যখনই আমাদের জাতিসত্তার প্রয়োজন পড়েছে—এগিয়ে এসেছেন তিনি। কলম কিংবা রাজপথ দুটোই ছিল তাঁর ক্যানভাস।
তাঁর শেষ দিকের একটি কবিতা আমার মনে পড়ছে এ মুহূর্তে। কবিতাটি ২৮ এপ্রিল ২০০৬ তারিখে দৈনিক যুগান্তর সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতাটির শেষ পংক্তিগুলো তুলে দিচ্ছি পাঠকের জন্য:
আখেরে পাড়ায় নেমে আসে অপরূপ মধুময়
চন্দিন্সমার। এই অপরূপ চন্দিন্সমাকে মুছে ফেলার কালিমা
জাগবে না কোনোখানে। কেবল চন্দ্রিমা
জাগবে হৃদয়ে—যার আভা চিরকাল রয়ে যাবে।
হে চন্দ্রিমা, রেখো মনে, এই যে লিখছি আমি, তার
সত্তা তার রইবে না, কিন্তু তুমি আসমানে জ্বলজ্বল করবে সর্বদা!
(জ্বলজ্বল করবে সর্বদা / শামসুর রাহমান)
‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ দিয়ে যার যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেই কবি সহাস্যে মৃত্যুকে ভেদ করে গেছেন। কলাম, প্রবন্ধ, সমালোচনা, নিবন্ধ, অনুবাদ—কী করেননি তিনি। কিন্তু প্রধান পরিচয়ে কবি হিসেবেই সর্বদা উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন শামসুর রাহমান—বাংলার প্রয়োজনে, বাংলা ভাষার প্রয়োজনে, বাংলা কবিতার প্রয়োজনে।
তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম ডিআইটি অ্যাভিন্যুতে। সহাস্যে আমাকে তার অফিসে স্বাগত জানিয়ে তিনি সদ্য বের হওয়া বিচিত্রা আমার হাতে তুলে দিলেন। তিনি আমাকে আপনি সম্বোধন করে বলতে থাকলে, আমি ভীষণ লজ্জিত হয়ে বললাম “দয়া করে ‘তুমি’ বলবেন আমাকে। ” না, তাতে কোনো কাজ হলো না। মৃদু হেসে বললেন, “আপনি সময় পেলে আসবেন। ”
মৃদুভাষী শামসুর রাহমানের চাওয়ার কিছুই ছিল না। চাহিদার কোনো দীর্ঘ তালিকা ছিল না তাঁর। কবিতার নেশা ছিল। ছিল পংক্তির সাথে খেলা করার স্বপ্ন। মনে পড়ছে, তিনি তখন সাপ্তাহিক বিচিত্রার প্রধান সম্পাদক, খুব সম্ভবত ১৯৭৯ সালে।
তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম ডিআইটি অ্যাভিন্যুতে। সহাস্যে আমাকে তার অফিসে স্বাগত জানিয়ে তিনি সদ্য বের হওয়া বিচিত্রা আমার হাতে তুলে দিলেন। তিনি আমাকে আপনি সম্বোধন করে বলতে থাকলে, আমি ভীষণ লজ্জিত হয়ে বললাম “দয়া করে ‘তুমি’ বলবেন আমাকে। ” না, তাতে কোনো কাজ হলো না। মৃদু হেসে বললেন, “আপনি সময় পেলে আসবেন। ”
আট/দশ মিনিটের এই যে প্রথম দেখা, তা অনেকটা স্বর্ণোজ্জ্বল স্মৃতির চাদরেই মোড়া হয়ে গেল আমার জীবনে। এরপর সময় পেলেই ঢু মেরেছি ডিআইটি অ্যাভিন্যুতে। প্রিয় কবিকে দেখে এসেছি এক নজর।
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, সামরিক দুঃশাসনের যাঁতাকল, অন্যায়-অবিচার আর রাজনৈতিক নিপীড়ন আমার মতো হাজার হাজার তরুণকে দেশ ত্যাগে অনেকটা বাধ্য করে। বিদেশেও বিচিত্র হয়ে ওঠে আমার নিত্য সঙ্গী সাপ্তাহিকী। এক সময় আমি বিচিত্রা’র প্রবাস থেকে কলামে নিয়মিত লেখা শুরু করি।
২.
বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকার আমন্ত্রণে কবি শামসুর রাহমান প্রধান অতিথি হয়ে একটি অনুষ্ঠানে আসেন ১৯৯০ সালে। তখন বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকার সভাপতি ছিলেন সাঈদ-উর-রব। আমি লীগ সভাপতি সাঈদ-উর-রবের আমন্ত্রণেই সে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগ পাই। কবির সাথে সে অনুষ্ঠানেই আবার দেখা হয় দীর্ঘদিন পর। দীর্ঘক্ষণ আড্ডা, সাহিত্য বিষয়ে আলোচনা হয় মধ্যরাত পর্যন্ত।
মনে পড়ছে এরপর কবির সাথে সাহিত্য আড্ডায় অংশ নেবার সুযোগ হয় নিউইয়র্কের ইয়র্ক অ্যাভিন্যুর, বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের বাসভবনে। সে আড্ডার মূল আয়োজক ছিলেন গল্পকার পুরবী বসু। তার আমন্ত্রণেই নিউইয়র্ক-নিউজার্সিতে বসবাসরত বাঙালি লেখক-কবিরা সমবেত হয়েছিলেন আড্ডায়। শামসুর রাহমান ছিলেন সে আড্ডার মধ্যমনি। আড্ডায় আরো অংশ নিয়েছিলেন লেখক হাসান ফেরদৌস, ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, পুরবী বসু, প্রয়াত কবি আল-মুকতাদির, ড. সলিমুল্লাহ খান, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল প্রমুখ।
সলিমুল্লাহ খান, শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ দুটি কবিতা, ‘স্বাধীনতা তুমি’ এবং ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’—এগুলোর তুলনামূলক আলোচনা করেছিলেন অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে। বিভিন্ন প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করছিলেন কবি শামসুর রাহমানকে। লক্ষ্য করেছিলাম, কবি খুব মৃদুভাষায় সংক্ষিপ্ত উত্তর দিচ্ছিলেন। মৃদু হেসে তিনি বলছিলেন, আমি শুনব, আপনারা বলুন। তাঁর অন্যতম প্রিয় কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ তিনি পড়েও শুনিয়েছিলেন সেদিন।
এর ক’বছর পর কবি যখন গ্লুকোমা রোগে আক্রান্ত হন, তখন আবারও উদগ্রীব হয়ে পড়েন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী তাঁর অনুরাগীরা। কবিকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে এসে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। নিউইয়র্কের বিশিষ্ট চিকিৎসকবৃন্দ, বাংলা সাপ্তাহিকীগুলোর সম্পাদকবৃন্দ, সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবীসহ সর্বস্তরের প্রবাসীরা তাঁর চিকিৎসার জন্য এগিয়ে আসেন। কবি দেশে থেকেও যাতে তাঁর চোখের ওষুধগুলো নিয়মিত পেতে পারেন, সে ব্যবস্থায়ও এগিয়ে আসেন বেশ ক’জন সুহৃদ প্রবাসী বাঙালি। এসময় কবির সম্মানে একটি সংবর্ধনার আয়োজনও করা হয়। খুব সংক্ষিপ্ত এবং আবেগ আপ্লুত বক্তব্যে কবি শুধুই ভালোবাসা এবং কৃতজ্ঞতা জানান প্রবাসী সমাজকে।
৩.
কবি যখন হরকাতুল জিহাদের জঙ্গিদের দ্বারা আক্রান্ত হন, তখনও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাঙালিদের প্রতিবাদ ছিল তীব্র। নিউইয়র্কের এস্টোরিয়ায় একটি মিলনায়তনে নাগরিক প্রতিবাদসভার আয়োজন করে হামলাকারীদের বিচার দাবি করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন লেখক সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠনের কাছে কবির নিরাপত্তাদানে বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করতে স্মারকলিপিও দেন প্রবাসীরা।
শামসুর রাহমানের মৃত্যু, আমাদের একটি পাঁজর ভাঙার শব্দের মতোই। ১৯৯৯ সালে কবি নিজে অটোগ্রাফ দিয়ে তাঁর কিছু বই আমার দু’ মেয়ে নাহিয়ান ও নাশরাত এবং আমার সহধর্মীনি কবি ফারহানা ইলিয়াস তুলি ও আমাকে দিয়েছিলেন। আমার কবিবন্ধু আবু হাসান শাহরিয়ার অত্যন্ত যত্নের সাথে আমাদের কাছে—নিউইয়র্কে, বইগুলো পাঠিয়ে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছিলেন। আজ আমি কবির নিজ হাতের স্বাক্ষরে হাত বুলিয়ে তাঁর অস্তিত্ব খুঁজি বারবার। তিনি লিখেছিলেন—‘আমার পুরনো, সামান্য বই দিলাম ভালোবেসে। ’
কবি অত্যন্ত আবেগ নিয়ে প্রায়ই বলতেন, প্রবাসী বাঙালিদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু বাংলা সাহিত্য, বাংলা ভাষা, বাঙালির চেতনা, সভ্যতার আলো প্রতিষ্ঠার জন্য কবি শামসুর রাহমান যে কাজ রেখে গেছেন, তার জন্য গোটা বাঙালি জাতিই তো তাঁর কাছে চিরকৃতজ্ঞ। কী করেননি তিনি? লেখালেখি থেকে শুরু করে মিছিল, সমাবেশ, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ। বাংলাদেশের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মিছিলে, ঘাতক দালাল নির্মুলের আন্দোলনে এই অগ্রজ বয়সেও রাজপথের মিছিলে আমরা দেখেছি শুভ্রকেশধারী এই মহান কবিপুরুষকে।
অনেক কবিতার জন্যই অমর হয়ে থাকবেন শামসুর রাহমান। তাঁর ‘আসাদের শার্ট’, ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’, ‘সফেদ পাঞ্জাবী’, ‘বর্ণমালা, আমার দুখিনী বর্ণমালা’, ‘গেরিলা’, ‘এক ধরনের অহংকার’, ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’ প্রভৃতি কবিতা থেকে যাবে অনন্তকাল।
শামসুর রাহমানের মৃত্যু, আমাদের একটি পাঁজর ভাঙার শব্দের মতোই। ১৯৯৯ সালে কবি নিজে অটোগ্রাফ দিয়ে তাঁর কিছু বই আমার দু’ মেয়ে নাহিয়ান ও নাশরাত এবং আমার সহধর্মীনি কবি ফারহানা ইলিয়াস তুলি ও আমাকে দিয়েছিলেন। আমার কবিবন্ধু আবু হাসান শাহরিয়ার অত্যন্ত যত্নের সাথে আমাদের কাছে—নিউইয়র্কে, বইগুলো পাঠিয়ে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছিলেন। আজ আমি কবির নিজ হাতের স্বাক্ষরে হাত বুলিয়ে তাঁর অস্তিত্ব খুঁজি বারবার। তিনি লিখেছিলেন—‘আমার পুরনো, সামান্য বই দিলাম ভালোবেসে। ’
বই কি কখনো পুরনো হয়? কিংবা ভালোবাসা! হে প্রিয় কবি!
কবি চলে গেছেন। যেখান থেকে কেউ ফেরে না আর। তিনি তার যাত্রার প্রস্তুতি এভাবেই সেরেছেন ক্রমশ: ‘যাত্রার আগে’—এই কবিতাটি ৯ এপ্রিল ১৯৯৯ তারিখে লেখা। স্থান পেয়েছে ‘নক্ষত্র বাজাতে বাজাতে’ গ্রন্থে।
আমি তো শিগগিরই চলে যাব, বড় একা
যাব চুপচাপ, তোমাদের কাউকেই
সহযাত্রী করব না নিরুদ্দেশ যাত্রায় আমার। জেদ করে
লাভ নেই, আমাকে যেতেই হবে তোমাদের ফেলে
কবি, আপনার কবিতা ততদিনই থাকবে, যতদিন থাকবে বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতি—আপনি আমাদের অস্তিত্বের অহংকার।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১৭, ২০১৫