ঢাকা, শনিবার, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

বিউপনিবেশকরণ, ভারতের মুক্তিসংগ্রাম ও নজরুল | মাসুদুজ্জামান

বিশেষ রচনা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩৪ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০১৫
বিউপনিবেশকরণ, ভারতের মুক্তিসংগ্রাম ও নজরুল | মাসুদুজ্জামান

The construction of colonial discourse is then a complex articulation of the tropes of fetishism – metaphor and metonymy – and the forms of narcissistic and aggressive identification available to the imaginary . . . One has then a repertoire of conflictual positions that constitute the subject in colonial discourse. The taking up of any one position, within a specific discursive form, in a particular historical conjuncture, is then always problematic – the site of both fixity and fantasy.
HOMI BHABA

In the history books the discoverer sets a shod foot on virgin sand, kneels, and the savage also kneels from his bushes in awe. Such images are stamped on the colonial memory, such heresy as the world’s becoming holy from Crusoe’s footprint or the imprint of Columbus’s knee.
DEREK WALCOTT

১৮৯৯ সাল, দুনিয়া জুড়ে টালমাটাল অবস্থা। নতুন এক শতকে প্রবেশ করবে আমাদের পৃথিবী।

ইতোমধ্যে ঔপনিবেশিক ইঙ্গ-ফরাসি শক্তি তামাম দুনিয়ায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে ফেলেছে। ওই বছরেই ব্রিটিশশাসিত বঙ্গভূমি বর্ধমানের আসানসোলের এক অখ্যাত পাড়াগাঁয়ে ততোধিক এক দরিদ্র পরিবারে ‘মাটির ঘরে’ জন্ম নিল এক শিশু দুখু মিয়া, যার পোশাকি নাম কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুলের যে-বছর জন্ম সেই বছরেই দক্ষিণ আফ্রিকায় বেঁধে যায় ইঙ্গ-বোয়ার যুদ্ধ। প্রকাশিত হয় জোসেফ কনরাডের ‘অন্ধকারের হৃদয়’ বা দ্য হার্ট অব ডার্কনেস আর রাডইয়ার্ড কিপলিঙের ‘শ্বেতাঙ্গ পুরুষের দায়বোধ’ (দ্য হোয়াইট ম্যান্স বারডেন)।

বোয়ার যুদ্ধের অব্যবহতি পরেই উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম জাতীয় স্তর অতিক্রম করে আন্তর্জাতিকতাবাদে উত্তীর্ণ হয়, দেশে দেশে সংগ্রামী বিপ্লবী সংগঠনগুলোর মধ্যে যে নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছিল, তারই প্রভাবে ঘটে যায় এই ভিন্ন ধরনের ভুবনীকরণ। চরম রাজনৈতিক মতাদর্শিক অভিন্ন সম্পর্ক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামরিক সহায়তার সূত্র ধরে দেশে দেশে একসূত্রে বাঁধা পড়েন বিপ্লবীরা। কৃষ্ণআফ্রিকা, বাদামি এশিয়া আর স্বৈরশাসিত হিস্পানিরা মিলে যে আধুনিকতাবিরোধী বিশ্বায়নের সৃষ্টি করেছিল, সেই বিকেন্দ্রিক উপনিবেশবিরোধী শক্তিই পরে বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। তবে পশ্চিমী বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে এই বিপ্লবীরা সেদিন যতটা একাট্টা হতে পেরেছিল, এখন সেই সংগ্রামের মধ্যে লক্ষ করা যাচ্ছে পথ ও মতের নানা বিভ্রান্তি। বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা আর অভ্যন্তরীণ শ্রেণীসংগ্রামের পরিবর্তে এখন ধর্মই হয়ে উঠেছে সবকিছুর নিয়ামক, নিয়ন্ত্রক। ক্রুসেডীয় উদ্দীপনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করেছে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ আর জঙ্গীগোষ্ঠী তৎপর রয়েছে মার্কিনি আধিপত্য খর্বের নামে মানবিক আত্ম-পর হত্যাযজ্ঞে।

নজরুল যখন জন্মগ্রহণ করেন বা তার শৈশবস্থায় ইউরোকেন্দ্রিকতার শনৈ শনৈ অবস্থা। ভারতবর্ষেও চলছে ঔপনিবেশিক শক্তির ভাঙাগড়ার খেলা, কী করে ভারতবর্ষের মানুষকে বিভক্ত করে রাখা যায়। প্রথম প্রকল্প হিসেবে মেকলের উত্তরসূরীরা ১৯০৫ সালে বাংলাকে ভেঙে দু-টুকরো করে দিল, এই বিভাজন আর কখনো জোড়া লাগেনি। ১৯৪৭ সালে মাউন্টব্যাটেন ভারত ভেঙে দেয়ার আগে সোহরাওয়ার্দী-শরৎ বসুর আপ্রাণ ঐক্যপ্রচেষ্টা সত্ত্বেও লীগ-কংগ্রেসের কারসাজিতে বৃহৎ বাংলার স্বপ্ন (আসামসহ) ভেঙে যায়। জিৎ হলো সেই সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের। জীবিকার প্রয়োজনে ঘরছাড়া নজরুল ছ’বছর বয়সেই অর্জন করেছিলেন বিভাজনের এই বীভৎস অভিজ্ঞতা।



“অনিশ্চিত জাতির সাহিত্য অনিশ্চিতই হয়। কিন্তু যখনই জনআকাঙ্ক্ষার বিষয়টি তাতে মিশে গিয়ে একধরনের ঐক্য সৃষ্টি করে, তখনই তা নবীর মহান বাণীর মতো হয়ে ওঠে। ” কথাটা বলেছিলেন হোর্সে মার্তি। মার্তি সাহিত্যকেই মনে করেছিলেন আশার সর্বোচ্চ স্থল। নজরুল তার রচনাকে, বিশেষ করে কবিতাকে সর্বোচ্চ শিখরে তুলে এনেছিলেন। স্বজাতীয়-বিজাতীয় নিন্দুকের তীব্র বাণ তার হৃদয়কে সারাক্ষণ ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত করলেও নিজের সংকল্পসাধনা থেকে একচুলও বিচ্যুত হননি। তার কবিতার ভাষা ছিল বিদ্যুতায়িত, তুঙ্গ আবেগে স্রোতস্বিনি, কিন্তু অব্যর্থ। তার গদ্যরচনাও ছিল আবেগে কম্পমান, তবে লক্ষভেদী; জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় চঞ্চল, অস্থির, তীব্র।



ইউরোপও তখন টালমাটাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেই ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো বিশ্বের দশ ভাগের নয় ভাগ এলাকা কব্জা করে ফেলেছে; কেবলমাত্র ব্রিটেনের দখলেই তখন পৃথিবীর এক-পঞ্চমাংশ এলাকা আর পৃথিবীর এক-চতুর্থাংশ মানুষ তার শাসনাধীন। পরিস্থিতি তপ্ত হয়ে ছিল আগেই, একটুকরো স্ফুলিঙ্গ পেয়ে তা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। অস্ট্রো-হাঙ্গেরির ভবিষ্যৎ কর্ণধার আর্চডিউক ফার্দিনান্দ ফ্রঁসেজ সিংহাসনে বসার আগেই খুন হলেন এক আততায়ীর হাতে। শুরু হয়ে গেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এটা ১৯১৪ সালের কথা, নজরুলের বয়স তখন মাত্র পনের বছর। নজরুলও গেলেন যুদ্ধে, বাঙালি পল্টনে। কিন্তু উপনিবেশবাদীদের ছক কি খুব স্পষ্ট ছিল তার কাছে? মনে হয় না, তবে হয়ত আঁচ করতে পেরেছিলেন তাদের কারসাজি।

ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর তখন প্রকৃতপক্ষেই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। সাম্রাজ্য চাই, আরো সাম্রাজ্য। কিন্তু কোথায় সেই ভূমি যেখানে গিয়ে আসন গেড়ে ছড়ি ঘোরানো যাবে? ততদিনে অবশ্য যা হবার তা শুরু হয়ে গেছে, টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে ইউরোপ। এরই প্রেক্ষাপটে ১৯১৬ সালে লেলিন বললেন, “এই প্রথম আমাদের দুনিয়া সম্পূর্ণ ভাগ হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে যে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে তা হলো আরো বিভক্তি। ” এর পরই সম্প্রসারণের সম্ভাবনা শেষ হয়ে যাওয়ায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো তাদের নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি শুরু করে। বিশ্বযুদ্ধের পর অস্ট্রো-হাঙ্গেরি আর তুরস্ক যায় ভেঙে, জার্মানি হারায় তার উপনিবেশ। শুধু তাই নয়, জার্মানি এবার ‘অভিবাসী ঔপনিবেশিক’ শক্তি রূপে ইউরোপকেই তার উপনিবেশ করে তুলবার হঠকারি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাণিজ্যের গান্ধর্ব্য বিবাহের সূত্রে একদিন যে উপনিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল, তারই মোহে সে মাতাল হয়ে ওঠে। এই সময় মার্তিনীয় কবি ও রাষ্ট্রদ্রষ্টা এইমে সেজার প্রথম মোক্ষম একটা কথা বলেছিলেন, ফ্যাসিবাদই হচ্ছে উপনিবেশবাদ, ফ্যাসিবাদের হোতারাই এখন ইউরোপে ফ্যাসিবাদের দন্তনখ বিস্তার করতে শুরু করেছে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভূমিস্মাৎ পরাজয়ের পরে জার্মানি ও ইতালির সেই স্বপ্নসাধ ভেঙে যায়, জাপানও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার ওপর তার কর্তৃত্ব বর্জন করতে বাধ্য হয়। ছোটো-বড়ো সমস্ত ঔপনিবেশিক শক্তি—ব্রিটেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, স্পেন, পর্তুগাল—তাদের দখল করা ভূখণ্ড একে একে ছেড়ে আসতে শুরু করে। ইউরোপীয় উপনিবেশের এই পশ্চাদপসরণ প্রক্রিয়া শুরু হয় ব্রিটেনের ভারত ছেড়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে, ১৯৪৭ সালে। একে একে উপনিবেশগুলো স্বাধীনতা অর্জন করতে শুরু করে। এই সময় নজরুল যদিও জীবিত, কিন্তু অসুস্থতার কারণে ওই আনন্দযজ্ঞে যোগ দেয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে স্বাধীনতার জন্যে যে উদ্দীপ্ত কবিতা বা সাহিত্যের প্রয়োজন, বিপ্লবীরা যে সাহিত্যের অগ্নিকণা বুকের কাছে সংগোপনে গচ্ছিত রেখে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়বে, তার সব উপাদানই ছিল নজরুলের কবিতায়, ছিল টুকরো টুকরো প্রবন্ধে।

ভারতবর্ষ আর বিশ্ব-ইতিহাসের চমৎকার এক সন্ধিক্ষণে জন্ম নিয়ে বেড়ে উঠছিলেন নজরুল ইসলাম এবং বাংলাভাষার আরেক বিস্ময়কর প্রতিভা জীবনানন্দ দাশ। উনিশ শতকের শেষ দিকে আধুনিকতার ঢেউ জাগে ইউরোপে। পদার্থবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, ভাষাবিজ্ঞান, ভবিষ্যবাদ, চিত্রকল্পবাদ, আভাগার্দ আন্দোলন ইত্যাদি তত্ত্ব-তথ্যে-ভাবনায় বদলে যাচ্ছে মানুষের মনোলোক, দ্রুত বাঁক নিচ্ছে শিল্প-সাহিত্য। নজরুল, দারিদ্র্যের কারণে যার অবস্থান প্রান্তে, ধর্মীয় পরিচয়ের সূত্রে যিনি ‘অপরে’র দলে, স্বভাবজ প্রখর বুদ্ধি, স্বশিক্ষা ও সৃজনীপ্রতিভার গুণে উঠে এলেন সমকালীন সাহিত্যের কেন্দ্রে। জীবনানন্দ ছিলেন ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত আলোকনপর্বের দ্বারা বিভাবিত ভারতবর্ষীয় সন্তান, কেন্দ্র থেকে উত্থিত হয়ে সৃষ্টি করেছিলেন আরেক কেন্দ্র—ভবিষ্যত আধুনিকতার কেন্দ্র। জীবনানন্দের আধুনিকতা সম্প্রসারিত হয়েছে, ভবিষ্যত প্রজন্ম জীবনানন্দের প্রভাব এড়াতে পারেননি, কী কবিতায়, কী কবিতাতত্ত্বে, কী জীবনভাবনায়। নজরুলের সেই অর্থে কোনো যোগ্য উত্তরসূরী নেই। নেই মূলত দুটি কারণে: (এক) তার মতো স্বাভাবিক প্রতিভা নিয়ে কেউ জন্মগ্রহণ করেননি; (দুই) তিনি ছিলেন অননুকরণীয়; অর্থাৎ তাকে অনুকরণ করে আত্মপ্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব ছিল না। শিল্পে-সাহিত্যে এমনিতেই অনুকৃতির কোনো গুরুত্ব নেই, এর ওপর তা যদি হয় নজরুলের অনুকরণ, প্রতিষ্ঠা পাওয়া তো দূরের কথা, সাহিত্যের ইতিহাসের পাদটীকাতেও স্থান পাওয়া সম্ভব ছিল না। অথচ কী বিস্ময়কর, তারই সমসাময়িক শীর্ষকবির রবিকরোজ্জ্বল ছায়াকে একেবারে এড়িয়ে সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন নিজস্ব ভুবন—কবিতায়, গানে, গদ্যে। সমকালীন টালমাটাল সময়ের দ্বারাও আন্দোলিত হয়েছেন তিনি, জানিয়েছেন তীব্র প্রতিক্রিয়া।

২.
“অনিশ্চিত জাতির সাহিত্য অনিশ্চিতই হয়। কিন্তু যখনই জনআকাঙ্ক্ষার বিষয়টি তাতে মিশে গিয়ে একধরনের ঐক্য সৃষ্টি করে, তখনই তা নবীর মহান বাণীর মতো হয়ে ওঠে। ” কথাটা বলেছিলেন হোর্সে মার্তি। মার্তি সাহিত্যকেই মনে করেছিলেন আশার সর্বোচ্চ স্থল। নজরুল তার রচনাকে, বিশেষ করে কবিতাকে সর্বোচ্চ শিখরে তুলে এনেছিলেন। স্বজাতীয়-বিজাতীয় নিন্দুকের তীব্র বাণ তার হৃদয়কে সারাক্ষণ ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত করলেও নিজের সংকল্পসাধনা থেকে একচুলও বিচ্যুত হননি। তার কবিতার ভাষা ছিল বিদ্যুতায়িত, তুঙ্গ আবেগে স্রোতস্বিনি, কিন্তু অব্যর্থ। তার গদ্যরচনাও ছিল আবেগে কম্পমান, তবে লক্ষভেদী; জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় চঞ্চল, অস্থির, তীব্র।

ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে একই সঙ্গে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন প্রতিরোধ ও স্বাধীনতার তত্ত্ব। ফ্রাঞ্জ ফানোঁ বলেছিলেন এই ধরনের সাহিত্যের বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে লেখককে রাজনৈতিকভাবে সচেতন থাকতে হয়। সৃষ্টি করতে হয় অভিন্ন বৈপ্লবিক সত্তা আর তা হলেই নির্যাতিতরা ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই চালাতে পারে। ফানোঁ এই প্রক্রিয়াটাকেই বিউপনিবেশিকরণ বলে চিহ্নিত করেছেন আর বিউপনিবেশীকরণই সৃষ্টি করে ‘নতুন মানুষ’। নজরুল কিভাবে এই নতুন মানুষ সৃষ্টির কথা বলেছিলেন তার কয়েকটি নিদর্শন:

এসো—এসো আমার লক্ষ্মীছাড়ার দল। ত্যক্ত শতমুখী আমাদের বিজয়কেতন, মড়ার মাথা আমাদের রক্ত দেউল-দ্বারে মঙ্গল-ঘট, গরল আমাদের তৃষ্ণার জল, দাবানল শিখা আমাদের মলয়-বাতাস, নিদাঘ-আতপ আমাদের তৃপ্তি, জাহান্নাম আমাদের শান্তি-নিকেতন। এসো আমার শনির শাপদৃপ্ত ভাইরা। আমরা জয়নাদ করব অমঙ্গল আর অভিশাপের। সদ্য পুত্রহীনা জননী আর স্বামীহারা সদ্য বিধবার সৃষ্টি-কাঁদানো ক্রন্দন আমাদের মাধবী-উৎসবের গান, মৃত্যু-কাতর মুখের যন্ত্রণা আমাদের হাসি, আর ঐ যে ঘরে-ঘরে মায়ের মমতা, বোনের স্নেহ, প্রেয়সীর ভালবাসা—ঐ আমাদের চোখের জল। ঐ যে গৃহের শান্তি, তৃপ্তি, আনন্দ, ঐ আমাদের কান্না। (আমার লক্ষ্মীছাড়ার দল)



নজরুল যখন এই লেখাগুলো লিখছিলেন, ভারতবর্ষে তখন চলছে ব্রিটিশ উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম। কিন্তু তাতে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল প্রধান দুই ধর্মসম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমান। নজরুল ঠিকই বুঝেছিলেন এই বিরোধ জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকেই বাধাগ্রস্ত করবে। ফলে ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি, এরই ভেতর দিয়ে আবির্ভাব ঘটবে নতুন মানুষের। জাতীয় মুক্তি বা গণমানুষের মুক্তি একটি প্রক্রিয়া মাত্র। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে যদি প্রতিক্রিয়াশীলতা ঢুকে পড়ে তাহলে স্বাধীনতার স্বপ্ন সুদূরপরাহতই থেকে যাবে।



ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে এখানে যে লক্ষ্মীছাড়ার দলকে আহ্বান জানানো হলো তারাই সৃষ্টি করবে প্রতিরোধ। লক্ষণীয়, দেরিদা অবিনির্মাণের কথা বলতে গিয়ে যে যুগ্মতার কথা বলেছিলেন, সম্পূর্ণ লেখা জুড়েই প্রসঙ্গের পর প্রসঙ্গ, বাক্যের পর বাক্যে তারই অবিরল অজস্র উল্লেখ: শতমুখী / বিজয়কেতন, মড়ার মাথা / মঙ্গল-ঘট, গরল / তৃষ্ণার জল ... ইত্যাদি। অমঙ্গল থেকে শুভের দিকে কবিসত্তার অভিযাত্রা। নজরুল মনে করেন এই অমঙ্গল আর শনির জ্বালানো রুদ্র-চুল্লির মধ্যে বসে নবসৃষ্টির সাধনা করতে হবে। তরুণদের জানাচ্ছেন ধ্বংসের আহ্বান। উল্লিখিত উদ্ধৃতিটি শব্দব্যবহারের দিক থেকে তীব্রভাবে উদ্দীপনামূলক, কোথাও কোথাও রোমান্টিক, কোমল; কিন্তু বৌদ্ধিকতার দ্বারা পরিশীলিত নয়। তবে যে আহ্বান জানানো হয়েছে, তা অকৃত্রিম, কবি দ্রুততম সময়েই ঔপনিবেশিকতার অবসান চান।

আরেকটি দৃষ্টান্ত :

এসো ভাই হিন্দু। এসো মুসলমান। এসো বৌদ্ধ। এসো ক্রিশ্চিচিয়ান। আজ আমরা সব গণ্ডী কাটাইয়া, সব সঙ্কীর্ণতা, সব মিথ্যা সব স্বার্থ চিরতরে পরিহার করিয়া প্রাণ ভরিয়া ভাইকে ভাই বলিয়া ডাকি। আজ আমরা আর কলহ করিব না। চাহিয়া দেখ, পাশে তোমাদের মহাশয়নে শায়িত ঐ বীর ভ্রাতৃগণের শব। ঐ গোরস্থান—ঐ শ্মশানভূমিতে—শোনো শোনো তাহাদের তরুণ আত্মার অতৃপ্ত ক্রন্দন। (নবযুগ)

এখানেও সেই আহ্বান, তবে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। আত্মঘাতি ও ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত থেকে মুক্ত হয়ে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়বে এদেশের মানুষ, হিন্দু-মুসলমান সব শ্রেণীর মানুষ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামায় লিপ্ত না থেকে স্বাধীনতার জন্যে প্রতিবাদ লড়াই করবে, এরকম প্রত্যাশা থেকেই নজরুল লিখেছেন উদ্দীপনামূলক এই গদ্য।

নজরুল যখন এই লেখাগুলো লিখছিলেন, ভারতবর্ষে তখন চলছে ব্রিটিশ উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম। কিন্তু তাতে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল প্রধান দুই ধর্মসম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমান। নজরুল ঠিকই বুঝেছিলেন এই বিরোধ জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকেই বাধাগ্রস্ত করবে। ফলে ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি, এরই ভেতর দিয়ে আবির্ভাব ঘটবে নতুন মানুষের। জাতীয় মুক্তি বা গণমানুষের মুক্তি একটি প্রক্রিয়া মাত্র। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে যদি প্রতিক্রিয়াশীলতা ঢুকে পড়ে তাহলে স্বাধীনতার স্বপ্ন সুদূরপরাহতই থেকে যাবে।

বিউপনিবেশী বয়ানের (ডিসকোর্স) ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এডওয়ার্ড সাঈদ জাতীয় মুক্তিআন্দোলনের কয়েকটি ধাপের কথা উল্লেখ করেছেন: দেশীয় বোধ থেকে জাতীয় হয়ে ওঠা এবং তা থেকে স্বাধীনতা অর্জন করা (প্যারি ৪৩)। সাঈদ এই ধরনের লেখাকে চিহ্নিত করেছেন স্বাধীনতার রচনা বলে। এই রচনা, সাঈদের মতে, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর স্বার্থ ছাড়িয়ে সেক্যুলার রাজনৈতিক বোধের দ্বারা বিভাবিত থাকে, ফলে তা সৃষ্টি করে সামাজিক সচেতনতা। ফানোঁ এবং এইমে সেজার স্বাধীনতাতত্ত্বের কথা বলতে গিয়ে আরো একধাপ এগিয়ে বলেছেন, এই ধরনের রচনায় ইউরোপ-উত্তর বৈশ্বিক মানবিকতার কথাও থাকতে পারে। নজরুল মূলত এই বৈশ্বিক মানবিকতার দ্বারাই দিক্ষীত ছিলেন। এজন্যেই নজরুল অকপটে বলতে পেরেছেন:

আজ চাই, ভরাট-জমাট জীবনের সহজ, স্বচ্ছন্দ, সতেজ গতি ও অভিব্যক্তি। কোথাও কোনো জড়তা, অজ্ঞতা, অক্ষমতা ও আড়ষ্টতা না থাকে। আজ পথের বাধা পাষাণ অটল হিমাচলের মত বজ্রদৃঢ় হলেও সত্য-সাধকের পদাঘাতে চক্ষের নিমেষে চূর্ণিত হবে। অমৃতের সন্ধানী যে ভগবৎশক্তি যার শিরায় শিরায় অমিত বীর্যের অক্ষয় ভাণ্ডার সঞ্চিত করছে, তার বল-দর্পিত চরণাঘাতে ত্রিভুবন ভীত-কম্পমান হবেই হবে। তার রোষ-কটাক্ষেও সম্মুখে অবিদ্যাজনিত সব ভয় বিতাড়িত হবে। সমাজধর্মের দুরুহঙ্কারে উচ্চশির ভূলুণ্ঠিত হবে, এ হতেই হবে। সত্য ও মুক্তির জয়রথের যাত্রাপথ রোধ করতে পারে এমন গন্ধর্ব-কিন্নরের মায়া এই দুনিয়ায় নাই। যে সত্যের ভান এ পর্যন্ত পৃথিবীতে দুর্দিনের তরে আপন প্রভাব-মহিমা বিস্তার করে দুর্দিনেই নিজের বোনাজালে, নিজের গড়া শিকলে আবদ্ধ, পঙ্গু ও অবসন্ন হয়ে পড়ত, আজ তার দিন ফুরিয়ে গেছে। আজ ঐ নেবে আসছে ভারতের বিশাল জীবনের পরে পরিপূর্ণ সত্যমুক্তির আলোকপ্রপাত। আর তারই স্পর্শে তাতে জ্বলে উঠবে বিচিত্র নবসৃষ্টির অফুরন্ত আশা ও আনন্দ। (আজ কি চাই)

ঔপনিবেশিক শক্তিকে নজরুল এভাবেই একদিকে যেমন উদ্দীপ্ত ভাষায় ও ভঙ্গিতে অগ্রাহ্য করেছেন, তেমনি নিজের, অর্থাৎ উপনিবেশিতের অধীন ভারতীয়দের ক্ষুদ্রতাকে অগ্রাহ্য করে আত্মশক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হতে চেয়েছেন। ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করে নিয়েছিলেন বৌদ্ধিক মতাদর্শ, নজরুল এই মতাদর্শের পরিবর্তে চেয়েছিলেন জড় স্থবির ভারতবাসী, বিশেষ করে মুসলমানদের আত্মজাগরণ। গ্রামসি তার ‘আধুনিক যুবরাজ’ গ্রন্থে জাতীয় স্বাধীনতার সূত্র হিসেবে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেছেন। নজরুল জনমানুষের এই স্বতঃস্ফুর্ত আত্মজাগরণের ওপরই গুরুত্বারোপ করেছেন। ভারতের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে লিখিত তার অধিকাংশ রচনা তাই উদ্দীপনামূলক।

জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের আরেক ভাবুক ক্যাবরাল অবশ্য জোড় দিয়েছেন মতাদর্শের উপর। “মুক্তিসংগ্রাম হচ্ছে বিপ্লব”—এই ছিল তার ধারণা। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকাঠামো আর ঔপনিবেশিক সমাজ কাঠামোকে ভেঙে দিয়েই অর্জন করতে হবে স্বাধীনতা। নজরুল খুব সচেতনভাবে যে এই কাঠামো ভাঙতে চেয়েছেন তা নয়, মতাদর্শিক সীমাবদ্ধতাও তার ছিল, কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা আর হিন্দু-মুসলমান উভয়েই উপনিবেশের কবল থেকে মুক্তি পাক, সে বিষয়ে তিনি ছিলেন নিঃসংশয়।

শ্বেতাঙ্গদের তথাকথিত দায়বোধের কথা বলে একচক্ষু কিপলিং বা মেকলে ভারতের জন্যে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির হস্তক্ষেপকে বৈধ আর চিরস্থায়ী করতে চেয়েছিলেন; অন্ধকারের হৃদয়কে কনরাড বা শ্বেতাঙ্গ লেখকেরা কখনই আলোকিত করেননি বা করে নিতে চাননি। কিন্তু নজরুল, প্রান্তবর্তী হয়েও (এটাও ছিল মূলত উপনিবেশের ফল) স্বধর্মের মানুষ তো বটেই সামগ্রিকভাবে চেয়েছিলেন ভারতের স্বাধীনতা। নজরুলমানস ও সাহিত্যের এটাই বিশিষ্টতা।



বাংলাদেশ সময়: ২০৩৪ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।