আবারও বহুরূপীয়া এসেছে।
কেবল এটুকুই জানে মিত্রা।
অথচ মায়া পিসি নিজেও কোনো দিন থাকেনি হাঁড়িভাঙ্গাতে, থাকেনি পিসির বাবা, দাদুর বাবা। যারা ছিল, তারা সবাই খুশি মনেই চলে এসেছিল সবকিছু ছেড়েছুড়ে। কারোরই থাকার ইচ্ছে ছিল না হাঁড়িভাঙ্গাতে। আর থাকা যায় নাকি ওই জায়গায়! আনাচে-কানাচে সাপ আর ব্যাঙরা ঘুমায় সারা বছর, মাস ছয়েক গাঁয়ের আশপাশে পানি জমে থাকে, সড়কে উঠতে হয় আধমাইল আলপথ মাড়িয়ে, সন্ধ্যা হলেই চাষারা সবাই গাছের নিচে বসে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গল্প বলে আর হাসাহাসি করে, কখনও আবার রেগেমেগে সারা পাড়া মাথায় তোলে। কী করে থাকা যায় ওই জায়গায়! নেহাত থাকার কোনো বাড়িঘর ছিল না, সেই জন্যেই তো ওখানে ঘর তুলেছিল প্রেমনারায়ণ সান্যাল। তবে তা-ও কি তার আর নিজের সাধ্য ছিল! ধনী একটা শ্বশুর পেয়েছিল, সেই শ্বশুরের আবার চিররোগী একটা মেয়েও ছিল, মেয়েটাকে সে সাত-পাঁচ হিসাব করে গছিয়ে দিয়েছিল গরীব সান্যালপুত্রের ঘাড়ের ওপর। আর সান্ন্যালপুত্রই বা কী করে, খেয়েপরে বাঁচতে তো হবে, তাই বিয়ে করল সেই চিররোগী বাগচীকন্যাটাকে। আহ্, সারা জীবন খাটতে খাটতেই মরে গেল লোকটা। রান্নাবান্নাও নাকি নিজেকে করতে হতো, কাপড়ও কাচতে হতো, এমনই এক গরীব অথচ ব্রাহ্মণ ছিল সে। অবশ্য খেটেখুটে যত ক্লান্তই হোক, আর রোগী বউটাও যতই কাহিল থাকুক, ছেলেপেলে নেহাত কম হলো না। মেয়ে কয়টা হলো, সে হিসাব অবশ্য কারো জানা নেই। কেউ বলে নয়টার কথা, কেউ বলে তেরোটার কথা, কেউ বলে পাঁচটার কথা—একেবারে গোলমেলে ব্যাপার সেটা। তবে ছেলেদের কথা আলাদা। সেই হিসাব সকলেরই জানা আছে। তিন-তিনটা ছেলে ছিল তাদের। তাদের একজন বাপ-মায়ের অবস্থা বুঝে বিয়ে করেই চলে গিয়েছিল গোবিন্দপুরে, আরেকজন গিয়েছিল ঘাটিনা গ্রামে, বাপ-মায়ের কাছে অবশিষ্ট ছিল কেবল এক প্রেমনারায়ণ সান্যাল। সেই হিসাবে হাঁড়িভাঙ্গার সেই ভিটা তাদের প্রেমের ভিটা। সেখানে এখন কেউ থাকে না, নাকি কাকপক্ষী থাকে, কেউ সে ভিটা দেখতেও যায় না। বড় বড় কয়েকটা ফলের গাছ আছে সেখানে, সেই ফল কখন ধরে, কখন ঝরে কেউ জানে না। শোনা যায়, বর্ষা আসুক আর না আসুক, সেটা এখন সাপ আর শেয়ালদের বাগানবাড়ি। আর খালি শোনা যাবে কেন, প্রতিবছরই তো কেউ না কেউ মারা যায় ওখানে সাপের কামড় খেয়ে, কেউ না কেউ পাগল হয় শেয়ালের কামড়ে। লোকজন শিউরে ওঠে প্রেমের ভিটার কথা শুনলে, তবু আবার লুকিয়ে-চুরিয়ে নাকি সেখানেই যায় হাগা-মোতা ধরলে, মেয়েদের সঙ্গে অপকর্ম সারতে। এ রকম এক জঘন্য ভিটা, অথচ এখনও সেই প্রেমের ভিটার গল্প উথলে ওঠে পিসির কণ্ঠ থেকে। এখনও সেখানকার রক্তজবার, ঝুমকোজবার কথা বলে সে, বলে দুপুরচণ্ডী-সন্ধ্যামালতি গাছের কথা, হলুদ কলাবতীর কথা, রঙিন কলাবতীর কথা; যেন নিজের চক্ষে দেখেছে সেসব গাছ, নিজের হাতে অসংখ্যবার পূজা দিয়েছে সে ওইসব ফুল দিয়ে। অবশ্য ওসব গাছের কয়েকটা বংশধর এখানেও আছে। এখানে—কালীমন্দিরের পাশে, এই দুপুরে গা ছমছম করা অন্ধপুকুরের পাশে। পিসি গর্ব করে বলে, প্রেমের ভিটার গাছ; আর শুনতে শুনতে সে মনে মনে বলে ওঠে, প্রেমের ভিটার না ছাই—কোনখান থেকে কোন পাখি ঠোঁটে করে নিয়ে এসেছে, তা কি পাখি নিজেও জানে! পাখি জানে না, গাছ জানে না, মাটি জানে না, অথচ কেবল পিসিই জানে প্রেমের ভিটার রক্তজবা, প্রেমের ভিটার ঝুমকোজবা। রক্তজবা, ঝুমকোজবা, মুখে গাবের রং লাগানো বহুরূপীয়া—সুর করে বলতে বলতে মেঝে থেকে গা তোলে সে। গরম পড়েছে খুব। এই সময়ে বিছানায় নয়, ভালো লাগে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা মেঝের ওপর শুয়ে থাকতে। তাই মেঝেতেই শুয়ে আছে সে। কিন্তু এখন তার রক্ত চনমন করছে, উঠে শাড়িতে ভালো করে বুক ঢেকে জানালার কাছে যায় সে।
আহ্, তার চেয়ে কত সুন্দর তাদের এই ভিটা! কোনো দিন যায়নি অবশ্য, কিন্তু শুনতে শুনতেই বুঝে গেছে সে, ওর চেয়ে ঢের ভালো এই ভিটা—ভিটা তো নয়, বাড়ি; চারপাশে আরও কত জল, ওই তো পশ্চিমে বিল, ওই তো পশ্চিম থেকে দক্ষিণ বরাবর খাল কেটে নিয়ে আসা ফুলঝোড় নদীর পানি, দক্ষিণ থেকে তা আবার সড়কের পাশ ঘেঁষে পুব দিক হয়ে মোড় নিয়েছে উত্তরের দিকে। তাহলে কী দরকার ওই প্রেমের ভিটার চারপাশের খানাখন্দে জমা ছটাক ছটাক কাদাপানির কথা চিন্তা করে! কাঠের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় সে। ইচ্ছে হচ্ছে বারান্দা দিয়ে চারপাশ ঘুরে আসতে, কিন্তু উত্তরের বারান্দায় যাওয়া যাবে না, উত্তরের বাতাস ভালো না মোটেও। তাছাড়া উত্তর দিকে মুসলমানদের ভিটে, যদিও তা বেশ খানিকটা দূরে, যদিও তার আগে ক্ষেতখোলাও আছে। এই তো ওখানে অন্ধপুকুর, সেটা পেরোনোর পর খানিকটা জঙ্গল, তারপর ফের জলাভূমি, শীত এলে শুকিয়ে সেটা খটখটে হয়ে যায়, তাই ওটার পাশ দিয়েই বিল বরাবর নালা কাটা হয়েছে গভীর করে। শীতে অবশ্য সেখানেও আর নাও চলে না। কিন্তু অন্তত শীত অবধি কোনো সমস্যা হয় না ঘাট থেকে নৌকায় করে নদীতে যেতে। এইভাবে সান্ন্যালবাড়ি এখন বছরের আট-নয় মাসই জলে ঘেরা একটা দুর্গ যেন। নালার পরে উত্তর দিকে নাকি জঙ্গলই ছিল এত দিন, কিন্তু জঙ্গল কেটে সেখানে নতুন করে চাষ করছে মুসলমান এক চাষা। কালীচরণ সান্যালের দয়ার শরীর, মরার আগে সে নাকি বলে গিয়েছিল তার সেই হাঁড়িভাঙ্গার কোনো এক মুসলমানের ছেলে বড় হলে তাকে ওই জায়গাটা চাষের জন্যে দিতে। এত দিনে বড় হয়ে গেছে সে, চাষবাস করছে সেখানটাতে, সেসব তো আর দেখা যায় না এখান থেকে, এমনকি দোতলার উত্তর বারান্দায় দাঁড়ালে পরেও। কিন্তু কোনো কিছু দেখা যাক বা না যাক, এটুকু জানাই যথেষ্ট যে, পাঁচলিয়া না কোত্থেকে যেন কয়েক ঘর মুসলমান এসে নাকি ওইখানে বাড়ি করেছে। উত্তরের বাতাস তাই আরও নোংরা হয়ে গেছে বাবা-কাকাদের কাছে। এদিকে পুবের বারান্দায় পিসি বসে আছে, কী বলেছে কে জানে, রূপু দিদি হি হি করে হাসছে, মায়া পিসিও হাসছে তাল মিলিয়ে। কিন্তু কী হবে ওই হাসাহাসি শুনে! পা টিপে টিপে মিত্রা তাই গিয়ে দাঁড়ায় দক্ষিণের বারান্দায়। সেখান থেকেও চোখে পড়ে খোলা পশ্চিম দিক, এ বেলা সেদিকে তাকাতেই মন ভরে যায় তার। কী সুন্দর ঝিম ধরে আছে সবকিছু, ঝিম ধরে আছে দুবলাই বিল! মনে হয় বিল নয়, জমিই ওটা, জমির ওপর একটা রুপালি স্তর জমেছে। তবে রুপালি স্তরের মধ্য থেকে মাঝে-মধ্যে মরা ডাল মাথা তুলে আছে। মাছ ধরার জন্যে জেলেরা মরা ডাল ফেলেছে।
বিল থেকে চোখ ঘুরিয়ে মিত্রা এবার চায় পুব-দক্ষিণ কোণে। ওইখানে বিরাট এক বটগাছ, অসংখ্য ঝুরি নেমেছে নিচের দিকে। বটগাছকে ঘিরে হাটখোলা, আর আজ বোধ হয় হাটবারই হবে। সড়কটায় তাই গরুর গাড়ি, একটা ঘোড়াও দেখা যাচ্ছে তলিয়ে গেছে গাঁইটের ভারে। ভালো দিনেই এসেছে বহুরূপীয়া। শিব-গৌরীর পার্বণ না হোক, শিব আর গৌরী সেজে এক দিনেই ওদের পকেট ভরে উঠবে। হয়তো জানে না ওরা, গেলবার বহুরূপীয়ারা কী ধাওয়া খেয়েছে! কিন্তু এখন এইসব ভাবতে তার ভালোই লাগছে না। ছেঁড়া কাপড় বাঁধা এ রকম সময়ে দুপুর এলে তার ভালো লাগে না, দুপুর এলে সে খুব একা একা হয়ে পড়ে, তবে একা একা হয়ে পড়ে বলেই হয়তো একটু ভালোও লাগে। গড়ান বেয়ে গরুর গাড়িটা নামছে এখন। কেন যেন গাড়োয়ান গরু দুটোর লেজ টেনে ধরে রেখেছে, আর মুখ দিয়ে যেন জোরে জোরে বলছে একটা কিছু। এইবার কয়েকটা লোক আসছে মাথায় বস্তা নিয়ে। প্রায় নাচতে নাচতে এগোচ্ছে বস্তার ভারে। দেখে হাসি আসে, কিন্তু তবু ভালো লাগে না। তাই সে ঘরে ফিরে আসে, আনমনে কান পাতে পুবের বারান্দায়। সেখানে এখনও মায়া পিসি, এখনও রূপু দিদি। রূপু দিদি বলছে মায়া পিসিকে, কিন্তু পিসি, খারাপ লাগে না তোমার?
কেন, খারাপ লাগবে কেন?
বাহ্, খারাপ লাগবে না? এই যে তুমি এখন আর মাংস খেতে পারো না—
পিসির বোধ হয় শুনেই বমি চলে আসে, সে রকম শব্দই যেন বেরিয়ে আসে তার মুখ দিয়ে, আর তা সামলাতে সামলাতে দিদিকে বলল সে, মাংসের কথা শুনলেই আমার গা গুলিয়ে আসে। কী যে খাস তোরা...নিরামিষ খেতে কত মজা লাগে!
তা লাগে। নিরামিষ খেতেও মজা লাগে। তুমি রাঁধলে আরও মজা লাগে। কিন্তু তাই বলে তিন বেলা? কী যে বলো না তুমি পিসি। এখন আঙুরফল টক লাগে, না? তুমি যে মাংস খেতে কত ভালোবাসতে...
এ রাম, এ রাম...কী যে বলিস না। চুপ কর তো।
মায়া হইহই করে ওঠে। রূপসুন্দরীর সঙ্গে গলা মিলিয়ে এপাশ থেকেও খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে মিত্রা। আর তাই রূপসুন্দরীর হাসি থেমে যায়, মায়াও গলা উঁচিয়ে বলে, হাসছে কে রে? মিত্রা নাকি?
পুরোটা পড়ুন বিশেষ আয়োজনে। অপেক্ষায় থাকুন!
** মঈনুস সুলতানের ভ্রমণ | টাকোনিক ক্রেস্ট ট্রেইলের তুষারে হাইক
** হুমায়ূন আহমেদের অগ্রন্থিত গল্প | এলাচি বেগমের স্বদেশ যাত্রা
** হারুকি মুরাকামির উপন্যাস | শোনো বাতাসের সুর
** আন্দালিব রাশদীর উপন্যাস | কঙ্কাবতীর থার্ড ফ্লোর
** রাফিক হারিরির অনুবাদে | আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা
** হাসান আজিজুল হকের আত্মজীবনী | বসন্তের বাতাসের মতো
** রকিব হাসানের থ্রিলার উপন্যাস | ভোরের জ্যোৎস্না
** মঞ্জু সরকারের উপন্যাস | মরা নদীর ঘাট
বাংলাদেশ সময়: ১৮১১ ঘণ্টা, জুলাই ৭, ২০১৫