ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ঔপনিবেশিক ভারতের বিলাতি নারীরা | আদনান সৈয়দ (পর্ব ২)

ধারাবাহিক রচনা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১৯ ঘণ্টা, আগস্ট ২৩, ২০১৫
ঔপনিবেশিক ভারতের বিলাতি নারীরা | আদনান সৈয়দ (পর্ব ২)

পর্ব ১ পড়তে ক্লিক করুন

ভারতের পথে পথে |
ঔপনিবেশিক ভারতের সমসাময়িক সময়ে বিলেতের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার দিকে একটু তাকানো যেতে পারে। এ কথা মানতে হবে যে ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে বিলেত ছিল গোটা পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো মধ্যে অন্যতম একটি দেশ।

শিল্পবিপ্লব, সভ্যতা, কারিগরি প্রসার, কল-কারখানা স্থাপন—সবমিলিয়ে ইংল্যান্ড ছিল সেই সময়ে রমরমা একটি দেশ। বিশাল সম্পদের মালিক এই  বিলেতিদের নাকটাও ছিল সমান তালেই অনেক উঁচু আর লম্বা! বিলেতিদের দৃষ্টিতে সেই সময় ভারত একটি গরীব দেশ। চেহারা তাদের মোটেও খুব একটা সুবিধের নয়। ধর্ম কুসংস্কারে ভরা এই মানুষগুলো আদব-কায়দা প্রায় জানে না বললেই চলে। বিলাতি নারী মানেই সেখানে মেমসাহেব আর ভারতীয় স্থানীয় নারীরা সেই মেমসাহেবদের খেদমতে সদাই ব্যস্ত। বিলাতি পুরুষ মানেই কর্মস্থল থেকে বাড়ি তারপর তাদের সমগোত্রীয়দের সাথে ক্লাবে চুটিয়ে  আড্ডা। বলার অপেক্ষার রাখে না যে, সেই আড্ডায় অংশ নিতে পারতেন শুধুমাত্র উচ্চশ্রেণীর ভারতীয় রাজা-মাহারাজ বা সেরকম সমকক্ষের মানুষজন। খুব স্বাভাবিকভাবে বিলাতি পুরুষদের নজর থাকত বিলাতি নারীদের ওপরই। কিন্তু ঔপনিবেশিক ভারতে বিলাতি পুরুষের তুলনায় বিলাতি নারীর সংখ্যা ছিল হাতেগোণা। এজন্য অনেক বিলাতি পুরুষকে বিলেত থেকে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া জাহাজের দিকে হা করে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হতো। কেউ কেউ স্থানীয় ভারতীয় নারীদের নিয়েই সুখী হতে চেষ্টা করত। এদের কেউ কেউ তাদের বিয়ে করত, তবে বেশিরভাগই ভারতীয় নারীদের উপপত্নী হিসেবেই ব্যবহার করত।



খুব স্বাভাবিকভাবে বিলাতি পুরুষদের নজর থাকত বিলাতি নারীদের ওপরই। কিন্তু ঔপনিবেশিক ভারতে বিলাতি পুরুষের তুলনায় বিলাতি নারীর সংখ্যা ছিল হাতেগোণা কয়েকজন। এজন্য অনেক বিলাতি পুরুষকে বিলেত থেকে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া জাহাজের দিকে হা করে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হতো। কেউ কেউ স্থানীয় ভারতীয় নারীদের নিয়েই সুখী হতে চেষ্টা করত।



আগেই উল্লেখ করেছি বিলেত থেকে সেই সময়ে ভারতে যাওয়া এত সহজ ছিল না। তার ওপর যদি তিনি নারী হন তাহলে তো কথাই নেই। সেই সাথে রয়েছে জাহাজের কিছু নিয়ম কানুন। কেবিন পাওয়াটা রীতিমতো কঠিন ব্যাপার। শুধুমাত্র উপরওয়ালারাই কেবিনের জন্যে আবেদন করতে পারত। উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের স্ত্রী বা কোনো হোমরা-চোমড়া ডিউকরাই কেবিনের যথার্থ প্রার্থী হতে পারত। আর বাদবাকিদের অবস্থা ছিল খুব নাজুক। মিসেস এলিজা ফে আঠারো শতকের দিকে ভারতে ছিলেন এবং তিনি কয়েকবারই বিলেত থেকে ভারতে আসা-যাওয়া করেছেন। বিলেত থেকে ভারতে যাওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতার কিছু বর্ণনা তিনি তার বোনকে লেখা একটি চিঠিতে দিয়েছেন। “আমার কেবিনের দরজা প্রায় সবসময়ই বন্ধ করে রাখা হতো। বাইরে থেকে সেখানে না থাকত কোনো আলো অথবা না কোনো বাতাস। ক্যাপটেনটা আস্ত একটা বেয়াদব এবং তার আচরণ ছিল উদ্ধত। সে তার যাত্রীদের অনেকটা অর্ধাহারে রেখে দিত। ”

তবে বাস্তবতা হলো, জাহাজে অনেক সময় খাবার ফুরিয়ে যেত। তখন জাহাজের ক্যাপটেনের কৃচ্ছ্রসাধন করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকত না। সাধারণত বিলেত থেকে জাহাজ ছাড়ার সময় যথেষ্ট পরিমাণ তাজা মাংস, ভেড়া, গরু, মদের বোতল জাহাজে মজুত থাকত। মিনি ব্লেন নামের এক বিলাতি নারী যিনি ১৮৫৬ সালে তার স্বামীর সাথে ভারতে গিয়েছিলেন—তার লেখা ডায়েরি থেকে জানা যায়: “যতই দিন যেত ততই খাবারের সংগ্রহ কমতে থাকত। খাবার পানির সমস্যা দেখা দিত। অনেক সময় পানির রং হয়ে যেত চায়ের রঙের মতোই যা ছিল পান করার অযোগ্য। ” মিনি যখন জাহাজে চড়েন তখন তিনি ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। তার বর্ণনায় দেখা যায়, তিনি এক সপ্তাহ পর্যন্ত কোনো খাবার মুখে তুলতে পারেন নি। জাহাজ যখন কেপ অব গুড হোপে ভিড়লো তখন প্রথমবারের মতো তিনি সেদ্ধ শুয়োরের মাংস, চপ কারি এবং আধা কাঁচা খাসির মাংস খাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। এক চিঠিতে তিনি তার মাকে লেখেন: “তুমি কল্পনাও করতে পারবে না যে এই খাবারগুলো ছিল অর্ধেকটাই পঁচা। খাবার থেকে সেই দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। একদিন আমি মাংস কাটতে দেখি ওর ভেতর চারটা সাদা পোকা কিলবিল করছে। ” (ওমেন অব দি রাজ: দি মাদারস, ডটারস, ওয়াইভস অ্যান্ড ডটারস অব দি ব্রিটিশ এমপায়ার ইন ইন্ডিয়া। লেখক মার্গারেট মেকমিলান, রেনডম হাউস ট্রেড, ২০০৭, পৃষ্ঠা ২৩)



বিলেত থেকে ভারতের পথে জাহাজ মূলত দুটো জায়গায় থামত। প্রথমটি হলো সেন্ট হেলেনা এবং দ্বিতীয়টি কেপ অব গুড হোপ। এ দুই জায়গা থেকেই খাবার পানি এবং অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য জাহাজে বোঝাই করা হতো। বিনোদনে জাহাজের যাত্রীদের জন্য এটি ছিল সবচেয়ে বড় সুযোগ। দীর্ঘদিন পানিতে ভাসার পর মাটির স্পর্শ পাওয়ার জন্যে সবার প্রাণ উন্মুখ হয়ে থাকত। যাত্রীরা প্রাণভরে স্থানীয় মদ ও তাজা মাংস খেত এবং শহরের বিভিন্ন জায়গায় দলবেঁধে ঘুরতে বের হয়ে পড়ত।



তবে সাধারণ সৈন্যদের স্ত্রীদের অবস্থা ছিল আরো মানবেতর। জাহাজের কেবিন পাওয়া তো দূরের কথা, তারা কোনো রকম জাহাজের বিভিন্ন জায়গায় রাত্রি যাপন করত। কখনো কখনো তাদের স্থান হতো মদ রাখার পিপের পাশে, কখনো তারা ঘুমাতে পারত ঘোড়ার খোঁয়াড়ের পাশে। জাহাজের ডেকে যাওয়ার অনুমতি তাদের ছিল না। ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে সাধারণ সৈনিকরা তাদের স্ত্রীদের নিয়ে জাহাজে চড়ার অনুমতি পেত না। শুধুমাত্র উচ্চ মর্যাদার সেনারাই তা করতে পারত। কিন্তু বিশ শতকের গোড়ার দিকে বিলেতে সে প্রথার পরিবর্তন আনা হয় এবং জাহাজে সাধারণ সেনারাও তাদের স্ত্রীদের নিয়ে আসার সুযোগ পায়।

বিলেত থেকে ভারতের পথে জাহাজ মূলত দুটো জায়গায় থামত। প্রথমটি হলো সেন্ট হেলেনা এবং দ্বিতীয়টি কেপ অব গুড হোপ। এ দুই জায়গা থেকেই খাবার পানি এবং অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য জাহাজে বোঝাই করা হতো। বিনোদনে জাহাজের যাত্রীদের জন্য এটি ছিল সবচেয়ে বড় সুযোগ। দীর্ঘদিন পানিতে ভাসার পর মাটির স্পর্শ পাওয়ার জন্যে সবার প্রাণ উন্মুখ হয়ে থাকত। যাত্রীরা প্রাণভরে স্থানীয় মদ ও তাজা মাংস খেত এবং শহরের বিভিন্ন জায়গায় দলবেঁধে ঘুরতে বের হয়ে পড়ত। সেন্ট হেলেনা এবং কেপ অব গুড হোপ—দু’জায়গারই পানশালাগুলো লোকে গমগম করত। স্থানীয় ক্ষুদে ব্যবসায়ীদের—জাহাজের যাত্রীদের কাছ থেকে কিছু টাকা পয়সা কামিয়ে নেওয়ার সেটা ছিল মোক্ষম সময়।



বিলেত থেকে ভারতের রাস্তা ছোট হয়ে যাওয়ায় আরো বেশি সংখ্যক বিলাতি নারীদের ভারত ভ্রমণের ইচ্ছা প্রখর হতে শুরু করে। সেই সাথে জাহাজের মানও আগের থেকে অনেক ভালো হয়। জাহাজের কেবিনের সংখ্যা বাড়ানো হয় এবং খাবার দাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুদ নিশ্চিত করা হয়।



১৮৩০ সালের দিকে জাহাজের এই যাত্রাপথ আগের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ এবং দ্রুত হয়ে পড়ে। সেই সময় সুয়েজ, লহিত সাগর এবং বোম্বের মধ্যে প্রথম স্টিমার চালু হয়। ১৮৪০ সালে পেনিসুলার স্ট্রিমশিপ কোম্পানি এবং ভারত সরকারের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী সুয়েজ এবং ভারতের বিভিন্ন বন্দরে স্টিমার চালু শুরু হয়। সেই সময় পি অ্যান্ড ও(পেনিসুলার এন্ড ওরিয়েন্টাল স্টিমশিপ কোম্পানি) ছিল ভারত ভ্রমণের জন্যে খুব পরিচিত একটি নাম। পাশাপাশি আরেকটি রাস্তাও চালু ছিল। এসকোর এবং ক্লান লাইন—যা লিভারপুল থেকে সরাসরি বোম্বের বন্দরে ভিড়ত। কলকাতা স্টারলাইন চলত লিভারপুল এবং কলম্বো এবং ইটালিয়ান রুবাটিনো লাইন ছিল জিনিওয়া এবং নেপলস হয়ে বোম্বে পর্যন্ত। ১৮৬৯ সালে সুয়েজ খাল দিয়ে স্টিম ইঞ্জিনের এই পথ আবিষ্কার হওয়ার পর বিলেত থেকে ভারত আসতে চার থেকে ছয় সপ্তাহ সময় সাশ্রয় হলো। বিলেত থেকে ভারতের রাস্তা ছোট হয়ে যাওয়ায় আরো বেশি সংখ্যক বিলাতি নারীদের ভারত ভ্রমণের ইচ্ছা প্রখর হতে শুরু করে। সেই সাথে জাহাজের মানও আগের থেকে অনেক ভালো হয়। জাহাজের কেবিনের সংখ্যা বাড়ানো হয় এবং খাবার দাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুদ নিশ্চিত করা হয়। জাহাজের যাত্রীদের মাঝে প্রচুর পরিমাণ ব্রান্ডি, হুইস্কি, বিস্কিট এবং চা গরম করে খাওয়ার জন্যে স্পিরিট বাতি সরবরাহ করা হতো। ১৮৮২ সালে প্রকাশিত বিলাতি নারীদের গাইড বই হিসেবে প্রকাশিত ‘ইন্ডিয়া আওটফিট’ গ্রন্থের বর্ণনা দেখা যাক। “যারা সমুদ্র ভালোবাসেন তাদের জন্য যাত্রাপথটি খুবই আনন্দের। সাধারণত জাহাজে সব যাত্রীরাই খুব ভদ্র। কখনো কখনো জাহাজের ডেকে বিভিন্ন রকম গান বাজনার ব্যবস্থা আয়োজন করা হয়ে থাকে। জাহাজের দীর্ঘ যাত্রাপথে পাঠাগারের ব্যবস্থাও রয়েছে। তাই এমন একটি সুন্দর সময়ের সাথে ভ্রমণ করার ইচ্ছা না হওয়ার কোনো কারণ নেই। ”

বলার অপেক্ষা রাখে না বিলাতি নারীদের পটানেরা জন্যে এই ধরনের বিজ্ঞাপন ছিল মোক্ষম অস্ত্র এবং ভারতে পাড়ি দেওয়ার জন্যে তারা সবাই এমনিতেই উন্মুখ হয়ে বসে থাকত।

পর্ব ৩ পড়তে ক্লিক করুন



বাংলাদেশ সময়: ১৭১৮ ঘণ্টা, আগস্ট ২৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।