ভাবিনি ঘটনাটি বলার পরপরই আমাকে বাড়িটা ছেড়ে দিতে হবে।
সামনে থেকে দেখলে বাড়িটা ছিল অভিজাত।
সেদিনই উঠছিলেন ভদ্রলোক সামনের বাড়িটাতে। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে নিচের সিঁড়িতে দেখলাম মালপত্র ওঠানোর তদারকি করছেন। কাচের একটা শো-কেস যেন সাবধানে ওঠে আর কোনোদিকের দেয়ালে ঘষা না লাগে, ক্রমাগত রানিং কমেন্ট্রি ঝেড়ে সেটা নিশ্চিত করতে চাচ্ছিলেন। আমি যেহেতু সিঁড়িতেই উঠব, শো-কেস তখন কয়েক সিঁড়ি উঠে গেছে, তাই আমাকে নিচে দাঁড়াতে হলো। চারজন মানুষ চার কোণে ধরে বিশাল জিনিসটা সিঁড়ির বাঁক পর্যন্ত নিতে হিমশিম খাচ্ছিল। তারা আসলে কেউই দেখতে পাচ্ছিল না কোনদিকে যাচ্ছে বা কোনদিকে যাবে। এক সময়ে ভদ্রলাকের সঙ্গে আমিও কমেন্ট্রিতে যোগ দিলাম। শো-কেসটা মোটামুটি উপরে উঠে গেলে ভদ্রলোক আমার দিকে হাত বাড়ালেন। হ্যান্ডশেক করতে করতে বললেন, ‘এ বাড়িতে থাকেন বুঝি?’
‘জি, দোতলায়ই, আপনার পেছনের দিকের অ্যাপার্টমেন্টে। ’
‘আপনি কী করে জানলেন আমি দোতলায় এলাম?’
‘ওই একটাই বাসা খালি যে এখানে!’
‘তা ঠিক তা ঠিক। ’ ভদ্রলোক মনে হয় নিজের বোকামিতে লজ্জা পেলেন। বললেন, ‘সিঁড়ি খালি, চলুন উপরে যাওয়া যাক। ’
উপরে উঠে তার সাথে তার বসার ঘরের দিকে উঁকি দিলাম। বেশি ফার্নিচার নেই। আধুনিকতার পরিচয় এটাই, সিম্পল লিভিং। অবশ্য হতে পারে তখনো সব আনা হয়নি। যা আনা হয়েছে, মোটামুটি জায়গামতো রাখা হয়েছে, ছিমছাম লাগছিল দেখতে। উঁকি দিতেই ভদ্রলোক বললেন, ‘আসুন না ভেতরে। ’
সোফায় মোড়ানো খবরের কাগজ ছিঁড়ে উঠিয়ে আমাকে বললেন, ‘বসুন। ’ শো-কেসটা জায়গামতো রাখালেন তদারকি করে। লম্বা দেয়ালে অনেকখানি জায়গা ফাঁকা রাখলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এখানে বসবে বইয়ের শেলফ’, ইশারায় কতকগুলো কার্টন দেখিয়ে দিলেন। দেখলাম দেয়ালের শেষ মাথায় গাদাগাদি করা কার্টন, মনে মনে ভাবলাম, এত্ত বই! ঘরের জিনিসপত্র বলে দেয় ভদ্রলোক রুচিশীল আর ব্যবহারে অমায়িকও বটে। শো-কেস জায়গামতো রাখা হলে তিনি আমার পাশের সোফায় এসে বসলেন। কেন যেন দু’চার কথাতেই আমাদের গল্প জমে গেল। রাস্তাঘাটের পরিস্থিতি, রাজনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থার ক্রমাবনতি, কিছুই বাদ পড়ল না। ফাঁকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘অফিস থেকে ফিরছেন, টায়ার্ড না তো?’
‘না না, বহুদিন এখানে কেউ থাকে না। কারো সাথে কথা বলার সুযোগ হয়নি। ভালোই লাগছে। ’
‘বহুদিন কেউ ছিল না বুঝি?’
‘না। তবে সে অনেক আগে এক ফ্যামিলি, না মানে একজন—’
‘একজন কী?’
‘সে আছে এক গল্প। আপনি বুঝবেন না। ’
‘বুঝব না কেন? বলুন না শুনি। ’
‘না, মানে আপনি এ বাড়িতেই উঠেছেন, আর এ বাড়ি নিয়ে এমন একটা গল্প, আপনার যদি খারাপ লাগে—’
‘খারাপ লাগবে কেন? আমার সত্যি কৌতূহল হচ্ছে, ভাই, বলুন না, লজ্জা করবেন না। আমার কিচ্ছু খারাপ লাগবে না, প্রমিজ। ’
কেউ ওভাবে জানতে চাইলেই আমি সেই গল্পটা বলতাম না। আমি ঠিক করেই রেখেছিলাম যে ওই গল্পটা কখনোই কাউকে বলব না। কিন্তু জানি না তখন আমার কী হলো, ওই বাড়িতে, ওই ঘরে বসে যেন মনে হলো কেউ আমাকে দিয়ে কাহিনীটা বলিয়ে নিচ্ছে। মানে মনে হলো ভেতর থেকে কোনো এক ধাক্কায় আমি গড়গড় করে কথা বলতে শুরু করলাম। ...
মানুষ যখন থেকে অ্যাপার্টমেন্টে থাকে তখন থেকেই তারা ‘অ্যাপার্ট’, মানে দূরে দূরে থাকতে আরম্ভ করল। দেখলাম উপরের মানুষ নিচের মানুষকে চেনে না। আমি নিশ্চিত, রাস্তায় বা অন্য কোথাও দেখা হলেও জানবে না একই ছাদের ওপর-নিচে তাদের বাস। তবে এই ধারণা থেকে বেরিয়ে এলাম যখন বছর তিনেক আগে এই বাড়ি ভাড়া নিয়ে এলো এক পরিবার। মালপত্র ওঠাবার দিনেই ভদ্রলোক করিডোরের শেষ মাথায় আমার দরজায় টোকা দিলেন। বুঝতেই পারছিলাম না প্যাকেজিঙের ব্যবসার সাথে জড়িত মোটামুটি পয়সাওলা একজন মানুষের কী দরকার পড়েছিল পেছনের ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টের করো সাথে পরিচিত হবার। যাই হোক, আমার পুরোনো কাঠের সোফায় মহানন্দে তিনি বসে পড়লেন। ভদ্রলোকের নাম ফরিদ আহমাদ। আমুদে ভদ্রলোক পরিচয়ের পরে গল্প শুরু করে দিলেন।
‘লালমাটিয়ার এ দিকটা ভালোই, কী বলেন?’
‘জি, তা ভালো। ট্র্যাফিক জ্যাম একটু কম। ’
‘সেটাই। আমার ফ্যাক্টরি মিরপুরে, ধানমন্ডিতে ছিলাম এতদিন কিন্তু এত ভীড় বেড়েছে, যাওয়া আসা মুশকিল। ’
‘তা ঠিক। ’
‘আমার অবশ্য যে কোনোখানে থাকলেই চলে। ছেলেমেয়ে নেই তো। তা, আপনার কজন?’
‘আমার তিন ছেলে মেয়ে। বড়ো মেয়ে ইউনিভার্সিটিতে, পরেরটা কলেজে আর ছোটো ছেলে স্কুলে। ওয়াইফ মারা গেছের সাত বছর আগে। ’
‘ওহ্, সো স্যাড। ছেলেমেয়েদের নিয়েই তাহলে আপনার সংসার। ওদের নিয়ে বাসায় আসবেন, আমার ওয়াইফ খুশি হবে। ’
‘জি আসব। ’
আমার বড়ো মেয়ে চা বানিয়ে আনলে তিনি তার সাথেও কথা বললেন, আগ্রহ করে চা খেয়ে উঠে পড়লেন। সেদিন ভদ্রলোকের সাথে আর কথা হয়নি। জিনিসপত্র গোছাতে ব্যস্তও ছিলেন নিশ্চয়। পরে বহুবার সিঁড়ি কি করিডোরে দেখা হয়েছে। তবে তাকে সবচেয়ে বেশি দেখেছি পেছনের বারান্দায়। শোবার ঘরের সাথে লাগানো যে বারান্দা তাদের, সামনেই একটা শিউলি গাছ, সামান্য ফাঁকা জায়গা পেরিয়ে আমাদের বাড়ির একমাত্র বারান্দাটা। বিল্ডিঙের এক ধারে ওইটুকু খালি জায়গা, দুটো অ্যাপার্টমেন্টে সেখানে মুখোমুখি। আমি বরাবরই সেই বারান্দায় পায়চারি করি, বসে চা খাই। সেখানে বসে তাদের বারান্দার দিকে চোখ পড়লেই কাচের স্লাইডিং ডোরের ওপারে বাড়ির ভেতরের অনেকটা অংশ দেখা যায়। একেবারে সামনেই অন্য বাড়ির বারান্দা জেনেও কেন যেন সেখানে পাতলা মসলিনের পর্দা টাঙিয়েছিলেন তারা বা তিনি। প্রথম প্রথম বিরক্তই হয়েছি, তাদের কি কোনো প্রাইভেসির প্রয়োজন নেই? অন্তত আমার তো আছে। ঘোর গরমের দিনে অফিস থেকে ফিরে আমি লুঙ্গি পরে খালি গায়ে চা নিয়ে বারান্দায় বসি। তারা আসার পর থেকে গায়ে গেঞ্জি চড়াতে হতো। অথচ ইচ্ছে করে না হলেও চোখ তো চলেই যায়, দেখতাম বাসার ভেতরে তাদের গতিবিধি একেবারে স্বাভাবিক। বিশফুট দূর থেকেই যে কেউ তাদের দেখছে, এ নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। তবে আমি একেবারে ড্যাবড্যাব করে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকিনি; আড়চোখে দেখতাম। হাজার হলেও মানুষ কি কৌতূহলকে অস্বীকার করতে পারে! স্বামী-স্ত্রী নিজেদের মতো থাকত, গল্পগুজব থেকে শুরু করে ঢলাঢলি, কিছুই নিয়ন্ত্রিত ছিল না। জানি না কেন তারা মনে করত ওই ফিনফিনে পর্দা আর শিউলি গাছের সামান্য কিছু ডালপাতা তাদেরকে সবার চোখের আড়াল করেছে। ধীরে ধীরে পরে অবশ্য মনে হয়েছিল তারা দেখাতেই চায়, নিজেদের নিয়ে তাদের একরকম লোকদেখানো ব্যাপার আছে। তার আগে বহুদিন বাড়িটা খালি পড়ে ছিল, হঠাৎ প্রতিবেশি আসায় আমার ভালোই লাগত। আমার বাড়িতে ছেলেমেয়েরা তো থাকত তাদের মতো, আমি বলতে গেলেই একলাই, তাই আসতে যেতে তাদের বাড়িতে উঁকি দেয়াটা আমারও এক ধরনের বিনোদন হয়ে গেল। বসার ঘরের দরজা কখনো সামান্য খোলা থাকলে ফরিদ আহমাদ হয়তো আমাকে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসতে দেখলেন। নিজেই বেরিয়ে এসে বলতেন, ‘আসুন না একসাথে চা খাওয়া যাক। আমিও এই ফ্যাক্টরি থেকে ফিরলাম। ’
এত আকর্ষণীয় আহ্বানে সাড়া না দিয়ে উপায় নেই। আমি নাচতে নাচতেই ভেতরে যেতাম। ছিমছাম ঘরে বিভিন্ন জায়গার অ্যান্টিকস, ছোটো ছোটো নেপালি কার্পেট আর বই দিয়ে সাজানো। আমাদের কথার মধ্যেই তার স্ত্রী ঝুমা চা-নাস্তা নিয়ে উপস্থিত হতেন; যোগ্য ঘরণী যাকে বলে, কপালে টিপ, পরনে পাড়ওলা শাড়ি। তাকে আমি কখনো বাসা থেকে বেরোতে দেখিনি অথচ সবসময় যেন বাইরে যাবার জন্য তৈরি হয়ে থাকতেন। সাজটা অনেকটা আগেকার দিনের বাঙালি মেয়েদের মতো। সেই সাজ দেখে মনে হতো, হাল ফ্যাশানের হাওয়া তার গায়ে লাগেনি বলেই তার দিকে চোখ পড়লে আর ফেরানো যায় না। কিন্তু পরের বউকে যেভাবে দেখা ভদ্রতা, সেভাবেই দেখতাম তাদের ওই বসার ঘরে বসে। চা হাতে ঝুমাও গল্পে ঢুকে পড়ত। ফরিদ আহমাদ একদিন বললেন, ‘অফিস তো মতিঝিলে, না?’
‘হ্যাঁ। ’
‘এত দূরে থাকেন কেন?’
‘আছি বাচ্চাদের জন্য। সবার পড়াশোনা এদিকে। আমি একা কষ্ট করি। ’
‘তা ঠিক, বহু সময় বাসেই থাকতে হয় আপনাকে। ’
‘এতদূরের রাস্তায় বাসা-অফিস করে বাজার-টাজারও তো করতে হয়। ’
‘তা তো হয়ই। ’
‘ইস্, বেশ কষ্ট!’
আমি কিছু বলার আগে ঝুমা কথা ঘুরিয়ে অন্যদিকে নিয়ে গেল, বলল, ‘ওর অবস্থা যদি আপনার মতো হতো তবে যে কী হতো!’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কেন?’
‘মানে শুধু ফ্যাক্টরি আর বাসা, এর বাইরে আর কোথাও তাকে যেতে দেখবেন না। অলস যাকে বলে। আমার কিছু ইচ্ছে করলেও এনে দেবে না। ’
কথার শেষের দিকে কণ্ঠস্বরটা আহ্লাদী হয়ে গেল ঝুমার। আমি সেটা গায়ে না মাখিয়ে বললাম, ‘আপনি তো মনে হয় বাসাতেই থাকেন, একটু এগোলেই তো কত দোকানপাট এদিকে, চলে যাবেন নিজেই। ’
‘নাহ্, আমার ওসব ভালো লাগে না। ওই সে ফ্যাক্টরির কোনো লোককে দিয়ে বাজার করিয়ে আনে, তাই দিয়েই চলে যায়। ’
তখন মুখ খুললেন ফরিদ আহমাদ, ‘তবে? অলস শুধু আমি?’
ঝুমা হাসল, ‘নাহ্, সত্যিই মাঝে মাঝে কিছু একটা হয়ত খুব ইচ্ছে করে, কিন্তু সবকিছু এত দূরে যে যাওয়ার কথা ভাবতে ভালো লাগে না। এই যেমন, সেই মতিঝিলে হোটেল পূর্বাণী আছে না? ওরা দারুণ মাটন প্যাটিস বানায়। ছোটোবেলায় অনেক খেয়েছি। এখন তো আর ওদিকে যাওয়া হয় না। ’
আমি লাফিয়ে বললাম, ‘সে তো আমার অফিসের পাশেই। কালই পেয়ে যাবেন মাটন প্যাটিস। ’
ঝুমা খুশি হলো। ফরিদ আহমাদ বললেন, ‘ঠিকই তো, ঝুমা ওনাকে টাকা দিয়ে দিও প্যাটিস কেনার জন্য। ’
টাকার কথায় আমি কিছু বললাম না। ওরকম বড়ো হোটেল থেকে হুট করে গাদাখানেক প্যাটিস কিনে আনার সামর্থ আমার নেই। তাই টাকা নেয়াই ভালো। শুধু ভাবলাম, ঝুমার সাজসজ্জার মতো তার খাবারের পছন্দও আদ্যিকালের। আমার ছেলেমেয়েরা তো খেতে চাইলে আজকাল বার্গার, পিজা খেতে চায়, আমি নিজেও প্যাটিস বা ক্রিমরোল খাওয়ার কথা কখনো ভাবি না।
পরদিন সকালে ঝুমা যেন দরজায় তৈরিই ছিল। দরজা সামান্য ফাঁক করে হাত বাড়িয়ে টাকাটা দিল। লাজুক মুখ করে বলল, ‘আপনার বাড়ির সবার জন্যেও আনবেন কিন্তু। ’
আমি তাকে শুধু ‘ধন্যবাদ’ বললাম। দেখলাম, ঝুমার সাথে কথা বলতে গিয়ে ‘ভাবী’ ডাকটা কিছুতেই আমার মুখে আসছে না। সে বয়সে আমার চেয়ে যত না ছোটো, তাকে দেখায় তার চেয়েও ছোটো, উচ্ছল তরুণীর মতো। জানি না কেন, সকাল সকাল তাকে দেখে আমার দিনটাই অন্যরকম হয়ে গেল। ভ্যাপসা গন্ধওলা যে অফিসে পুরোনো কাঠের চেয়ারে বসতে প্রতিদিন আমার অসহ্য লাগত, সেদিন কিছুই খারাপ লাগল না। তারপর আবার বেরিয়ে সোজা গিয়ে ঢুকলাম ঝকঝকে পূর্বাণী হোটেলের বেকারিতে। একেকটা প্যাটিস একশ’ বিশ টাকা, ভাবাই যায় না। অথচ অনায়াসে গোটা দশেক কিনে হাতে ঝুলিয়ে আমি বাসার দিকে রওনা দিলাম। সব কেমন সিনেমার মতো মনে হচ্ছিল। সেদিন আড্ডাও জমল খুব ফরিদ আহমাদের বাড়িতে। আমার বড়ো মেয়ে প্যাটিস দেখে তো অবাক হলোই, তাছাড়া প্রায়ই বিকেলে আমাকে চা বানিয়ে দিতে হচ্ছে না বলে সে এমনিতেও খুশি। তবে তখন ছেলেমেয়েরা আমার নির্লিপ্ত, কঠোর ব্যক্তিত্বকে ধীরে ধীরে খানিকটা বদলে যেতে দেখে ঠিক আনন্দ পাচ্ছিল নাকি অস্বস্তিতে ভুগছিল বলা কঠিন। আমার জানতে চাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। কে জানে, তাদের সাথে কথা বলতে গেলে ওই বাড়ির মূল আকর্ষণ ঝুমার কথাটি যদি প্রকাশ হয়ে যায়! তাই বাড়ি ফিরে ফরিদ আহমাদ আর ঝুমাকে নিয়ে কখনো কিছু বলি না।
তবে ওই ব্যাপারটি নিয়মে দাঁড়িয়ে গেল; সকাল বেলা আমার অফিসে বেরোনোর সময়টা ঝুমার মুখস্ত। ফরিদ সাহেব তখনো নিশ্চয় ঘুমেই থাকেন। ঝুমা দরজার ফাঁক দিয়ে কোমর পর্যন্ত শরীর বের করে হাত বাড়িয়ে টাকাটা দেয়, কোনোদিন সিঙ্গাড়া, কোনোদিন জিলাপি, ফেরার সময়ে এসব আনা চাই। এমনকি কোনোদিন ঝুমা ‘কাল না তাড়াহুড়োর মধ্যে সে বাজার করে আনেনি। আমাকে একটু এই কটা জিনিস এনে দেবেন, প্লিজ’ বলে কাঁচা-মরিচ, ধনিয়া পাতা থেকে শুরু করে গরুর মাংস পর্যন্ত লেখা লম্বা লিস্ট ঝুমা ধরিয়ে দিত। আমি হাসিমুখে বাজার সেরে বাড়ি ফিরতাম। সে বলত, ‘খুব কষ্ট দিলাম, না?’ আমি হাসতাম, যেন বাজার করতে দিয়ে আমার প্রতি কোনো দয়া করা হয়েছে, এমন ভঙ্গিতে বলতাম, ‘তা কেন! মতিঝিল তো এমন জায়গা যেখানে রাস্তায় বেরোলে কী না পাওয়া যায়, অফিস থেকে বেরিয়ে ফুটপাথে হাঁটতে হাঁটতে যে কোনো মানুষ বাড়ির সমস্ত জিনিস কিনে ফিরতে পারে। ’
‘তবু, এতসব জিনিস টেনে আনা—এরপর থেকে আনলে ট্যাক্সি নিয়ে আসবেন, প্লিজ। বাজারের টাকা থেকে ভাড়াটা নিয়ে নেবেন। ’
আমি মাথা দোলাতাম। তবে একদিন মনে হলো, সামান্য এগিয়ে গিয়ে যে কোনো ডিপার্টমেন্ট শপ থেকে ঝুমা কি মাংস বা এসব কিনে আনতে পারে না? সে যেন আমার চিন্তার ভেতরে ঢুকে পড়ল, বলল, ‘কী আর বলব, আসলে এখানকার বড়ো দোকানগুলোর মাংস ফ্রেশ থাকে না, একবার তো রান্নার পরেও এয়ার ফ্রেশনারের গন্ধ যাচ্ছিল না। আপনি যেটা আনেন, সেটা একেবারে তাজা। ’
ঝুমার প্রশংসায় খুশি হয়ে আমি বাড়ি ফিরি। চোখে লেগে থাকে ঝুমার হাত নাড়ানো, কথা বলা, মিটিমিটি হাসি। সন্ধ্যার পরেও মাঝে মাঝে আমি বারান্দায় বসে থাকতাম, হয়ত তারা বারান্দায় আসবে বা কাচের স্লাইডিং ডোর ভেদ করে তাদের দেখা যাবে, এই আশায়। আমার বারান্দাপ্রীতির জন্য কিছুটা লজ্জিতও হতাম। বড়ো মেয়েটা নিশ্চয়ই বুঝে ফেলবে আমি এখানে বসে কোনদিকে তাকিয়ে থাকি। সেটা ভেবে সতর্ক হলেও সেখানে বসে ফরিদ আহমাদের বাড়িতে উঁকিফুচকি মারা কিছুতেই বন্ধ করতে পারলাম না; বরং বাড়ল। রাতে কখনো ফরিদ সাহেব হয়তো বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন, তো ঝুমা এসে পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরল, দুজনে মিলে খুব করে হেসে উঠল। আমার ভাব দেখে মনে হতো যেন একটু এগিয়ে কান পাতলে শুনতে পাব তারা কী বলছে। কখনো দেখতাম ভেতরে খাবারের টেবিলে তারা খেতে বসেছে। মনে মনে ভাবতাম, আমিই তো বাজার করে এনেছি, খেতে বসে আমার কথা একবারও কি উঠছে না? উঠছে নিশ্চয়ই। ভেবে বেশ মজাই লাগত। খাবারের পর দেখতাম দুজনে মিলে টেবিল পরিষ্কার করল, তারপর বামদিকের বেডরুমে ঢুকে গেল। আমার অস্থির লাগত, মনে হতো এর পরেও দেখতে পারলে বেশ হতো। একদিন বুদ্ধি করে বাসার সেদিকের রুমের বাথরুমে চলে গেলাম। টুলের ওপরে দাঁড়িয়ে বাথরুমের উঁচু জানালা দিয়ে তাদের বেডরুমের জানালা দিয়ে তাকালাম। আমি ভাবতেই পারিনি ওখান থেকে এত স্পষ্ট দেখতে পাব। বিছানায় পাশাপাশি শোয়া তাদের দুই জোড়া পা দেখা যাচ্ছিল। আমি প্রায়ই রাতে বাথরুমে ঢুকে সেই পায়ের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতাম। একটা সময় ঘরের আলো বন্ধ হয়ে যেত, লালচে আলো জ্বলে উঠত তার বদলে। মনে হতো আমার বিষণ্ণ ঘরের পাশে যেন নতুন এক গ্রহের আবির্ভাব হয়েছে; অচেনা, অদেখা আর চিরসবুজ। বাথরুম আর কতক্ষণ আটকে রাখব, ছেলেমেয়েরা সন্দেহ করবে, এই ভেবে বেরিয়ে আসতাম। মন না মানলে আবার বারান্দায় গিয়ে বসতাম। ‘বাবা, এত রাতে মশার কামড় খাবে তো’, মেয়ের কথা উপেক্ষা করে বারান্দায় চলে গেলাম এক রাতে। গিয়ে তো আমার চোখ ছানাবড়া। ওদের ডাইনিং টেবিলের ওপরে একটা মোমবাতি জ্বলছে আর তার ক্ষীণ আলো এসে পড়েছে বারান্দায়। সেখানে আকাশের দিকে মুখ তুলে দাঁড়িয়ে আছে ঝুমা। মনে মনে নিজেকেই প্রশ্ন করলাম, এই এক্ষুণই না আমি তাকে বিছানায় ঘুমাতে দেখলাম? তারপর নিজের মনেই হাসলাম, হয়ত আমার মতো তারও ঘুম আসছে না। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে আছে ঝুমা। মুখে ঠিক বিষণ্ণতাও না আবার হাসিও না, সমস্ত কিছু মাখামাখি হয়ে অদ্ভুত একটা বৈপরিত্য তৈরি করেছে। মানুষ যেমন বহুবছরেও আবিষ্কার করতে পারেনি মোনালিসা হাসছে নাকি হাসি দিয়ে কষ্ট ঢাকছে, তেমনি শিউলিগাছের ফাঁক দিয়ে আমার কৌতূহল কিছুতেই সিদ্ধান্ত নিতে পারল না প্রায় মধ্যরাতে ঝুমা মনের খুশিতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে নাকি মনের দুঃখে? মুখ স্পষ্ট দেখতে না পেলেও আমি তার শরীরের ভাঁজগুলো ঠিকই দেখতে পাচ্ছিলাম। অত রাতে আশেপাশে কেউ নেই, ছেলেমেয়েরা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে, আপনমনে ঝুমার দিকে তাকিয়ে থাকতে তখন আমার কোনো বাধা নেই। আমি নিশ্চিত ঝুমা আমাকে দেখতে পায়নি, টুলে বসে ছিলাম, রেলিঙের ওপর দিয়ে কতটুকুইবা দেখা যেতে পারে। অথচ খানিক পরেই মনে হলো সে যেন আমাকে দেখানোর জন্যই নানারকম ভঙ্গি করছে, আড়মোড়া ভাঙছে বা গুনগুন করে গান ধরেছে। রাতের নিস্তব্ধতায় সেই আওয়াজ আমার কানে পৌঁছে যাচ্ছে কিন্তু মনে পড়বে পড়বে করেও ঠিক মনে পড়ছে না গানটা। ঝুমার নানান কাণ্ড দেখতে দেখতে কখন রাত তিনটা বেজে গেছে খেয়াল করিনি, পরদিন অফিস আছে, ঘুমাতে হবে বলে উঠে বাথরুমে গেলাম। মনে হলো, বউ তো বারান্দায়, দেখি ফরিদ আহমাদ ঘুমিয়ে আছেন কি না। টুলের ওপরে দাঁড়িয়ে আমার চোখ গোল গোল হয়ে গেল। বিছানায় ফরিদ আহমাদ তো আছেনই, ঝুমাও আছে। দুজনেই ঘুমাচ্ছে। নিথর দুই জোড়া পা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ঝুমার পায়ের গোড়ালির ওপরে নাইটির লেসের ঝালর দেখা যাচ্ছে, হ্যাঁ, বারান্দায় সেই পোশাকেই দাঁড়িয়ে ছিল সে, কয়েক সেকেন্ড আগে মাত্র। আমি চলে এলাম বলে কি ঝুমাও ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল? কিন্তু এত তাড়াতাড়ি? কেমন যেন খটকা লাগল। দৌড়ে গেলাম বারান্দায়, গিয়ে দেখি অবিকল আগের মতোই ঝুমা বারান্দায় পায়চারি করছে, মোমবাতিটা হাতে তুলে এনেছে, গলে পড়া মোম আঙুল দিয়ে তুলে তুলে শিখার কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। আমি বারান্দায় নিজেকে লুকোতে ভুলে গেলাম। মোমবাতি দিয়ে খেলতে খেলতে ঝুমা হঠাৎ করে মুখ ফেরাল আমার দিকে, খুব মিষ্টি করে হাসল, এ যেন মধ্যরাতে দেখা হওয়া নয়, যেন দিনেদুপুরে স্বাভাবিকভাবে করিডোরে দেখা হয়েছে। আমি হঠাৎ থমকে গেলাম, কিছু বুঝতে না পেরে আবার বাথরুমে দৌড়ে গেলাম, জানালায় উঁকি দিলাম, হ্যাঁ, ঝুমা ঘুমাচ্ছে বরের সাথে। তারপর দৌড়ে বারান্দায় এলাম, ঝুমা মোমবাতি ধরে আছে, সামান্য বাতাস এলে হাত দিয়ে শিখাটাকে বাঁচাচ্ছে। বারান্দা থেকে সোজা চলে এলাম বিছানায়, কাঠ হয়ে পড়ে থাকলাম। ঘটনাটার বিভিন্ন ব্যাখ্যা নিজের ভেতরে দাঁড় করাচ্ছিলাম—ঝুমা আমার সাথে খেলছে কি? কোনো ব্যাখ্যাই মনমতো হলো না। ঘুমও হলো না রাতভর। চোখ ডলতে ডলতে পরদিন অফিসের জন্য বেরিয়েছি, দেখি ঝুমার হাত বেরিয়ে এলো সামান্য খোলা দরজা দিয়ে, হাতে টাকা।
‘দেশবন্ধু থেকে লুচি আর তরকারি আনতে পারেন আজ?’
হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিতে গিয়ে দেখি, ঝুমার পরনে সেই রাতের পোশাকই, লম্বা হাতার সামনে গোলাপি লেস। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে। চোখ লাল দেখেই কি না জানি না, ঝুমা জানতে চাইল, ‘ঘুম হয়নি বুঝি? খুব গরম পড়েছে, তার ওপরে প্রায় সারারাত ইলেকট্রিসিটি নেই, ঘুমানো মুশকিল। ’
আমি কোনো কথা বললাম না। ইলেকট্রিসিটি কখন গেল? মনে করতে পারলাম না। এজন্যেই কি ঝুমা মোমবাতি জ্বালিয়েছিল? কিন্তু তাদের বেডরুমে তো মিটিমিটি ডিমলাইট ঠিকই জ্বলছিল। আমার বাড়িতেও তো ইলেকট্রিসিটি ছিল। আর তাদের বেডরুমে ছিল কিন্তু ডাইনিংরুমে ইলেকট্রিসিটি ছিল না? কিন্তু ওভাবে তাদের লক্ষ করছি এসব তো আর বলা যায় না, তাই টাকা নিয়ে আমি হাঁটা দিলাম।
কিন্তু সেদিন থেকে আমার রুটিন বদলে গেল। অফিস থেকে এসেই আমি ঘুমিয়ে পড়ি। ছেলেমেয়েদের সাথে কথা প্রায় হয়ই না। তারা পড়াশোনা শেষ করে ঘুমিয়ে পড়লে আমি বারান্দায় গিয়ে বসি। ঝুমা আমাকে লক্ষ করার ভঙ্গি না করে বারান্দায়, ডাইনিং রুমে ঘোরাফেরা করতে থাকে। একটু পরপর আমি বাথরুমের জানালায় গিয়ে উঁকি দেই, হ্যাঁ, ঝুমা স্বামীর পাশে ঘুমিয়ে আছে। সব বুঝতে পেরেও আমি দিনের পর দিন নেশাগ্রস্তের মতো ঝুমাকে দেখতে থাকি। আমি জানতাম রাতভর যে বাড়িময় ঘুরছে সে ঝুমা নয়। কিন্তু দিনের বেলা ঝুমাকে সে কথা বলতে সাহস হতো না। বললে সে কিভাবে নেবে জানি না, আবার হঠাৎ করে তাকে মনভরে দেখার সুযোগটাও যদি হারিয়ে যায়। তবে ঝুমা যে আমাকে দেখানোর জন্যেই বাড়ির ওই দিকটাকে রাত হলেই শো-কেস বানিয়ে ফেলত, তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। যেমন ডাইনিং রুমের চেয়ারে পা উঠিয়ে ঝুমা তার নাইটি হাঁটু পর্যন্ত উঠিয়ে নিত, তারপর ধীরে ধীরে লোশন লাগাত, ধীরে ধীরে সারা শরীরেও লাগাত, চুল আঁচড়াত, ওসব কাজ ওই বাড়ির অতগুলো ঘর-বাথরুম ফেলে ডাইনিং রুমে দাঁড়িয়ে করার কোনো মানে ছিল না। তবে আমি দেখতেই থাকতাম। ঝুমা হোক বা ঝুমার দ্বিতীয় সত্তা, তাকে দেখাই আমার জীবনের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়াল। একদিন এমন হলো, রাত দুটোয় ঝুমা মোমবাতি হাতে বারান্দায় এলো। আমি জানতাম সে জানে না আমি আগে থেকেই বারান্দায় ঘাপটি মেরে আছি। অথচ সে মোমবাতিটা নিজের গলার কাছে উঠিয়ে নিল, নিচে থেকে ছড়িয়ে পড়া আলোয় তার মুখটা অপার্থিব মনে হচ্ছিল। দেখলাম এক ঝটকায় সে সরাসরি আমার দিকে তাকাল তারপর তার মুখটা কঠিন হয়ে গেল। তারপর আরো কঠিন। আমি কেমন যেন অনঢ় হয়ে গেলাম, বারান্দা থেকে চলে আসা তো দূরের কথা, আমার হাত-পা সব পাথর হয়ে গেল; চোখের পলক পর্যন্ত পড়ল না। জানি না কতক্ষণ, এক সময়ে ফুস করে মোমবাতিটা নিবে গেল, কোনোদিক থেকে বাতাস এলো হয়তো, আর আমার চোখের সামনে আস্ত ঝুমা অন্ধকারে মিশে উধাও হয়ে গেল। আমি ভাবলাম, তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নাকি! হাত-পায়ে জোর ফিরে পেয়ে দৌড়ে গেলাম বাথরুমে, টুলের ওপরে দাঁড়িয়ে জানালায় চোখ রাখলাম। ফরিদ আহমাদ শুয়ে আছেন আর পায়ের কাছে বসে আছে ঝুমা। ঘরে স্বাভাবিক উজ্জ্বল লাইট জ্বলছে। ঝুমার চুলগুলো উসকোখুশকো, হাতে একটা প্রাচীন ভোজালি, নেপাল থেকে আনা। ওই বাড়িতে অনেক অ্যান্টিকস দেখেছি, বিয়ের পরে তারা নিশ্চয় বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে গেছে, ফরিদ সাহেব কিছু গল্পও বলেছিলেন। নেপালি ভোজালিটা দেখিয়ে খাপের কারুকার্য নিয়ে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলেন। জিনিসটা বেশ বড়ো আর ধারাল বলে আনার সময়ে এয়ারপোর্টে ওটা নিয়ে কী ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল সে গল্পও করেছিলেন। ভোজালির খাপের ওপরে পিতলের কারুকাজ দেখে সত্যি মুগ্ধ হয়েছিলাম আমি। কিন্তু অত রাতে ঝুমার হাতে সেটি থাকাটা খুবই বেমানান এটুকু বুঝতে কষ্ট হয়নি। আমার ভয় করতে লাগল। ছোট্ট জানালা দিয়ে যতটুকু মুখ বাড়ানো যায় ততটুকু বাড়িয়ে আমি তাকিয়ে থাকলাম। ঝুমা যেন ফুসছিল, বড়ো বড়ো নিশ্বাস নিচ্ছিল, তারপর এক সময় ভোজালিসহ হাত সোজা ওপরে উঠিয়ে বসিয়ে দিল ফরিদ আহমাদের শরীরে। আমার সারা গায়ে ঘাম ছুটে গেল। বিস্ময়ের চোটে হুড়মুড় করে আমি টুল থেকে পড়ে গেলাম। তাড়াহুড়োয় বাথরুমের দরজা আটকাইনি। শব্দ শুনে বড়ো মেয়ে ‘কী হলো, কী হলো’ বলে ছুটে এল। হাত ধরে আমাকে ওঠাতে ওঠাতে বলল, ‘এই টুলটা সবসময় বাথরুমে কী করে আসে বলো তো, ওটায় লেগে পড়ে গেছো, না?’
মেয়ে আমাকে শুইয়ে দিয়ে ঘুমাতে চলে গেল। পরপরই আমি বেড়ালের মতো শব্দহীনভবে বারান্দায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। দেখলাম যথারীতি দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঝুমা; চোখমুখ বিষণ্ণ, উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে যেন বিশেষ কিছু দেখছে অথচ ওপরের দিকে সামান্য চাঁদের আলো পর্যন্ত নেই।
একজন মানুষকে খুন করে সামান্য পরে কেউ বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাওয়া খেতে পারে ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। ওরকম একটা বিষয় পেটে চেপে ঘুমানো অসম্ভব তাই পরদিন অফিসেও যেতে পারলাম না। শুধু পরদিন কেন, তার পরের দুই দিনও আমি অফিসে যাইনি। কাউকে বলতে পারছি না পাশের বাসায় একটা লাশ পড়ে আছে। ঝুমা কেন সবাইকে বলছে না তা-ও বুঝতে পারছিলাম না। জ্বরে দুর্বল হয়ে পড়ে ছিলাম বলে বারান্দায় গিয়ে দেখাও হতো না ঝুমা আছে কি না। আমি কী করে এতকিছু জানলাম তার কী জবাব দেব, এই ভয়ে কাউকে জিজ্ঞাসাও করতে পারি না। বড় মেয়ে আমাকে খাবার খাইয়ে দিয়ে ইউনিভার্সিটিতে যায়, ছোটোরাও বেরিয়ে যায় তারপর ফিরেও আসে সময়মতো। সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলছে, কেউ সেরকম কিছুই বলছে না। তিনদিনের মাথায় বিছানা থেকে উঠতে পারা মাত্রই টুল নিয়ে বাথরুমে চলে গেলাম। আশ্চর্য! তখনো বিছানায় সটান পড়ে আছে ফরিদ আহমাদ। মাথায় কিছুতেই ঢুকল না ঝুমা কি লাশ নিয়ে বসে আছে নাকি পালিয়ে গেছে? কে জানে! কখনো কাউকে দেখিনি তাদের বাসায় আসতে, কেউ কি তাদের খোঁজ নেবে? ফরিদ আহমাদের ফ্যাক্টরি থেকে তো অন্তত কেউ আসতে পারে!
দুপুরের দিকে বাসার দরজায় শব্দ হলো। কোনোরকমে উঠে গিয়ে খুলে দেখি বাড়িওলা। আমাকে দেখে বললেন, ‘কী হয়েছে আপনার?’
‘জ্বর। ’
‘হ্যাঁ, তাই তো, দারোয়ান বলছিল দুদিন ধরে বেরোননি। এদিকে পাশের ফ্ল্যাটে এতবড়ো ঘটনা ঘটে গেল, জানেন না মনে হয়। ’
‘কী হয়েছে?’ নির্দোষ মুখ করে বললাম আমি।
‘খুন। ফরিদ আহমাদ বলে যে ভদ্রলোক থাকতেন, তিনিও দু’দিন হলো বেরোননি। ফোন করে পাচ্ছে না বলে তার ফ্যাক্টরির ম্যানেজার এলো সকালে। তারপর দরজা ভেঙে দেখা গেল তিনি বিছানায় পড়ে আছেন। ছুরি দিয়ে মেরে রেখে গেছে কেউ অথচ দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। যাই হোক, ওসব পুলিশের ব্যাপার। গন্ধে তো ওদিকটায় যাওয়া যাচ্ছে না, আপনারা আছেন কী করে এখানে?’
‘আমি আসলে ঘরেই ছিলাম, জ্বর তো। কিন্তু ফরিদ সাহেবের স্ত্রী, তিনি কই?’
‘স্ত্রী মানে? ফরিদ সাহেব তো একাই থাকতেন। তার কোনো স্ত্রী ছিল কি কখনো? আমি জানি না তো!’
‘অবশ্যই ছিল। তার স্ত্রী আর তিনি থাকতেন। ’
‘আপনি নিজে চোখে দেখেছেন?’
‘জি, বহুবার দেখেছি। ’ প্রমাণের জন্য অনেক কিছু মুখে চলে আসছিল কিন্তু নিজেকে সামলালাম।
‘আশ্চর্য তো, ফরিদ সাহেব একা থাকার জন্য বাড়ি ভাড়া নিলেন, আমি বললাম একা মানুষের জন্য এত বড় বাড়ি... তো আমার কী, ভাড়া নেবেন তিনি। কিন্তু তার কাছে যে বাইরে থেকে কোনো মেয়ে আসত, থাকত এসব তো আমি জানতেই পারিনি। ওই ব্যাটা দারোয়ানও তো আমাকে কিছু বলেনি। এ তো খুব জটিল কেস হয়ে গেল, ভাই। ’
তখন কেন যেন আমার সন্দেহ হলো, আমি ছাড়া ঝুমার কথা আর কেউ জানে না, এমনও কি হতে পারে? বাড়িওলাকে বিষয়টা সেভাবে বলব কি-না ভাবতেই তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, ভাই, আপনি তার বাড়িতে কোনো মহিলাকে দেখেছেন, এটা আর কাউকে বলবেন না যেন। একে তো খুন, তারওপরে মেয়েমানুষের দুর্নাম, এই বাড়িতে আর কেউ থাকবে না। আমার খুব ক্ষতি হয়ে যাবে। প্লিজ, কাউকে বলবেন না। ’
তিনি বলার আগেই আমি মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিলাম, ঝুমার কথা আমি কাউকে বলব না। কারণ ততক্ষণে আমি কেন যেন নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম যে ঝুমাকে আর কেউ দেখেনি একমাত্র আমি ছাড়া। তবু সন্দেহ দূর করার জন্য ছেলেমেয়েরা ফিরে এলে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম, ‘দুই হাত দূরে কী হয়ে গেল দেখলি?’
বড় মেয়ে অবাক হয়ে বলল, ‘বিষয়টা হলো তিনি ঘরে খুন হয়েছেন আর দরজাও ভেতর থেকে বন্ধ। ভোজালি পড়ে আছে পায়ের কাছে। একলা মানুষ থাকতেন, খুনও কি তিনি নিজেই নিজেকে করলেন? আজব ব্যাপার। ’
‘একলা মানুষ?’ জানতে চাওয়ার ভঙ্গিতে বললাম আমি।
‘ওমা, তুমি তো প্রায়ই সন্ধ্যায় যেতে ওখানে, ফরিদ সাহেবের সাথে কাউকে দেখেছো কোনোদিন?’
আমি তাড়াতাড়ি অন্যদিকে তাকালাম। কে জানে আমার মুখে কিছু ধরা পড়ে যায়! ...
গল্প বলা শেষ হলে দেখি শ্রোতা ভদ্রলোক গালে হাত দিয়ে চিন্তা করছেন। আমি বললাম, ‘তারপর থেকে এ বাড়ি নিয়ে একটা ধাঁধার মধ্যে আছি, বুঝলেন? তবে কাউকে এসব বলিনি। ছেলেমেয়েদের বললে ভাববে মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আর বাড়িওলা শুনলেইবা কী ভাববেন, আমাকেই হয়ত উঠে যেতে বলতে পারেন এসব বাজে কথা রটাচ্ছি বলে। এই ভাড়ায় এরকম বাড়ি তো আশেপাশে পাব না, বিরাট বিপদে পড়তে হবে। তাই মুখ বন্ধ করে ফেললাম। আশা করি আপনিও ব্যাপারটা গোপনই রাখবেন। কিন্তু সে যাই হোক, আপনি আবার কিছু মনে করবেন না, আপনার বাড়ির ব্যাপারেই গল্প হচ্ছিল কিনা... আপনাকে দেখলে যা মনে হয়, এসব খুন-টুন বা রহস্য নিয়ে আপনার নিশ্চয় কোনো ভয়ভীতি নেই, নাকি?’
ভদ্রলোক সামান্য হাসলেন। হাসিতেই বোঝা যায় ভয়ের ব্যাপারটা তিনি উড়িয়ে দিলেন। আমি নিশ্চিন্ত হলাম। তবে তিনি কিছু বলার আগেই ভেতর থেকে কারো চলাফেরার শব্দ শোনা গেল। আমি বললাম, ‘গল্পে গল্পে জানতেই চাওয়া হয়নি, বাড়ির আর সবাই কোথায়?’
‘সবাই বলতে আর কে, আমি আর আমার স্ত্রী। জিনিসপত্র টানাটানিতে সে এমন ক্লান্ত, খাট এনে বেডরুমে সেট করতেই বলল ঘুমুবে; এই উঠল মনে হয়’, বলেই ভদ্রলোক ‘সিনথিয়া, সিনথিয়া—’ বলে ডাকলেন। কিছুক্ষণ পরেই তার স্ত্রী সিনথিয়া এসে আমাদের দুই সোফার মাঝখানে দাঁড়ালেন। মুখ তুলে তাকালাম বটে তবে মুখ হা হয়ে গেল; দেখলাম ঝুমা দাঁড়িয়ে আছে, আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে, ঠিক বারান্দা থেকে মাঝরাতে মোমবাতির আলোয় যে হাসি আমি দেখেছি, অবিকল সেই হাসি। আমি সোফার ওপরে অসাড় হয়ে গেলাম। হাসি থামিয়ে ঝুমা বলল, ‘কাছাকাছি সিঙ্গাড়া কোথায় পাওয়া যায় বলুন তো? সব গুছিয়ে রাতের খাবার রাঁধতে তো বেশ দেরি হবে। ’
আমি সম্মোহিতের মতো বললাম, ‘এই তো মোড়ের কাছে। ’ সিনথিয়া আদুরে গলায় স্বামীকে বলল, ‘কয়েকটা সিঙ্গাড়া এনে দাও না, প্লিজ—’ তিনি বললেন, ‘মাথা খারাপ, আমি এখন খুব টায়ার্ড। ’ আমার মুখে প্রায় চলেই আসছিল, দিন, আমি এনে দেই—কিন্তু নিজেকে সামলালাম। ছুটে বেরিয়ে এলাম তাদের বসার ঘর থেকে। বাড়ি না গিয়ে সোজা উপরে বাড়িওলার ওখানে চলে গেলাম। এক নিশ্বাসে তাকে বললাম, ‘আমি বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছি, আপনাকে জানাতে এলাম। ’
‘সে কী! কী সমস্যা? আপনি হাঁফাচ্ছেন কেন? বাড়ি পেয়ে গেছেন?’
‘না। ’
‘তাহলে হঠাৎ ছাড়ছেন? খুনটুন থেকে ভূতের ভয় পান নাকি? অদ্ভুত ব্যাপার! আজই তো সেখানে আরেক ভদ্রলোক উঠলেন, শান্ত-ভদ্র, এবারে আর কোনো ঝামেলা হবে না, দেখবেন। ’
‘তিনিও একা, তাই না?’
‘হ্যাঁ, অনেক বইটই, পড়াশোনা নিয়ে থাকেন, সৌখিন মানুষ। একাই তিনি। ’
বাড়িওলা মতামত জানার জন্য আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, জুলাই ১৪, ২০১৫