জুলিয়াস সিজার
______________
সবাই তাকে ‘টেকো লম্পট’ বলে সম্বোধন করত এবং বলত যে, সে ছিল প্রত্যেক রমণীর কাছে আকাঙ্ক্ষিত স্বামী এবং প্রত্যেক পুরুষের কাছের ঈপ্সিত স্ত্রী।
অনেকেই জানত, সে কয়েক মাস ক্লিওপেট্রার শোবার ঘরে কাটিয়েছে।
আলেকজান্দ্রিয়া থেকে রোমে ফিরে আসার সময় সে বিজয়ের স্মারক হিসাবে ক্লিওপেট্রাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। এই মহান বিজয় এবং গৌরবের জের ধরে ইউরোপ এবং আফ্রিকায় তার সাম্রাজ্য বিস্তারের লক্ষ্যে সে গ্লাডিয়েটরদের আমৃত্যু লড়াই করার নির্দেশ দিয়েছিল। এছাড়া সে ক্লিওপেট্রার দেওয়া উপহার এবং অন্যান্য মূল্যবান ধনরত্ন প্রদর্শন করে আত্মতুষ্টি ও বীরত্ব জাহির করেছিল।
পুরো সাম্রাজ্যের একমাত্র ময়ূরপঙ্খী রঙের টোগা দিয়ে রোম শহর তাকে সুসজ্জিত করেছে এবং জলপাই রঙের পত্রাবলী ও রঙিন ফুলের তৈরি শিরোমাল্য পড়িয়েছে। এবং রাজকবি ভার্জিল তার স্বর্গীয় বংশ পরিচয় মহা সমারোহে উদযাপন করেছিল, যা অ্যানিয়াস, মঙ্গল গ্রহ এবং ভেনাস থেকে অবতীর্ণ হয়েছিল।
এই ঘটনার খুব বেশি দিন পরে নয়, বীরত্বের শিখরে আসীন হয়ে সে নিজেকে সার্বভৌম ক্ষমতার একমাত্র অধিপতি হিসাবে প্রচার করা শুরু করে। তার এই ঔদ্ধত ব্যবহারের জন্য আশেপাশের লোকজনের অলঙ্ঘনীয় অধিকার রীতিমত হুমকির মুখে পড়ে।
এবং তার ঘনিষ্ঠ লোকজন ও পাদ্রিরা মিলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, এক আউন্স ওজনের সতর্ক প্রতিরোধ এক পাউন্ড ওজনের মুক্তি লাভের চেয়ে শ্রেয়।
বীর বিক্রম সিজারের মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য ঘনিষ্ঠ সহচরগণ তাকে ঘিরে থাকে। এবং তার প্রিয়পাত্র ব্রুটাস, যে হয়ত তার পুত্র, সর্বপ্রথম তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে এবং তার পেছনের দিকে প্রথম ছুরি বিদ্ধ করে। সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত অন্যান্যদের ছুরিও তাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে। তারপর সবাই বিজয় উল্লাসে রক্তাক্ত ছুরি স্বর্গের দিকে উঁচিয়ে ধরে। তার নিথর দেহ পাথরের ওপর পড়ে থাকে। কোনো ক্রীতদাসও তাকে স্পর্শ করার সাহস পায়নি।
______________
হিরাক্লিস
______________
কঠোর শাস্তি দেওয়ার জন্য সম্রাট জিয়ুসের খুব নামডাক ছিল। একসময় খারাপ ব্যবহার করার জন্য সে তার ছেলে হিরাক্লিসকে ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি করে দিয়েছিল।
হিরাক্লিসকে, রোমের সবার কাছে সে হারকিউলিস নামে সুপরিচিত ছিল, লিডিয়ার মহারানী ওমফলি ক্রয় করেছিলেন এবং মহারানী অনুগত সেবক হিসাবে সে একদিন একটা সাপ ধরে হত্যা করেছিল।
শৈশবের পরে সে কখনোই কোনো সাপ ধরে টুকরো টুকরো করে কাটেনি। সে একজোড়া সাপ বন্দি করে, যেগুলো রাতের আঁধারে মাছির রূপ নিয়ে ঘুমন্ত মানুষদের ডাকাতি করত।
তার সেই বীরত্ব দেখে মহারানী ওমফলি অভিভূত হতে পারেননি। কেননা তিনি একজন প্রেমিকা চেয়েছিলেন, দেহরক্ষী নয়।
তারা দুজনে প্রায় সব সময়ই অন্দর মহলে থাকত। তবে তারা কয়েক বার বাইরে বেরিয়ে এসেছিল।
হিরাক্লিসের পরনে থাকত মুক্তার মালা, স্বর্ণের চুড়ি এবং উজ্জ্বল রঙের অন্তর্বাস। তবে সেই অন্তর্বাস বেশিক্ষণ তার পরনে থাকত না। কেননা তার বিশাল শরীরের মাংসপেশীর চাপে একসময় ওগুলো ছিঁড়ে যেত। অন্যদিকে মহারানীর গায়ে থাকত সিংহের চামড়া দিয়ে তৈরি পোশাক। হেরাক্লিস খালি হাতে নিমিয়ায় সেই সিংহকে হত্যা করেছিল।
রাজ্যের পুরোটা জুড়ে চাউর হয়েছিল যে, যখন হেরাক্লিসের ব্যবহারে মহারানী নাখোশ হতেন, তখন তিনি স্যান্ডেল দিয়ে তার পাছায় চপেটাঘাত করতেন। তবে হেরাক্লিসের হাতে যখন ফাঁকা সময় থাকত, তখন সে মহারানীর পায়ের কাছে বসে সেলাই করত এবং কাপড় বুনত। সেই সময় অন্দরমহলের ক্রীতদাসীরা পাখা দিয়ে তাকে বাতাস করত, সাজ-সজ্জা করে দিত, খুশবো মাখত এবং সুরা পান করাত।
হেরাক্লিসের আরাম-আয়েশ মাত্র তিন বছর টিকেছিল। দুনিয়ার বারোজন শক্তিশালী মানুষের কাজ করার জন্য তার পিতা জিয়ুস তাকে ফিরে যেতে হুকুম জারি করেছিল।
______________
স্তালিন
______________
তিনি জর্জিয়ার ভাষায় লেখা শিখেছিলেন। জর্জিয়া তার আবাসভূমি। কিন্তু ক্যাথলিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা তাকে রাশিয়ান ভাষায় কথা বলার জন্য বাধ্য করেছিল।
পরবর্তী সময়ে মস্কোতে তার দক্ষিণ ককেশীয় উচ্চারণ তাকে অনেক ভুগিয়েছিল।
সুতরাং তিনি রাশিয়ানদের চেয়েও বেশি করে রাশিয়ান হতে চেয়েছেন। এটা কি সত্যি না যে, নেপোলিয়ান কর্সিকায় জন্মগ্রহণ করার পরেও ফরাসীদের চেয়ে বেশি ফরাসী ছিলেন? এবং ক্যাথারিন দ্য গ্রেট, যিনি জন্মগতভাবে জার্মান ছিলেন, রাশিয়ানদের চেয়ে বেশি রাশিয়ান ছিলেন?
জর্জিয়ান আয়োসিফ জুগ্যাশভিলি রাশিয়ান নাম গ্রহণ করেছেন। তিনি নিজেকে স্তালিন হিসাবে জাহির করেন। স্তালিনের অর্থ হচ্ছে ‘ইস্পাত’।
ইস্পাত কঠিন মানুষটি চেয়েছিলেন তার ছেলেও ইস্পাতের মতো দৃঢ় এবং শক্ত হোক। কিন্তু বলা হয়, শৈশব থেকে স্তালিন তার ছেলে ইয়াকভকে আগুনে পুড়িয়ে এবং বরফে ভিজিয়ে হাতুড়ির আঘাতে বড় করতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। ইয়াকভ তার মায়ের ছেলে। উনিশ বছর বয়সে সে বৈরী পরিবেশ মেনে চলতে অস্বীকৃতি জানায়, কেননা সেই সময় সে দুঃসহ কঠিন জীবন বহন করতে পারছিল না।
একদিন সে ট্রিগার টিপে।
গুলি তাকে মারতে পারেনি।
একসময় হাসপাতালে তার ঘুম ভাঙে। বিছানার পায়ের কাছে তার বাবা দাঁড়িয়ে মন্তব্যের সুরে বললেন:
‘গুলিটাও ঠিক মতো নিশানা করতে পারোনি। ’
______________
কাফকা
______________
বিশ্বে প্রথম নারকীয় হত্যাযজ্ঞের দামামা বাজার কাছাকাছি সময়ে ফ্রাঞ্জ কাফকা তার অমর সাহিত্য কর্ম ‘মেটাম্যরফোসিস’ রচনা করেন এবং হত্যাযজ্ঞ শুরু হওয়ার অল্প পরেই রচনা করেন ‘দ্য ট্র্যাপ’।
এগুলো ছিল দুটি দুঃস্বপ্ন:
একজন মানুষ বিশাল তেলেপোকা হয়ে জেগে ওঠে এবং কেন তা হয়েছে, কিছুতেই সে অনুধাবন করতে পারে না। পরিশেষে একদিন ঝাড়ু দিয়ে ঝেঁটিয়ে দৃষ্টির আড়ালে সরিয়ে দেওয়া হয়।
আরেকজন লোক ধরা পড়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে বিচার করা হয়েছে এবং বিচারে সে দোষী প্রমাণিত হয়েছে। অথচ লোকটি আসল কারণ জানে না কেন সে দোষী। অবশেষে একসময় জল্লাদ তার শিরচ্ছেদ করেছে।
এসব গল্প এবং গ্রন্থের কাহিনী বিশেষভাবে খবের কাগজে স্থান পায়, যা দিনের পর দিন যুদ্ধের অগ্রগতির কথা প্রকাশ করে।
লেখক, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চেহারার অশরীরী ভূত, নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণায় কাতর হয়ে লিখেছেন।
তিনি যৎসামান্য প্রকাশ করেছেন। বলতে গেলে কেউ তার লেখা পড়েনি।
নিঃশব্দে তিনি চলে গেলেন, যেন প্রস্থানের পরেও তার অস্তিত্ব বিদ্যমান। অন্তিম মুহূর্তে তিনি বিছানায় শুয়ে ডাক্তারকে শুধু বলতে পেরেছিলেন:
‘যন্ত্রণা থেকে আমাকে মুক্তি দিন, নইলে আপনি কিন্তু একজন খুনী। ’
______________
মার্ক টোয়েন
______________
ইরাক আক্রমণের কয়েক মাস পরে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ঘোষণা দিয়ে বলেছেন যে, ফিলিপাইনের স্বাধীনতা যুদ্ধকে মডেল হিসাবে গ্রহণ করে তিনি এই যুদ্ধে নেমেছেন।
উভয় যুদ্ধই স্বর্গ থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েছে।
গোমড় ফাঁকা করে বুশ আরও বলেছেন যে, তিনি যা করছেন, তা ঈশ্বর প্রদত্ত নির্দেশ। এবং শত বৎসর পূর্বে প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ম্যাককিনলেও ঈশ্বরের দৈব বাণী পেয়েছিলেন:
‘ঈশ্বর আমাকে বলেছেন যে, ফিলিপিনোদের হাতে কিছুতেই তাদের ভবিষ্যৎ ছেড়ে দেওয়া যাবে না।
তারা নিজেদের শাসন করার জন্য যোগ্য নয়। কাজ করার মতো আমাদের কিছু নেই। বরং তাদের সবাইকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে, সভ্য করতে হবে এবং খ্রিস্টান বানাতে হবে। ’
সুতরাং ফিলিপিনোদের ভয়-ভীতির হাত থেকে ফিলিপাইনকে মুক্ত করা হয়েছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একই পথ অনুসরণ করে রক্ষা করেছে কিউবা, পুয়ের্তো রিকো, হন্ডুরাস, কলাম্বিয়া, পানামা, ডোমিনিকান রিপাবলিক, হাওয়াই, গুয়াম, সামোয়া ...
একসময় লেখক অ্যামব্রোস বিয়ার্স উদ্ঘাটন করে:
‘যুদ্ধ হচ্ছে আমাদের ভূগোল শেখার জন্য ঈশ্বরের পদ্ধতি। ’
এবং তার সহকর্মী লেখক এবং এন্টি-ইম্পিয়্যারলিস্ট লিগের নেতা মার্ক টোয়েন জাতির জন্য একটা পতাকার নকশা এঁকেছিলেন। সেই পতাকায় তিনি তারকার পরিবর্তে ছোট ছোট মাথার খুলির ছবি দিয়েছিলেন।
জেনারেল ফ্রেডেরিক ফানস্টন অভিমত প্রকাশ করে বলেছিলেন যে, রাষ্ট্রদ্রোহিতার জন্য টোয়েনকে ফাঁসিতে ঝুলানো উচিত।
টম সয়্যার এবং হাক ফিন তাদের জনককে প্রতিরক্ষা করেছিল।
______________
আলী
______________
সে ছিল প্রজাপতি এবং মৌমাছি।
রিংয়ের মধ্যে সে যেন ভেসে বেড়াত এবং হুল ফোঁটাত।
১৯৬৭ সালে, মোহাম্মদ আলী, জন্মের পর বাবা-মা যার নাম রেখেছিলেন কসিয়াস ক্লে, সৈনিকের পোশাক পরিধান করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।
‘ভিয়েতকংদের বিরুদ্ধে আমার কোনো বিদ্বেষ নেই,’ তিনি বলেছিলেন। ‘আমাকে কোনো ভিয়েতনামী নিগার বলে সম্বোধন করেনি। ’
ওরা তাকে দেশদ্রোহী বলে দোষারূপ করেছে। এছাড়া তাকে পাঁচ বছরের কারাবাসও দিয়েছে এবং মুষ্টিযুদ্ধ থেকে অব্যহতি দিয়েছে। ওরা তার ‘বিশ্ব চ্যাম্পিয়ানশিপ’ খেতাব জোর করে ছিনিয়ে নিয়েছে।
এই শাস্তি পরবর্তী সময়ে ট্রফি হিসাবে তার কাছে ফিরে এসেছে। বিশ্ব চ্যাম্পিয়াশিপ খেতাব ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য তাকে রাজা হিসাবে আখ্যায়িত করে।
কয়েক বছর পরে কলেজের ছাত্ররা একটা কিছু আবৃত্তি করার জন্য তাকে অনুরোধ করে। তিনি ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বিশ্বের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত কবিতা আবৃত্তি করেন:
‘আমি, আমরা। ’
___________________________________
দক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম প্রধান লেখক এদুয়ার্দো গালিয়ানো। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্প লেখক, সাংবাদিক এবং সাম্রাজ্যবাদের কঠোর সমালোচক ছিলেন। উরুগুয়ের রাজধানী মন্তেবিদেয়োতে ১৯৪০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। মাধ্যমিক পড়ালেখা অসমাপ্ত রেখে মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি কাজ আরম্ভ করেন। পরবর্তীতে ষাটের দশকের শুরুতে সাংবাদিক হিসেবে কর্ম জীবনে প্রবেশ করেন। দীর্ঘ ৫০ বছর লেখালেখি করেছেন পুঁজিবাদ বা সাম্রাজ্যবাদ বিরুদ্ধে। বলা হয়, তার লেখনির মাধ্যমে তিনি লাতিন আমেরিকার ‘অপহৃত স্মৃতি’কে উদ্ধার করে পুনর্জীবিত করেছেন। ‘মেমোরীজ অফ ফায়ার’ (তিন খণ্ড), ‘ডেইজ এন্ড নাইটস্ অফ লাভ এন্ড ওয়ার’, ‘দ্য বুক অফ অ্যামব্রেসেস’ এবং ‘ওয়াকিং ওয়ার্ডস্’ তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
গল্পসূত্র: অনূদিত গল্পগুলো ‘মিররস্ : স্টোরিজ অফ অলমোষ্ট এভরিওয়ান’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। স্পেনিশ ভাষা থেকে গল্পগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন মার্ক ফ্রাইড।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫১ ঘণ্টা, জুলাই ৮, ২০১৫