ঢাকা: ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ, তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানি তাগিদ’...। চাঁদ উঠেছে।
গানের প্রথম গায়ক আব্বাসউদ্দিন আহমেদের স্মৃতিচারণ থেকে উঠে আসে এর সৃষ্টির ইতিহাস।
আব্বাসউদ্দিন একদিন কাজী নজরুল ইসলামকে বলেন, কাজীদা, একটা কথা মনে হয় এইযে পিয়ারু কাওয়াল, কাল্লু কাওয়াল- এরা উর্দু কাওয়ালি গায়, তাদের গান শুনি বেশ বিক্রি হয়। এ ধরনের বাংলায় ইসলামি গান হলে কেমন হয় দাদা? তারপর আপনি তো জানেন- কিভাবে আপনাকে কাফের, কুফর প্রভৃতি বলে বাংলার মুসলমান সমাজের কাছে অগ্রহণযোগ্য করে রাখার চেষ্টায় আদাজল খেয়ে লেগেছে একদল কট্টর।
আব্বাসউদ্দিন নজরুলকে আরও বলেন, আপনি যদি ইসলামি গান লেখেন, তাহলে মুসলমানদের ঘরে ঘরে আবার উঠবে আপনার জয়গান। কথাটি কবির মনে লাগলো। বিদ্রোহী কবি তার চেতনা নিয়ে জেগে উঠলেন। নজরুল পাল্টা বললেন, আব্বাস, তুমি ভগবতীবাবুকে বলে তার সময় নাও, আমি ঠিক বলতে পারি না। তিনি সময় দিলে আমি দেবো।
পরে আব্বাসউদ্দিন আহমেদ ভগবতীবাবুকে-অর্থাৎ গ্রামোফোন কম্পানির রিহার্সাল-ইন-চার্জকে জানালেন। কথাটি শুনে তিনি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। বলে বসলেন, না না না, ওসব গান চলবে না। ও হতে পারে না।
তখন অবশ্য তিনি এর লাভ-ক্ষতি চিন্তা করেননি। এতে মনের দুঃখ মনেই চেপে গেলেন আব্বাসউদ্দিন। এর প্রায় ছয় মাস পর। বৃষ্টি ভেজা দুপুর। আব্বাসউদ্দিন অফিস থেকে গ্রামোফোন কম্পানির রিহার্সালে গেলেন। দেখেন, একটা ঘরে বৃদ্ধা আশ্চর্যময়ী আর বৃদ্ধ ভগবতীবাবু বেশ হাসি-খুশি গল্প করছেন। আব্বাসউদ্দিন নমস্কার দিতেই বৃদ্ধ বললেন, বসুন বসুন। তিনি বৃদ্ধের রসাপ্লুত মুখের দিকে চেয়ে ভাবলেন, এই-ই তো উত্তম সুযোগ।
আব্বাসউদ্দিন বলে ফেলেন। বলে ফেলেন তার সে পুরানো কথা। ‘যদি কিছু মনে না করেন- সেই যে বলেছিলাম ইসলামি গান দেওয়ার কথা, আচ্ছা একটা এক্সপেরিমেন্টই করুন না, যদি বিক্রি না হয় আর নেবেন না, ক্ষতি কী’? এতে ভগবতীবাবু হেসে বললেন, ‘নেহাতই নাছোড়বান্দা আপনি! আচ্ছা, করা যাবে’।
তখন পাশের ঘরে কাজীদা (কাজী নজরুল ইসলাম) ছিলেন। আব্বাসউদ্দিন নজরুলকে বললেন, ভগবতীবাবু রাজি হয়েছেন। তখন সেখানে ইন্দুবালা তার কাছে গান শিখছিলেন। নজরুল বলে উঠলেন, ‘ইন্দু, তুমি বাড়ি যাও, আব্বাসের সঙ্গে কাজ আছে’। এরপর ইন্দুবালা চলে গেলেন। নজরুল এক ঠোঙা পান আর চা আনতে বললো দশরথকে। তারপর দরজা বন্ধ করে আধা ঘণ্টার মধ্যেই লিখে ফেললেন ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ...’। ব্যস হয়ে গেলো গান। তখনই সুর যোগ করে শিখিয়ে দিলেন আব্বাসউদ্দিনকে।
এরপর আবার পরের দিন লিখলেন ‘ইসলামেরই সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর’। গান দু’খানি লেখার ঠিক চার দিন পরই রেকর্ড হয়। এর মধ্যে দুটি ইসলামি গান লিখে অধৈর্য হয়ে যান নজরুল। তার চোখে-মুখে আনন্দ খেলা করতে থাকে।
এরপর এলো রেকর্ডের সময়; তখনকার দিনে যন্ত্র ব্যবহার হতো শুধু হারমোনিয়াম আর তবলা। এদিকে গান দু’খানি মুখস্থও হয়নি আব্বাসউদ্দিনের। নজরুল নিজে যা লিখে দিয়েছিলেন, মাইকের পাশ দিয়ে হারমোনিয়ামের ওপর ঠিক আব্বাসউদ্দিনের চোখ বরাবর হাত দিয়ে নজরুল নিজেই সেই কাগজখানা ধরলেন, আব্বাসউদ্দিন গেয়ে চললেন। এ হলো প্রথম ইসলামি গান রেকর্ড।
নজরুল ১৯৩১ সালের শেষের দিকে গানটি লিখেন। রেকর্ড হওয়ার মাস দুয়েক পরই ছিল ঈদুল ফিতর। আর ঈদের সময়েই রেকর্ডটি বাজারজাত করে গ্রামোফোন কোম্পানি। রেকর্ড নং-৪১১১, প্রকাশকাল ছিল ১৯৩২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। আর এ রেকর্ডটির সুবাদেই আজ থেকে প্রায় ৮৩ বছর আগে শ্রোতাদের কানে প্রথমবারের মতো পৌঁছে যায় ‘রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ গানটি। আর তাই তো ৮৩ বছর ধরে কালজয়ী গানে সবার পবিত্র ঈদুল ফিরত।
পুরো গানটি
ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানি তাগিদ।
তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ
ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
আজ পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে
যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ।
ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমণ, হাত মেলাও হাতে,
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।
ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী
সেই গরীব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।
ঢাল হৃদয়ের তশতরীতে শিরনি তৌহিদের,
তোর দাওয়াত কবুল করবেন হজরত হয় মনে উম্মীদ।
ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
তোরে মারলো ছুঁড়ে জীবন জুড়ে ইট পাথর যারা
সেই পাথর দিয়ে তোলরে গড়ে প্রেমেরই মসজিদ।
ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানি তাগিদ।
** এক গানে ঈদের আমেজ-খুশি-মাহাত্ম-চেতনা
বাংলাদেশ সময়: ০৭৩৭ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০১৫
আইএ