রাস্তাটা একেবারেই নির্জন। হেডলাইটের আলোয় মুষলধারে বৃষ্টি দেখতে ভালো লাগছে জাফরের।
ড্যাশবোর্ডের ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত বেশি নয়, ন’টা বেজে পাঁচ। কিন্তু আশপাশের অবস্থা দেখলে মনে হয় অনেক রাত। মদের নেশা কেটে যাচ্ছে। রাস্তার পাশে গাড়ি থামাল ও। পাশে ফেলে রাখা বোতলটা তুলে নিয়ে ছিপি খুলে লম্বা চুমুক দিল।
বোতল রেখে সিগারেট ধরাল। রেডিওতে গান হচ্ছে। ভালো না লাগায় বন্ধ করে দিল রেডিও। হেডলাইট নিভিয়ে পুরো অন্ধকার করে দিল। নির্জন এই পাহাড়ি পথে বৃষ্টির মধ্যে একলা বসে থাকতে কেমন লাগে দেখতে চাইছে।
নেশা ধরতে আরম্ভ করেছে আবার। গাড়ির ছাদে বৃষ্টির একটানা শব্দ। নিরালা এই নির্জনতা ভালোই লাগছে ওর। ফুরফুরে হয়ে আসছে মেজাজ। বাড়ি যাবার তাড়া নেই।
কটকছড়িতে যাচ্ছে ও। ওখানে একটা বাংলো আছে ওর। চিটাগাং-রাঙামাটি সড়ক থেকে মোড় নিয়ে অনেকখানি ভেতরে চলে গেছে একটা রাস্তা, সেটার মাথায় কটকছড়ি। তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করছে ওখানে একটা বিদেশি কোম্পানি। নিজেদের সুবিধের জন্য অনেক কিছুই করেছে ওরা। বাজার গড়ে উঠেছে, ভালো কিছু দোকানপাট হয়েছে, একটা ব্যাংক শাখা অফিস খুলেছে, রাস্তা তৈরি হয়েছে ট্রাক চলাচলের জন্য।
বছর তিনেক আগে কটকছড়িতে বাংলোটা কিনেছে জাফর। দোতলা কাঠের বাড়িটা ছিল এক নিঃসন্তান ধনীর। তাঁর বিধবা স্ত্রীর কাছ থেকে কিনেছে জাফর। গাছপালায় ঘেরা বাড়ি। আশপাশে রয়েছে প্রচুর বুনো লতা আর ফুলের গাছ। বসন্ত এলে ফুলে ফুলে ভরে যায়।
বাড়িটা কিনে ওটাকে আধুনিক করার জন্য প্রচুর টাকা খরচ করেছে জাফর। বাথরুম, রান্নাঘরে দামি দামি ফিটিংস লাগিয়েছে। ছুটি কাটানোর চমৎকার জায়গা।
ঢাকায় কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলে বিরক্তি আর একঘেয়েমি কাটাতে ওখানে যায় ও—মানে যেত, তবে গত এক বছর ধরে একবারের জন্যও যেতে পারেনি ও। সালমার কারণে।
সালমা জাফরের স্ত্রী। স্বভাবে বিপরীত। নির্জন পাহাড়ে যাওয়ার কথা শুনলেই আঁতকে ওঠে সালমা।
গভীর রাতে সালমা যখন ঘুমে অচেতন, ঢাকার বাড়িতে লোডশেডিংয়ের অন্ধকার, প্রায়ই জানালায় বসে জায়গাটার কথা ভেবেছে ও। বুনো ফুল, পাহাড়, নদী, বন। কাঁধে ছিপ, হাতে মাছ নিয়ে গোধূলির সবুজ আলোয় পাহাড়ি পথে বাংলোয় ফেরার আনন্দ! আহা!
‘ফ্যাটাল ম্যারেজ!’ বিড়বিড় করল ও।
সালমা সুন্দরী। বিয়েও করেছে দুজনে প্রেম করে। তবে বেশিদিন এই প্রেম টেকেনি। জাফরের ধারণা, ভালোবাসা নয়, শুধুমাত্র ক্ষণিকের মোহে ওকে বিয়ে করেছে সালমা।
চূড়ান্ত ঝগড়া হয়ে গেছে গতকাল। চিৎকার-চেঁচামেচি, জিনিসপত্র ভাঙা ইদানীং নিত্যদিনের ঘটনা। তবে গতকালকের ঝগড়াটা মাত্রা ছাড়িয়েছিল। এ রকম ঘটতে থাকলে অনেক খারাপ কিছু ঘটে যেতে পারে। তাই গত রাতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও। ঢাকায় আর একটা মুহূর্ত নয়। চলে যাবে, দূরে, অনেক দূরে। সালমার কাছে থাকলে বাঁচবে না ও।
একটা ফিল্ম কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও। প্রতিবছর একটা করে ছবি বানায়। সব ছবি হিট। কিন্তু সালমাকে বিয়ে করে সব নষ্ট হতে বসেছে। কাজে মনোযোগ দিতে পারে না। যখন-তখন অফিসে গিয়ে হাজির সালমা। প্রতিদিনই ওর কোনো না কোনো আবদার—শিল্প মেলায় যেতে হবে, চায়নিজ খাওয়াতে হবে, বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। একা গেলে যাক, আপত্তি নেই—কতবার বুঝিয়েছে জাফর, কিন্তু সালমা শুনবে না। এমনিতে একা সে বেরোয় না তা নয়, প্রচুর বেরোয়, কিন্তু জাফর অফিসে গেলেই যেন মাথায় রক্ত চড়ে যায় সালমার, ওকে বিরক্ত করাটা ওর একমাত্র লক্ষ্য।
আগে মদ খেত না জাফর, সালমার যন্ত্রণায় মানসিক অশান্তি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য এই বিষ ধরেছে। মাতাল হয়ে সব ভুলে থাকাটা অনেক শান্তির।
গত রাতে ঝগড়ার পর আজ সকালে উঠেই ব্যাগ-সুটকেস গুছিয়ে নিয়ে, অফিসের ভার ম্যানেজারের ওপর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে জাফর। বাগড়া দিচ্ছিল সালমা, শোনেনি ও। সোজা গাড়িতে উঠে বসেছে।
প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়তেই চমকে চোখ মেলল জাফর। ঘুমিয়ে পড়েছিল নাকি? হাই তুলল ও। কানে আসছে বৃষ্টির শব্দ। গাড়ির ছাদে আঘাত হেনে চলেছে একটানা।
হাত লম্বা করে আড়মোড়া ভাঙল। ড্যাশবোর্ডের ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত দশটা বেজে পাঁচ। নির্জন রাস্তায় বৃষ্টি দেখা অনেক হয়েছে। এবার যেতে হয়। হেডলাইট জ্বালল। বৃষ্টির ফোঁটা নাচছে রাস্তার ওপর।
এখনও অনেকটা পথ যেতে হবে। দশ মাইল। ভালো রাস্তা হলে দশ মাইল কোনো ব্যাপারই না। কিন্তু রাস্তা খারাপ। বৃষ্টিতে নিশ্চয় আরও খারাপ হয়ে আছে।
কটকছড়িতে পৌঁছে রাতের বেলা এই দুর্যোগের মধ্যে কোনো দোকান খোলা পাবে না, জানে, তাই চিটাগাং থেকেই বাজার করে নিয়ে এসেছে। তরকারি, ডিম, আলু, মাখন, হিমায়িত মুরগি, গরুর মাংস, বিস্কুট, চানাচুর, চা-কফি, সোজা কথা, প্রয়োজনীয় কোনো কিছুই প্রায় বাকি রাখেনি।
সালমার কথা ভাবল আবার। কী করছে এখন সে? নিশ্চয় ক্লাবে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। ভাবতেই তেতো হয়ে গেল মন। রাগ গিয়ে পড়ল যেন চাবিটার ওপর। জোরে মোচড় দিল ইগনিশন কি-তে। স্টার্ট হলো ইঞ্জিন। এ সময়টায় এদিকে এমনিতেই যানবাহন থাকে না, রাতের প্রথম দিকে ট্রাক চলাচল করে, এগারোটা বাজতে না বাজতে বন্ধ হয়ে যায়। আজকে ট্রাকেরও দেখা নেই। নিশ্চয় দুর্যোগ দেখে বেরোয়নি ড্রাইভাররা।
মদ গিলে গিলে মাথার ভেতরটা কেমন ঘোলা হয়ে গেছে। পিচ্ছিল রাস্তায় ঠিকমতো ড্রাইভ করে যেতে পারলেই হয় এখন।
যতটা সম্ভব সাবধানে গাড়ি চালাল ও। সমানে চলছে উইন্ডশিল্ড ওয়াইপার, কিন্তু বৃষ্টির সঙ্গে কোনোমতেই কুলিয়ে উঠতে পারছে না। ভেজা কাচের ভেতর দিয়ে সবকিছুই ঘোলাটে দেখাছে। বৃষ্টির চাদর ভেদ করে সামনের দিকে বেশিদূর অগ্রসর হতে পারছে না হেডলাইটের আলো।
সামনে মোড়। ওটার কয়েক গজ পরে মূল রাস্তা থেকে নেমে গেছে আরেকটা সরু কাঁচা রাস্তা। ঝোপঝাড়ের মধ্যে প্রায় লুকানো। কড়া নজর না রাখলে চোখ এড়িয়ে যেতে পারে। গতি কমাল ও।
মোড় পেরিয়ে এসে একজন লোককে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। টর্চ জ্বেলে সংকেত দিচ্ছে। মাথায় ক্যাপ, গায়ে বর্ষাতি। পাশে সাইডস্ট্যান্ডে কাত করে দাঁড় করানো একটা মোটর সাইকেল।
পুলিশ! এত রাতে এখানে? নিশ্চয় মোটর সাইকেল খারাপ হয়েছে। নাকি পাহারা দিচ্ছে? চিন্তিত হলো জাফর। মাতাল হয়ে গাড়ি চালানোর অপরাধে না শেষে ড্রাইভিং লাইসেন্সটা ক্যানসেল হয়!
আবার ইশারা করল লোকটা।
পাশে এসে থামল জাফর। জানালার কাচ নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী?’
‘টহল দিতে বেরিয়েছিলাম,’ মুখ ভালোমতো দেখা যাচ্ছে না লোকটার। ক্যাপ টেনে দিয়েছে কপালের ওপর, বর্ষাতির কলারটা উঁচু করে দিয়েছে, বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য বোধ হয়। ‘ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল। স্টার্ট নিচ্ছে না কিছুতে। ’
‘কোথায় যাচ্ছিলেন?’
‘রাঙামাটি। ’
‘আমি তো ওখানে যাব না। কটকছড়ি যাচ্ছি। ’
‘মোবাইল আছে আপনার কাছে?’
‘না, ফেলে এসেছি। শান্তিতে ছুটি কাটাতে যাচ্ছি আমি আমার বাংলোতে। মোবাইলের ঝামেলা সঙ্গে আনিনি। ’
‘টেলিফোন আছে আপনার বাংলোতে?’
‘আছে। ’
‘তাহলে অসুবিধে নেই। থানায় ফোন করে পিকআপ আনতে বলব। আপনার অসুবিধে হবে না তো?’
‘না না, অসুবিধে আর কী। উঠুন। ’ প্যাসেঞ্জার সিটের দরজা খুলে দিল জাফর।
উঠে বসল লোকটা।
পুরোটা পড়ুন বিশেষ আয়োজনে। অপেক্ষায় থাকুন!
** হাসান আজিজুল হকের আত্মজীবনী | বসন্তের বাতাসের মতো
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩১ ঘণ্টা, জুলাই ২, ২০১৫