মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী শাহাবুদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মেলাঘরে ট্রেনিং নিচ্ছিলেন। তখন তিনি ওখানে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন।
আমরা জানি যে, শিল্পী শাহাবুদ্দীন ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর সকালে শাহবাগের বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্রের ছাদে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশন যেমন, তেমনি তীব্র দেশোত্মবোধ, স্বাধীনতার স্পৃহা, প্রতিপক্ষের প্রতি ঘৃণা—এসব বোধ মিলিয়ে তার ক্যানভাস সাহসী মানুষের বিচিত্র অভিব্যক্তি রূপায়িত হয়েছে।
শাহাবুদ্দীন গভীর অভিনিবেশে অনুভব করেছেন এই মহানায়কের মৃত্যু। তাই গুলিবিদ্ধ শেখ মুজিব হয়েছেন তার ছবির বিষয়। গুলিবিদ্ধ মুজিবকেও নানা দৃষ্টিকোণ থেকে শিল্পী এঁকেছেন। একজন বীরের মতোই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, এই দৃশ্য আমরা দেখতে পাই তার চিত্রপটে। ভীরু কাপুরুষের মতো নয়, বঙ্গবন্ধু যেভাবে বুক চিতিয়ে গর্জে উঠেছেন, হুমকি দিয়েছেন প্রতিপক্ষ পাকিস্তানিদের, তেমনি উত্তোলিত বক্ষে তিনি শক্র-হাতে গুলিবিদ্ধ হতে দ্বিধাম্বিত হননি। এই ধারার চিত্রে আমরা মৃত্যুকে দেখি না, যেন বীরের জীবনের আত্মিক এক পর্যায়কে বীরের মতোই সমাপ্ত হতে দেখি।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য এবং ৬৯-এর গণ-আন্দোলনে সক্রিয় শিল্পীকর্মী হিসেবে আন্দোলনে যোগ দেয়ার জন্য, পারিবারিকভাবে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকার জন্য এ শিল্পীর যুদ্ধে অংশগ্রহণ অনেকটাই স্বাভাবিক। শাহাবুদ্দীনের বাবা-মা এবং পরিবারের অন্য পাঁচ ভাই—সবাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
এ শিল্পী কিশোর বয়স থেকেই দেখেছেন, স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বড় মানুষকে শিল্পের শ্রদ্ধার্ঘ জানানো শাহাবুদ্দীনের মনের বিশেষ প্রবণতা। তিনি পৃথিবী বিখ্যাত ব্যক্তিদের ছবি এঁকেছেন।
১৯৭৫ সালে নৃশংসভাবে জাতির পিতা সপরিবারে নিহত হলেন। তখন প্রবাসে অবস্থানরত শিল্পী প্রথমত শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। তারপর শিল্পীর চেতনায় শোধিত হয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে অজস্র অভিব্যক্তিতে পরিস্ফূট হতে থাকে শাহাবুদ্দীনের ক্যানভাস। এ কথা প্রায় সব দর্শকেই অবগত আছেন যে, শাহাবুদ্দীন তার সৃজনতাপ প্রয়োগ করে শিল্পের নতুন নতুন মুদ্রা তৈরি করেন। বঙ্গবন্ধুকে শাহাবুদ্দীন উদ্ধ্যত-শির বীর সৈনিকের মতো এঁকেছেন। তার ক্যানভাসে বঙ্গবন্ধু এসেছে পতাকার মতো উড্ডীন, মশালের মতো উজ্জ্বল, ক্যানভাসের মধ্যখানে আগুনের গোলার মতো বিস্ফোরিত।
কালো মুজিব কোটে দুহাত প্রসারিত করে লক্ষ জনতাকে আলিঙ্গনরত বঙ্গবন্ধুকে শাহাবুদ্দীনের এসব মুদ্রার পাশাপাশি আছে বেদনার্ত বঙ্গবন্ধু, মাথা নুইয়ে দেশের জন্য ভাবনারত যদিবা দিশেহারা। শিল্পী এই থিম নির্বাচন করেছেন বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর। এগুলো অনেকটাই মন্ময়ধর্মী পরিকল্পনা। শাহাবুদ্দীন যদিবা এক্সপ্রেসানিস্ট ভাবধারার শিল্পী, তবু এখানে আমরা শোকার্ত একটা ট্রাজিক ব্যঞ্জনা পাই।
শাহাবুদ্দীন গভীর অভিনিবেশে অনুভব করেছেন এই মহানায়কের মৃত্যু। তাই গুলিবিদ্ধ শেখ মুজিব হয়েছেন তার ছবির বিষয়। গুলিবিদ্ধ মুজিবকেও নানা দৃষ্টিকোণ থেকে শিল্পী এঁকেছেন। একজন বীরের মতোই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, এই দৃশ্য আমরা দেখতে পাই তার চিত্রপটে। ভীরু কাপুরুষের মতো নয়, বঙ্গবন্ধু যেভাবে বুক চিতিয়ে গর্জে উঠেছেন, হুমকি দিয়েছেন প্রতিপক্ষ পাকিস্তানিদের, তেমনি উত্তোলিত বক্ষে তিনি শক্র-হাতে গুলিবিদ্ধ হতে দ্বিধাম্বিত হননি। এই ধারার চিত্রে আমরা মৃত্যুকে দেখি না, যেন বীরের জীবনের আত্মিক এক পর্যায়কে বীরের মতোই সমাপ্ত হতে দেখি।
শাহাবুদ্দীন গুলিবিদ্ধ বঙ্গবন্ধুকে ভিন্ন আঙ্গিকেও এঁকেছেন। গুলিবিদ্ধ মহানায়ক বুক চেপে ধরেছেন এবং কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন। যেন তার বিশ্বাস হচ্ছে না বাংলাদেশের বুকে তাকে কোনো শক্রর হাতে এভাবে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ দিতে হবে। শাহাবুদ্দীন মুজিব ট্রাজিডিকে এভাবে বিচিত্র আঙ্গিকে চিত্রায়িত করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে মহাকাব্যের নায়ক—এই ভাবনার চিত্রণ দৃষ্টান্ত শাহাবুদ্দীনের বঙ্গবন্ধু চিত্রমালা।
আমরা যেন শাহাবুদ্দীনে বঙ্গবন্ধু চিত্রমালার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ নামক মহাকাব্যের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করে ফেলতে পারি। রাজনৈতিক চেতনা, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, পারিবারিকসূত্রে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়া, এসব কারণে শাহাবুদ্দীন যে বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন, সে বিষয়টিকেই সুদীর্ঘ সাড়ে তিন দশক এঁকে চলেছেন।
বঙ্গবন্ধুর ইমেজ তাই বহুবছরের মনের রসায়নে পরিশ্রুত হয়ে প্রকাশ পাচ্ছে শাহাবুদ্দনের ক্যানভাসে। ওই নামে আমরা শাহাবুদ্দীনের ছবিতে বিষয়ের ঘনিষ্টতা প্রত্যক্ষ করি এবং একজন ধ্যানী মানুষ যেভাবে তার প্রিয় বিষয়কে শ্রদ্ধা জানায়, সেভাবেই বঙ্গবন্ধু নানারূপে শাহাবুদ্দীনের সামনে আজও উপস্থিত হচ্ছেন।
লেখক : চিত্রসমালোচক
বাংলাদেশ সময় : ১৯৩৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৫