ফোনে কথা বলতে বলতে বিয়ের সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম কিন্তু রাত পার হতেই নিউ জনসন রোডের একটি পুরনো বিল্ডিঙের তিনতলায় মোটা মোটা বই আর ফাইলে গিজগিজ করা একটি কক্ষে আমরা যে বিয়েটা সেরেই ফেলব, সেটা ভাবিনি। আমার সহকর্মী আমান সাহেব এক ফাঁকে তিনজন অ্যাডভোকেট আর কাজী সাহেবকে মিষ্টিমুখ করালেন।
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সেরে যখন নিচে নামলাম তখন রোদের গায়ে ধারাল ছুরি। আমাদের ছায়া ছোট হয়ে এসেছে। আমি চোখ পিটপিট করে আকাশে তাকাই আর ও সতর্কতার সাথে কপালে ওড়না টেনে দেয়। আমরা হাতে হাত ধরে থাকলাম। হাতে হাত বাইরে বেরুলে এমনিতেই ধরে থাকি। পাটকাঠিতে পেঁচিয়ে ওঠা শিমলতার মতো ওর বুকের কাছে আমার একটা বাহু হাত দিয়ে ও পেঁচিয়ে ধরে। আজও তাই হাত ধরায় নতুন কিছু টের পেলাম না।
ও বলল, “আমরা কোথায় যাব?”
আসলেই তো, কোথায় যাব আমরা? আমি থাকি নারায়ণগঞ্জ। ঘরে অশীতিপর বাবা আর ছোট দুই ভাই। আর ও থাকে ইউনিভার্সিটির হলে। বিয়ে করার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পরবর্তী গন্তব্যের বিরক্তিকর চিন্তায় পড়ে গেলাম। ঘরে যেহেতু বাবা আছেন আর শুভকাজে বাবার অনুমতিও নিই নি সেহেতু আমাদের বাসার রাস্তা কিছুতেই মাড়ানো যাবে না। আর ওর হলেও স্বামী এলাউ করে না!
আমরা একটা রিকশা খুঁজছি যার পেছনের পর্দাটা অবশ্যই আস্ত থাকবে। একটা নতুন রিকশা পেলে ভালো হতো। ওতে চড়ে আরাম। যদিও নতুন রিকশায় যুগল দেখলে আশেপাশের লোকজন একবার ঘাঁড় ঘুরিয়ে তাকাবেই তবু রাস্তাটা একটু ফাঁকা পেলেই এদিক ওদিক চকিতে তাকিয়ে ওকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে আমিও একটা অস্থির চুমু খাবই। ঢাকা শহরে সাড়ে চার বছরের প্রেমে আমাদের এই সব চুম্বনের ইতিহাস প্রায় প্রতিটি সড়ক বা সড়কের ডিভাইডারে মাথা তোলা বিষখেকো গাছগুলো জানে।
মুমূর্ষু একখানা রিকশা পাওয়া গেল। এ ধরনের রিকশায় আমরা কখনোই চড়ি না। অগত্যা সংকট আর রোদের তেজ থেকে বাঁচতেই মনে হয় চেপে বসলাম। সাইডে বা পেছনে কোথাও পর্দা নেই ফলে দুজনেই মুখ তিতা করে হাঁটুতে হাত রেখে দুপাশে আলগা বসে রইলাম। আপাত উদ্দেশ্য গুলিস্তান, রাজধানী হোটেলের কাচ্চি বিরিয়ানি।
রিকশায় উঠে লক্ষ্য করলাম, ওর গাল এক পাশে ফুলে গেছে। আমি আঙ্গুলে ইশারা করলাম, “কী গো?”
ও বলল, “আজকের দিনে আক্কেল দাঁত উঠতেছে। কী যন্ত্রণা!”
আমি বললাম, “ভালোই হলো। আমাদের আজ বুদ্ধি দরকার। ”
“হ মুণ্ডু” বলে নিজেই নিজের গাল হাতে পরীক্ষা করে বলে “বেশি ফুলছে?”
আমি হেসে বলি, “আরে নাহ। ”
রাজধানী হোটেলের বয়গুলো আমাদের চেনা। সাড়ে চার বছরে কম তো যাই নি! দুপুরের ভীড় ঠেলে আমরা উপরে উঠে এলাম। বসার চিন্তা না করে আগে গেলাম বেসিনে। ফ্রেশ হয়ে ম্যানেজারের কাছে যেতেই একজন পথ দেখায়, “ঐ টেবিলটা খালি হইছে। ”
আমরা টেবিলে ব্যাগ রেখে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে থাকি। ও আমার দিকে না তাকিয়ে ব্যাগে কী যেন খটরমটর করতে করতে বলে, “কই বললে না তো, কোথায় যাব?”
কোথায় যাব আমরা? আমি থাকি নারায়ণগঞ্জ। ঘরে অশীতিপর বাবা আর ছোট দুই ভাই। আর ও থাকে ইউনিভার্সিটির হলে। বিয়ে করার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পরবর্তী গন্তব্যের বিরক্তিকর চিন্তায় পড়ে গেলাম। ঘরে যেহেতু বাবা আছেন আর শুভকাজে বাবার অনুমতিও নিই নি সেহেতু আমাদের বাসার রাস্তা কিছুতেই মাড়ানো যাবে না। আর ওর হলেও স্বামী এলাউ করে না!
হায় রে, কোথায় যাব আমরা? এত বছর আমরা কেবল প্রেমই করে গেছি। ওর মাস্টার্স শেষ না হলে মানে আরো দুই বছর ওদের ফ্যামিলিতে বিয়ের কথা তুলবে না আর ওর সময় না হলে আমারও তো কোনো চেষ্টায় লাভ বিশেষ নেই। তাই নিজেরা বিয়ে করার কথা প্রায়ই ভেবেছি। এমনকি ব্যক্তিগত বা পারিবারিক যে ভাবেই হোক, বিয়ে হলে এরপর কী হবে কিংবা আমাদের বাবুসংখ্যা কত হবে, এদের নামধামই বা কী রাখব, সব ঠিক করা আছে। এর অর্থ, আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনের ছকটা কষে রেখেছি। আর মাঝে মাঝে মোবাইলে দীর্ঘ আলাপে, আমাদের সহিষ্ণু কান গরম হওয়া পর্যন্ত প্রয়োজনে ওসবের আপডেট করি। এই যেমন, গত রাতের কথাই ধরা যাক, ও এক পর্যায়ে বলল, “তোমার উকিলবন্ধুকে ফোন করো। আমরা বিয়ে করব। ”
উকিলবন্ধু মানে আমাদের এক প্রতিবেশি অ্যাডভোকেট। ছুটির দিনে হাঁটাহাঁটিসূত্রে তাঁর সাথে আমার একটি অসম বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। আমাদের বিষয়ে তিনি অবগত। আর এ কারণে প্রায়ই তিনি আমাদের বিয়ে করে ফেলার পরামর্শ দেন। ওর কথাটা আমি সাথে সাথে তাঁকে জানালাম। তিনি বললেন, “স্বাগতম। তবে সঙ্গে পাসপোর্ট সাইজের ছবি নিয়ে আইসেন। ”
আমরা ছবি আনতে ভুললাম না। এমনকি বিয়ের বাজারের জন্য এটিএম কার্ড, সহকর্মী আমান সাহেব বা জুতো-জামার সাফসুতরোর কথাও ভুললাম না। সবই মনে রাখলাম শুধু এইটুকু ভাবলাম না, বিয়ে করে আসলে আমরা করবটা কী! যাব কোথায়? তখন আমিও ওর দিকে প্রশ্নের চোখে তাকিয়ে বলি, “কই যাই..?”
আমরা পরস্পরের পৃথিবীটা জানি। যাওয়ার জায়গা বিশেষ নেই। আর বাইরে যাওয়ার ভাগ্যও তেমন সুবিধের না। সবই মনে আছে, জাতীয় জাদুঘর, সোনারগাঁও কারুপল্লী, এমনকি বসুন্ধরা সিনে কমপ্লেক্স, যেখানেই অতি আগ্রহ করে, ওর ক্লাশ আর আমার অফিস থেকে সময় বের করে গেছি, প্রথমবার খালি হাতেই ফিরে এসেছি। এমন আরো অনেক হয়েছে। প্রথম প্রথম রাগ হতো। পরে রাগ না করে বরং হেসে গড়িয়ে পড়তে পড়তে আমরা ফিরে এসেছি।
কাচ্চি বিরিয়ানি অর্ডার দেয়ার মুখে ও বলল, “এক প্লেট। আমি একটুখানি খাব। মাড়ি ব্যথা করতেছে। ”
আমি বললাম, “তাহলে চলো, আগে ওষুধ নিয়ে আসি। ”
ও মানে না, “আরে ধ্যাৎ। আগে খাও। এরপর ভাবো কী করবে। ”
আমি বললাম, “বীথি আন্টিকে একটা ফোন দাও না!”
ও চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে মুচকি হাসি দেয়, “দেব?”
আমিও হাসি, “দাও না। দেখ না কী বলে। ”
আমাদের সম্পর্কের শুরুর পাতাগুলোয় বীথি আন্টির সহযোগিতার অনেক কথা আছে। তিনি থাকেন মাণ্ডায়। যাওয়ার জন্য গুলিস্তান থেকে খুবই সহজ লোকেশন। তিনি আমাদের প্রায়ই বলতেন, “তোরা বিয়ে করে ফেল। বিয়ে করে আমার বাসায় আসবি। ” কিন্তু সমস্যা হলো, গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকবার নির্লজ্জের মতো তাঁর বাসায় যেতে চেয়েও যাওয়ার অনুমতি পাইনি। প্রায় প্রতিবারই বাসাভর্তি তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কথা শুনতে শুনতে ওখানে যাওয়ার আশা একরকম বাদই দিয়েছি আর এ কারণেই সম্ভবত তাঁর কথাও আমাদের আর মনে নেই। তবে রাজধানী হোটেলের গরম আর সুস্বাদু কাচ্চি বিরিয়ানি খেতে খেতে যখন আচমকা বীথি আন্টির কথা মনে হলো তখন ওর ক্রমাগত প্রশ্নের মুখে একটা আশার বাতিই যেন চোখে ভেসে ওঠে। আর যেহেতু আমরা বিয়েটা করে ফেলেছি, তাঁর দেয়া পুরনো প্রতিশ্রুতির কথা ভাবলে মাণ্ডার বাসাটাকে গন্তব্য করার সামাজিক অধিকার তো তৈরি হয়েই যায়!
বীথি আন্টিকে ও ফোন দিল। ফোন দিয়ে ও জানাল, বীথি আন্টি জানালেন, তিনি মাণ্ডায় নেই। নাইওর গেছেন গ্রামের বাড়ি। তিনদিন পর এলে তখন যেতে বলেছেন। কেন জানি মনে হচ্ছিল, এমনটাই শুনব! প্রথম যে কোনো যাত্রায় আমাদের জন্য জানালাগুলো তো বন্ধই থাকে! কথা শুনে দুজনেই মন ভার করে চুপচাপ খেয়ে গেলাম। ক্ষুধা সত্যিই ছিল। গন্তব্যের কঠিন দুশ্চিন্তার মাঝেও আমি ফাঁকে ফাঁকে ওর মুখে টুকরো মাংস তুলে দিই। এ অভ্যাসটা আমাদের পুরনো। যে কোনো কিছু খেতে বসলে ওকে খানিকটা আমার হাতে খাইয়ে দিতেই হবে।
“চলো, বলধা গার্ডেন যাই?”
আমার কথায় মুখের খাবার জোর করে গিলে খানিকটা বিরক্তি ঝাড়ল ও, “বিয়ে করেছি কি বলধা গার্ডেন যাওয়ার জন্য! ”
তাও তো কথা। ঝাড়ি শুনে বোকার মতো ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। “তাহলে কী করি বলো তো, কই যাই?”
আমাদের খাওয়া শেষ হয়ে আসে। বেসিন থেকে ঘুরে এসে টিস্যুতে হাত মুছতে মুছতে ও বলল, “তোমার কোন বন্ধুর বাসায় চলো। অথবা কোনো মেসেটেসে। ”
কাঁধের কাছেই ওয়েটার এসে দাঁড়িয়েছে। এটা টেবিল খালি করার একটা নীরব অনুরোধ। আমি বিল পরিশোধ করে উঠে দাঁড়ালাম, “আচ্ছা চলো, দেখি কী করা যায়। ”
হোটেল থেকে বেরিয়ে আমরা পল্টনের দিকে হাঁটা দিই। পল্টন আমাদের তীর্থস্থান। দুজন এক সাথে হলে আমরা পল্টন যাবই। ফুটপাতে বই কেনা, নেড়েচেড়ে দেখা বা গরমে ভিজে গেলে বিয়ের কার্ড দেখার ছুতোয় আজাদের ঠাণ্ডা বাতাসে দম নেওয়া দুজনেরই ভীষণ পছন্দ। আমি ওকে মনে করিয়ে দিই, “চল, কালামের দোকানে যাই। বই কিনি। ”
এই প্রস্তাবটা ও সব সময় সানন্দে গ্রহণ করে। কিন্তু আজ শুনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে নাক ফুলিয়ে সরাসরি অগ্রাহ্য করল, “না। আজ আমি আমার ব্যাগ ভারী করতে রাজি না। ”
আমরা জিপিওর সামনে সচিবালয়কে মুখ করে একটা গাছের নিচে দাঁড়াই। ছায়ায় দাঁড়িয়ে টের পেলাম, তীব্র রোদের ঝাঁঝ কিছুটা কমে আসছে। কয়েক দমকা বাতাসও লাগল গায়ে। আমি কথা বলছি না দেখে ওকে তখন খানিকটা অধৈর্যে পায়, “এত বড় শহরে তোমার একটাও যাওয়ার জায়গা নেই!”
আমরা ছবি আনতে ভুললাম না। এমনকি বিয়ের বাজারের জন্য এটিএম কার্ড, সহকর্মী আমান সাহেব বা জুতো-জামার সাফসুতরোর কথাও ভুললাম না। সবই মনে রাখলাম শুধু এইটুকু ভাবলাম না, বিয়ে করে আসলে আমরা করবটা কী! যাব কোথায়? তখন আমিও ওর দিকে প্রশ্নের চোখে তাকিয়ে বলি, “কই যাই..?”
আমার সব কিছুই ওর জানা। আর জানে বলেই অন্য সময় হলে ওর এ আগ্রাসন নিয়ে তর্কে বসা যেত কিন্তু এই মুহূর্তে তা না করে ‘দাঁড়াও দেখি’ বলে মোবাইলের কন্টাক্ট নাম্বারগুলো এক এক করে দেখতে থাকলাম। ঢাকায় থাকে এমন অনেকেরই নাম্বার আছে। কিন্তু পুরনো পরিচয়, বীথি আন্টির মতো দেয়া পুরনো প্রতিশ্রুতিওয়ালা বন্ধুদের খুঁজে খুঁজে যাকেই ফোন দিচ্ছি, ফোনের অপর প্রান্ত থেকে আসা নানা সংকট আর আফসোসের শব্দে তাদের ওখানে যাওয়ার আশা সঙ্গে সঙ্গে ইরেজ করে দিচ্ছি। পরিচিত সবার কাছে বিয়ের কথা সহজে বলাও যাচ্ছে না। এই সব ব্যাপারে সবার কান সমান নিরাপদও নয়। অতএব সমুদয় যৌথ বুদ্ধি ও চেষ্টা জড়ো করেও কারো বাসায় যে যেতে পারছি না, এটা মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেল।
খুবই অসহায় বোধ করি। চোখের সামনে সচিবালয় ও অদূরে পল্টন মোড় ঘেঁষে নানা স্থাপনা আর রাস্তায় নানা রঙ ও সাইজের গাড়ির সারি ঢাকা শহরে সাড়ে চার বছরের পুরনো প্রেমিক যুগল বা সদ্য বিবাহিত দম্পতির এতটুকু আশ্রয়ের খোঁজ দিতে পারে না। আমরা গাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকি। হঠাৎ হাওয়ায় আমাদের শরীর যতটা জুড়োয়, মনের ভেতরে হতাশা আর ব্যর্থতার অগ্নি ততই লকলক করে বাড়তে থাকে। এ আগুন আর নিভবে বলে মনে হয় না। তখন আমার একটু সাহসী হয়ে উঠতে মন চায়, “চলো, কোনো হোটেলে যাই?”
ও বিস্ময়ে আমার দিকে তাকায়। আজ ওর বিস্মিত হওয়ারই দিন। যা বলছি তাতেই ও চোখ বড় করে ফেলছে। তবে অন্য বিকল্প উপায়ও মাথায় ধরছে না দেখে অগত্যা ও বিষয়টা নিয়ে একটু ভাবে, “হোটেলে যাব? হোটেল নিয়ে কত কী শুনি..”
আমি ওকে ভরসা দিলাম, “আমরা এখন হাজব্যান্ড-ওয়াইফ। ভয়ের কী আছে! চলো চেষ্টা করে দেখি। ”
হোটেলে গিয়ে বড় ধাক্কাটা খেলাম। নাম-ঠিকানা আর উদ্দেশ্য সত্যিসত্যি বলার পরও হোটেল ম্যানেজারের চোখ কেমন সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল। পরপর দুটো হোটেলে চেষ্টা করলাম। ম্যানেজারদের চোখ আর জেরায় আশ্রয়ের বদলে আমরা সত্যিকারের ভয় পেয়ে ফিরে এসেছি। সমস্যা আমাদেরও ছিল। কথা বলার সময় অবশ্য আমাদের যথেষ্টই জড়তায় পেয়েছিল। আমরা কনফিডেন্টলি কিছু বলতে পারছিলাম না।
শেষমেষ হলো না। কোথাও কিছু হলো না। আমি একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজ করি। চেহারায় পালোয়ানসুলভ কিছু নেই। শুকনাশানকা শরীর। আর অনার্সে পড়লেও দেখতে ও ছোটখাট গড়নেরই একটি মেয়ে। এ কারণেই কি আমাদের কেউ বিশ্বাস করল না! ও বলে, “আচ্ছা, আমরা কি মিথ্যেবাদী রাখাল?”
আমি তখন ওর হাত চেপে ধরি, “তা কেন হবে সোনা। আসলে আমরাই হয়ত বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার মতো বড় হয়ে উঠতে পারিনি। বয়সের ছাপ তো আমাদের কারো শরীরেই নেই!”
এই কথাটা ও সাথে সাথে ধরে, “এই যে বলি, বেশিবেশি খাও। তা তো করো না। এখন দেখো জীবনে স্বাস্থ্যের কত দরকার!”
পল্টন মোড়ে দাঁড়িয়ে ধূলি-ধোঁয়া আর শব্দমণ্ডিত পড়ন্ত বিকেলের সমস্ত হতাশা আর ব্যর্থতার দায় গিয়ে পড়ল নিরীহ স্বাস্থ্যের ওপর। আমিও ছাড়লাম না, “তুমিও তো খাও না। সেদিন সুমনের মায়ের জন্য রক্ত দিতে যে গেলে, পর্যাপ্ত ওজনের জন্য ওরা তোমার রক্ত নেয়নি। এর অর্থ কী দাঁড়ায়? এর অর্থ, তুমিও ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করো না। ”
আমাদের এই হাস্যকর তর্কের আড়ালে বেদনার যে উত্তপ্ত লাভা বইছে তা যদি পাশ ঘেঁষে চলে যাওয়া অসংখ্য নারী-পুরুষের কেউ জানত। এই শহরে এমন কখনো ঘটে? এমন আচানক শূন্য হয় কারো পৃথিবী? আমরা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলি আর অসহায়ত্বের কিছু চাপা দুঃখবোধ গরম নিঃশ্বাসের সাথে বেরিয়ে আসে। লক্ষ্য করি, সকালের ফাইল আর বইয়ে ঠাসা উকিলের কক্ষ বা কাজী সাহেবের মুখে মুখে ভেঙ্গে ভেঙ্গে বলা কিছু মধুর শব্দের বয়স বাড়তে থাকে। আমান সাহেবের খাওয়ানো মিষ্টির স্বাদ জিভ থেকে নেমে যায়। নিউ জনসন রোডে আদৌ গেছি কি না সে সত্যতা অবিশ্বাস আর দ্বিধার পেণ্ডুলাম হয়ে ভেতরে কোথাও নড়তে থাকে।
পল্টন মোড়ে প্রতিদিন একই চিত্র। আমাদের পরিবর্তিত পরিচয়ের কোনো গুরুত্ব এখানে নেই। হয় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করো নয় কোনো বাসেটাসে উঠে পড়। এ কারণেই কোথাও যাওয়া নিয়ে আমাদের সমস্ত দিনের ভাবনার ইস্তফা দিতে চাইলাম। ও হয়ত আমার ভেতরের কথা শুনতে পারছিল। ব্যাগ নাড়া দিয়ে হঠাৎ বলল, “চল ফিরে যাই। ”
আমি ওর দিকে তাকাই এক পলক। যেন কতদিন এই মুখ দেখি না। সত্যিই তো, হোটেলে খেতে বসলে বা কোথাও এক সাথে দাঁড়ালে বা ঘাসেটাসে বসলে আমি শুধু ওকেই দেখি। ও একটু পরপর মিছেমিছি রাগ করে ‘কী দেখো এত, কী দেখো এত’ বলে আর আমিও হাসি দিয়ে ‘কিছু না, কিছু না’ করে তাকিয়েই থাকি। আজ বিয়ে নয় বরং বিয়েপরবর্তী গন্তব্যের চিন্তায় ওর দিকে তাকাতেই মনে নেই! এমনকি রাজধানী হোটেলেও না। সেই দীর্ঘ শোক থেকেই মনে হয় ওই মুহূর্তে ওকে আমার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হলো। ওর চোখে টলটল করছে কান্না। এই বুঝি ডাকবে বান। সামান্য কিছুতেই যে চোখ ফুলিয়ে ফেলে সে এই জিনিস সারাদিন কিভাবে আটকে রেখেছে সেটাই রহস্য।
হোটেলে গিয়ে বড় ধাক্কাটা খেলাম। নাম-ঠিকানা আর উদ্দেশ্য সত্যিসত্যি বলার পরও হোটেল ম্যানেজারের চোখ কেমন সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল। পরপর দুটো হোটেলে চেষ্টা করলাম। ম্যানেজারদের চোখ আর জেরায় আশ্রয়ের বদলে আমরা সত্যিকারের ভয় পেয়ে ফিরে এসেছি। সমস্যা আমাদেরও ছিল। কথা বলার সময় অবশ্য আমাদের যথেষ্টই জড়তায় পেয়েছিল।
ঠোঁট উল্টে বললাম, “চলো। ”
মোড়েই দাঁড়িয়েছিল একটি ডবলডেকার। আমরা দোতলায় উঠে বসলাম। ও আমার কাঁধে মাথা ছেড়ে দেয়। শহরের মোড়ে মোড়ে তখন অফিসফেরত মানুষ আর গাড়ির জট। আমরা বসেই থাকি। আমার কাঁধে মাথা রেখেই ও বলে, “একটা ব্যাপার দেখেছো?”
“কী?”
“সবাই যখন তাদের বাসায় আমাদের দাওয়াত করত, লজ্জা আর অপবিত্রতার কথা ভেবে আমরা যেতাম না। কিন্তু আজ যখন আমরা নিজে থেকেই যেতে চাইলাম ওরা সবাই খুব অসুবিধায় পড়ে গেল। আমাদের কেউই বিশ্বাস করতে পারছে না!”
আমি যোগ করি, “ঠিকই বলেছো। ”
ও আমার কাঁধ থেকে মাথা তোলে না। গাড়ি চলতে থাকে। সারি সারি দালান আর গাছ আমাদের পিছনে দৌড়োয়। আমরা ইউনিভার্সিটির গেটে নামি আর আমাদের আগেই চারপাশে নেমে পড়ে আরেকটি সন্ধ্যা। গেটের পাশে হোটেলগুলোতে তখন ছেলেমেয়ের হাঁকডাক আর ভাজাপোড়ার ঘ্রাণ। বললাম, “কিছু খাওয়া দরকার। ”
ও বলল, “তবে একটু ওয়েট কর। আমি হলে গিয়ে বিয়ের শাড়িটা পরে আসি। ”
আমি হাসলাম, “আমিও যাই?”
ও বলল, “চলো তবে। ”
আমরা রিকশা নিলাম। খোলা রিকশায় রাস্তার দুপাশের বৃক্ষ ছুঁয়ে আসা বাতাস গায়ে লাগার সাথে সাথে মনে হলো ও তাজা হয়ে উঠল, “আজ আমরা মাঠে বসব। মাঠের ঘাস নিশ্চয় আমাদের ফিরিয়ে দেবে না। কী বলো?”
ওর কথা শুনে বড় মায়া হলো। বললাম, “আজ কি পূর্ণিমা?”
ও বলল, “কেন বলো তো?”
গাছের ফাঁক দিয়ে আঙ্গুল তাক করে বলি, “দেখো, কেমন চাঁদ উঠেছে। ”
রিকশা চলছে আর বড় বড় গাছের ডালপালার ফাঁক দিয়ে চাঁদটা যেন অন্ধকার পথে টর্চ মারছে। ও মাথা ঘুরিয়ে আকাশের দিকে তাকায়, “সত্যিই তো, খুব সুন্দর চাঁদ!”
আমি আস্তে করে ওর কানের কাছে মুখ নিই, “ঠিক আমার বউয়ের মতো। ”
ও আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল নাকি লজ্জা পেল বোঝা গেল না কিন্তু রাস্তাটা হঠাৎই একটু সুনসান হয়ে পড়ে। আমরা আর কথা বলি না। চোখে চোখ রেখে মুচকি হেসে দ্রুত রিকশার হুডটা তুলে দিই।
বাংলাদেশ সময়: ১৬২১ ঘণ্টা, আগস্ট ১০, ২০১৫