‘নিখুঁত লেখা বলে কিছু নেই, যেমন নেই নিখুঁত হতাশা বলে কিছু। ’ কলেজে পড়ার সময় ঘটনাক্রমে এক লেখকের সঙ্গে আমার দেখা হয়।
___________________________________
ভাষান্তর : জিয়া হাশান
___________________________________
বিশে পা দেওয়ার পর থেকে এভাবেই আমার জীবনযাপন চলে। আর এ জন্য আমাকে অন্যদের কাছ থেকে বেদনাদায়ক ঘা খেতে হয়েছে। আবার প্রতারণার শিকার হয়েছি। অনেক ভুলবোঝাবুঝিও হয়েছে। তবে অনেক অদ্ভুত অভিজ্ঞতাও আমার ঝুলিতে জমা পড়েছে। অনেকে তাদের কাহিনী বলার জন্য আমার কাছে এসেছে। সেতুর মতো তাদের কথাবার্তা আমার মাথার ওপর দিয়ে চলে গেছে। তা আর ফিরে আসেনি। সে সময় আমি মুখ বন্ধ করে রাখি, কাউকে কিছু বলিনি। এভাবেই আমি আমার বয়সের বিশের কোঠায় গিয়ে পাড়ি। এখন ভাবছি, একটা গল্প বলব। অবশ্য তাতেই যে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তা কিন্তু নয়। কেননা কাহিনী বলার পরও ঘটনাগুলো যেভাবে ছিল, সেভাবেই থেকে যায়।
আসল কথা হলো, গল্প লেখা স্বচিকিৎসার কোনো ব্যাপার না। বরং বলা ভালো, তা স্বচিকিৎসার হীন চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে স্বীকার করতেই হবে যে, সততার সঙ্গে কোনো কাহিনী বলা খুবই কষ্টকর। কেননা আমি যেসব শব্দ খুঁজে বেড়াই, তা মনে হয় গহীন গভীরে গিয়ে লুকায়। এটা একেবারেই সত্যনিষ্ঠ স্বীকারোক্তি, কোনো কৈফিয়ত নয়। তবে শেষ পর্যন্ত আমি যা লিখেছি, তা-ই সেরা, এর চেয়ে ভালো লেখা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। এ ছাড়া এ ব্যাপারে আমার আর কিছু বলার নেই। এখনো আমি ভাবছি, যেভাবে তুমি এখন দক্ষ, বছরের পর বছর, কিংবা দশকের পর দশক আগে তুমি তা ছিলে। এভাবে চিন্তা করলেই তুমি তোমাকে বাঁচাতে পারো বলে আমার ধারণা। তবে তার পরও যখন তোমার কাজ হয়ে যাবে, তখন হাতি সমতলে ফিরে এসে তোমার চেয়ে আরো সুন্দর শব্দে তার নিজের কাহিনী বয়ান করতে সক্ষম হবে।
* * * * *
লেখালেখির ব্যাপারে ডেরেক হার্টফিল্ডের কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। অবশ্য বলা উচিত, পুরোটাই তাঁর কাছ থেকে শেখা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে হার্টফিল্ড নিজে একজন সাধারণ মানের লেখক ছিলেন। আপনি যদি তাঁর বই পড়ে থাকেন, তাহলে সহজেই বুঝতে পারবেন আমি কী বলতে চাচ্ছি। তাঁর লেখা পড়া খুব কষ্টসাধ্য। আর লেখার প্লট এলোমেলো, থিম একেবারেই শিশুসুলভ। এসব সত্ত্বেও যে কজন অসাধারণ লেখক তাঁদের লেখাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছেন, তাদের মধ্যে তিনি অনন্য। হেমিংওয়ে, ফিৎজারেন্ডের মতো তাঁর সময়কার অন্যান্য লেখকের সঙ্গে তুলনা করে দেখেছি যে তাঁর লেখালেখি তেমন সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়নি বলে আমার মনে হয়েছে। আবার তাঁর দুর্ভাগ্য তাই, জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছেও তিনি তাঁর নিজের শত্রুকে ভালো করে চিনতে পারেননি। তাই যখন চিনতে ও বুঝতে পারলেন, তখন তাঁর আর কিছু করার নেই। তাঁর সঙ্গে আট বছর দুই মাস ধরে নিজের মতো করে লড়াই চালিয়ে গেলেন। তারপর মৃত্যুর পথ বেছে নিলেন। ১৯৩৮ সালের রবিবারের এক রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে ডান হাতে হিটলারের পোর্ট্রেট চেপে ধরে বাঁ হাতে ছাতা খুলে ইম্পেরিয়াল স্টেট ভবনের ছাদ থেকে ঝাঁপ দেন। তবে তাঁর অদ্ভুত জীবনযাপনের মতো অনুরূপভাবে মৃত্যুও জনসাধারণের কাছে তেমন আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়নি।
তবে আমার সৌভাগ্য, ইতিপূর্বেই আউট অব প্রিন্ট হয়ে যাওয়া হার্টফিল্ডের প্রথম উপন্যাস একদিন হাতে আসে। তখন আমি মাধ্যমিক স্কুলের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। সামারের ছুটি চলছে তখন। আর আমি চর্মরোগে পড়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সময় পার করছি। যে চাচা তখন আমাকে বইটি এনে দেন, বছর তিনেক পর তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। মাথা থেকে পা পর্যন্ত তা ছড়িয়ে পড়ে। দেহের প্রবেশ ও বাহিরপথে প্লাস্টিক টিউব গুঁজে দেওয়া হয়। আর একসময় তা সরিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু এসে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। শেষবার যখন দেখি, তখন তাঁর শীর্ণদশা, মুখজুড়ে লালচে-বাদামি আভার দারুণ দাপট। আর দেহকাঠামো একেবারে বানরের মতো ক্ষুদ্রকায়।
* * * *
সব মিলিয়ে আমার তিন চাচা ছিলেন। তার একজন সাংহাইয়ের শহরতলিতে মারা যান। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার দিন দুয়েক পর তাঁরই পুঁতে রাখা ভূমি মাইনে তাঁর পা পড়ে। তৃতীয় চাচাই কেবল এখন বেঁচে আছেন। তিনি জাদুকর। বসন্তের গরমে তিনি সারা জাপান ঘুরে বেড়ান।
* * * *
ভালো লেখালেখির ব্যাপারে হার্টফিল্ড যা বলেছেন, তা জড়ো করলে দাঁড়ায় এ রকম—‘তিনি লেখক, যিনি সাহিত্য লেখেন। তাই বলা যায়, লেখকের লেখাই হবে মূলকথা। তিনি সব সময় দূরত্ব বজায় রাখবেন। আর তিনি কী বুঝলেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং তিনি কী মাপকাঠি ব্যবহার করেছেন, সেটাই বিবেচনার বিষয়। ’ এ কথা যদি মানি, তাহলে আমার আর সমস্যা কোথায়? কেননা কেনেডি যে বছর মারা যান, সেই ১৯৩৬ সালেই তো আমার হাতে আসে মাপকাঠি। আমি তাঁর পানে ভয়ে ভয়ে থাকাই। তারপর পনেরো বছর কেটে গেছে। এই এতগুলো বছর ধরে সত্যিকারভাবেই আমি অনেক কিছু ত্যাগ করেছি। ফ্রিটজ ইঞ্জিনযুক্ত উড়োজাহাজ থেকে লাগেজ, তারপর সিট ও সর্বশেষ সেবিকাদের বের করে দেওয়ার মতো ওই পনেরো বছর আমি কেবল সম্ভাব্য সব কিছুই পরিত্যাগ করেছি। কিন্তু জ্ঞান আহরণের পথে কোনো কিছুই অর্জন করতে পারিনি। ফলে আমার নিজের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে যায়। এমনকি এটা বলা ঠিক হচ্ছে কি না, তা-ও বুঝতে পারি না। এতে যদি সব কিছু সহজ হয়ে যায়, তাহলেও আমার সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হচ্ছে যে, যখন আমি বুড়ো হব, মৃত্যুর হাতে পড়ব, তখন আর আমার দেখানোর মতো কিছু কি থাকবে? আমাকে পোড়ানোর পর এক টুকরো হাড়ও অবশিষ্ট থাকবে কি না, তা নিয়ে আমি সন্দিহান। ‘যাদের আত্মা কলুষিত, তাদের কলুষিত স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নেই। আর যাদের আত্মা সত্যিই কলুষিত, তারা স্বপ্ন দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না। ’ এটা ছিল আমার মরহুমা দাদির প্রিয় উক্তি। তিনি মারা গেলে আমি সবার আগে হাত বাড়িয়ে আস্তে করে তাঁর চোখ বন্ধ করে দিই। গরমের সময় বৃষ্টি ফুটপাতে বর্ষণ বন্ধ করে দিলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। তেমনই দাদিমার চোখ বন্ধ করে দিলে তাঁর ঊনাশি বছর ধরে দেখা স্বপ্ন নিঃশেষ হয়ে যায়।
* * *
লেখালেখি নিয়ে আরো কিছু লিখছি। তবে এটাই হবে আমার শেষ কথা। আমার কাছে লেখালেখি খুবই কষ্টকর একটা ব্যাপার। কখনো কখনো মাস কেটে যায়, একটা লাইনও লিখতে পারি না। আবার কখনো কখনো একটানা তিন দিন তিন রাত ধরে লেখার পর একসময় বুঝতে পারি, যা কিছু লিখছি তা কিছু হয়নি। এই সব কিছু সত্ত্বেও লেখালেখির মধ্যে আনন্দ আছে। জীবনযাপনের সমস্যাদির সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, লেখালেখির মধ্যে অর্থবহ কিছু খুঁজে পাওয়া খুবই সহজ। এটা যখন আমি বুঝতে পারি, তখন আমার বয়স খুব কম। তাই বিস্ময়ে সপ্তাহখানেক ধরে হতভম্ব হয়ে থাকি। মনে হয়, আমি যদি একটু জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন হতাম, তাহলে আমার পাগলামির সঙ্গে দুনিয়া চলত, সব কিছুর মূল্যবোধ বদলে যেত, আর সময়ের প্রবাহও পরিবর্তিত হতো। আমার ধারণায় সমস্যাটা হচ্ছে, বোধবুদ্ধিটুকু অনেক দেরি করে এসেছে। তখন আমি নোটখাতার একটা পাতার মাঝ বরাবর দাগ টানি। তার বাঁ পাশে লিখি যা যা অর্জন করেছি। আর ডান পাশে যা যা হারিয়েছি। হারানোর তালিকা দল বেঁধে বাড়তে থাকে। কারণ অনেক আগে যা কিছু পরিত্যাগ করেছি, যা কিছু স্যাক্রিফাইস করেছি, যা কিছু ছলনা করেছি—তা সব কিছু একাকার হয়ে যায়। শেষে আমি আর তাল রাখতে পারি না। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করি কোনো কিছু না হারাতে। তাই আসলে আমরা তাদের মাঝখানে গহীন গহ্বর তৈরি করে তাতে রেখে দিই। আর সেই গহ্বরের গভীরতা অপরিমেয়, তাই আপনার মাপকাঠি যতই লম্বা হোক না কেন, মাপার উপায় নেই। যা হোক, লেখালেখির ব্যাপারে আমি এটা নয় ওটা নয়, কেবল এ রকম একটা তালিকা তৈরি করতে পারি। কোনো ছোটগল্প বা সাহিত্যবিষয়ক কোনো লেখা নয়, এমনকি কোনো শিল্পকর্মও আমার নেই। তা ছাড়া প্রথম পৃষ্ঠার মাঝ বরাবর আগাগোড়া রেখা টানা রয়েছে যে নোটখাতায়, তাতে তালিকা ছাড়া আর কী-ই বা করা যায়। এ থেকে হয়তো একটা ছোটখাটো শিক্ষা হতে পারে—আপনি যদি সাহিত্য বা শিল্পকলা সম্পর্কে আগ্রহী হন, তাহলে আপনাকে গ্রিকদের কিছু কঠিন লেখাপত্র পড়তে হবে। প্রাচীন গ্রিকদের ভাবনা ছিল, সত্যিকারের শিল্পকলা সৃষ্টির জন্য দাস জরুরি। তারা মাঠেঘাটে কাজ করবে, বাড়িতে খাবারদাবার বানাবে, জাহাজের দাঁড় টানবে, আর নাগরিকরা ভূমধ্যসাগরের রোদে বসে কবিতা লিখবে কিংবা গণিতচর্চায় মত্ত হয়ে থাকবে। আর ভোররাত তিনটার দিকে ফ্রিজে যারা খাবারদাবার খুঁজে বেড়ায়, আমার লেখা কেবল তাদের জন্য। আর তারাই বুঝতে পারবে আমি কী রকম।
॥ দুই ॥
এ কাহিনীর শুরু ১৯৭০ সালের ৮ আগস্ট। তা চলে আঠারো দিন ধরে। তার মানে, একই বছরের ২৯ আগস্টে গিয়ে কাহিনীর সমাপন।
॥ তিন ॥
‘এই বড়লোক চোদনারা সব নরকে যাবে। ’ আমা পানে তাকিয়ে র্যাট চিৎকার করে। তার হাত কাউন্টারে রাখা। চেহারাজুড়ে বিষণ্ণতা। তবে তার চিৎকারটা আমার পেছনে বসে কফি বানাচ্ছে যে লোকটা, তার প্রতিও হতে পারে। কেননা আমি আর র্যাট পাশাপাশি বসা। সুতরাং আমাকে বলার জন্য তার এত বড় চিৎকারের দরকার ছিল না। যা হোক, চিৎকার শেষ করে সে তার সুস্বাদু বিয়ারে চুমুক লাগায়। তবে তার মুখ-চোখজুড়ে ক্লান্তির ভাব থেকেই যায়।
স্বাভাবিকভাবেই তার চিৎকারের প্রতি কেউ মনোযোগ দেয় না। কেননা ছোট বারটা খদ্দেরে ভরা। আর সবাই একে অপরের সঙ্গে চিৎকার করে কথা বলছে। তাই চেঁচামেচিতে ভরপুর পুরো বারটাকে ডুবতে থাকা জাহাজের পাটাতন বলে মনে হচ্ছে।
‘পরজীবীর দল। ’ বলে র্যাট তার মাথা নাড়ে, মনে হয় নজরও বদলায়, ‘এইগুলা কিছু করতে পারবে না। এগুলা আমার দ্যাখা আছে। বড়লোকের ভাব মারাচ্ছে আর জ্বালায়ে মারছে, যত্তসব। ’
আমি আমার বিয়ারের গ্লাসে চুমুক দিয়ে চুপচাপ থাকি। ফলে র্যাটের মুখও বন্ধ হয়ে যায়। কাউন্টারে রাখা হাতের প্রতি মনোযোগ দেয়। বারবার দেখে। যেন হাতটা বনফায়ারের ওপর মেলে ধরা। তবে তার ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে উপরে তাকাই, সিলিং দেখি। আর সে তার প্রতিটি আঙুলে চোখ বোলাতে থাকে। ফলে আমাদের কথাবার্তা আর এগোয় না। সব সময় এ রকমই হয়।
গ্রীষ্মের এই গরমে আমরা যেন পাল্লা দিয়ে বিয়ার টানি। আমাদের খাওয়া বিয়ার দিয়ে ২৫ মিটারের সুইমিংপুল অনায়াসে ভরে ফেলা যায়। আর বাদামের খোসায় জে-এর বারের মেঝে পাঁচ সেন্টিমিটার পর্যন্ত পুরো হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এটা যদি না করি, তাহলে গরমের অসহ্য যাতনা থেকে রেহাই পাওয়ার আর কোনো উপায় থাকে না।
জে-এর বারের কাউন্টারের ওপাশে সিগারেট ধরা কতগুলো আঙুলের ছবি ঝোলানো। আমি যখন খেতে খেতে ঝিমিয়ে পড়ি, তখন একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকাই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার পানে নজর গেঁথে রাখতে কোনো ক্লান্তি আসে না। একসময় আমার মনে হয়, ছবিটাতে যেন দুই সবুজ বানর আকাশ পানে টেনিস বল ছোড়াছুড়িতে মত্ত। জে’কে ডেকে বলি। ছবিটার প্রতি একঝলক চোখ বোলানোর পর তার নির্লিপ্ত স্বর—‘হ্যাঁ, ও রকম করেই ছবিটা ঝুলিয়েছি। ’ আমি জিজ্ঞেস করি, ‘তার অর্থ কী?’ তখন তার সাফ জবাব, ‘বাঁয়ের বানরটা তুমি আর ডানেরটা আমি। আমি তোমারে বিয়ারের বোতল দিই আর তার বিনিময়ে তুমি আমাকে টাকা দাও। ’
ব্যস, আমি আবার আমোদের সঙ্গে বিয়ার পানে মত্ত হয়ে পড়ি। র্যাট তার সবগুলো আঙুলে চোখ বোলানো শেষ করে আবার মুখ খোলে—‘ওগুলা আমাকে জ্বালিয়ে মারছে। ’ তবে বড়লোকদের প্রতি র্যাটের মুখ খারাপ করা এটাই প্রথম নয়। আগেও বহুবার করেছে। তাতেই বোঝা যায়, আসলেই সে বড়লোকদের ঘৃণা করে। অথচ তার নিজের পরিবার মোটামুটি বড়লোকই। আমি তাকে তা স্মরণ করিয়ে দিলে জবাবও তার, ‘এ জন্য তো আমি দায়ী নই। ’
সাধারণত যখন বিপুল পানমত্ত অবস্থায় থাকি, তখন এ নিয়ে কথা উঠলে আমি পাল্টা জবাব দিই—‘হ্যাঁ, তুমিই দায়ী। ’ অবশ্য বলার পর আমার ভেতরে কিছুটা অপরাধবোধ কাজ করে। কেননা র্যাটের কথার যুক্তি আছে।
যা হোক, এ নিয়ে এক রাতে সে কথা চালিয়ে যায়। সেদিনই প্রথম আমাদের আলাপ অনেক দূর পর্যন্ত এগোয়। একসময় সে বলে, ‘তোমার ধারণা কী? আমি কেন বড়লোকদের ঘৃণা করি। ’ আমি ঘাড় ঝাঁকাই। তার মানে, আমি জানি না। ‘আমি কেবল সঠিকটা বুঝেছি বলেই বলছি। বড়লোকদের কোনো কল্পনা নেই। এমনকি রুলার ও ফ্ল্যাশলাইট ছাড়া তারা তাদের সহায়-সম্পদে কোনো দাগ টানতে পারে না। ’ র্যাট কথা বলতে গেলেই ‘সঠিকটা বুঝেছি বলেই বলছি’ বলে শুরু করে। এটা তার অনেকটা মুদ্রাদোষের মতো। আমি তার কথায় সায় দিই, ‘হ্যাঁ, তাই। ’
ব্যস, তার কথা আরো সামনে এগোয়, ‘হ্যাঁ, তারা গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিয়ে ভাবতে পারে না। তবে তারা ভাবনার একটা ভাব নিতে পারে কেবল। তারা এ রকম কেন করে বুঝতে পারো?’ আমি মাথা নাড়ি, ‘না, কোনো ধারণা নেই। ’ র্যাট তখন মুখ চালিয়ে যায়—‘তাদের ভাবনার দরকারও পড়ে না। বড়লোক হওয়ার জন্য কিছু মেধার দরকার ঠিকই, তবে বড়লোক থাকার জন্য তার আর কিছুরই দরকার নেই। যেমনভাবে মহাকাশের স্যাটেলাইটগুলোর গ্যাসলাইনের দরকার হয় না। একই জায়গায় তারা বারবার ঘুরপাক খায়। কিন্তু আমি তো তা নই, তুমিও তা নও। বেঁচে থাকার জন্য আমাদের ভাবতে হয়। আগামীকালের আবহাওয়া থেকে শুরু করে বাথটাবের ছিপি নিয়েও আমাদের ভাবনার দরকার পড়ে। তোমার কী মনে হয়?’ র্যাট কথা শেষ করে পকেট থেকে টিস্যু বের করে। তা দিয়ে নাকটা শব্দ করে ঝেড়ে নেয়।
আমি কেবল সংক্ষিপ্ত জবাব দিই, ‘হয়তো এ রকমই সব কিছু। ’ তবে সে যা বলতে চায়, তার সবটুকু বলে ফেলেছে কি না, বুঝতে পারি না। তাই তাকে পরীক্ষা করার জন্য কেবল বলি—‘তবে শেষ পর্যন্ত আমাদের সবাইকে একইভাবে মরতে হবে। ’ সঙ্গে সঙ্গে র্যাট আমার কথা লুফে নেয়—‘হ্যাঁ, একসময় সবাই মরবে। তবে তার আগে আমাদের আরো বছর পঞ্চাশেক কষ্টকর জীবন পাড়ি দিতে হবে। সঠিকটা বুঝেছি বলেই বলছি, এই পঞ্চাশ বছরে আমাদের অনেক কিছু ভাবনার আছে। তবে কোনো কিছু না ভেবে পাঁচ শ বছর বাঁচা সত্যিই ক্লান্তিকর। তোমার কী মনে হয়?’ এভাবেই আমাদের কথাবার্তা চলে।
পুরোটা পড়ুন বিশেষ আয়োজনে। অপেক্ষায় থাকুন!
** আন্দালিব রাশদীর উপন্যাস | কঙ্কাবতীর থার্ড ফ্লোর
** রাফিক হারিরির অনুবাদে | আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা
** হাসান আজিজুল হকের আত্মজীবনী | বসন্তের বাতাসের মতো
** রকিব হাসানের থ্রিলার উপন্যাস | ভোরের জ্যোৎস্না
** মঞ্জু সরকারের উপন্যাস | মরা নদীর ঘাট
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৬ ঘণ্টা, জুলাই ৫, ২০১৫