের আগা গোড়ায় পোলাপান হয়। বড় ছেলের বয়স ষোল। কিছুদিন মাদ্রাসায়, কখনো হেফ্জখানায় পড়াশোনা আবার কখনো টাইলসমিস্ত্রী হিসেবে কাজ করেছে। কিছুদিন আগে স্থানীয় চেয়ারম্যান অফিস ম্যানেজ করে বয়স বাড়িয়ে জন্মনিবন্ধন করে। পরে দালাল মারফতে পাসপোর্ট তৈরি করে গত দেড় মাস আগে মালদ্বীপ পাড়ি জমিয়ে বাড়িতে টাকাও পাঠিয়েছে। একমাসের বেতন দশ হাজার টাকা নগদ হাতে পেয়েছে রশিদ উদ্দিন। এ নিয়ে খুশির যেন অন্ত নেই। বড় ছেলের সাথে কথা বলে পরের ছেলেগুলোকেও পাঠানোর চেষ্টা করছে রশিদ। অবশ্য মেয়েগুলো পড়াশোনায় খুব মনোযোগী। তাই তাদের নিয়ে কোনো চিন্তা নেই।
ওই গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারের কেউ না কেউ বিদেশে থাকে। সৌদি, কুয়েত, দুবাই, ওমান, ইতালি কেউ বা লন্ডন। পাশের পাড়ির এক ছেলে তিন বছর আগে বিদেশ গিয়ে বাড়ি করেছে। সীমানা প্রাচীরসহ পাঁচ তলা ফাউন্ডেশন। ভবনের দুইতলার কাজ শেষ। টিয়া রং দিয়ে বাড়ি কালার করেছে। বাড়ির গেইটের উপর দুইটা ঈগল পাখি। এসব দেখে মাঝে মাঝে আফসোস করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েন অছিম উদ্দিন। বিভিন্নভাবে শুধু স্ত্রী অজিফা বেগমকেই দায়ী করেন তিনি। অজিফা বেগম কখনো প্রতিবাদ করেন না। শুধু নামাজ পড়ে দোয়া করেন আল্লাহ যেন ছেলেদের আয় রোজগার বাড়িয়ে দেয়। যেদিন অছিম উদ্দিনের হাতে মাসে অন্তত দশ হাজার টাকা তুলে দিতে পারবে তার ছেলেরা, সেদিন কিছু বলার মনবাসনা স্থির করে রেখেছেন অজিফা বেগম।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৮ ঘণ্টা, জুন ২৫, ২০১৫