আবুল হোসেন (জন্ম: ১৫ আগস্ট ১৯২২; মৃত্যু: ২৯ জুন ২০১৪) নিম্নকণ্ঠ-বিরলপ্রজ-আত্মপ্রচারবিমুখ-মিতকথনপ্রীতিসন্ধানি কবিতাশিল্পী। তাঁর পৈত্রিক নিবাস খুলনা জেলার দেয়াড়া গ্রামে।
প্রায় বিরল এই কবি তাঁর অবস্থান সম্পর্কে প্রবল সচেতন; আজকের পাঠক যে তাঁকে নিয়ে তেমনঅর্থে আলোচনা করে না—করবে না, তা তিনি অনুধাবন করেছেন। কবিতাসংগ্রহের উৎসর্গপত্রে তাঁর সেই অনুভব প্রকাশ পায় এভাবে—[কবি দুই নাতিকে লিখছেন] “আমার কথা বাবা মা আত্মীয় স্বজনের কাছে হয়ত শুনবে। তার চেয়ে তোমরা আমাকে অনেক বেশি পাবে এই বইতে, যেমন পাবে আরো অনেকে যারা আমাকে দেখেনি, আমার কথা শোনেও নি। ” [অক্টোবর ২০০০, গতিধারা, ঢাকা]
রঙ-রাজনীতি-রাজ্যপাট আর অহেতুক অহমিকার টান থেকে অনেক অনেক দূরে কবিতার ঘরবাড়ি বানিয়ে গেছেন বয়সী বটের ছায়াধারণকারী কবি আবুল হোসেন। আলাপচারিতায় আর কলমের ঝর্ণাধারায় প্রমিত কাব্যনির্মাতা যে হোসেনকে আমরা পেতে থাকি প্রায় প্রতি প্রহরে, তিনি যেন আমাদের—কবিতার লালন আর সেবাপ্রদানকারী সেবকের অভিভাবক হয়ে স্থির বসে আছেন বাংলাদেশের কোটি কোটি শিল্পদরোজার চৌকাঠে! আবুল হোসেনের কবিতায় আবেগের চেয়ে জ্ঞানের প্রাধান্য বেশি; মনন আর বৈদগ্ধ্য গায়ে মেখে তাঁর কবিতাবলি গদ্যের স্বাদও উপহার দেয় অনায়াসে। রুচিবদলের পাঠকের জন্য সৃজনবোধের যে খোরাক, তার সন্ধান পাওয়া যায় আবুল হোসেনের কথামালায়। চিন্তা আর মেজাজে নগরজীবনকে আত্মস্থ করে তিনি নির্মাণ করে গেছেন দীনতা আর ফাঁকির বিপরীতে আপনজন-কথিত স্নেহের তুলির পরশ। গাঢ়রঙ-তীব্র উত্তেজনা এবং স্লোগাননির্ভরতা তাঁর কবিতাকে স্পর্শ করতে পারেনি; বিবেকবোধসম্পন্ন মানুষের চেতনাজগতে সাম্প্রতিক ও চিরকালীন ভাবনারাজির সুঁইসুতো আটকানোর একটা তাগিদ সম্ভবত তিনি অনুভব করেছিলেন।
সমাজ-সমকাল-মানবিক অবক্ষয় আর প্রতারিতের প্রতিদিনের দিনলিপি আবুল হোসেনের কবিতার ক্যানভাস সাজাতে থাকে তাঁর স্বপ্ন-কল্পনা আর ত্যাগের উজ্জ্বল আলোকসভায়। ভাষাকে আর স্বদেশের সাতন্ত্র্যকে কবিতায় আঁকতে চেয়েছেন তিনি। বাংলাভাষার সমৃদ্ধ শব্দভাণ্ডার আর অমিত শিল্পরসকে সবসময় মনে রেখে পথ চলেছেন এই দায়িত্ববান কবি। কবিতার ভাষা নির্বাচনে নিজের তাগিদকে ব্যাখ্যা করেছেন অনেকটা পথ পেরিয়ে, জানাচ্ছেন—“প্রায় প্রথম যৌবনে, স্থির করেছিলাম যাকে আমরা সাধারণত মানুষ কথাবার্তা বলে, কাজকম্ম সারে, কবিতায় সেই আটপৌরে মুখের কথা ও বাকভঙ্গিকে তুলে ধরার চেষ্টা করব। সেই পরীক্ষা নিরীক্ষার সংকল্পে চিরকাল অবিচল থেকেছি, কখনো ক্লান্তি বোধ করিনি, তা থেকে ক্ষান্তও হইনি। কবি যে মাজা ঘষা ছাটাই বাছাই করে শব্দ সাজান, কবিতার কথা তৈরি করেন, তা কখনো ভুলিনি, কিন্তু লোকের চলতি কথার মধ্যেও অজান্তে একটা ছন্দ সুর, ভঙ্গি এসে যায়, সেটা সহজে চোখে পড়ে না। সব ভাষারই এই রকম একটা বৈশিষ্ট্য আছে। তাকে চিনতে, চেনাতে চেয়েছি। ” [ ভূমিকা, কবিতাসংগ্রহ]
তাঁর প্রথম কাব্য “নববসন্ত” প্রকাশিত হয় ১৯৪০ সালের ১৪ আগস্ট। প্রথম গ্রন্থেই তিনি নতুন ভাষা প্রয়োগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন; চেষ্টা করেছেন সমকালীন কাব্যপ্রবণতাকে পেরিয়ে যেতে। ছন্দকে ঢেলে সাজানোর কিংবা নতুন করে দাঁড় করাবার সাহসী পদক্ষেপ তিনি নিয়েছিলেন সেই অল্পবয়সেই। তবে বাংলাদেশের ঐতিহ্যিক শব্দ পরিবর্তন বা রূপান্তরে তাঁর ঘোরতর আপত্তি রয়েছে [যেমন: আবহাওয়া স্থলে হালকালে প্রবর্তিত জলবায়ু]। এই বইটি রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেছিলেন। আর বইটি পড়ে নজরুল তাঁকে একদিন সামনা সামনি বলেছিলেন, “একি করেছো হে? তোমার বয়সে এরকম কবিতা কেউ লেখে? এর মধ্যে তারুণ্য কোথায়?... কবিতা কি এত মেপে মেপে লেখে?” সৃষ্টিসুখের উলাসে কাঁপা অমিত-উদ্যমের কবিতানির্মাতা নজরুলের এমন মন্তব্যইতো স্বাভাবিক! ভাবতে অবাক লাগে প্রায় সত্তর বছর ধরে প্রায় নির্মোহভাবে, রাজনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত না হয়ে, অকল্পনীয় পরিমিতিবোধের শাসনে মেপে মেপে কবিতা লিখে, বাংলা কবিতার চর্চা ও সেবা করে গেছেন এই কবি। কবিতালগ্নতার প্রাকপর্ব সম্বন্ধে তিনি তাঁর পাঠককে জানাচ্ছেন:
“আমি তো একেবারে ছেলেবেলা থেকেই লেখালেখি শুরু করি। সম্ভবত ১৯২৯ সালে নদীয় জেলার কৃষ্ণনগরের কলেজিয়েট স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি। লেখার প্রেরণাটা মূলত রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ার সূত্রে। তৃতীয় শ্রেণী চতুর্থ শ্রেণীতে ওঠার সময় বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী সভায় অনেকগুলো বই উপহার পেয়েছিলাম। এখান থেকে সাদামাটা বইটা হাতে নিলাম। পাতলা হলদে মলাটের উপরের দিকে বড় বড় লাল অক্ষরে লেখা ‘সোনার তরী’। নিচে লেখকের নাম ‘শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’। দেখি গল্প বা জীবজন্তুর কথা কিংবা অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনী নয় গদ্যও নয়, বইটা পদ্যের। দোনামনা করে প্রথম কবিতার লাইন ‘গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা’ পড়তেই মনের মধ্যে এমন আলোড়ন শুরু হলো, বুকের মধ্যে আবেগ এমন উথলে উঠেছিল—আমি প্রায় এক নিঃশ্বাসে সমস্ত কবিতাটি পড়ে ফেললাম। পড়া শেষ হলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। কী ছিল ওই কবিতায়। ” [সাক্ষাৎকার, মত ও পথ বর্ষ ১ সংখ্যা ৬ ঢাকা ১ নভেম্বর ২০০৯]
তারপর ভেতরে ভেতরে বিচিত্র জিজ্ঞাসা—কে এই রবীন্দ্রনাথ, কী তাঁর ক্ষমতা, মানুষের সামর্থ্য কতটুকু?; আর খাতার পর খাতা হিজিবিজি লিখতে লিখতে আবুল হোসেনের কবিতা লেখার আরম্ভ। প্রেরণা পেয়েছিলেন স্কুলের বাংলা বিষয়ের শিক্ষক চারুবাবুর। ১৯৩২ কি ৩৩ সালে বড় বোনের বিয়েতে বরের মজলিসে উপহার কার্ডে লেখা কবিতাটি তাঁর প্রথম আনুষ্ঠানিক রচনা। [এর আগে যে সব আঁকিবুকি করেছেন, তার ভেতর কোনো কবিতার খসড়া ছিল কি-না কে জানে!; আর থাকলেও তা আজ অনানুষ্ঠানিক]
কবি আবুল হোসেন দীর্ঘ কবিতাযাপনে অনুভব করেছেন—হয়ত কোনো কাজের ফাঁকে কিংবা ঘুমুতে যাবার সময় মাথার ভেতরে কবিতার পঙক্তি আনাগোনা করছে, তখন তা লিখে না রাখলে পরে আর হাজার চেষ্টায়ও তা মনে করতে পারা যায় না। আর আজ, আমরা খুঁজছি তাঁর না-বলা কথাসমূহের অনুভবছবি। একেবারে আরম্ভের দিকের কবিতায় আমরা কবি আবুল হোসেনকে দেখি ভেতরের না-বাহির-করা অনুভূতিকে সাজানোর কারিগরের কাতারে। তিনি লিখছেন :
আমার শোণিতে, স্বেদে, অশ্রুতে ভিজিয়ে যে কবিতা
ছড়িয়েছি ইতঃস্তত তুমি কি পড়েছো কোনো দিন?
অনুভব করেছো কি আমার বেদনা সীমাহীন?
মন্ত্রমুগ্ধ কোনো রাতে খুলে দেখেছো, দেকেছো কি তা? [পূর্বলেখ]
স্বপ্ন আবুল হোসেনের কবিতার একটি আলোকক প্রসঙ্গ। দিনবদলের বাতাস কিংবা সভ্যতার অগ্রগমণে (সভ্যতা কি আদৌ এগিয়েছে; সভ্যতা নির্মাণের নামে শান্তির নামে যত যুদ্ধ হয়েছে, যত মানুষ মরেছে, তার হিসেব কষতে গেরে বিস্মিতই হতে হয়!) তিনি সান্ত্বনা আর নবজাগরণের আহ্বান প্রত্যাশা করেছেন। প্রতীক্ষার কান পেতে শুনতে চেয়েছেন আগমনি-বারতা।
স্বপ্ন দেখেছি দীর্ঘ দিবস রাতে,
শ্রান্তিবিহীন শিকারী আঁখির পাতা:
শুভ্র বকের কোমল পালক ঢাকা
জ্যোছনা রাতের সাদা মেঘ আর প্রভাতী পূর্বাকাশ;
আজ দেখি তার রঙিন পাখায় আঁকা
কুটিল হিয়ার স্নিগ্ধ প্রবঞ্চনা। [নবযুগ]
সাহিত্যবোধ, মানবভাগ্য, প্রজন্মান্তরের আশাবাদ আর প্রীতিসমেত গীতলতায় বাঙালির অহেতুক অবগাহনের কাহিনী বোধ হয় কবি আবুল হোসেন বুঝেছেন; কাছ থেকে অবলোকন করেছেন স্বপ্নবিভোরতার গল্পগাথা। যে সময়ে নারীরা কেবল ঘরের কিংবা অন্দরমহলের সৌন্দর্য লালন আর বৃদ্ধির মহৎ দায়িত্বে নিয়োজিত, যখন তাদের বাইরে বেরোনো অথবা প্রতিভার প্রকাশ ছিল প্রায় অসম্ভব, তখন রাজকুমারীর জন্য কোনো রাজকুমারের স্বপ্নযাত্রা কিংবা ঘোড়ায় চড়ে আসতে-থাকা ওই কুমারের প্রতীক্ষায় প্রহর-না-গোনা নারীর গল্প আঁকছেন কবি; আজকের দিনেও রান্নাঘরে কোনো আধুনিক মেয়ের মনে রাজকুমারের ছুটে আসার দৃশ্য উঁকি দেয় কি না, সে কথাও হয়ত ভাবতেন তিনি:
রাজপুত্রেরা পক্ষীরাজের পিঠে চড়ে কত নদ নদী পর্বত বন
মরুভূমি পথ ধরে ছুটেছে ঊর্ধশ্বাসে রাজকুমারীর তলাসে; ...
রাজকুমারের চোখে যেন ঘুম নেই, চলেছে তো চলছেই।
রাজকুমারীর খোঁজ কোনো দিন ওরা পাবে কি না সে কথা গল্পে
লেখে না, ...রাজকুমারীরা ওদের পথের
দিকে চেয়ে থাকে জানালার ফাঁকে
এমন কথাও শুনিনি। [বাংলার মেয়ে]
আবুল হোসেন আমাদের উত্তরাধিকার নির্মাণ আর দায় ও দারিদ্র্যের ভাষ্য-সাজানোর কবিতাকর্মী। সভ্যতার পথ-পরিক্রমায় মানবযাত্রার অংশগ্রহণ ও অবদান কিংবা উৎপাদন-সৃজননির্ভর ইতিহাস-ঐতিহ্যের দরোজায় কড়া নাড়ে তাঁর চেতন-অভিপ্রায়। চিনতে না-পারা সবুজরেখা, স্মৃতি-কুসুমের রাত, প্রাণহীন মানুষের ঘরময় দাপাদাপি, স্বপ্নভাঙার আহাজারি, সমুদ্রের জলে ভেসে থাকা নীরব নিবিড় অন্ধকার, হঠাৎ জেগে-ওঠা দূরস্থিত খরস্রোতা পাহাড়িয়া নদী, পাথরের মতো শক্ত ছুঁছলো ঢেলা, সবুজ কচি ধানের বীজ, মতাব্দির সাহারার বন্দর, ব্যাবিলন-পিরামিড-সুলেমান-ক্রুসেড-জেরুজালেম, চিকচিকে সকাল, অমাবস্যার দিঘির পাড় আর ছোট ছোট গ্রাম ও শহরের খোঁদাই করা রূপালি ফলক-ফটক পেরিয়ে কবি আবুল হোসেন উত্তরাধিকারের দায় ও দাবির দরোজায় উপনীত হয়েছেন যেন; শ্রান্ত পরিভ্রমণ শেষে প্রাসাদের পাহাড়ে পাহাড়ে নীল নরম জ্যোৎস্নায় ছুড়েছেন কতিপয় প্রবল প্রশ্ন:
আমরা কি মনে রাখব দেখেছি যা দুই চোখে?
চাষী মাঠে ধান বোনে, সুতো কাটে তাঁতী,
শান দেয় কুড়ালে কামার, জেলেরা নদীতে ফেলে
জাল, ঘটি বাটি বানায় কুমোর, কাঠ কাটে করাতীরা,
রেঁদা ঘষে ছুঁতোর, ক্ষেতে কলে জান দেয় হাজার
হাজার মজুরেরা। [উত্তরাধিকার]
লোকভাবনা আর লোকবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিরাট-বিস্তৃত পরিসর আজ আমাদের বিবেচনার বাইরে কি না, সে প্রশ্নও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কবি আবুল হোসেনও বোধ হয় আমাদের চেতনার ওই স্তরটিকে শাণিত করতে চেয়েছেন; ঐতিহ্যবিস্মৃতির আড়ালে তৈরি করতে চেষ্টা করেছেন উদার-অসীম কৃতজ্ঞতার চিন্তাভুবন।
‘দুঃসময়ের কাল’ (এ নামে একটি কাব্যও আছে তাঁর) তাঁর কবিতার অন্যতম অনুষঙ্গ। ভারতীয় প্রবণতা—দুঃস্বপ্নডানায় ডুবে থাকা (ইউরাপীয়দের মতো স্বপ্নডানায় ভাসতে থাকা নয়) কবি আবুল হোসেনকে আক্রান্ত করতে পেরেছে সহজেই; তিনি বহুভাবে অনেক কবিতায় তাঁর এই দুঃস্বপ্নযাত্রার কথা বলেছেন। জীবনের অগ্রগমনপথে তিনি বারবার লক্ষ করেছেন আমাদের স্বপ্ন দেখার আবেগ এবং স্বপ্নভাঙার বাস্তবতা। পাকিস্তান-আন্দোলন, দেশবিভাগ, ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই, স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম—এসব দুর্গম চিন্তাপরিক্রমা পার হয়ে তিনি খেয়াল করেছেন প্রকৃতঅর্থে স্বপ্নভ্রান্তির বহরের অপ্রতিরোধ্য প্রাচীরের পেছনে পড়ে রয়েছি আমরা। আমাদের সততায়, নৈতিকতায়, এমনকি দৃঢ় মনোবলেও ধস নেমেছে। আমাদের হাত-পা, চোখ-কান সবকিছুই অন্যায়, অসত্য আর দুর্নীতির কাছে বাধা পড়ে গেছে। আমরা কিছু করতে চাইলে করতে পারি না, কিছু বলতে চাইলে বলতে পারি না। আমরা প্রত্যেকেই যেন জিম্মি হয়ে পড়েছি আমাদের বৈরী সময়ের কাছে, চলমান দুঃসময়ের কাছে। যার রাহুগ্রাস থেকে বেরিয়ে আসার যেন কোনো পথই খোলা নেই। আমরা যে সময়ে বাস করছি সে সময়টা নিঃসন্দেহে ভয়ানক রকমের দুঃসময়। দুঃসময়ের রাহুগ্রাসে আমরা একেবারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। আমাদের চারদিকে কোনো সুসংবাদ নেই, সুবাতাস নেই; এমনকি সুস্থ চিন্তাভাবনা করার মানুষেরও বড় অভাব। যে সমাজে বাস করছি সে সমাজ আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না, এমনকি যে রাষ্ট্রে বাস করছি সে রাষ্ট্রও নিরাপত্তাদানে অপারগ। আমরা নানারকম সামাজিক এবং রাষ্ট্রিক সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হচ্ছি। পা পিছলে ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছি। সমাজের একজন সুস্থ এবং বিবেকবান মানুষ হিসেবে কবি আবুল হোসেন এই বৈরী সময়কে ধারণ করেছেন তাঁর কবিতায়; জানিয়েছেন তাঁর অভিমত ও অভিপ্রায়।
কুয়াশানিবিড় কাল সম্ভবত আবুল হোসেনকে ক্লান্ত করত (মাঝে মাঝে আশান্বিতও করত কি!)। অবিশ্রান্ত চিৎকার আর ডাল-ভাত-রুটিমাখা আলো-হাওয়ায় মন বাঁধেন তিনি পরম মমতায়। স্থবিরতার বিপরীতে, নীরব সংগ্রামের বজ্রকাঠিন্যে, অন্ধকার দূর করার শক্তি খোঁজেন তিনি—খুঁজেছেন সারাটি জীবন। একান্ত অনুভব জানাচ্ছেন আমাদেরকে: “আলো নিভিয়ে শুয়েছি যেই/ ঘরের মধ্যে নামল নিবিড় অন্ধকার,/ যেন এক অন্তহীন অরণ্যের মেঘ/ জমে আছে আমার এই কামরায়”। [আলো নিভিয়ে] স্বপ্নময়তা, গীতলতা, ভাবালুতা—সহজ করে বললে, রঙিন সকালে জানালার ধারে বসে জীবনকে দেখে নেওয়ার মতো মানসিক প্রস্তুতি বহন করেই তিনি যাপন করেছেন কবিতার কঠিন—কঠিনতম পথ; কিংবা, অন্যভাবে বললে এরকম দাঁড়ায়: কবি আবুল হোসেন ইজিচেয়ারে এলিয়ে দেহ কতোকাল ধরে নিয়েছেন কবিতার এই উত্তাপ (তাপ নয়)! মাঝে মাঝে মনে হয়, কবি কি গোপন করেছেন কোনো কথা—নীরবে; নাকি বলছেন দেদারছে, যা কিছু দেখছেন, অনুভব করছেন? ভাবি, তাঁর চোখে দেখা সেই ধীরে চলে যাওয়া কন্যাটির কথা, যেমনটি জানিয়েছেন তিনি :
সমস্ত শরীরে মেখে মায়ের ভা’য়ের ভালোবাসা,
সকলের মুগ্ধদৃষ্টি, অনাবিল প্রশংসার ভাষা,
দিনের রাতের যত বিস্ময় দু’ চোখে নিয়ে, মা রে
তুই চলে গেলি, দেখার যা শোনার যা দেখে শুনে।
শুধু যা বলার ছিল কিছু তার বলতে পারলিনে
মুখ ফুটে। [আমার মেয়েকে]
আবুল হোসেন জানতেন, জিনিসের দাম বাড়ে; বৃদ্ধি পায় না মানুষের দর (মানুষ কি জিনিস!) পেশাজীবীদের বেতনস্বল্পতা—জীবনের, সংসারের দায় বহনের ভারে ক্লান্ত মধ্যবিত্তের বিষণ্ণ চোখ হয়ত কবিকে ভাবিয়ে তুলেছে বারবার। ভারতের স্বাধীনতা, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্মলাভ, বাঙালির ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবি ও সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তি—এসব দেখেছেন তিনি সবাক নয়নে; অবিরাম বাড়তে থাকা দ্রব্যমূল্য; চালের-ডালের-আলুর-শাকের-হাঁড়ির-গাড়ির বাজার তিনি দেখেছেন, দেখছেন সেই কবে থেকে। আর ঠিক ঠিক বুঝেছেন—“চাহিদা নাই মানুষগুলোর। /কেবলি তার পড়ছে বাজার। ”
ট্রেন-পেন তাঁর কবিতায় প্রবেশ করেছে গতি-নতুনত্ব-চিন্তা আর বিস্ময়ের বহর সঙ্গে নিয়ে। ধেয়ে-চলা ট্রেনের জানালা কিংবা শূন্যে পাড়ি দেওয়া পেনের অদৃশ্য খোপে জেগে থাকে কত স্বপ্ন—কত অজানাকে জানার বাসনা।
কবির গদ্যচর্চাকে প্রয়োজন বলে ভাবতেন কবি আবুল হোসেন; তাঁর ধারণা কবির না-বলা কথার অনুরণন মেলে তাঁর গদ্যের গাঁথুনির আড়ালে। তাঁর কবিতায় দেশ যেমন আছে, তেমনি আছে দেশের জন্য আত্ম-উৎসর্গকারী নেতাদের প্রসঙ্গও।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৮ ঘণ্টা, জুন ২৯, ২০১৫