ভোর রাতে আচমকাই ঘুম ভেঙে যায়। এই নিয়ে একই ধরনের স্বপ্ন তিনবার দেখল সে।
স্বপ্নগুলোতে ওরা দুজন। স্বর্ণা আর সৌম্য। সৌম্য, মানে সৌম্য দা। অথবা সৌম্য ভাই। স্বর্ণা যখন চিটাগাং মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয় সৌম্য তখন ফোর্থ ইয়ারে উঠেছে। সেটাকে কি আর ওঠা বলে! ফোর্থ ইয়ারে ক্লাস করে বটে, কিন্তু প্রস্তুতি নিচ্ছে থার্ড ইয়ারের জুরিস প্রুডেন্স সাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষা দেয়ার। ভাইবা বোর্ডে দুইবারেও নুরুল ইসলাম স্যারের মন গলাতে পারেনি। অগত্যা…। সেই সৌম্য কি সৌম্য দা, না সৌম্য ভাই সেটা বুঝতেই সময় লেগেছে অনেকটা। মমিনুল ইসলাম সৌম্য। সেকেলে ভালো নামের সাথে একটা আধুনিক ডাক নাম। হয়তোবা সৌম্যর সাথে ‘ভাই’য়ের চেয়ে ‘দা’ বেশি শ্রুতিগ্রাহ্য। জুনিয়রদের কাছে তাই সে সৌম্য দা। মমিনুল ইসলাম নামটায় কারো তেমন কোনো আগ্রহ থাকেনি।
প্রথম দুবার এমন স্বপ্ন দেখেছে মাস দুয়েক আগে কয়েকদিনের ব্যবধানে। তার কদিন আগেই ফেইসবুকে সৌম্যকে খুঁজে পেয়ে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। সৌম্য একসেপ্ট করেছে। ব্যাস, এইটুকুই। দুজনের মধ্যে আর কোনো কথাবার্তা বা যোগাযোগ হয়নি। চিটাগাং মেডিকেলের মিউচুয়্যাল ফ্রেন্ডদের বিভিন্ন পোস্টে অবশ্য বিভিন্ন সময়ে কমেন্ট করেছে দুজনই। কিন্তু নিজেদের মধ্যে কথা চালাচালি হয়নি। স্বর্ণার ইচ্ছে হয়েছে কথা বলতে, অর্থাৎ ইনবক্সে হাই হ্যালো করতে। সংকোচে আর করা হয়নি। ‘কেন, সব সময় আমারই আগে ইচ্ছে হতে হবে? এত দেমাগ কিসের? উনিও তো একবার নক করলে পারতেন। এমন তো না যে চিনতে পারেন নি। ’ তবে যখনই ল্যাপটপ খুলে ফেইসবুকে ঢুকেছে একবার করে সৌম্যর ওয়াল ঘুরে এসেছে। ছেলেটা এখনো আগের মতোই রয়ে গেছে। হয় রাজনীতি না হয় ক্রিকেট। এসব পোস্টেই ফেইসবুকের ওয়াল ভরা। এসব স্বর্ণাকে টানে না। তবে মাঝে মাঝে কিছু ফিলোসফিক্যাল পোস্ট থাকে। সেগুলো পড়তে স্বর্ণার ভালো লাগে। মনে হয় সে নিজেও তো তেমন করে ভাবে। মনে হয় তার নিজের কথা, সৌম্য একইভাবে ভাবল কিভাবে!
প্রথমবারে স্বপ্নটা দেখে খুব অবাক হয়েছিল স্বর্ণা। কফি ইনে মুখোমুখি বসে কফির কাপে চুমুক দেয়া, কিংবা লেডিস হোস্টেলের সামনে লাভ লেইনে পাশাপাশি হেঁটে যাওয়া, নার্সিং হোস্টেলের পাশে ভূতুড়ে অন্ধকারে নিজেদেরই ভূত প্রেত হয়ে যাওয়া—এসব স্বর্ণার পরিচিত মনে হয় না। এমন তো কিছু ঘটেনি কখনো। তবুও স্বপ্নে তেমনটিই দেখে।
ঘটলে কেমন হতো এটা ভাবতেই স্বর্ণা আবেশে শিহরিত। স্বল্পভাষী, স্মার্ট আর সুদর্শন সৌম্যকে প্রথম পরিচয়েই ভালো লেগেছিল স্বর্ণার। তার চেয়ে বড় কথা, যতবারই কাছে থেকে দেখেছে আর কথা বলেছে ততবারই ওর শান্ত সৌম্য ব্যক্তিত্ব স্বর্ণাকে আকৃষ্ট করেছে। স্বর্ণারও মনে হয়েছে তাকেও সৌম্যর ভালো লেগেছে। ব্যস, ওটুকুই। আর কিছু না। তবুও ঘুম ভেঙে স্বর্ণা চঞ্চল হয়েছে। আরিফের সাথে জীবনটা অনেকটাই সুন্দর। তবুও কেন যেন মনে হয় সৌম্যর সাথে জীবনটা সুন্দরতর হতে পারত। অন্তত বিদেশ বিভূঁইয়ে পড়ে থাকতে হতো না। টরন্টোর জীবনে মাঝে মাঝেই হাঁপিয়ে ওঠে। দেশ ছেড়ে একদিনও মন টেকে না তার। কিন্তু আরিফ ফিরে যেতে রাজি হয় না। সৌম্যর প্রোফাইলে দেখেছে, ও এখন দিনাজপুর মেডিকেলের অধ্যাপক। ‘না হয় দিনাজপুরেই প্র্যাকটিস করতাম। ’ স্বর্ণা আবারো আন্দোলিত হয়। কেন হয় নিজেই বুঝতে পারে না।
এতদিন পর সৌম্যর সাথে প্রথম পরিচয়ের দিনটা মনে পড়ে যায়। খুব সুন্দর একটা রৌদ্রস্নাত সকাল ছিল। সেদিন ওদের ভর্তির দিন। অনেক ফরমালিটি। কলেজ অফিসে ফর্ম আর ফি জমা দেয়া। সেখান থেকে হাসপাতালে বিভিন্ন বিভাগে স্বাস্থ্য পরীক্ষা, তারপর ফিরে এসে আবার অফিসে রিপোর্ট জমা দেয়া। অনেক ঝক্কি ঝামেলা। কিন্তু এসব কাজে সিনিয়র ভাইরা হেল্প করেন। নবাগতদের সাথে নিয়ে নিজেরা ঘুরে ঘুরে সব কাজ করিয়ে নেন। এত হেল্পিং এটিচিউড দেখে স্বর্ণা আর ওর বন্ধুরা ভীষণ অবাক হয়েছিল। এমন জানলে বাবাকে সাথে না আনলেও হতো। অবশ্য পরে জেনেছে এই হেল্পটা একেবারেই স্বার্থহীন নয়। চিটাগাং মেডিকেলে এর নাম ‘ফিসিং’। স্বর্ণা আর তার বন্ধুরা সব ‘ফিস’। এখন মনে হলেই হাসি পায়। বিভিন্ন দলের কর্মীরা সারি বেঁধে অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকত। ভর্তিচ্ছু কেউ এলেই তাকে যে যার মতো পাকড়াও করে ভর্তি প্রক্রিয়ায় সাহায্য করতে নিয়ে যেত। এটা হচ্ছে পরিচয়ের একটা ছুঁতো। সেই পরিচয়ের সূত্র ধরে ক্যাম্পাসে যোগাযোগ, হোস্টেলে সিট পেতে সহযোগিতা, এমনকি নিজের বা বন্ধুদের রুমে ওঠানো—এভাবেই দলে ভেড়ানোর প্রথম ধাপ। যেন জাল দিয়ে মাছ ধরা। সেখান থেকেই ‘ফিসিং’ আর ‘ফিস’ এর কনসেপ্ট। সত্যিই হাস্যকর, বিরক্তিকরও বটে।
স্বর্ণা ছিল সৌম্যর সেদিনকার প্রথম ‘ফিস’। অফিসের সামনে যেতেই ‘স্লামালেকুম চাচা’ বলে বাবাকে এমন একটা সালাম ঠুকে দিয়েছিল যেন কত জনমের চেনা। তারপর বাবাকে বা তাকে কিছুই করতে হয়নি। যা করার সৌম্যই করেছে। সে বাবাকে নিয়ে পেছনে পেছনে গিয়েছে মাত্র। কেন যেন স্বর্ণার অনেক ভালো লেগেছিল সেদিনের কয়েক ঘণ্টা। সব কাজ সেরে লেডিস হোস্টেলে নিয়ে গিয়ে মনিট্রেস ঝর্না আপার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে যাতে একটা সিট ম্যানেজ করে দেয়। বলেছে, যেকোন দরকারে যোগাযোগ করতে। ‘ঝর্নাকে বললেই হবে। আমাকে খবর দেবে। আমি এই হোস্টেলের ৩১/বি তে থাকি। ’
সেদিন এটুকুই। ‘আহা, তখন যদি মোবাইল ফোন, ফেইসবুক, ইমেইল এসব থাকত! আমিও একটা এসএমএস করে বড়শি ফেলতাম। দেখতাম ফিস ফাঁদে পা দিত কী দিত না। দেখতাম কে ফিস আর কেইবা ফিসার ম্যান বা ফিসার ওম্যান। ’ আহা, প্রযুক্তি কেন যে এতো দেরি করে এলো!
তারপর থেকে ক্যাম্পাসে দেখা হয়েছে প্রায়ই। লেকচার ক্লাস বদলের সময়, লাইব্রেরিতে পড়ার সময়, ক্যান্টিনে, এখানে সেখানে, কোনো উৎসবে অনুষ্ঠানে। টুকটাক কথা হয়েছে। কেমন আছো, পড়াশোনা কেমন হচ্ছে, সিটের অসুবিধা হচ্ছে কিনা, ঢাকায় কবে যাবে। আমাদের প্রোগ্রামে এসো—এই জাতীয়। মেয়েদের দেখলে অনেক ছেলেই যেমন হামলে পড়ে, প্রগলভ হয়, তেমন কোনো আদিখ্যেতা নেই। কথা বলে খুব সুন্দর করে, প্রাণবন্তভাবে। কিন্তু একটা বাউন্ডারি কখনোই অতিক্রম করে না। মেয়েদের একটা উপলব্ধির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় থাকে। তা থেকে স্বর্ণা বুঝতে পারে সৌম্যর তাকে ভালো লাগে। কিন্তু বুঝতে দেয় না। না দিলেই কি হয়? স্বর্ণা ঠিকই বুঝতে পারে। তারও তো সৌম্যকে ভালো লাগে। সেও বুঝতে দিতে চায় না। মেয়েরা কি নিজেরা যেঁচে পড়ে প্রেম নিবেদন করে? ‘একবার সৌম্য দা প্রপোজ করেই দেখুক না। ’ দুজনই নতুন একটা ফিসার ম্যান ফিসার ওম্যান খেলে। একজন ভাবে অন্যজন কিছুই বুঝতে পারছে না, অন্যজনও একই কথা ভাবে।
সৌম্য ক্রিকেটে ছিল চৌকষ। সেই সাথে গিটার বাজাত খুব সুন্দর। কলেজের সব অনুষ্ঠানেই তার ডাক পড়ত। চাই নিজের দলের, কী ভিন্নদলের। সেই গিটারের সুর কতদিন তাকে আনমনা করেছে! স্বর্ণাকে যদিও খেলাধুলা কখনো আকর্ষণ করেনি, কিন্তু ইন্টার ক্লাস ক্রিকেটে মাঠে যাওয়াই চাই। অন্তত সৌম্য যতক্ষণ না আউট হচ্ছে ততক্ষণ থাকা চাই। এমন জায়গায় দাঁড়াবে সৌম্য যাতে তাকে দেখতে পায়। ওর ধারণা তাতে ব্যটসম্যান বাড়তি ইনসেনটিভ পাবে। হয়তো তাই।
শেষাবধি যে কথাটা বলার তা আর বলা হয় না কারোই। থার্ড ইয়ারে সাপ্লিমেন্টারি পেলেও সৌম্য কিভাবে যেন বাকি পরীক্ষাগুলো নিয়মিতই পাশ করে যায়। স্বর্ণার যখন ফোর্থ ইয়ার শুরু তখনই ইন্টার্নশিপ শেষ করে সৌম্যর পোস্টিং হয়েছে ঝালকাঠিতে। ঝালকাঠি! এ তো এক অন্য ভুবন। চলে যাবার দিন সৌম্য দেখা করতে এসেছিল ওর সাথে। তেমন কোনো কথা হয়নি। বলল বিদায় জানাতে এসেছে। যদি কখনো দরকার মনে করে তবে ইচ্ছে হলে যেন যোগাযোগ করে। কমপক্ষে এক বছর তো ওখানে থাকতেই হবে। চাইলেই ঝালকাঠি হাসপাতালে যোগাযোগ করা তো তেমন কিছু কঠিন ব্যাপার না। তবে কি সেটাই ছিল সৌম্যর প্রপোজ করা? আশ্চর্য, এমন স্মার্ট ছেলে এতটা মুখচোরা হয় নাকি! তবুও যদি সে সময় মোবাইল ফোন, ফেইসবুক সে সব কিছু থাকত!
ঝালকাঠি হাসপাতালের ঠিকানায় একটা চিঠি পাঠাবে কি পাঠাবে না সেই বোঝাপড়া করার সময় হাতে পায়নি স্বর্ণা। ঈদের ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে জানতে পারে বিয়ের আলাপ চলছে বিভিন্ন জায়গায়। বাবা মা হজে যাবেন। মেয়ের বিয়ে না দিয়ে যাবেন না। কী বিপদ! সে মৃদু আপত্তি করেছিল, ফাইনাল পরীক্ষাটা হয়ে নিক। আর তো মাত্র দুই বছর, ইত্যাদি ইত্যাদি।
কেন, তোর কোনো পছন্দ আছে? তাহলে বল। ছেলের বাড়ি থেকে প্রস্তাব নিয়ে আসুক। ছেলে ভালো হলে আপত্তি করব কেন!
না না, ঠিক তা না।
তবে?
স্বর্ণা কোনো উত্তর দিতে পারে না। আরিফের সাথে ওর বিয়ে হয়ে যায়। সলিমুল্লাহ থেকে পাশ করে বেড়িয়েছে মাত্র। ইন্টার্নি শেষ করেই বিদেশ পাড়ি দেয়ার প্ল্যান। বাবা এমন পাত্র হাতছাড়া করতে নারাজ। আরিফের অপেক্ষা করতে হয় স্বর্ণার ইন্টার্নি শেষ হওয়া অবধি। তারপরই থান্ডার বে হয়ে টরোন্টোর জীবন শুরু। সৌম্যর স্মৃতি ফিকে হয়ে গিয়েছিল। ফেইসবুকে সৌম্যকে খুঁজে পেয়ে আবার সেই স্মৃতি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। হুট করেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়।
সেই থেকেই তিনবার একই ধরনের স্বপ্ন দেখা। দুজনের । ঈষদুষ্ণ প্রেম। সেই কালে ক্যাম্পাসে যেমনটা হতো। অবশ্য প্রথম দিনে স্বপ্নে দেখা প্রেমটা। ঈষদুষ্ণ হলেও দ্বিতীয় দিনে লাভ লেইনের আলো আঁধারিতে সৌম্যর অবাধ্য ঠোঁট আর হাত সামলাতে খানিকটা বেগ পেতে হয়েছে স্বর্ণার।
এত অসভ্যতা করলে কিন্তু চলে যাব এখনই।
অসভ্যতার কী দেখেছো! সবে তো শুরু।
তোমাকে দেখলে বা তোমার সাথে কথা বললে সবাই ভাববে তুমি ভাজা মাছও উল্টে খেতে জানো না। এখন দেখছি তুমি জিজিএমপি।
সেটা আবার কী!
গোপনে গোপনে মেট্রিক পাশ।
দুজনেই হো হো করে হেসে ওঠে। স্বর্ণার ঘুম ভেঙে যায়। আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখে তার ঠোঁট দুটো ভেজা। হয়তো নিজের জিভ দিয়ে ভিজিয়েছে। হয়তোবা ‘তুমি স্বপ্নে আসিয়া গিয়াছো আমার তপ্ত ললাট চুমি...’ হয় নাকি এমন?
সেই থেকে বারবারই তার কথা মনে হচ্ছে। ক্রিকেট রাজনীতি আর গিটার নিয়ে সৌম্যর যে জগত ছিল তার সাথে স্বর্ণার কোনো সখ্য বা যোগসূত্রই নেই। তবুও কিসের মোহ সে বুঝতে পারে না। এর মধ্যে জানতে পেরেছে মেডিকেল কলেজের পুনর্মিলনী হবে আগামী মাসে। অনেক দিন থেকে জমিয়ে রাখা দেশে বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনায় নতুন মাত্রা পেল। পুনর্মিলনীতে গেলে অনেকদিন পর পুরোনো বন্ধুদের সাথে দেখা হবে। শুনেছে ওখানে নাকি অনেক মজা হয়েছে আগের বছর। আরিফ আপত্তি করেনি। বলেছে—‘তুমি গিয়ে ঘুরে এসো। আমি ছুটি পাব না। ঝুমুরও থাকুক আমার কাছে। ওর তো স্কুল খোলা। রেজিস্ট্রেশন লিস্ট দেখে জানতে পেরেছে সৌম্যও যাচ্ছে পুনর্মিলনীতে। দেখা হয়ে যাচ্ছে তাহলে। এতদিন পর!
স্বর্ণাও তামান্নাকে ঢাকায় ফোন করে বলেছে ওর হয়ে রেজিস্ট্রেশন করে নিতে। কালই সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে বুকিং দিয়ে এসেছে। আর রাতেই আবার স্বপ্নটা দেখল। না, সেদিনের মতো ঠোঁট বা হাতের খেলা নয়। দেখেছে খুব সাদামাটা আটপৌঢ়ে ধরনের প্রেম। হাত ধরাধরিও নয়, পাশাপাশি লাভ লেইনে হাঁটছে দুজন। তারপর রিক্সায় পাশাপাশি বসে কফি ইনে গিয়ে কফি খাওয়া। ব্যাকগ্রাউন্ডে গান বাজছে ‘সুজাতাই সবচেয়ে সুখে আছে/ শুনেছি যে লাখপতি স্বামী তার...’—দুজনেই চুপচাপ বসে কফিতে চুমুক দিয়ে গান শোনে। লাভ লেইনে বা রিক্সায় কোথাও সৌম্যর ঠোঁট বা হাত অবাধ্য হয় না। ‘সেদিন রাগ করেছি বলে আজও কি রাগ করতাম? স্বপ্নেও এতটাই ভীরু?’
সেদিনের সেই স্বর্ণা আর সৌম্য নয়। আজকের দুজন। স্বর্ণার গালে আগের মতো টোল পড়ে না। সৌম্যরও মাথার চুল হালকা হয়ে এসেছে। মনে হলো চুলে রঙও দিচ্ছে। স্বর্ণার হঠাৎই ঘুম ভেঙে যায়। তার চোখ ভিজে গেছে। কিন্তু চোখ স্বপ্নের ভেতর ভিজেছে, নাকি স্বপ্ন ভাঙার পর ভেজেছে তা বুঝতে পারে না।
তার অদ্ভুত একটা ইচ্ছে হয়। পাগলামিতে পেয়ে বসে। এবার পুনর্মিলনীতে দেখা হলে সৌম্যর কাছে একটা জিনিস চাইবে। অনুষ্ঠান শেষে সন্ধ্যা বেলায় দুজন কফি ইনে মুখোমুখি বসে অনেকক্ষণ ধরে কফিতে চুমুক দেবে। কফির কাপ হাতে নিয়ে বলবে, ‘আমি কফি হাউসের সেই গানের মতো সবচেয়ে সুখী কোনো সুজাতা নই। ’ শুনেছে কফি ইন এখন নাকি নেই, উঠে গেছে। তাহলে অন্য কোনো কফি শপ আছে নিশ্চয়ই কাছাকাছি। তাতেই চলবে। তারপর রাতের কৈশোর পেরিয়ে গেলে দুজনে আলো আঁধারিতে লাভ লেইনে পাশাপাশি হেঁটে যাবে কিছুক্ষণ। ব্যাস, এটুকুই। পুনর্মিলনীতে বাজানোর জন্য সৌম্য নিশ্চয়ই গিটার নিয়ে আসবে। নার্সিং হোস্টেলের পেছনের সেই ভূতুড়ে অন্ধকারে সৌম্যকে বলবে গিটার বাজিয়ে শোনাতে। ‘মনে পড়ে আজ সে কোন জনমে বিদায় সন্ধ্যা বেলা...’—সে চুপচাপ বসে শুনবে। ঝরে যাক কিছু অশ্রু না হয়।
স্বর্ণা নিজের কাছে অঙ্গীকার করে। সে সাহসী হবে। যে করেই হোক সৌম্যকে বলবে তার ইচ্ছের কথা। কেন এমন ইচ্ছে হচ্ছে সে জানে না। তবে ইচ্ছেটা ভীষণ প্রবল হয়েছে, বিশেষ করে কাল রাতের স্বপ্নটা দেখার পর। হয়ত সৌম্য বলবে এটা নিছক পাগলামি। হয়তো রাজি হবে না। আবার হতেও তো পারে।
মানুষ ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে অবচেতনে। কিন্তু জেগে স্বপ্ন দেখে সচেতনে, নিজের ইচ্ছে শক্তির তীব্রতায়। স্বপ্ন থাকলেই তা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা থাকে। স্বপ্ন না থাকলে সেই সম্ভাবনা থাকবে কোথায়! আর স্বপ্নটা যদি বাস্তবায়িত নাও হয়, স্বপ্ন দেখার বা স্বপ্নের কথা কাঙ্ক্ষিত মানুষটির সাথে শেয়ার করার আনন্দও কম কিসে!
স্বর্ণা ৫ই জানুয়ারির অপেক্ষা করে থাকে। সেদিন চিটাগাং মেডিকেল কলেজের পুনর্মিলনী। এবারে জেগে জেগে স্বপ্ন দেখে লাভ লেইনে পাশাপাশি হাঁটছে দুজন। সৌম্যর হাতে সেই পুরোনো গিটার। এবারে না হয় স্বর্ণাই হবে এক সন্ধ্যার ধীবরী। ওরা একবার মাছ, একবার জেলে। হোক তা ক্ষণিকের।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩০ ঘণ্টা, জুলাই ৭, ২০১৫