স্থান-কাল-পাত্র : প্রাথমিক বয়ান
আমাদের এ কাহিনীর যাত্রা শুরু হোক মরা নদীর ঘাট বটতলা থেকে।
যাত্রার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যারা কাহিনীর গতি-প্রকৃতিকে প্রভাবিত করবে, তারা আসলে সবাই মরা নদীর তীরবর্তী গ্রামের বাসিন্দা।
বটতলায় ডাকাতের দোকান-কাম-টিস্টলে এমনিতেই সারাক্ষণ ভিড় লেগেই থাকে। আজ বশিরকে ঘিরে তৈরি ভিড় কন্ট্রোল করতে দোকানে উপস্থিত স্বয়ং খাজা ডাকাত। দোকানদারি করার বদলে ভিড়কে নেতৃত্ব দেবার ভূমিকায় তার আগ্রহ বেশি। অন্যদিকে ডাকাতের মেয়ে দুলালি খুব মনোযোগ দিয়ে দোকানের সব কাপেই চা বানাতে ব্যস্ত। লিকারের সঙ্গে কৌটার দুধ আর চিনি মেশাতে আজ তার হাতের গতি ও কাপে চামচ নাড়ার টুং টাং আওয়াজটাও যেন ভিড়ের মতো মুখর। দোকানের বারান্দায় বাঁশের বেঞ্চিতে বসে বশির গ্রামবাসীদের মধ্যে কার সম্পর্কে বেশি আগ্রহ দেখাবে, সেটা বুঝতে না পেরেই যেন চোখ ঘোরাচ্ছে সবার ওপরেই।
ইটালি-ফেরত বশির আমাদের এ কাহিনীর নায়ক হবার মতো যোগ্য চরিত্র। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়ে নানা ধরনের কর্ম করে দেশে যারা বৈদেশিক মুদ্রা পাঠায়, তারা তো অর্থনীতির মাপকাঠিতে গরীব দেশের নায়কই বটে। ঠ্যংভাঙা গ্রামেও আছে এরকম পাঁচজন। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে শ্রমিকের কাজ করে দেশে টাকা পাঠায় নিয়মিত। একজন এরই মধ্যে বাড়ি পাকা করেছে, জায়গা-জমি কিনতেও বিদেশি টাকার জোর বেশি। বছরের পর বছর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেও সংসারে স্বচ্ছলতা এনেছে প্রবাসীরা। এ কারণে জামাইকে বিদেশে পাঠানোর জন্য পাঁচ লাখ টাকা পণ দিয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়েছে সাফাত বেপারি। অন্যদিকে পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে হলেও বিদেশে যাওয়ার লাইন খুঁজছে গ্রামের অন্তত জনা দশেক বেকার যুবক। ইতোমধ্যে দালালকে নগদে দুই লাখ টাকা দিয়ে অপেক্ষা করছে একজন। বিদেশযাত্রার স্বপ্ননেশায় মাতাল যুবকদের ভিড়ে ইটালি-বশির সৌভাগ্যের বরপুত্র যেন।
বিদেশে যাওয়ার কথা বলেই দশ বছর আগে ভাইদের কাছে পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রির আড়াই লাখ টাকা আদায় করেছিল বশির। ঝগড়া হয়েছিল ভাইদের সঙ্গে। এরপর কাউকে কিছু না বলে একদিন উধাও হয়েছিল গ্রাম থেকে। বেশ কয়েক বছর কোনো খোঁজ ছিল না তার। বাড়িতে টাকা পাঠায়নি। টেলিফোন-টেলিগ্রাম দূরে থাক, একটা চিঠিও লেখেনি ভাইদের কাছে। ধারণা করেছিল অনেকে, চাকরি খুঁজতে ঢাকা গেছে। পরে লিবিয়া-ফেরত একজনের কাছে শোনা গেছে, লিবিয়ায় গিয়েছিল বশির। সে দেশে গোলমাল শুরু হওয়ায় কর্মস্থল থেকে পালিয়েছে। তার পর থেকে নিখোঁজ। যুদ্ধের ডামাডোলে মারাই গেছে সম্ভবত।
বেকার অবস্থায় গ্রামে যারা ফোরটুয়েন্টি বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে, তারাও বশিরের দেশে মাটি না পাওয়ার শেষ পরিণতির কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছে। কিন্তু মরুভূমিতে একা হারিয়ে গিয়েও বশির মরেনি আসলে। আফ্রিকার মরুভূমি পেরিয়ে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে, নানা ঘাটের পানি খেয়ে অবশেষে ইটালির মিলান নগরীতে পাকাপোক্তভাবে থিতু হয়েছে। লুকিয়ে-পালিয়ে থাকার দিন তার শেষ। কারণ ইটালির মতো দেশে বৈধভাবে বসবাসের ছাড়পত্র পেয়েছে সে। দেশি টাকায় প্রায় এক লাখ টাকা বেতনের চাকরি পেয়ে গাড়িও কিনেছে। নিজেই নিজের গাড়ি চালিয়ে কাজে যায়, এয়ারকন্ডিশন্ড ঘরে বাস করে। দেশে ফেরার বছরখানেক আগে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল সে। ফোনে ভাইদের কাছে নিজের মৃত্যুঞ্জয়ী সৌভাগ্যের কাহিনী বিস্তারিত জানিয়েছে। ভাইদের কাছে খবর শুনে গ্রামবাসীদের কেউ কেউ বশিরকে রূপকথার নায়ক হিসেবে কল্পনা করতে শুরু করেছিল, আবার শোনা কথার এসব গল্পগুজব রূপকথার মতো ভুয়া ভেবেছিল অনেকেই। প্রমাণ হিসেবে নগদ টাকা পায়নি বলে বশিরের উন্নতিতে খুশি হওয়ার মতো দায়িত্ববোধ জাগেনি আপন ভাইদেরও। অবশেষে দশ বছর পর নিজেই নিজের জীবন্ত সুখবর হয়ে ঠ্যাংভাঙায় ফিরেছে বশির।
তিন মাসের ছুটিতে দেশে ফেরার উদ্দেশ্য ভাইদের কাছে আগেই জানিয়েছিল বশির। মা ও আত্মীয়-স্বজনদের দেখতে এসে দেশি মেয়েকে বিয়ে করতে চায় সে। দেশে বিয়ে করলে ক্রমে মা ও দু-একটি ভাতিজাকেও ইটালি নিয়ে যেতে পারবে। আর বিবাহিত স্ত্রীকে ইটালিতে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রেডি করেই দেশে ফিরবে বশির। বিয়ের পর স্ত্রীর পাসপোর্ট, ভিসা, বিমানভাড়া থেকে শুরু করে তাবত খরচ বশিরই বহন করবে।
তিস্তাপারের বিভিন্ন গ্রাম থেকে বিদেশ খাটতে অনেকেই গেছে ঠিক, কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকার দেশে যায়নি একজনও। পরিবারও নিয়ে যায়নি কেউ। তবে বিদেশে আয়-উন্নতির প্রমাণ দিতে নিয়মিত বাড়িতে কমবেশি টাকা পাঠিয়েছে সবাই। এদিক থেকে ব্যতিক্রমী বশির অধিক সৌভাগ্যবান, নাকি তার ফোরটুয়েন্টি স্বভাবটাই শুধু বিকশিত হয়েছে বিদেশের আবহাওয়ায়? এ নিয়ে সংশয় আছে গ্রামবাসীদের। তার পরও ইটালি-বশিরের জন্য উপযুক্ত পাত্রী ঠিক করতে কোমর বেঁধে লেগেছে আত্মীয়-স্বজনরা। ঠ্যাংভাঙার বহু বেকার যুবক বিদেশে যেতে না পারার হতাশা ভুলতে আজকাল নেশাভাঙ করে সময় কাটায়। সেখানে কোন ভাগ্যবতী মেয়ে বিনা খরচে ইটালি যাবে? এটা দেখারও কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে অনেকের মনে।
মরা নদীর পারের গ্রামাঞ্চলে বিবাহযোগ্য পাত্রীর অভাব নেই। সবার চোখে পড়ার মতো পাত্রী বটতলার ঘাটেও আছে একজন। বিয়ের বয়স, স্বপ্ন, যৌবন উছলে অপচয় হওয়ার পরও তার বিয়ের ফুল ফোটার লক্ষণ নেই। তার একটা বড় কারণ সে এই এলাকার কুখ্যাত খাজা ডাকাতের মেয়ে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই খাজা এলাকার দুর্ধর্ষ ডাকাতদের একজন হয়ে উঠেছিল। তাকে দেখলে মান্যগণ্য ব্যক্তিরাও মুখে হাসি ফুটিয়ে খাতির দেখাত, ভেতরে ভেতরে ভয়ে কাঁপত সবাই। গাঁয়ের ধনী গেরস্তরা তো বটেই, গরীব মানুষরাও ভয় পেত খাজা ডাকাতকে। সুন্দরগঞ্জের সরদারবাড়ি ডাকাতি হওয়ার পর খাজা ধরা পড়ে এবং জেলে যায়। টানা সাড়ে নয় বছর জেল খাটার পর বছর দুয়েক আগে মুক্তি পেয়েছে খাজা।
জেল থেকে বেরিয়ে খাজা ডাকাতি পেশা ছাড়ার ঘোষণা দেয়। কিন্তু তার মুখের কথা বিশ্বাস করেনি সবাই। কারণ বাপ-ভাইদের মতো ক্ষেতের কাম করতে কামলা-কিষাণদের দলে ভেড়েনি খাজা, আবার ভালো মানুষ সাজতে মাথায় টুপি দিয়ে মসজিদেও যায় না। গোঁয়ার ও খেলোয়াড়ি স্বভাবটা আছে আগের মতো। সংসার চালানোর জন্য চরের একমাত্র আবাদি জমিটা বিক্রি করে বাড়ির সমানে বড় দোকান দিয়েছে। ঠ্যাংভাঙা ঘাটের বটতলা তথা পাকা রাস্তার মাথায় চৌচালা ঘর উঠেছে একটা—ভিত পাকা, নতুন টিনের চাল, সঙ্গে বড় বারান্দাও আছে। ঘরটা যে বড় মনিহারি দোকান, সেটা ভেতরে সাজানো হরেক রকম মাল মুহূর্তেই বলে দেয়। তবে ঘরের চওড়া বারান্দাটা আসলে রেস্টুরেন্টও বটে। আরাম করে বসে চা-বিড়ি খাওয়ার জন্য বাঁশের তিনটা বেঞ্চি আছে, মাঝখানের টেবিলে কলসভরা পানি ও মগ। ক্লান্ত পথচারীরা বসে ইচ্ছামতো তৃষ্ণা মেটাতে পারে।
সাইনবোর্ড ছাড়াই দোকানটা সবার কাছে ‘ডাকাইতের দোকান’ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু দোকান চালায় আসলে ডাকাইতের মেয়ে দুলালি। বাপ জেলে থাকার সময় দুলালিও মায়ের সঙ্গে কোমর বেঁধে সংসারের হাল ধরেছিল, আবার কষ্ট করে হাই স্কুলে পড়ে কোনো রকমে ম্যাট্রিক পাস করেছে। জমি বিক্রির টাকায় খাজা ডাকাত ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া না শেখাক, অন্তত দুলালিকে ভালো ঘরে বিয়ে দেবে—সমাজের লোকজন এমন আশা করেছিল। কিন্তু ডাকাতের শখ মহাজন ব্যবসায়ী হওয়া। বাড়িতে পাকা দোকান দিয়েছে ভালো কথা, কিন্তু দোকানে মেয়েকেও বসিয়েছে। এখন দোকানের আসল কর্ত্রী যে দুলালিই, সেটা তার দোকানে বসা ও দোকান চালনা দেখেও বোঝা যায়। তবে দোকানদারিতে যতই যোগ্যতা দেখাক ডাকাতের মেয়ে, পাত্রী হিসেবে নিজের রূপ-যৌবন তো আর লুকিয়ে রাখতে পারে না। দোকানের বহু খদ্দেরই দোকানদারনীকে বিশেষ দৃষ্টিতে দেখে।
পুরানা ঘাটে ডাকাইতের নতুন দোকান গ্রামবাসীদের মিলন ও বিনোদন কেন্দ্র হয়েছে যেন। দেশে ফেরার গাঁয়ের পড়শি-স্বজনদের সঙ্গে মোলাকাতের জন্য বশিরকে বাড়ি বাড়ি যেতে হয় না। বটতলায় এসে ডাকাতের দোকানে বসে অনেককেই পেয়ে যায়। এখানে বলে রাখা ভালো, পড়শি হিসেবে খাজা ডাকাতের সঙ্গে বশিরের ভাইদের সম্পর্ক মোটেও ভালো নয়। খাজাকে ধরিয়ে দেয়ার পেছনে বশিরের বড় ভাই নাসিরও গোপনে পুলিশকে তথ্য দিয়েছিল। এখন তারা ডাকাতের দোকানে কোনো সওদা কিনতে আসে না পর্যন্ত। কিন্তু ইটালি-বশির বাড়িতে এসেই কেন ডাকাতের দোকানে আসর বসায়? বিয়ের জন্য শুধু ভাইদের ওপর নির্ভর করতে পারছে না বলেই কি? লোকজনের কাছে নিজের ভাগ্য বদল ও ইটালি দেশের বাস্তবতার নানা গল্প শোনায় বশির, যা রূপকথার চেয়েও অবিশ্বাস্য মনে হয় অনেকের কাছে। গল্প বলার ফাঁকে ফাঁকে সে দোকানের দিকে তাকিয়ে দোকান দেখে, দুলালির দোকানদারি দেখে, নাকি দুলালিকেও দেখে আড়চোখে? মেয়ে দোকানে থাকলে খাজা দোকানে বসে না সাধারণত। কিন্তু আজ বশিরকে দেখেই সম্ভবত মেয়ের পাশে দোকান আগলে বসে আছে।
ইটালি দেশের গল্পগাথা অগ্রাহ্য করে উপস্থিত গ্রামবাসীর মধ্যে খাজা ডাকাতই প্রথম চেঁচিয়ে বশিরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলে।
বিদেশের ফোরটুয়েন্টি গপ্পো হামাকে আর শোনাইস না, বশির! দেশে যত গ্যাঞ্জাম থাউক, কাজিয়া-ঝগড়া যা-ই হউক, নিজ দেশের ঠাকুর হয়ে থাকপো। ভিনদেশে গিয়া মোটাতাজা কুকুর হয়া লাভ কী হামার? আরব দেশে মিসকিনি করিয়া বাড়িতে দালান তুলছে কতজন, কিন্তু মিসকিনি স্বভাব তার ঘোচে নাই। না কী কন বাহে তোমরা?
ডাকাতি ছাড়লেও গোঁয়ার্তুমি ও সন্ত্রাস সৃষ্টির অভ্যাস যে যায়নি এখনও, সেটা দোকানদারি করতে গিয়েও মাঝে-মধ্যে কারণে-অকারণে উত্তেজিত চিৎকার করে সকলকে জানান দেয় খাজা। কিন্তু সদ্য বিদেশ-ফেরত ইটালি-বশিরের উদ্দেশে তার উত্তেজিত চিৎকারে পুরনো রাগ-ক্ষোভ কাজ করে কি না, সেটা ভিড়ের সঙ্গে মিশে অনুসন্ধান করার আগে নৌকাবিহীন এই ঠ্যাংভাঙা ঘাটের অতীত ও হাল-হকিকত ভালো করে খেয়াল করা দরকার।
পুরোটা পড়ুন বিশেষ আয়োজনে। অপেক্ষায় থাকুন!
** হাসান আজিজুল হকের আত্মজীবনী | বসন্তের বাতাসের মতো
** রকিব হাসানের থ্রিলার উপন্যাস | ভোরের জ্যোৎস্না
বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, জুলাই ৪, ২০১৫