॥ এক ॥
ইফফতের সাথে ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটসের সরোবরের ভেতর দ্বীপাণুতে দাঁড়িয়ে আর দুন্দুর-মুন্দুর করা ঠিক হবে না। আই রিয়েলি হ্যাভ টু হিট দ্য রোড।
হাইওয়ের স্পিডি ট্রাফিকের ভেতর দিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। তাই ম্যাপ দেখে আস্তে-ধীরে ব্যাক রোড ধরে চলি। অন্য পাশের উল্টো লেন দিয়ে ক্রস করতে করতে কেউ সবুজে গাঢ় হলুদ রঙের সূর্যমুখী ফুল আঁকা চেসিসের দিকে ফিরে তাকায়। এটা আমার জীবনের প্রথম গাড়ি। এই কারের আদি মালকিন মিমোজা জংধরা ধাতব বডিতে পেইন্ট ব্রাশ দিয়ে এঁকেছেন সবুজ ঘাস ও অনেকগুলো সোনালি সানফ্লাওয়ার। রিয়ালিস্টিক কেতায় ফুলপাতা আঁকার হাত তাঁর খুবই ভালো। মিমোজার সুহৃদ কেলভিন উইন্ডশিল্ডের ওপর ছাদ কেটে স্ক্রু ডাইভার দিয়ে বসিয়ে দিয়েছেন হরিণের ডালপালাওয়ালা শিং। তাতে অন্য পাশ দিয়ে ড্রাইভ করতে করতে এই গাড়ির দিকে একপলক তাকালে মনে হয় সূর্যমুখী ফুলের ঝোপের ভেতর থেকে গলা বাড়িয়ে সড়ক দেখছে মর্দা হরিণ। ইফফত আমাকে বিদায় দিতে পার্কিং লট অবধি আসেনি। চিত্রিত এই গাড়িটা দেখিয়ে তাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। ও ওয়েল, এই মুহূর্তে...আই মাস্ট কিপ মাই আইজ অন দ্য রোড। আমাকে কমপক্ষে ঘণ্টা বারো ড্রাইভ করতে হবে। আর এই কারের যে হালত তাতে ড্রাইভিং টাইম—কে জানে, আরো বেশিও হতে পারে। এত দীর্ঘ পথ আমি আর কখনও একা ড্রাইভ করিনি।
এ গাড়িটা আমি জলের দামে মিমোজার কাছ থেকে সংগ্রহ করেছি। মন থেকে ইফফতের এনার্জি মুছে ফেলার জন্য আমি মিমোজা ও তাঁর সুহৃদ কেলভিনের কথা ভাবি। এঁদের কাছ থেকে আমি উইন্টার হাইকিংয়ের সবক নিই। এঁরা খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলেও এঁদের ঠিক দম্পতি বলা যায় না। দুজনের শরীরেই বহমান ভিন্ন দুই গোত্রের নেটিভ আমেরিকান বা রেড ইন্ডিয়ান ব্লাড। কেলভিনের পিতামহ ছিলেন সম্পূর্ণ চিরোকি ইন্ডিয়ান। তাঁর পিতার প্রজন্মে বৈবাহিক সূত্রে তাঁদের মিথস্ক্রিয়া হয় হিস্পানিকদের সাথে। তাই কেলভিন চিরোকি ভাষা বেশ খানিকটা জানলেও তাঁর সংস্কৃতি লাতিনোদের মতো। আবার মিমোজার মা ছিলেন নিউ ইংল্যান্ডে বাসরত নেটিভ আমেরিকানদের মোহাক গোত্রের কন্যা। তাঁর পিতার জাতিসত্তা সম্পর্কে আমার স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। তবে গাত্রবর্ণের জন্য আন্দাজ করি, তাঁর শরীরে আছে আফ্রিকান বা ক্যারিবিয়ান রক্ত। এঁরা ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টদের মধ্যে নবিসদের জন্য হাইকিং প্রোগ্রামের আয়োজন করে থাকেন। গাইড হিসেবে নিউ ইংল্যান্ড অঞ্চলের ট্রেইল সম্পর্কে এঁদের অভিজ্ঞতা প্রচুর। অনায়াসে তাঁদের হাইকিং শাস্ত্রের ট্রেইনার বলা চলে।
কেলভিন ম্যাসাচুসেটসের বার্কশায়ার টাউনের কাছাকাছি নির্জন বনানীতে তাঁর পোষা ঘোড়া ও দুটি কুকুর নিয়ে কাঠের কটেজে বাস করেন। তাঁর কটেজে ঢোকার মুখে দরজার ওপর লাগানো হরিণের শিং। কাছেই কোথায় যেন একটি ট্রেইলারে মিমোজার আস্তানা। উইন্টার হাইকের ওয়ার্মআপ হিসেবে আমি আরো জনা তিনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের নবিস হাইকারদের সাথে তাঁর কটেজে রাত্রিবেলা স্টোরি টেলিং সেশনে যোগ দিই। কটেজের আঙিনায় গম্বুজের মতো দেখতে মাটি দিয়ে লেপাপোঁছা একটি কুটির। তার ছাদে ঘাস ও আইভি লতার গাঢ় আচ্ছাদনে জমে আছে তুষারের স্তর। ভেতরে আমরা ভালুকের চামড়ার গালিচার ওপর গনগনে অগ্নিকুণ্ড ঘিরে আরামসে বসি। কাঠের ছোট্ট পিপা থেকে ঢেলে মিমোজা আমাদের ছোট্ট পেয়ালায় পরিবেশন করেন অল্প একটু মুনশাইন। তরলটি গলাধঃকরণে আমি ইতস্তত করলে কেলভিন তাঁর টিকির মতো সরু পনিটেলে গাঁথা পাখির পালক দিয়ে কান চুলকিয়ে বলেন—ভয় পাওয়ার কিছু নেই, এর অ্যালকোহল কন্টেন্ট শরীরকে তৈরি করবে শীতরাত্রির সাথে যোঝার জন্য। আমরা পোড়ামাটিতে তৈরি পাইপে এরপর কোনো এক গাছের সুগন্ধি বাকলের সাথে তামাক মিশিয়ে ধূমপান করি। আর তখন কেলভিন চিরোকি গ্রোত্রের সনাতন একটি গল্প বলার উদ্যোগ নেন। ততক্ষণে মুনশাইনের মৌতাত জমে উঠেছে। মিমোজা তাঁর খুঁতি থেকে বের করেন র্যাটোল ব্লেক বলে আদিবাসী নেটিভ আমেরিকানদের চোখে পবিত্র সরীসৃপের কাঁটায় তৈরি কাঁকই। তা দিয়ে তিনি কেলভিনের বাহু আঁচড়ে রক্তিম করে দিলে শুরু হয় তাঁর গল্প বলা। তাঁর বাচনিক চিরোকিদের আদি গল্পে সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে গূঢ় বয়ান ছিল, অগ্নিকুণ্ডে লাকড়িগুলো ফুলকি ছড়িয়ে পড়পড় করে পুড়ছিল, আর মিমোজা উঠে দাঁড়িয়ে কোমরে হুলাহুপ বা গোলাকার রিং পরে গল্পের বর্ণিত বিষয় উপলক্ষ করে হিপসের হিপনোটিক মোচড়ে তৈরি করছিলেন প্রজাপতি বা ঈগল পাখির আকৃতি। হোয়াইটওয়াশ করা দেয়ালে তার শরীরে সৃষ্ট আকৃতিগুলো শ্যাডো পাপেটের মতো ছায়া ফেলছিল।
স্টোরি টেলিংয়ের পরবর্তী পর্যায়ে আমরা সকলে নিজেদের কিংবদন্তি বা গাথা বলে আসরে শামিল হই। এ পর্বে মিমোজা সকলকে একটি করে ক্রিস্টাল বল দেন। আমরা কিছুক্ষণ ধ্যানস্থ হয়ে স্ফটিকের গোলকের দিকে তাকিয়ে ছোটবেলায় শোনা গল্পের ডিটেলসকে স্মৃতিতে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করি। অনেকক্ষণ মনোযোগ দিয়ে তাকাতেই গোলকে ভেসে ওঠে আমার মাতামহীর বয়সের ভারে জরাজীর্ণ মুখাবয়ব। এই কিসসা তাঁর মুখ থেকে শোনা। আসরে ভাষান্তরে এই গল্পের বর্ণনা দিতে গিয়ে দেখি গোলকে ভেসে যাচ্ছে আমার শৈশবের স্মৃতিপট। আমি পজ নিয়ে স্ফটিকে ফুটে ওঠা আমার শিশুকালের দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। ঠিক তখনই সূত্রধরের মতো মিমোজা বলেন—যে জীবন আমরা অলরেডি যাপন করেছি, তা কিন্তু হারিয়ে যায় না। আমরা চাইলেই ফিরে যেতে পারি অতীতে, অনুভব করতে পারি হারিয়ে যাওয়া মুহূর্তের হার্দিক উষ্ণতা, সংসারের সংবেদন, কিংবা সে সময়ের কোনো দ্বন্দ্বজনিত বিষাদ। তাঁর বাচনে আমাদের স্মৃতিময়তা তীব্র হয়ে ওঠে। সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে স্ফটিকে দেখছে ছোটবেলায় ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহ। মিমোজা আমাদের প্রত্যেকের নিজস্ব গল্পের বিষয়বস্তুর দিকে খেয়াল করতে বলে মন্তব্য করেন—প্লিজ, পে অ্যাটেনশন টু দ্য ফ্যাক্ট দ্যাট এই মুহূর্তে যে গল্পের ছবি তুমি কাচে দেখছো, তা কিন্তু তোমার গ্র্যান্ডপ্যারেন্টস বা গ্রামের বুড়ো কোনো লোক শুনেছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে। তারপর বাচ্চাদের কাছে বলার সময় কাহিনীর কিছু অদলবদল হয়েছে। এই পরিবর্তনের সাথে মিশ্রিত হয়েছে তাঁদের অভিজ্ঞতা ও অন্তর্দৃষ্টি। গাইজ, ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড দ্যাট ইউ আর কানেক্টিং রাইট নাও টু ইন্টার জেনারেশনাল নলেজ সিস্টেম। কিসসাগুলোর প্রতীক ও রূপকের আবডালে লুকিয়ে আছে পূর্বপ্রজন্মের ধারণা, মূল্যবোধ ও সংস্কার। নদীর জলের মতো ধারাবাহিকভাবে আমাদের ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তাদের অভিজ্ঞতা। আবার এই স্রোতজলে মিশ্রিত হচ্ছে আমাদের স্বপ্ন, দিনযাপনের বাস্তবতা ও প্রতিফলনজনিত অভিজ্ঞান।
পুরোটা পড়ুন বিশেষ আয়োজনে। অপেক্ষায় থাকুন!
** হুমায়ূন আহমেদের অগ্রন্থিত গল্প | এলাচি বেগমের স্বদেশ যাত্রা
** হারুকি মুরাকামির উপন্যাস | শোনো বাতাসের সুর
** আন্দালিব রাশদীর উপন্যাস | কঙ্কাবতীর থার্ড ফ্লোর
** রাফিক হারিরির অনুবাদে | আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা
** হাসান আজিজুল হকের আত্মজীবনী | বসন্তের বাতাসের মতো
** রকিব হাসানের থ্রিলার উপন্যাস | ভোরের জ্যোৎস্না
** মঞ্জু সরকারের উপন্যাস | মরা নদীর ঘাট
বাংলাদেশ সময়: ১২৩০ ঘণ্টা, জুলাই ৭, ২০১৫