মাথার পেছনে কেউ খোঁচা মারছে। ভাবলাম কেউ হয়তো ভুল করে মেরেছে।
হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে বকুল বললেন, কষ্ট করে মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকানোর জন্য ধন্যবাদ। আমাকে চিনতে নিশ্চয় আপনার কোনো সমস্যাই হয়নি।
-সমস্যা হওয়ার প্রশ্নই আসে না। যে গল্প আমাকে আজও তাড়িয়ে বেড়ায় সেই গল্পের কুশিলব আপনি। আর আপনাকেই ভুলে যাব? এটাও কি সম্ভব। তা যাচ্ছেন কোথায়?
-ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে, আপনি?
-আপাতত আমারও লক্ষ্য ময়মনসিংহ। এরপর হয়তো নেত্রকোনায়ও যেতে পারি।
-স্বপ্ন ভাই, আপনি কি সেই মেয়েটির পরিবারের সন্ধান পেয়েছিলেন?
- হুম, পেয়েছিলাম। কিন্তু আমিই ভিলেন, এটা বলতে পারিনি। অনেকবার চেষ্টা করেছি বলতে, কিন্তু...
ভাগ্যচক্রে তারুণ্যের সাপ্তাহিক ‘টিনএজ’ পত্রিকার সহ-সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছিলাম। সব সহকর্মীকে নিয়ে আনন্দেই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। যতটা না সময় অফিসে সম্পাদনার কাজে কাটাতাম, তার চেয়ে বেশি কাটাতাম ফেসবুকে। সহকর্মী কাম বন্ধু বকুল মাঝেমধ্যে এসে খোঁচা মারলেও খুব একটা ঝামেলা করত না। আর এই ঝামেলাহীন সময়ে নিজের আসল আইডির পাশাপাশি ফেক আইডিতে মেয়েদের সঙ্গে চ্যাট করে সময় কাটানোর নেশায় এক ধরনের আসক্তই হয়ে পড়ি।
একদিন রাতে সাপ্তাহিক পত্রিকার আউটপুট দেয়ার পর আমি ও বকুল অফিসেই থেকে যাই। আমি মগ্ন ফেসবুক ফেক আইডিতে চ্যাটে আর বকুল ফ্রিসেল তাস খেলায়।
তানজিনা ফেরদাউস নামের একটি আইডির সঙ্গে আমার ফেক আইডির ‘আমি মানুষ’ ঘনিষ্ঠতা বেশ পুরনো। প্রায় প্রতিদিনই হাই, হ্যালো চলে আমাদের মধ্যে। তানজিনা এবিসি ইউনির্ভাসিটিতে ফ্যাশন ডিজাইনে পড়ত। আর ‘আমি মানুষ’ মানে আমার ফেক আইডির পরিচয় ছিল সদ্য জার্মানি থেকে ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফেরা ধনী বাবার একমাত্র আদরের সন্তান। তানজিনা সেদিন রাতেও অনলাইনে ছিল, কিন্তু আমার চ্যাটে সাড়া দিচ্ছিল না। অনবরত হাই-হ্যালো করতে করতে একসময় তানজিনা জানাল, তার মন ভালো নেই। তাই চ্যাট করতে তার ইচ্ছা করছে না। কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে জানালো, ফিন্যান্সিয়াল প্রব্লেম। শিক্ষাসফরে যেতে তার ৩০ হাজার টাকা লাগবে। ২০ হাজার টাকা কোনোরকমে ম্যানেজ হলেও আর ১০ হাজার টাকার জন্য সে যেতে পারছে না। টিউশনি করে যা ইনকাম করে তা দিয়ে কোনোরকমে হোস্টেল ও নিজের খরচ হয়। আর সেমিস্টার ফি আসে গ্রামের বাড়ি থেকে। এ অবস্থায় শিক্ষাসফর তার কাছে কিছুটা বিলাসিতাও বটে।
বলে রাখা ভালো, ফেক আইডির আড়ালে চ্যাট করতে করতে আমারও একটা সফট কর্নার তৈরি হয়েছিল তানজিনার প্রতি। কিন্তু ভয়ও পেতাম এই মনে করে, যদি তানজিনার আইডিও ফেক হয়। মনে মনে ভাবলাম সুযোগটা হাতছাড়া করা মোটেও উচিত হবে না। ওর আইডিও ফেক কি না, তা যাচাইয়ের এটাই উত্তম সময়। আমি চালাকি করে তানজিনাকে জানালাম, বন্ধু হিসেবে শিক্ষা সফরের ১০ হাজার টাকা ধার দিতে রাজি আছি। আমার মুঠোফোন নাম্বার দিয়ে বললাম, সকাল ৯টায় ধানমণ্ডি ৮ নম্বরে এসে টাকা নিয়ে যেতে।
আমি ভেবেছিলাম, আমার মতো হয়তো তানজিনাও অনেকটা মজা করার জন্য এই নাটক করছে। কিন্তু তা হয়নি, সকাল ৯টা বাজার আগেই তানজিনার ফোন। সে এখন ধানমণ্ডির ৮ নম্বরে রবীন্দ্র সরোবরের সামনে দাঁড়িয়ে।
আমি ঘাবড়ে গেলাম। কী করব এখন? সামনে যাব কী করে? বকুল বলল, চলেন আমরা মেয়েটাকে দেখে আসি। আর দেখতে গেলে টাকা লাগবে কেন? মেয়েটা আপনাকে চিনবে কী করে? ফেক আইডিতে আপনার কি অরিজিন্যাল ছবি আছে?
দুজন রবীন্দ্র সরোবরে গিয়ে তানজিনার মুঠোফোনে কল দিলাম। জানতে চাইলাম, কী ড্রেস পরে এসেছে সে। লক্ষ্মী মেয়ের মতো তানজিনা বলল, লাল কামিজ, ওড়না ও সালোয়ার সবুজ। ফোন কেটে দিয়ে বকুলকে নিয়ে আড়ালে লুকিয়ে তানজিনাকে দেখি।
ছবির থেকেও বাস্তবের চেহারা সুন্দর। তবে কেমন যেন একটা আতঙ্কের ছাপ। লাল কামিজ সবুজ সালোয়ার ওড়না চমৎকারই মানিয়েছে। চেহারায় কিছুটা আতঙ্কের ছাপ। দেখে ভদ্রঘরের মেয়েই মনে হলো। আর এই দেখা থেকেই সফট কর্নার আরো সফট হয়ে পড়ে। নিজেকে প্রেমিক প্রেমিক ভাবতে লাগলাম। কিন্তু ১০ হাজার টাকা তো আমার পকেটে নেই। টাকা ম্যানেজ করার জন্য এই বন্ধু, ওই বন্ধুকে ফোন করতে লাগলাম। কাছের কোনো বন্ধুকে বাকি রাখিনি। একেকজন একেক ধরনের বাহানা তুলে কেউই টাকা দিতে রাজি হলো না। অবশেষে রিপন নামের কিছুটা দূর সম্পর্কের এক বন্ধু টাকা দিতে রাজি হলো। কিন্তু টাকা নিয়ে আসতে কম হলেও ১ ঘণ্টা সময় লাগবে। এরই মধ্যে বার বার ফোন দিচ্ছে তানজিনা। একবার বলি রেডি হচ্ছি অন্যবার বলি বের হচ্ছি, এমন নানা কথা বলে সময় ক্ষেপণ করতে লাগলাম। কেননা, সত্যি কথা বলতে এই মুহূর্তে সৎসাহস আমার হচ্ছে না। যদি ভুল বুঝে রাগ করে চলে যায়।
এক ঘণ্টার আগেই রিপন টাকা নিয়ে হাজির। অফিসের সামনে এসেই ফোন দিল আমাকে। যাক এবার তাহলে তানজিনার মুখোমুখি হওয়া যাবে। রিপনের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে তানজিনা যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানে গেলাম। কিন্তু কোথায় সেই লাল ড্রেস পরা তানজিনা? এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি কোথাও নেই। ফোন দিলাম, সুইচ অফ। বেশ খানিকটা দূরে মানুষের জটলা চোখে পড়ল। আগ্রহ নিয়ে আমরা জটলার কারণ অনুসন্ধানে এগিয়ে গেলাম। জটলা ভেদ করে ভেতরে ঢুকেই আমি হতবাক। বকুল আর আমি একে অন্যের দিকে থাকাচ্ছি। রক্তে লাল হয়ে লাল ড্রেস পরা মেয়েটার নিথর দেহটা পড়ে আছে রাস্তায়। একটু আগেও যে বার বার আমাকে অজানা আতঙ্ক নিয়ে ফোন দিচ্ছিল এখন সে মহাকালের পথে। গল গল করে চোখ বেয়ে জল পড়ছে। বুক চাপড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। এই ভুলের কি প্রায়শ্চিত্ত সম্ভব? একটি মিথ্যা, একটি ভুল, একটু রসিকতা এত নির্মম বাস্তবতার সম্মুখীন করবে, স্বপ্নেও কখনো চিন্তা করিনি।
বকুলের ধাক্কায় ঘোর কাটল। এরই মধ্যে বাস ময়মনসিংহের মাসকান্দায়। সঙ্গে আমরাও। এখন নামতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৮ ঘণ্টা, আগস্ট ১২, ২০১৫