ঢাকা, শনিবার, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

রাফিক হারিরির অনুবাদে | আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও ঈদের বিশেষ আয়োজন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১১ ঘণ্টা, জুলাই ৪, ২০১৫
রাফিক হারিরির অনুবাদে | আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা

বাদশাহ শাহরিয়ার ও তাঁর ভাই শাহজামান
বলা হয়ে থাকে যে প্রাচীন যুগে ভারত ও চীনদেশের সীমান্ত উপত্যকায় বনি ছাছান গোত্রের এক বাদশাহ ছিলেন (এই কাহিনীর সত্যতা এবং এর গোপন রহস্যের বিষয়ে পরম করুণাময় ও সর্বজ্ঞ আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন)। সেই বাদশাহর ছিল অসংখ্য সৈন্য-সামন্ত, অনুচরবর্গ ও খেদমতগার।

বাদশাহর দুটি ছেলে ছিল। বড় ভাই আর ছোট ভাই। দুই ভাই বীর ও সাহসী অশ্বারোহী যোদ্ধা ছিলেন। তবে বড় ভাই ছোট ভাইয়ের চেয়ে দক্ষ যোদ্ধা ও অশ্ব চালনায় অনেক বেশি পারদর্শী ছিলেন। বড় ভাই ন্যায়বিচার আর ভালোবাসার মাধ্যমে প্রজাদের শাসন করতেন। প্রজারা তাঁকে অনেক ভালোবাসত। বড় ভাইয়ের নাম ছিল বাদশাহ শাহরিয়ার আর ছোট ভাইয়ের নাম ছিল বাদশাহ শাহজামান। শাহজামান ছিলেন সামারকান্দের বাদশাহ।

তাঁরা উভয়েই নিজ নিজ রাষ্ট্রে দীর্ঘ বিশ বছর ধরে ন্যায়বিচারের সাথে শাসনকার্য চালিয়ে আসছিলেন। দুই সহোদর বাদশাহই ছিলেন সুখ আর সমৃদ্ধির চূড়ায়। এ অবস্থায় চলতে থাকাকালীন হঠাৎ একদিন ছোট ভাইকে দেখার জন্য বড় ভাই বাদশাহ শাহরিয়ারের মন উতলা হয়ে উঠল। তিনি উজিরকে নির্দেশ দিলেন ছোট ভাইয়ের সাথে দেখা করে তাঁকে নিমন্ত্রণ জানিয়ে বাদশাহর সামনে হাজির করতে। উজির বিনয়ের সাথে বাদশাহর হুকুম তামিল করলেন। তিনি বাদশাহ শাহজামানের দরবারে নিরাপদে উপস্থিত হয়ে বাদশাহকে সালাম দিয়ে তাঁকে জানালেন যে তাঁর বড় ভাই বাদশাহ শাহরিয়ার তাঁকে দেখার জন্য আকুল হয়ে অপেক্ষা করছেন। শাহজামান যেন বাদশাহ শাহরিয়ারের দরবারে উপস্থিত হন। উজিরের কথা শুনে শাহজামান তাঁর বড় ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য ভ্রমণের সমস্ত প্রস্তুতি নিতে থাকলেন। তাঁবু, ভ্রমণের খচ্চর, অনুচরবর্গ, সৈন্য-সামন্তসহ সবকিছুর প্রস্তুতি নিয়ে উজিরকে তাঁর অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় কাজের দায়িত্ব দিয়ে বাদশাহ শাহরিয়ারের সাথে দেখা করার জন্য তিনি রওনা দিলেন।

যেতে যেতে রাতের দ্বিতীয় প্রহর। শাহজামানের মনে পড়ল, বড় ভাইয়ের জন্য বিশেষ উপহারটা তো প্রাসাদে ফেলে এসেছেন। তাঁকে আবার প্রাসাদে ফিরে যেতে হলো।

প্রাসাদে ফিরে সোজা খাস হারেমখানায় ঢুকে দেখেন, তাঁর স্ত্রী বাদশাহর বিছানায় একজন কালো দাসকে সাথে নিয়ে জড়াজড়ি করে শুয়ে আছেন। কিছুতেই তাঁর বিশ্বাস হচ্ছিল না। এই দৃশ্য দেখে তাঁর সমস্ত চেহারা অন্ধকার হয়ে গেল। তিনি মনে মনে বললেন, ‘আমি এখনও শহর থেকে বের হইনি, এতেই যদি এ ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে যখন আমি দীর্ঘদিনের জন্য আমার ভাইয়ের সাথে থাকব, তখন এই বিশ্বাসঘাতিনী মহিলা কী কাণ্ডটাই না জানি ঘটাবে...?’

সাথে সাথে তিনি তাঁর তরবারি কোষমুক্ত করে বিছানায় শুয়ে থাকা দুজনকেই একসাথে হত্যা করলেন।

তারপর তিনি ফিরে এলেন আর ভাইয়ের শহরের দিকে যাত্রার জন্য নির্দেশ দিলেন। যখন শাহরিয়ারের রাষ্ট্রের কাছাকাছি চলে এলেন, তখন সংবাদবাহকরা শাহজামানের আগমনের সুসংবাদ বাদশাহ শাহরিয়ারের কানে পৌঁছে দিল।

শাহরিয়ার সাথে সাথে উপস্থিত হয়ে ছোট ভাইকে অভ্যর্থনা জানালেন। তাঁকে আনন্দের সাথে গ্রহণ করলেন এবং ভাইয়ের জন্য পুরো শহরটা রাঙিয়ে তুললেন।

ছোট ভাইকে সাথে নিয়ে একত্রে বসে যখন আনন্দের সাথে বাদশাহ শাহরিয়ার গল্পে মেতে উঠলেন, তখন ছোট ভাই শাহজামানের হঠাৎ করে বাড়িতে ঘটে যাওয়া তাঁর স্ত্রীর ঘটনাটা মনে পড়ল। আর এতে তার চেহারায় বিষণ্ণতা আর দুঃখের চিহ্ন ফুটে উঠল। তাঁর চেহারাটা বিবর্ণ হয়ে গেল, শরীর কেমন দুর্বল হয়ে পড়ল। ছোট ভাইয়ের এ অবস্থা দেখে শাহরিয়ার ভাবলেন, এটা হয়তো নিজ দেশ ছেড়ে আসা আর দীর্ঘ ভ্রমণের কারণে ঘটে থাকতে পারে। তাই তিনি কিছু জিজ্ঞেস না করে তাঁকে তাঁর অবস্থায় ছেড়ে দিলেন।

কিছুদিন যাওয়ার পর একদিন শাহরিয়ার ছোট ভাই শাহজামানকে বললেন, ‘ভাই তোমাকে আমি বেশ চিন্তিত আর মনমরা অবস্থায় দেখেছিলাম। কারণটা কি জানতে পারি?’

তাঁর উত্তরে ছোট ভাই বললেন, ‘ভাই, আমার ভেতরে ভেতরে কিছু বেদনা আছে। ’ এতটুকু বলেই তিনি চুপ হয়ে গেলেন। তিনি কিছুতেই ভাবতে পারছিলেন না কিভাবে বড় ভাইকে তাঁর স্ত্রীর বিশ্বাসঘাতকতার কথা বলবেন। তাই স্ত্রীর বিষয়ে যা ঘটেছে, সেটা চেপে গেলেন।

শাহরিয়ার বললেন, ‘আমার সাথে শিকারে চলো। এতে তোমার মন ভালো হতে পারে। ’ শাহজামান যেতে অস্বীকার করলেন। তখন বড় ভাই একাই শিকারে চলে গেলেন।

বাদশাহ শাহরিয়ারের প্রাসাদে অতিথি কক্ষের পাশে অনেকগুলো বড় বড় জানালা ছিল। সেই জানালা দিয়ে ওপাশের বাগিচা দেখা যায়। নানা ফুলের গাছে ভরা। মাঝখানে শানবাঁধানো বিরাট এক পুকুর, পাশেই ঝরনাধারা। খুব দারুণ আর মনোরম জায়গা। একদিন ছোট ভাই শাহজামান সেই জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলেন, প্রাসাদের ভেতরে একটা দরজা খুলে বিশজন দাস আর বিশজন দাসি বের হয়ে আসছে। তাদের সাথে সাথে বাদশাহর অপরূপা স্ত্রী হেঁটে হেঁটে আসছেন। সবাই ঝরনার ধারে নগ্ন হয়ে একে অপরের পাশে বসে পড়লেন। বাদশাহ শাহরিয়ারের স্ত্রী তখন ডাক দিলেন, ‘মাসউদ...!’ ডাক শুনে একজন কালো গোলাম এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরল আর বাদশাহর স্ত্রীও গোলামকে নিজ বাহু দিয়ে আঁকড়ে ধরলেন। এভাবে সব দাস-দাসি একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ঝরনায় নেমে পড়ল।

শাহজামান যখন এই দৃশ্য দেখলেন, তখন তাঁর মনের ভেতর যে অস্থিরতা আর বেদনা ছিল, তা দূর হয়ে গেল। তিনি মনে মনে বললেন, ‘খোদার শপথ, আমার ভাইয়ের বিপদ আর দুর্ভাগ্যের চেয়ে আমার দুর্ভাগ্য তো অনেক হালকা। ’ তিনি আবার স্বাভাবিকভাবে খাওয়া-দাওয়া শুরু করলেন। তাঁর মনের বোঝা হালকা হয়ে গেল।

এভাবে কিছুদিন পর বাদশাহ শাহরিয়ার শিকার থেকে ফিরে এসে দেখলেন তাঁর ভাইয়ের চেহারার সেই বিবর্ণ ভাবটা কেটে গেছে। চেহারায় এখন আর কোনো দুশ্চিন্তার ছাপ নেই। তিনি আগের চেয়ে অনেক পরিতৃপ্তির সাথে খাওয়া-দাওয়া করছেন। ছোট ভাই শাহজামানের এই অবস্থা দেখে বড় ভাই শাহরিয়ার বেশ অবাক হলেন।

বাদশাহ ছোট ভাইকে বললেন, ‘ভাই, কিছুদিন আগেও আমি তোমার চেহারায় দুশ্চিন্তার বিবর্ণ রং দেখেছিলাম। কিন্তু এখন তোমার চেহারা থেকে সেই রং দূর হয়ে গেছে। তোমার বিষয়ে আমাকে কিছু বলবে?’

তিনি উত্তরে বড় ভাইকে বললেন, ‘ভাইজান, আমার মুখমণ্ডলের রং যদি সত্যি সত্যিই পরিবর্তিত হয়ে থাকে তাহলে সে বিষয়ে আমি আপনাকে অবশ্যই বলব। আমার চেহারার এই রং পরিবর্তনের বিষয়ে আপনার একটা সংবাদ আছে। আপনি আমাকে সেই সংবাদের বিষয়ে ক্ষমা করবেন। ’

শাহরিয়ার বললেন, ‘আগে তোমার চেহারার বিবর্ণতার বিষয়ে আমাকে বলো। আমি সেটা শুনতে চাই। ’

তিনি বললেন, ‘ভাই আমার, আপনি যখন আমার কাছে আপনার উজিরকে পাঠালেন, তখন আমি ভ্রমণের সমস্ত প্রস্তুতি নিয়ে শহরের বাইরে রওনা দিলাম। কিন্তু হঠাৎ করেই ছোট্ট একটা প্রয়োজনে আমি আবার যাত্রাপথেই প্রাসাদে ফিরে গেলাম। প্রাসাদে ফিরে দেখলাম, আমার স্ত্রী একজন কালো গোলামকে সাথে নিয়ে আমার বিছানায় জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে। আমি তখনই তাদের দুজনকে হত্যা করি। তারপর আপনার কাছে চলে এলাম। কিন্তু আমার মাথার ভেতর সেই ভাবনাটা তখন পর্যন্ত ছিল। সেই বিশ্বাসঘাতকতা আমি কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না। ফলে আমাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত আর দুর্বল দেখাচ্ছিল। কিন্তু কেন আমার চেহারা থেকে সেই দুশ্চিন্তার রং সরে গেল, সে বিষয়ে আমাকে বলতে অনুরোধ করবেন না। আমাকে ক্ষমা করুন। ’

বাদশাহ শাহরিয়ার ভাইয়ের কথা শুনে বললেন, ‘তোমাকে খোদার দোহাই দিয়ে বলছি, তুমি আমাকে বলো কেন তোমার দুশ্চিন্তা দূর হয়ে গেল। ’

অতঃপর শাহজামান তাঁর ভাইয়ের কাছে শাহরিয়ারের স্ত্রীর বিষয়ে যা যা দেখেছিলেন, সবকিছু খুলে বললেন।

শাহরিয়ার সবকিছু শুনে বললেন, ‘আমি নিজের চোখে এইসব দেখতে চাই। ’

শাহজামান বললেন, ‘আপনি আবার শিকারের প্রস্তুতি নিন। তারপর সবকিছু ঠিক হয়ে গেলে আমার কাছে গোপনে লুকিয়ে থাকবেন। তখন নিজের চোখেই আমি যা যা বলেছি, তার সত্যতা দেখতে পারবেন। ’

বাদশাহ আবার শিকারে বের হওয়ার ঘোষণা দিলেন। তাঁবু, সৈন্য-সামন্ত, লোক-লস্কর নিয়ে শহরের বাইরে চলে গেলেন। সেখানে নিজের তাঁবুতে বসে তাঁর অনুচরদের নির্দেশ দিলেন, কেউ যেন তাঁর তাঁবুতে প্রবেশ না করে। তারপর তিনি তাঁবুর ভেতর থেকে গোপনে ছদ্মবেশে বের হয়ে প্রাসাদে তাঁর ভাইয়ের সাথে মিলিত হলেন। তাঁরা বাগানের একটি গোপন জায়গায় আশ্রয় নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। তারপর একসময় সম্রাজ্ঞী তাঁর দাস-দাসিসহ বের হয়ে এলেন। ছোট ভাই শাহজামান যা যা বলেছিলেন, বাদশাহর স্ত্রী দাস-দাসির সাথে সেই কাজগুলোই করলেন। এই দৃশ্য দেখে বাদশাহ শাহরিয়ার দিগ্‌ভ্রান্ত হয়ে পড়লেন। তিনি কোনো এক কবির একটি কবিতার লাইন আওড়ালেন—
‘মেয়েদের কখনও বিশ্বাস করো না, তাদের প্রতিশ্রুতির ওপর নির্ভর করো না
তাদের ভালোবাসা আজ মিথ্যায় প্রতিপন্ন হয়েছে
আর বিশ্বাসঘাতকতা হলো তাদের শরীরের বসন। ’

পুরোটা পড়ুন বিশেষ আয়োজনে। অপেক্ষায় থাকুন!

** হাসান আজিজুল হকের আত্মজীবনী | বসন্তের বাতাসের মতো
** রকিব হাসানের থ্রিলার উপন্যাস | ভোরের জ্যোৎস্না
** মঞ্জু সরকারের উপন্যাস | মরা নদীর ঘাট




বাংলাদেশ সময়: ১৮১৩ ঘণ্টা, জুলাই ৪, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।