টানা দড়ির নিচু নিরাপত্তাবেষ্টনী টপকে নিমেষেই নিষিদ্ধ এলাকায় পা পড়ে। চোখের সামনে নানা আকৃতির পলেস্তারাহীন নগ্ন দেয়াল।
চোখের সামনে নানা আকৃতি ও উচ্চতার বেশ কটি প্ল্যাটফর্ম। সিঁড়িগুলোর কোনোটা চ্যাপ্টা তো কোনোটা সরু, কোনোটা আবার ত্রিভুজ-বহুভুজের রূপ নিয়েছে।
একবার ডানে তো একবার বাঁয়ে, কখনও লাফিয়ে, কখনও শরীর ঘেঁষটে, শেষতক বুক আর কনুইয়ে ভর করে শরীরটাকে টেনে তোলা গেল পাঁচ হাজার বছরের পুরনো সভ্যতার ছাদে। এই ছাদের নিচে চাপা পড়া দিলমুন সভ্যতার সঙ্গে মিশে আছে মেসোপটেমিয়া-ব্যাবিলন-সুমেরীয়-অ্যাসিরীয় সভ্যতার ইতিহাস, গ্রিক-আরব-পারসিয়ান-হরমুজ-পর্তুগিজ-ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আগ্রাসন এবং প্রাচীন ভারত ও চীনের বাণিজ্য সংস্কৃতির গৌরবময় চিহ্ন।
পুরো ছাদজুড়ে হাজার হাজার বছরের ক্ষয় আর ধ্বংসের ছাপ স্পষ্ট। নিচু দেয়ালগুলো গোটা ছাদটাকে অনেকগুলো প্যানেলে ভাগ করলেও সবটা সমান নয়। ছাদের লেয়ারও একেক স্থানে একেক মাপের। যুগে যুগে সংস্কারের কারণেই হয়তো এমনটা হবে। তবে ছাদজুড়েই বছরের পর বছর ধরে মরু বাতাসে উড়ে এসে জমা হওয়া বালুর দাপুটে উপস্থিতি। পা দেবে যায় কোথাও কোথাও।
দুর্গের পায়ের নিচে বেড় দিয়ে শুয়ে থাকা অগভীর পরিখাটাকে এখান থেকে মরুভূমির বালুময় ট্রেইলের মতো মনে হয়। দক্ষিণে প্রাচীন শহরের আরও অনেক ধ্বংসাবশেষ। সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দূরের মানামা সিটিকে মনে হলো মাত্র কয়েক লাফের দূরত্ব।
পূর্ব দিকে পরিখা পার হলেই পারস্য উপসাগরের নীল জল। তার তীরে খেজুর বাগান পূর্ব-উত্তরে বিস্তৃত। পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে এই খেজুর বাগানের সুখ্যাতি বইছে দিলমুন। এখানেই পাওয়া গেছে খেজুরের সিরাপ উৎপাদনের প্রাচীনতম উপাদান মাদবাসা।
জানুয়ারির শুরুতে এখানকার আবহাওয়াটাও বেশ শরীর-সহনীয়। তাপমাত্রা ১৮ কি ১৯ ডিগ্রি। পড়ন্ত বিকেলে তেজহীন সূর্যটা ঝুলে আছে নীল সাগরের ওপর। শীত বুড়ির আঁচলে চেপে সাগর ছুঁয়ে ছুটে আসছে শরীর জুড়ানো বাতাস।
ছাদের এক কোণায় নিচু এক দেয়ালে ঠেস দিয়ে যেন গভীর নিদ্রায় মগ্ন এক মরুঘাষের ঝোপ। বার্ষিক মাত্র ৭০ মিলিমিটার গড় বৃষ্টিপাতের এই দেশে কয়েক মাস ধরে বৃষ্টির ছোঁয়া না পেয়ে শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে আছে। বাংলাদেশের মতো বছরে ২০৩০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত পেলে নিশ্চয়ই এ মরুঝোপের চেহারা অন্য রকম হতো। বালুময় পাথুরে অবয়বে হয়তো মাথা তুলত বট-পাকুড়ের চারা, সবুজ শোভা নিয়ে ঝুলত গুল্ম-লতা।
মৌসুমি জলবায়ুর চিরসবুজ দেশের সঙ্গে এই ঊষর মরুভূমির বিরাণ বুকের তুলনাচিন্তায় হঠাৎ ছেদ পড়ে দূর থেকে ভেসে আসা ধমকের সুরে।
একতলা সমান নিচের প্রশস্ত করিডোরে দাঁড়িয়ে প্যান্টের ভেতর ইউনিফর্মের শার্টটা আরও ভালো করে গুঁজছেন হালকা-পাতলা গড়নের এক নিরাপত্তারক্ষী। সরু গোঁফ, গলাটাও ঠিক বাজখাঁই নয়। তবে চোখে তার অধরাধী পাকড়াওয়ের আগুন।
সফরসঙ্গী বাংলানিউজের বাহরাইন করেসপন্ডেন্ট মোসাদ্দেক হোসেন সাইফুল সতর্ক করেন, গার্ডটা মনে হয় কেরালার। মধ্যপ্রাচ্যে ওরাই মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশের।
যেন ভুল করে উঠে পড়েছি—এমন ভাব নিয়ে এবড়োখেবড়ো সিঁড়ি আর ল্যান্ডিংগুলো টপকে দ্রুত নেমে আসি হারানো সভ্যতার চূড়ো থেকে।
মাথার ওপর হাত ঘুরিয়ে নিরাপত্তাকর্মী তড়পে ওঠেন, ‘দেয়ার আর ক্যামেরা এভরিহোয়্যার। ’
আমাদের সতর্ক করে চলে যান তিনি। কোথা থেকে এলেন, আর কোথাই বা গেলেন, কিছুই ঠাহর করা যায় না। এ দুর্গে এত খোপ খোপ কক্ষের ভিড়ে কে কোথা থেকে নজর রাখছে বোঝা মুশকিল। তবে মনিটরিংয়ের কারিশমা দেখে বুঝি, এখানে নিয়মের বাইরে যাওয়াটাই আত্মঘাতী। দর্শনার্থীরা কে কী করছে, সবই রেকর্ড হচ্ছে লুকানো ক্যামেরার চোখে।
টাওয়ার আকৃতির এক খোলা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ফের চোখ চলে যায় খেজুর বাগান পেরিয়ে খোলা সাগরে। এখান থেকে পশ্চিম-উত্তরে প্রাচীন মেসোপটেমিয়া-ব্যাবিলন-সুমেরীয়-অ্যাসেরীয় সভ্যতায়, উত্তরে পারস্য, পূর্বে সিন্ধু-মহেঞ্জোদারো-হরপ্পা সভ্যতা পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া যেত এক সাগরপথেই। এখনও আরব আমিরাত, কাতার, সৌদি আরব, কুয়েত, ইরাক, ইরান, পাকিস্তান আর ভারতের সঙ্গে এক সাগরপথেরই দূরত্ব এই দিলমুন বা বাহরাইনের।
খোলা সাগর থেকে চোখ সরিয়ে দুর্গ দর্শনে মনোযোগী হই। উঁচু-নিচু দেয়াল, নিরাপত্তাবেষ্টনী, নানা আকৃতির খোপ, হরেক আঙ্গিকের সিঁড়ি পেরিয়ে চলে আসি এক গুহার সামনে। গোটা দশ কি বারো সিঁড়ি টপকে নেমে পড়ি গুহার ভেতর।
গোটা গুহাজুড়ে আলো-আঁধারির খেলা। এক পাশে দেয়াল ঘেঁষে প্যাঁচানো নালার হাম্মাম। ঢাকার লালবাগ কেল্লার সঙ্গে এই হাম্মামটির অনেক মিল। তবে লালবাগ কেল্লার চেয়ে এই সভ্যতার বয়স অন্তত চার হাজার বছর বেশি—এই যা।
হাম্মামের উল্টো দিকে বিস্ময়কর এক কূপ। পাথরের ওপর পাথর দিয়ে বাঁধানো। নিচে নিকষ অন্ধকারে দৃষ্টি ঠেকে যায়। স্থানীয়ভাবে এটি পরিচিত দেবতা এনকির কূপ হিসেবে। পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন ইরাকে এনকি ছিলেন সমুদ্র দেবতা।
সুমেরীয় মিথলজি অনুসারে, পানি ও জ্ঞান নিয়ন্ত্রণ করতেন মেসোপটেমিয়া সভ্যতার এই প্রাচীন দেবতা। প্রাচীন বাহরাইন তথা দিলমুন দুর্গের এই কূপ থেকে সুপেয় জল নিঃসৃত করতেন তিনি। আর এই জলই বাহরাইন নামের জন্ম দেয়।
পুরোটা পড়ুন বিশেষ আয়োজনে। অপেক্ষায় থাকুন!
** ইমতিয়ার শামীমের উপন্যাস | লুকিয়ে রাখা জন্মদাগ
** মঈনুস সুলতানের ভ্রমণ | টাকোনিক ক্রেস্ট ট্রেইলের তুষারে হাইক
** হুমায়ূন আহমেদের অগ্রন্থিত গল্প | এলাচি বেগমের স্বদেশ যাত্রা
** হারুকি মুরাকামির উপন্যাস | শোনো বাতাসের সুর
** আন্দালিব রাশদীর উপন্যাস | কঙ্কাবতীর থার্ড ফ্লোর
** রাফিক হারিরির অনুবাদে | আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা
** হাসান আজিজুল হকের আত্মজীবনী | বসন্তের বাতাসের মতো
** রকিব হাসানের থ্রিলার উপন্যাস | ভোরের জ্যোৎস্না
** মঞ্জু সরকারের উপন্যাস | মরা নদীর ঘাট
বাংলাদেশ সময়: ১২২৯ ঘণ্টা, জুলাই ৮, ২০১৫