নাসির আলী মামুন বিশিষ্ট আলোকচিত্রী, দেশে পোরট্রেট ফটোগ্রাফির পথিকৃৎ, লেখক-সম্পাদক-সংগ্রাহক-সাক্ষাৎকারী, ফটোজিয়াম নামে এক আলোকচিত্র সংগ্রহশালার স্বপ্নচারী ও বাস্তবায়ক। এ সমস্ত পরিচয়ের নেপথ্যে আমার কাছে তাঁর একটি অনিবার্য পরিচয়পত্র দৃশ্যমান; আর তা হলো প্রতিইতিহাসকারের প্রতিচ্ছবি।
আলোকচিত্র কি কেবল ক্যামেরার কারিকুরি? শামসুর রাহমানের ভাষ্য মেনে মামুনের ক্ষেত্রে এর উত্তরে সবলে ‘না’ বলতে হয়। ‘ক্যামেরার কবি’ নাসির আলী মামুন ধরে রাখেন আলো-ছায়ার সম্মিলন ও দোলাচল। মুনেম ওয়াসিফ প্রণীত নাসির আলী মামুন তার আলো তার ছায়া (শ্রাবণ প্রকাশনী, ২০১৩)-তে অন্তর্ভুক্ত আলাপনে উঠে আসা কথাবার্তা এস্থলে উদ্ধৃত করা জরুরি—
...তখন লেখকদের বই উল্টাইতাম আমি। ফ্ল্যাপে যে লেখকের ছবি আমি দেখলাম, আমি তো তারে দেখছি গত সপ্তায়, ওমক অনুষ্ঠানে, সে তো এই রকম না। তার গর্ত আছে, সে কালো, কিন্তু ছবিতে মুখ ফোলা তার, ফর্সা। তার বসন্তের দাগ ছিল—দাগ নাই। এইটা কেমন? আমি তখন চিন্তা করলাম, না, এই রকম ছবি তো ছবি না। তখন আস্তে আস্তে আমারও চোখ আমি ঘুরাইলাম, মানুষের মুখের মধ্যে যা আছে, ক্ষত বিক্ষত এইগুলো সব আনতে হবে। শুধু তাই না, তার যে হৃদয়ের বেদনা, তার যে আনন্দ তার যে উচ্ছ্বাস সব ছবির মইধ্যে আনতে হবে। তার কষ্ট ছবির মধ্যে থাকতে হবে, থাকা উচিৎ আমি মনে করি, ঐটাই পোরট্রেট ফটোগ্রাফি। এবং তখন আমার মনে হইত যে, স্টুডিও ফটোগ্রাফি একটা সাইনবোর্ড। আমি তখন দেখলাম যে, না আমি তো সাইনবোর্ড পেইন্টার হইতে চাই না। সাইনবোর্ড আঁকাইয়া হইতে চাই না। (পৃষ্ঠা ১৮)
...বাহাত্তর সালে আমি ক্যামেরা হাতে নিলাম প্রথম, আমার নিজস্ব কোনো ক্যামেরা ছিল না। ধার করা ক্যামেরা, তখন আমি কাজে লাগাইলাম—এইসব মানুষদের যে ইমেজ আমার মধ্যে রইছে, সৃষ্টিশীল মানুষ এদের ওপর কাজ করব, পোরট্রেট করব। এদের দুঃখ, বেদনা এগুলোর ওপর কাজ করব। নির্মাণ করব তাদের চেহারা। (পৃ. ২১)
...সৃষ্টিশীল মানুষরা বাংলাদেশের, তারা অবমূল্যায়িত। রাষ্ট্র তাদেরকে সমর্থন করে না, রাষ্ট্র তাদেরকে জাতীয় পুরস্কার (বেশির ভাগেরই) দেয় না। মিড সেভেন্টিজ-এর পর শুরু হইছে একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক। তার আগে তো পদকই ছিল না, আমি তো তার আগেই ফটোগ্রাফি শুরু করছি। নানা কারণে... তারপর অর্থ কষ্ট, তাদের যে অবমূল্যায়ন রাষ্ট্র কর্তৃক সমাজ কর্তৃক... আর আমার জীবনের যে না পাওয়ার বেদনা, দরিদ্রতা, এই দুই রসায়ন এক সাথে হইয়া আমার ছবি এত অন্ধকার, কান্নাময়, এত রাফ। (পৃ. ৩০)
মানুষের মুখচ্ছবির অবয়বে এভাবে মামুন ধরে রাখেন মানুষ ও তার চলমান সময়কে। ‘ফাস্টকেলাস’ ছবি তোলার বাসনাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে এমন এক আলোকচিত্রধারা তিনি প্রবর্তন করলেন যে, ব্যক্তি তার ছবির ভেতর থেকে পরিপার্শ্ব-সময়-সমাজসমেত যেন কথা কয়ে ওঠে। আলোচিত্রশিল্পী আনোয়ার হোসেন ২৯ ডিসেম্বর ১৯৮০-তে যে টুকরো মন্তব্য করেছিলেন ‘মামুনের তোলা কবি আল মাহমুদের ভাঙা চশমার পোরট্রেট বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ পোরট্রেট আলোকচিত্র’—তা এই কারণেই সুসঙ্গত। ভাঙা চশমা আর তখন কোনো বস্তুগত উপাদান থাকে না, তা যেন কবির দুঃশীল বাস্তবেরই বার্তাবহ হয়ে ওঠে। প্রদর্শ্য বস্তুপুঞ্জ এভাবে নাসির আলী মামুনের ক্যামেরার কাজে নিজেই বয়ানকার হয়ে ওঠে। ক্যামেরা তখন কারিগরি সামর্থ ছাপিয়ে তার অধিক কিছু—দার্শনিক রঞ্জনমণ্ডিত।
১৯৭২-এ তোলা অকালপ্রয়াত অনুজ ইমরানের মায়াবী হাসিমাখা পোরট্রেট থেকে প্রত্যন্ত সন্তোষবাসী মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর ছবি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সম্মুখপ্রসারিত দৃষ্টির ছবি, অমিয় চক্রবর্তী-সত্যজিৎ রায়-রবিশঙ্কর-মুকুল দে-সমরেশ বসু-পক্ষিবিশারদ-সলিম আলী-পদার্থবিদ আবদুস সালাম প্রমুখের অসাধারণ সব ছবি, আহসান হাবীবের উদাস-এলায়িত ছবি, ধূম্রশালাকা হাতে জয়নুল আবেদিনের ছবি, সংবাদপত্রের সম্পাদক-টেবিলে বসা শামসুর রাহমানের ছবি, বিড়ালছানার সমাগমে এস এম সুলতানের নিভৃত ভাত খাওয়ার ছবি, বর্ধমান হাউজের বারান্দায় বসা কাজী মোতাহার হোসেনের ছবি, মাদার তেরেসার শান্ত ও সৌম্য দাঁড়িয়ে থাকা ছবি, সুফিয়া কামালের সাহসী-স্নিগ্ধ ছবি, মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে প্রিয় পাইপমুখে গুন্টার গ্রাসের ছবি, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ঋষিপ্রতিম ছবি, হুমায়ূন আহমেদের ভাবলেশহীন বসে থাকা ছবি, হুক্কাটানা মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের ছবি, আবুল হোসেনের ঋজু-টানটান উর্ধ্বপানে তাকিয়ে থাকা ছবি, পলাশবাড়ির বাগানে জসীমউদ্দীনের নিসর্গলগ্ন উদ্ভাসিত মুখোচ্ছবি, সৈয়দ শামসুল হকের দুই করতল একত্রবদ্ধ সব্যসাচী প্রতিমার ছবি, হাসান আজিজুল হকের মগ্ন মুখাবয়ব, সেলিম আল দীনের দূরাভিসারী দৃষ্টির ছবি, আহমদ ছফার ভাবুকতা দীপ্ত ছবি, অরুন্ধতী রায়ের দীপ্ত-প্রত্যয়ী ছবি, শহীদ কাদরী-আবু ইসহাক মাহমুদুল হক-বেলাল চৌধুরীর সৃষ্টিপ্রভাব ছড়ানো অগণন আলোকচিত্রগুচ্ছের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যের এক চলমান ইতিহাস বুনন করে চলেছেন নাসির আলী মামুন। ‘ছবি কথা বলে’ জাতীয় আপ্তবাক্যের নিকুচি করে ইত্যাকার পোরট্রেট যেন প্রতিষ্ঠা করে এই সত্য যে—ছবি অকথিত ইতিহাসকে ধারণ করে তার অমোঘ ইঙ্গিতসূত্রে। নাসির আলী মামুনের আলোকচিত্রসংগ্রহ গুন্টার গ্রাসের ঢাকা আবিষ্কার (দ্বিভাষিক, আগামী প্রকাশনী ২০০১), কীর্তিমানের মুখচ্ছবি (অনন্যা), Guru (নীড় লিমিটেড, ২০১৩) এ প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য।
২.
নাসির আলী মামুনের আরেক নেশা সাক্ষাৎভাষ্য ধারণ। এই ক্ষেত্রে তিনি কোনো শ্রেণিকরণে অবিশ্বাসী কারণ মৌল আদর্শে তিনি শ্রেণিহীন সাম্যসময়ের প্রত্যাশী। তাই সমাজকাঠামোর বিশিষ্ট বর্গ থেকে প্রান্তীয় বর্গ সবাইকে তিনি তার সাক্ষাৎভাষ্যে ধারণ করেন। একটি দৈনিকে দীর্ঘদিন যাবৎ ‘ঘর নাই’ শিরোনামে তিনি ঢাকা শহরের ভাসমান মানুষদের জবানি ধারণ করেছেন যা ঘর নাই (মাওলা ব্রাদার্স ২০০১) এবং চাড়ালনামা (আগামী প্রকাশনী ২০১১) গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। এই বিষয়ে তিনি বলেন—
হঠাৎ আমার মনে হইল এই যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিখ্যাত মানুষদের ওপরে এতকাল কাজ করলাম আমি, এই যে, এত বড় বড়, মানে হাইপোথিটিকালি বলি, এই যে এত বড় বড় দুর্বৃত্তদের ওপর যে আমি কাজ করলাম এর বাইরে যে মানুষগুলি আছে, দুর্বৃত্তদের কারণে যারা ফুটপাতে রাস্তায় পইড়া গেছে, পায়ের নিচে পইড়া গেছে, তাদের মনের অবস্থা কেমন এবং কী কারণে তারা হোমলেস। আমি একটা ছোট্ট টেপ রেকর্ডার আর একটা ক্যামেরা পকেটে নিয়া বাইর হই, দেখলাম যে প্রথমে ব্যাগ, ক্যামেরা, চকচকে ক্যামেরা দেখলে পালাই যাইত। ওরা মনে করত কোনো এনজিও’র লোক কিনা, কিডনি কাইটা লইয়া যাইব কিনা! কিম্বা গভর্নমেন্টের কোনো লোক কি না, পিছে পুলিশ আছে, নিয়া যাবে কি না! সেই জন্য খারাপ পোশাক পইড়া ছোট একটা টেপ রেকর্ডার আর একটা ছোট্ট পকেটে ক্যামেরো নিয়া বাইরইতাম। (মুনেম ওয়াসিফ প্রণিত পূর্বোক্তগ্রন্থ, পৃ. ৬০)
আমরা মনে করি গৃহহারা মানুষের অবিকল মুখের ভাষায় গৃহহারা বাংলাদেশই ধরা রইল মামুনের এই সিরিজ-কাজের মধ্য দিয়ে, যারা চোখে আঙুল দিয়ে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা চিহ্নিত করে চলে যে রাষ্ট্র নাগরিকের গৃহসংস্থানের ন্যূন অধিকার নিশ্চিত করতে পারেনি।
নাসির আলী মামুনের সাক্ষাৎভাষ্যের গ্রন্থ শামসুর রাহমান আল মাহমুদ তফাৎ ও সাক্ষাৎ (আদর্শ প্রকাশনী, ২য় সংস্করণ মে ২০১৪) এবং আহমদ ছফার সময় (শ্রাবণ প্রকাশনী, চতুর্থ সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১৩)। প্রথমোক্ত বইয়ে বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান দুই কবিকে নানান বৈঠকিতে বসিয়ে তিনি তুলে এনেছেন আবহমান বাংলা কবিতা থেকে তাঁদের নিজস্ব কবিতার ঘরবাড়ির গল্পগাছি। শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদকে মিলিয়ে দেয়ার ‘কৃতিত্ব’ প্রদর্শন নয় বরং এ বইয়ের নানা পর্বে আমরা দেখব কবির ভেতরের মানুষটিকে তিনি তুলে আনতে চেয়েছেন তাদের স্বপ্ন-স্বপ্নভঙ্গ—ভূতভবিষ্যবর্তমান; সেই সঙ্গে কবির বিশ্বাস-অবিশ্বাসের আখ্যান। আমরা মনে করি এই দুই কবিকে সম্যক বুঝতে গেলে মামুনের বইটির কাছে আমাদের আসতেই হবে।
আহমদ ছফা মামুনের অনন্ত আগ্রহের বিষয়। ছফার ভেতর থেকে এমন ভয়ংকর সত্যভাষ্য বের করে আনার তাকত নাসির আলী মামুনেরই থাকে বোধহয়—
একটা মানুষের মধ্যেই গোজামিল থাকে। কিন্তু যে সাপ সে হান্ড্রেড পার্সেন্ট সাপ। সে শেয়াল সে হান্ড্রেড পার্সেন্ট শেয়াল। মানুষ সাপও হইতে পারে, শিয়ালও হইতে পারে, পাখিও হইতে পারে। মানুষেরই বিবিন্ন চরিত্র নেয়ার ক্ষমতা আছে। বুঝেছো, গ্রাম দেশে আগে সাপ আর শিয়াল পাওয়া যাইতো। এগুলো নাই এখন! কারণ সাপ শিয়াল এরা মানুষ হিসেবে জন্মাইতে আরম্ভ করছে। (সূত্র : আহমদ ছফার সময়)
আহমদ ছফার সাক্ষাৎভাষ্যে সাহিত্যের গভীর নির্জন পথ ধরে সমাজ-সংস্কৃতির-রাজনীতির শত কাকলি যেমন শুনি তেমনি মামুনের ক্যামেরাকাজের মতোই তার প্রশ্ন-আলাপে বহমান সময় ও মানুষের সংগ্রামী বা ধাপ্পাবাজি চরিত্রও বের করা যেতে পারে।
নাসির আলী মামুন গৃহীত সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে আমরা যেমন সরদার ফজলুল করিমের জবানিতে পাই প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের জ্ঞানপিপাসা, দেশের জন্য কবি শহীদ কাদরীর আকুলতা ও কবির দিনানুদৈনিক লড়াইয়ের কথা, বেগম মমতাজ জসীমউদ্দীনের জবানিতে কবি জসীমউদ্দীনের অন্তর্মহলের কথা, স্ত্রীর অকালপ্রয়াণের অনুষঙ্গ-সূত্রে নারীপ্রসঙ্গে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ভাবনা, উপন্যাসের শব্দ থেকে অভিধানের শব্দে আবু ইসহাকের স্বচ্ছন্দ পরিব্রাজনের কথা, নিয়তিবাদের প্রতি হুমায়ূন আহমেদের আসক্তির কথা, মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের লালনগ্রস্থ মহাজীবনের কথা, প্রতিবাদের বেদিতে অরুন্ধতী রায়ের আরাধনার কথা, চারপাশের অশৈল্পিক শোরগোলে মাহমুদুল হকের স্তব্ধ হয়ে যাওয়া, চলচ্চিত্রে তারেক মাসুদের লড়াইয়ের কথা, অ্যালেন গীন্সবার্গ-নির্মলেন্দু গুণের বোহেমিয়ান বন্ধুত্বের কথা। এভাবে তার অজান্তেই নাসির আলী মামুন সাহিত্যসময়ের এক সুপ্রসর আর্কাইভস নির্মাণ করে চলেছেন। তার এই আর্কাইভাল কাজের একটি গ্রন্থবদ্ধ রূপ থাকা দরকার।
৩.
কবি জসীমউদ্দীন মামুনের সাহিত্যিক লড়াইয়ের প্রধান এক সূত্র। তার জসীমচর্চা কেবল ডকুমেন্টেশন নয় বরং বাংলা সাহিত্যের এই বিশিষ্ট সাহিত্যস্বরকে তিনি আমাদের সাহিত্যের সম্পূরক অংশ নয়, অন্যতম প্রধান অংশজ্ঞানে ২০০৩-এ তাঁর জন্মশতবর্ষে ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদ থেকে সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন শতবর্ষে জসীমউদ্দীন শীর্ষক সংকলন। বলা যায়, এ বইয়র মধ্য দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানপাঠ্য ‘পল্লীকবি’র বৃত্ত ভেদ করে বাংলা কবিতা ও বৃহদার্থে বাংলা সাহিত্যের গুরুতর আলোচনায় জসীমউদ্দীনের নতুন অভিষেক ঘটে। আমরা মনে করি এই কাজে নাসির আলী মামুন বিশেষ স্বীকৃতির দাবিদার। তার ছেদহীন জসীমচর্চা সাহিত্যপরিসরে কী প্রভাব তৈরি করেছে তার ফলাফল আমরা প্রত্যক্ষ করি কবির ১১০তম জন্মবার্ষিকীতে মাটি ও মানুষের কবি জসীমউদ্দীন (আদর্শ প্রকাশনী) নামে মহাকায় সংকলনের প্রকাশনা থেকে।
প্রায় নয়শত পৃষ্ঠার মাটি ও মানুষের কবি জসীমউদ্দীন ধারণ করেছে এযাবৎকালে রচিত ও প্রকাশিত জসীমউদ্দীন বিষয়ক উল্লেখযোগ্য রচনাসকল, কিছু নতুন লেখা; সেই সঙ্গে কবির অপ্রকাশিত রচনা, প্রামাণ্য জীবনবৃত্তান্ত, বিস্তারিত গ্রন্থপঞ্জি ও দুর্লভ আলোকচিত্রমালা। ‘সম্পাদকের নিবেদন’ এ নাসির আলী মামুন বলছেন—
মাটি ও মানুষের কবি জসীমউদ্দীন আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের এক অনিবার্য রূপকার। এ-বছর তাঁর জন্মের একশত-দশ বছর অতিবাহিত হলো। কিন্তু তাঁর সাহিত্যের মূল্যায়ন বা সৃষ্টিকর্মের ওপর ভিত্তি করে নিবিড় গবেষণা এখনো হয়নি। এক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে, দুই বাংলায় জসীমউদ্দীনকে নিয়ে যত প্রকাশিত লেখা আছে তা বাছাই করে একটি গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করা যাতে আগামীতে গবেষকরা এখান থেকে তথ্য উপাত্ত কাজে লাগাতে পারে।
‘জসীমউদ্দীন-এর সাহিত্য বিচার’, ‘স্মৃতিকথন’ এবং ‘বিবিধ প্রসঙ্গ’ শিরোনামে তিন পর্বে বিন্যস্ত এই গ্রন্থ পর্যালোচনায় আমরা দেখব সম্পাদক সামগ্রিক জসীম উদ্দীনের মুখচ্ছদ অঙ্কনের প্রয়াস চালিয়েছেন। তাই দীনেশচন্দ্র সেন, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, শিবনারায়ণ রায়, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আনিসুজ্জামান, সানজীদা খাতুন, শামসুজ্জামান খান, আবদুল মান্নান সৈয়দ, নির্মলেন্দু গুণ, সৈয়দ আবুল মকসুদ, সলিমুল্লাহ খান, কৃষ্ণা বসু, হুমায়ুন আজাদ, মুহম্মদ নূরুল হুদা, বীতশোক ভট্টাচার্য, বিশ্বজিৎ ঘোষ, মোহাম্মদ আজম প্রমুখের অন্তর্ভেদী বিশ্লেষণের পাশাপাশি মাহবুব-উল-আলম, কবিয়াল বিজয় সরকার, মহিন শাহ, নীলিমা ইব্রাহিম, মমতাজ জসীমউদ্দীন, মৃণাল সেন, আবু ইসহাক, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, শামসুর রাহমান, জামাল আনোয়ার, আসাদ চৌধুরী, হাসনা মওদুদ, আহমদ ছফা, আবুল আহসান চৌধুরীর স্মৃতিবিচিত্রার বর্ণিল সমাবেশ ঘটেছে এখানে। কবির মৃত্যুর অব্যবহিত পর আলোচ্য গ্রন্থের সম্পাদক তার অটোগ্রাফ খাতায় জসীমউদ্দীন সম্পর্কে বিশজন বিশিষ্ট লেখকের চকিত মূল্যায়ন লিখে রাখেন। এই গ্রন্থের পরিশিষ্টাংশে প্রথমবারের মতো সেগুলো প্রকাশিত হলো যার ঐতিহাসিক-সাহিত্যিক মূল্য সামান্য নয়। অটোগ্রাফ খাতার লেখক-তালিকায় অন্যান্যের মধ্যে রয়েছেন—ইব্রাহীম খাঁ, আবদুল কাদির, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, মুহম্মদ এনামুল হক, আবুজাফর শামসুদ্দীন, আবুল ফজল, কাজী মোতাহার হোসেন, সুফিয়া কামাল, আহসান হাবীব, সৈয়দ মুর্তাজা আলী। কবি আহসান হাবীবের তাৎক্ষণিক মন্তব্যে যেন ধরা পড়েছে জসীম উদ্দীনের সারসত্তা—
ঐতিহ্যবাহী বাংলা কবিতার মূল ধারাটিকে নগরসভায় নিয়ে আসবার কৃতিত্ব জসীম উদ্দীনের। জসীম উদ্দীন তাঁর কাব্যাদর্শে আজীবন অটল ছিলেন এবং গ্রাম্যতা পরিহার করেও গ্রামীণ ভাবাবহে তিনি প্লবিত করে রেখে গেছেন নগরাক্রান্ত চিত্ত।
গ্রন্থভুক্ত একশত তেরোটি রচনায় প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গে প্রতিভাসিত হয়েছে জসীমউদ্দীনের কবিতাপৃথিবীর বিষয় ও বৈশিষ্ট্য, তাঁর গদ্যচর্চা-গ্রামীণগীতিকা সংগ্রহ, সমসাময়িক কল্লোল যুগ, আধুনিকতা ও বিশ্বের বিভিন্ন সাহিত্য আন্দোলনের প্রেক্ষিতে জসীম-বিবেচনা, লোকজীবন ও লোকমানস-সাধনা, তাঁর প্রগাঢ় জাতীয়তাবোধ ও আন্তর্জাতিকতা, জসীমউদ্দীন ও জাতীয় সাহিত্য, মুক্তিযুদ্ধ-বঙ্গবন্ধু ও জসীমউদ্দীন। এছাড়া কয়েকজন লেখক লালন-হাছন রাজা-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ও আব্বাসউদ্দীনের সঙ্গে জসীমউদ্দীনের তুলনামূলক আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়েছেন।
এই সংকলনে এমন অনেকের মূল্যবান লেখার সন্ধান পাই আমাদের সাহিত্যিক পরিসরে যাদের নাম বহুশ্রুত নয়। লেখার গুরুত্বে সম্পাদক দুই বাংলার বহু আপাত অবজ্ঞাত সূত্র থেকে সেই সব লেখা সংগ্রহ করে একে ঋদ্ধিবান করেছেন। সেই সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের খ্যাতকীর্তি সমালোচকদের পাশাপাশি সাম্প্রতিক তরুণদের রচনা গ্রন্থবদ্ধ করে মাটি ও মানুষের কবি জসীমউদ্দীন-চর্চার নতুন অভিমুখ তৈরি করেছেন।
৪.
এসবের সমান্তরালে বহমান নাসির আলী মামুনের শক্তিমান-দরদী লেখকসত্তা। উদাহরণত আমরা তার ‘নজরুলের গ্রাম’ রচনায় দেখি চুরুলিয়ার গ্রামগহীন সফরে নজরুলের শেকড়সন্ধান, ‘আবু ইসহাককে দেখা’ শীর্ষক স্মৃতিভাষ্যে দেখি শব্দসন্ধানে কাঁচাবাজার ভ্রামণিক অভিধানপ্রেমি আবু ইসহাকের আন্তর্বয়ব, ‘নজরুলের আলোকচিত্রের বিধি ও কিছু জসীমউদ্দীন’ নিবন্ধে দেখি নতুন গবেষণারীতিতে হাসপাতালে মুখোমুখি বসা নজরুল ও জসীমউদ্দীনের আলোকচিত্র ধারণের পূর্বাপর, আর গুন্টার গ্রাস বিষয়ে স্মৃতি-মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে পাই দূরদেশের অলিগলিতে একজন টিনড্রাম-বাদকের নতুনভাবে বেজে ওঠার শব্দ।
৫.
নাসির আলী মামুনের অক্ষয় কীর্তি তার প্রতিষ্ঠিত ফটোজিয়াম। মিউজিয়ামের কথা জানতাম আমরা। আমাদের ধারণাবিশ্বে ফটোজিয়ামের অন্তর্ভুক্তি ঘটালেন তিনি। ফটোগ্রাফিকে ব্যক্তিগত এক্সিবিশনের ঘেরাটোপ থেকে ছিন্ন করে তিনি তাদের জনসম্পদ হিসেবে সংরক্ষণের এক ঐতিহাসিক দায় সম্পূর্ণ নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন। আর শুধু ছবি নয়, লেখকের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি, ডায়েরিরও সন্নিবেশ ঘটেছে তাতে। লেখকের আঁকা ছবি, শিল্পীদের স্কেচ-ড্রইং-অটোগ্রাফের সংগ্রহও আছে ফটোজিয়ামে। শামসুর রাহমানের আঁকা অর্ধশত চিত্রকর্ম, অস্কারবিজয়ী কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতা সিডনি পয়টিয়ারের আঁকা ছবিসহ শত শত সেলফ পোরট্রেটের সংগ্রহ ঋদ্ধ করেছে মামুনের এই আলোকচিত্র জাদুঘরকে। এছাড়া লোকাল স্টুডিও, ফটোগ্রাফারদের ছবি ও প্লেটের সংগ্রহের মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের ফটোগ্রাফির ইতিহাসের ধারাক্রম ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাঁচিয়ে রাখতে চান যেন প্রযুক্তির বিস্ফোরক বিকাশ অতীতসত্তাকে ভুলতে না দেয়। যেন ভবিষ্যতের ফটোগ্রাফার তার ক্যামেরা ক্লিকের আগে ভাবে এই পর্যায়টিতে আসতে তাঁকে আমানুল হক, নাইবউদ্দিন আহমদ, রশীদ তালুকদার, আনোয়ার হোসেন এবং অনিবার্যভাবে নাসির আলী মামুন-পর্ব পার হয়ে আসতে হয়েছে।
২০১৩-তে ষাট পেরিয়েছেন নাসির আলী মামুন। রাজধানী থেকে দূরে সাভারে বসত করা এই চিরমৃত্তিকালগ্ন মানুষটি তাঁর বহুধা কর্মের পেশি ও পেলবে হয়ে উঠেছেন আমাদের হৃৎ-আকাশের একজন প্রতিইতিহাসকার। আলোছায়ার অনন্য সম্পাতে তিনি আমাদের আরো ঋণী করে যেতে থাকুন। ইতি—দেনাগ্রস্ত আমরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১০ ঘণ্টা, জুলাই ১, ২০১৫