অঙ্গীকারনামা দাখিল, প্রদর্শন কিংবা লিফলেট ছাপিয়ে, বিতরণ করে কবি কবিতা লিখেন না। কবিধর্মই কবির অঙ্গীকারনামা।
২.
নবজাগ্রত বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্তের মানস মৃত্তিকায় প্রোথিত ছিল নজরুলের কবিধর্ম। কিন্তু কতটুকু? ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘শাতিল আরব’, ‘কামাল পাশা’, ‘কোরবানী’, ‘মোহররম’—এই কবিতাগুলোর ভাষা ও বিষয়বস্তুতে মুসলমানি লেবাসই পরিহিত। তাই বলে মুসলিম ঐতিহ্যের গুণকীর্তনই কবিতাগুলোর সারবস্তু নয়। তিনি যে উদারতা ও মানবীয়তার পথে অগ্রসর হচ্ছেন তারই শিল্পচিহ্নের সিঁড়িপথ এই কবিতাগুলো। আসলে স্বদেশ ও সমাজের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন কবি। মুসলিম ইতিহাস ও ঐতিহ্য দিয়ে পরাধীন ভারতবর্ষকে দেখানোর এই রীতি ছিল একেবারেই নতুন। কামাল পাশা শুধু মুসলমান কিংবা আধুনিক তুরস্কের বীর হিসেবে নয়, কামাল পাশা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী একজন আধুনিক মানুষ। এই আধুনিক মানুষের বিজয়গাঁথা প্রকাশের মাধ্যমে কবি স্বজাতি ও স্বসমাজকেই টেনে তুলতে চেয়েছেন। মুসলিম জাগরণের ডাক দিয়ে ‘মোহররম’ কবিতায় কবি নিশ্চয়ই আরব সমাজকে জাগাতে চাননি। চেয়েছিলেন অতীতমুখী, অভিমানি বাঙালি মুসলমানকে জাগিয়ে দিতে। কবি নজরুলের হাত ধরেই সংস্কৃতির অভিন্ন ইতিহাস, মিথ, চিন্তা ও প্রকরণের অভিনব পথে যাত্রা করল বাংলা কবিতা।
৩.
নজরুল নিজেই বলেছেন, “নিজেকে চিনলে, নিজের সত্যকেই নিজের কর্ণধার মনে জানলে নিজের ওপর অটুট বিশ্বাস আসে। ” সিয়ারসোল স্কুলের ছাত্র থাকাকালেই হয়ত নজরুল নিজেকে চিনতে শুরু করেছিলেন। কবি এই স্কুলে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন যুগান্তর দলের গোপন বিপ্লবী নিবারণচন্দ্র ঘটককে; যিনি শিক্ষকতার আড়ালে দেশপ্রেমিক ছাত্রদের মধ্যে বিপ্লবের মন্ত্র ছড়িয়ে দিতেন। দাপ্তরিক নথি বলে শিক্ষকের এই বিপ্লবী দীক্ষায় নজরুল সক্রিয় ছিলেন। ১৯১৭ সালের জানুয়ারি মাসে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর ৯ই মার্চ আদালতের রায়ে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন শিক্ষক নিবারণচন্দ্র। স্কুল কর্তৃপক্ষ সেদিন এই বিপ্লবীকে শিক্ষকতার পদ থেকে বহিষ্কার করেছিল। শুধু তাই নয়, এই বিপ্লবী শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগের সন্দেহে কবির বিরুদ্ধেও শাস্তির সিদ্ধান্ত পাস হয় ১৯১৭ সালের ২রা মে তারিখের স্কুল কর্তৃপক্ষের মিটিংয়ে, ‘kazi nazrul Islam of the same class be given Rs 5(five) a month from the it has been discontinued up to the Matriculation Examination,1918....’—একধরনের প্রতিশোধমূলক স্পৃহা থেকেই সেদিন দশম শ্রেণির সেরা ছাত্রটির মাসিক ৫ টাকার বৃত্তিটি কেড়ে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু অন্তরে লালিত শিক্ষক নিবারণচন্দ্রের নাম যে মুছতে পারেনি তার প্রমাণ ‘কুহেলিকা’ উপন্যাসেই আছে। সেসময় নিবারণচন্দ্রের মাসিমা বিপ্লবী নেত্রী দু’কড়ি বালা দেবীও কবিকে বিপ্লবী ভাবনায় উদ্ধুদ্ধ করেছিলেন। অনেকেই ধারণা করেন, বিপ্লবীদের সংশ্রব ও প্রেরণাতেই শুধু অস্ত্রচালনার প্রশিক্ষণ নিয়ে পরবর্তীতে বিপ্লব সফল করার জন্যই কবি গোপনে কাউকে কিছু না জানিয়ে নৌশেরায় ৪৯ নং বাঙালি রেজিমেন্টে যোগ দেন। জীবনের প্রথমপর্বের এই সশস্ত্র বিপ্লবভাবনা ছিল কবির স্বদেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ।
১৯২০ সালের মার্চ মাসে ৪৯ নং বাঙালি পল্টন রেজিমেন্ট ভেঙে গেলে কবি কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন। কলকাতায় ফিরে, সামাজিক আইডেনটিটির চাকরি তিনি করতে পারতেন। সাব-রেজিস্ট্রারধর্মী রাষ্ট্রীয় আমলা হওয়ার সুযোগও কবির হাতে ছিল। কিন্তু কবিধর্মকেই জীবন মানলেন নজরুল। জীবিকার জন্য বেছে নিলেন সাংবাদিকতার পথ। এই পথই কবিকে জনগণের কাছে নিয়ে গেল। চিরচেনা জনগণকে শিল্পীর দৃষ্টিতে, প্রজ্ঞার আলোকে দেখতে থাকলেন কবি। এই তাকানোর ভেতর দিয়েই নজরুলের মধ্যে জেগে উঠেছিল উপনিবেশবাদবিরোধী রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। জীবনের এই বাঁক একজন নিয়ম-নিষ্ঠ হাবিলদারকে জনগণমুখী কবিতে পরিণত করল। ঐতিহ্যের সঙ্গে একাত্ম হয়েই জনগণের স্বপ্ন ও দ্রোহকে প্রকাশ করলেন কবিতায়। মূলত শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের টাকায় বের করা সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’ই কবির জীবনকে পাল্টে দেয়। সঙ্গী ছিলেন বন্ধু কমরেড মুজফফর আহমেদ। বন্ধুর বোধ বন্ধুকে স্পর্শ করতেই পারে। মুজফফরের চিন্তার আলোও নজরুলের মানবীয় সত্তাকে বেগ দিয়েছিল। কিন্তু সূত্রাবদ্ধ মার্ক্সপন্থী তিনি ছিলেন না। আসলে সময় ও রাজনীতির আলো কবির অন্তরে আপনিতেই ঢোকে। আবার ব্যক্তি ও ইতিহাসও কবিকে আলোড়িত করে। যেমনটা করেছিল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অসহযোগ আন্দোলন। তিনি রমরমা ব্যবসা ছেড়ে, বাড়ি বিলিয়ে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানদের মিলনের আহবান জানান। সেসময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই নেতার দিকে নজরুল আকৃষ্ট হবেন, এটাই স্বাভাবিক। সেই জনপ্রিয় নেতা গ্রেফতার হন ১৯২১ সালের ১০ ডিসেম্বর। দেশপ্রেমের বিপুলতায় এমনিতেই বাহিত ছিল কবির অন্তর, প্রিয় নেতার গ্রেফতারে সেই অন্তরে দহন এলো। দেশাত্মবোধের তীব্রতায় কবি হঠাৎ করেই লিখলেন, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট—ভেঙে ফেল কর্ রে লোপাটে’র মতো অগ্নিময় পঙক্তি। বস্তুত ‘ভাঙার গান’ নামক এই কবিতাটিই কবি নজরুলকে আমূল পাল্টে দিল। সত্তার একটা সুচিন্তিত কলমে কবি লিখতে থাকেন প্রথামুক্তির কবিতা।
আগেই বলেছি প্রথাবিরোধী নজরুলকে বেগ ও সাহস দিয়েছিল ‘নবযুগ’ ও ‘সেবক’ পত্রিকার সাংবাদিকতা। কবির যে রাজনৈতিক বোধ, সেই রাজনৈতিক বোধের উৎসবিন্দুও এই দুটি পত্রিকা। তারপর ১৯২২ সালে এককভাবে সম্পাদিত ধূমকেতু পত্রিকার মাধ্যমেই সেই বোধের বিকাশ। পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয়গুলোই জানান দিচ্ছে কবির রাজনৈতিক বোধের স্বচ্ছতা। সম্পাদকীয় কলামে ‘ধূমকেতু’র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে নজরুল যে বিবৃতি দিচ্ছেন, তাই ব্যক্তি নজরুলের রাজনৈতিক দর্শন: “স্বরাজ টরাজ বুঝি না, কেননা ও কথার মানে এক এক মহারথী এক এক করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা, শাষণভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়দের হাতে। তাতে কোনো বিদেশীর মোড়লি করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যাঁরা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এদেশে মোড়লি করে দেশকে শ্মশানভূমিতে পরিণত করেছেন, তাদের পাততাড়ি গুটিয়ে, বোচকা পুটলি বেঁধে সাগরপাড়ে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন-নিবেদন করলে তাঁরা শুনবেন না। তাঁদের এতটুকু সুবুদ্ধি হয়নি এখনো। আমাদের এই প্রর্থনা করার, ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকুকে দূর করতে হবে।
সময় ও জনরোষানলের প্রচণ্ড উত্তাপে জন্মেছে নজরুলের কবিসত্তা। মায়াকোভস্কি, লোরকা, পাবলো নেরুদা, কিংবা নাজিম হিকমতের মতো তিনি উৎপীড়িতের পক্ষে শব্দ ও অনুভব স্থাপন করেন। সময়, সমাজ, দেশ ও মানুষের দিন-রাত্রিকে জীবন দিয়ে প্রকাশ করার সুস্পষ্ট শিল্পরীতিতে আস্থা রাখেন নজরুল। শিল্পশুদ্ধবাদীদের বক্রচাহনী কিংবা ‘অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ’কে পরোয়া না করে ‘মানব দানব দেবতার ভয়’ হয়ে তিনি লিখে গেছেন। এই লিখে যাওয়াই নজরুলের আদর্শবাদিতা কিংবা অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকারকেই রবীন্দ্রনাথ অগ্রজের দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করেছেন।
পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে। ....আর বিদ্রোহ করতে হলে সকলের আগে আপনাকে চিনতে হবে। বুক ফুলিয়ে বলতে হবে, ‘আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ’। বলতে হবে, যে যায় যাক, সে আমার হয় নিলয়। ”
পত্রিকার এই সম্পাদকীয় কিংবা আহবান নজরুল চৈতন্যের স্বচ্ছ বহিঃপ্রকাশ। সময় ও জনরোষানলের প্রচণ্ড উত্তাপে জন্মেছে নজরুলের কবিসত্তা। মায়াকোভস্কি, লোরকা, পাবলো নেরুদা, কিংবা নাজিম হিকমতের মতো তিনি উৎপীড়িতের পক্ষে শব্দ ও অনুভব স্থাপন করেন। সময়, সমাজ, দেশ ও মানুষের দিন-রাত্রিকে জীবন দিয়ে প্রকাশ করার সুস্পষ্ট শিল্পরীতিতে আস্থা রাখেন নজরুল। শিল্পশুদ্ধবাদীদের বক্রচাহনী কিংবা ‘অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ’কে পরোয়া না করে ‘মানব দানব দেবতার ভয়’ হয়ে তিনি লিখে গেছেন। এই লিখে যাওয়াই নজরুলের আদর্শবাদিতা কিংবা অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকারকেই রবীন্দ্রনাথ অগ্রজের দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করেছেন। অবিবেচকদের শাসিয়ে বলেছেন: “বিদগ্ধ বাগ্বিন্যাসের যেমন মূল্য আছে, সহজ সরল তীব্র ও ঋজু বাক্যের মূল্যও কিছু কম নয়। ....তীব্রতাও রসাত্মক হলেই কাব্য হয়ে ওঠে যেমন উঠেছে নজরুলের বেলায়। ....নজরুল ইসলাম সম্বন্ধে তোমাদের মনে যেন কিছু সন্দেহ রয়েছে। নজরুলকে আমি ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছি এবং উৎসর্গপত্রে তাকে কবি বলে অভিহিত করেছি। জানি, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ এটা অনুমোদন করতে পারোনি। আমার বিশ্বাস, তারা নজরুলের কবিতা না পড়েই এই মনোভাব পোষণ করেছো। আর পড়ে থাকলেও রূপ ও রসের সন্ধান করোনি, অবজ্ঞাভরে চোখ বুলিয়েছো মাত্র।
কাব্যে অসির ঝনঝনা থাকতে পারে না, এসব তোমাদের আবদার বটে। সমগ্র জাতির অন্তর যখন সে সুরে বাঁধা, অসির ঝনঝনায় যখন সেখানে ঝংকার তোলে, ঐকতান সৃষ্টি হয়, তখন কাব্যে তাকে প্রকাশ করবে বৈকি! আমি যদি আজ তরুণ হতাম তাহলে আমার কলমেও ঐ সুর বাজত। ”
কবিতা দিয়ে নজরুল পুরো বাঙালির, পুরো ভারতবাসীর মানবীয় ও স্বাদেশিক চেতনাকেই স্পর্শ করেছেন। রাষ্ট্র ও সমাজকে জাগিয়ে দেয়ার এই অঙ্গীকারকে, চেতনাকে, কবিতার ভাষাকে রবীন্দ্রনাথ শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন। জীবনানন্দের ‘আমি এতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না’ ধর্মী ভাষায় কবিতা লেখার শান্ত মন নজরুলের ছিল না। সময়ের প্রগাঢ় উত্তাপে তিনি জাহাজের সম্মুখে টানানো পতাকার মতো পত্পত করে উড়ছিলেন। ঘোষণা দিচ্ছেন স্বরাজের। তিনি মহাত্মা গান্ধী নন। কিন্তু কবিতার কালো কালো অক্ষর দিয়ে তিনি গান্ধীবাদিতার বাইরে এসে কিংবা গান্ধীবাদকে অটুট রেখেও মানুষ ও সময়কে মুক্তি দিতে চেয়েছেন। একটা উদ্দাম শিল্পজীবনে মানুষের স্বার্থে রচনা করেছেন মানুষের কবিতা। কবি নিশ্চয়ই জানতেন, রাজা কবিকে রাজদণ্ড দিতে পারেন, গ্রন্থকে বাজেয়াপ্ত করতে পারেন কিন্তু কবিতাকে কিংবা চিন্তাকে বাজেয়াপ্ত করতে পারেন না। চিন্তা কিংবা কবিতা আপন ধর্মেই সাধারণকে আকর্ষণ করে।
১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ‘ধূমকেতু’ পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছিল কবির ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি। কবিতাটির জন্ম শাসকবর্গকে নিশ্চয়ই স্বস্তি দেয়নি। তাই তিন সপ্তাহ পরেই যখন ‘ধূমকেতুর’ সম্পাদকীয়তে পূর্ণ স্বাধীনতার আহবান জানালেন, তখনই শিল্পীর বিরুদ্ধে জারি হলো আইনী ফরমান। শুধু ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ প্রকাশের অভিযোগে ইংরেজ প্রশাসন ‘ধূমকেতু’র অফিস তছনছ করে এবং তুলে নিয়ে যায় পত্রিকার অবশিষ্ট কপি। ছাড় পাননি পত্রিকার প্রকাশক। ভারতীয় দণ্ডবিধি ১২৪-এ ধারা অনুসারে ১৯২২ সালের ৮ই নভেম্বর গ্রেফতার হন প্রকাশক আফজাল-উল হক। ২৩ই নভেম্বর নজরুলকে গ্রেফতার করা হয় কুমিল্লা থেকে। অন্তরিন থাকা অবস্থা থেকে কবি মুক্তি পান ১৯২২ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ১৯২৩ সলের ৭ জানুয়ারি নজরুল লিখেন ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’। স্বাভাবিকভাবেই চলছিল বিচারকার্য। ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ সেই বিচারকার্যকে তরান্বিত করেছে। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটির জন্য কবিকে ১৯২৩ সালের ১৭ জানুয়ারি ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪-এ এবং ১৫৩ ধারানুসারে বিচারপতি সুইনহো কবিকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন। সরকারি নথিতে বলা আছে: “started from 11th August 1922 preaches emancipation from all restrains. Political social or religious independent in tone. The late editor Nazrul was convicted and sentenced under sec 124A & 153A IPC to 1 year r.n.on 17th January1823.”
কী ছিল আনন্দময়ীর আগমনের কণ্ঠে, যা সমগ্র প্রশাসনের ভিঁত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। কবিতাটি আসলে কোনো স্লোগান নয়, মা’র কাছে সন্তানের এক ধরনের প্রার্থনা। এধরনের প্রার্থনা ১৩২৮ সালের পূজোয় লেখা ‘আগমনী’ কবিতাতেও কবি রেখেছিলেন। মাকে আহবান করে কবি লিখেছিলেন: ....“আজ রণরঙ্গিণী জগৎমাতার দেখ মহারণ/ দশদিকে তাঁর দশ হাতে বাজে দশ প্রহরণ/ পদতলে লুটে মহিষাসুর,/ মহামাতা ঐ সিংহবাহিনী জানায় আজিকে বিশ্ববাসীকে—/ শাশ্বত নহে দানব- শক্তি—পায়ে পিষে যায় শির পশুর। ”
দানব শক্তি যে শাশ্বত নয় এই বার্তাই মানুষকে পৌঁছে দিতে চান কবি। ‘মোহররম’ কবিতাতেও মুসলমানদের জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি, “দুনিয়াতে খুনিয়ারা দুর্মদ ইসলাম,/লোহু লাও, নাহি চাই নিষ্কাম বিশ্রাম। ” কিংবা ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’ কবিতাতেও বিশ্ব-মানবিক নজরুলকেই পাই। যিনি আহবান জানাচ্ছেন, “টুঁটি টিপে মারো অত্যাচারে মা,/ গল-হার হোক নীল ফাঁসি,/ নয়নে তোমার ধূমকেতু-জ্বালা/ উঠুক সরোষে উদ্ভাসি। ”
কবিতা তো তাই, যা আমাকে আহবান করে কিংবা বোতলের ভেতর আটকানো আমার আত্মাটাকে মুক্তি দেয় কবিতা। আমি হয়ত মুক্তি চাই কিন্তু বুঝতে পারি না। কবিতা আমাকে বুঝিয়ে দেয়। দেখিয়ে দেয় পথ ও পথের মানচিত্র। কবিতার কাছে প্রণত হতে দীক্ষা লাগে না। লাগে প্রত্যয় ও আগ্রহ। এই প্রত্যয় ও আগ্রহ নিয়েই বাঙালি পাঠক নজরুলের শিল্পপথে প্রবেশ করেছে। কবিও প্রার্থিতদের নিরাশ করেন নি। ‘আগমনী’, ‘মোহররম’, ‘রক্তাম্বরধারিণী’, ‘খেয়াপারের তরুণী’ কিংবা ‘ভাঙার গান’ কবিতায় যে ভাষা ও বোধ তিনি প্রস্তুত করেছেন তারই উদ্দাম বিস্ফোরণ দেখিয়েছেন ‘আনন্দময়ীর আগমনে’। দুর্গতি নাশিনী মাকে ভারতবর্ষের মুক্তির দূত হিসেবে আহবান করছেন কবি। কবিতাটির কয়েকটি পঙক্তি: “অনেক পাঠা-মোষ খেয়েছিস, রাক্ষসী তোর যায়নি ক্ষুধা;/আয় পাষাণী, এবার নিবি আপন ছেলের রক্ত-সুধা!/ দুর্বলদের বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন শক্তি-পূজা/ দূর করে দে, বল্ মা, ছেলের রক্ত মাগে মা দশভুজা!/ সেই দিন হবে জননী তোর সত্যিকারের আগমনী, বাজবে বোধন-বাজনা, সেদিন গাইব নব জাগরণী। / ‘ময় ভুখা হুঁ—মায়ি’ বলে আয় এবার আনন্দময়ী,/ কৈলাস হতে গিরি-রাণীর মা-দুলালী কন্যা অয়ি!/ আয় উমা আনন্দময়ী!/ ....আর কতকাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি-আড়াল?/ স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল। / দেব-শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি,/ ভূ-ভারত আজ কসাইখানা,—আসবি কখন সর্বনাশী। ”
মাকে এভাবেই আহবান করেছেন কবি। ঐতিহ্যের সাথে সংযুক্ত হয়ে এই কবিতায় কবি ইংরেজ প্রশাসনকে মোকাবেলা করেছেন। দু’শ’ বছরের সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের চেয়ারটিকে আঘাত করেছে প্রতিটি পঙক্তি ও অক্ষরমালা। সাম্রাজ্যবাদী প্রভুরা নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতেই কবিকে এক বছরের রাজদণ্ড দিল। কিন্তু কবি ও কবিতাকে কি রাজদণ্ডে আটকে রাখা যায়! আটকে যে রাখা যায় না, তাই বলা আছে সুভাষচন্দ্র বসুর মন্তব্যে, “...কারাগারে আমরা অনেকেই যাই, কিন্তু সাহিত্যের মধ্যে সেই জীবনের প্রভাব কমই দেখতে পাই। তার কারণ অনুভূতি কম। কিন্তু নজরুল যে জেলে গিয়েছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর লেখার মধ্যে অনেক স্থানে পাওয়া যায়। এতেও বোঝা যায় যে তিনি একজন জ্যান্ত মানুষ। তাঁর লেখার প্রভাব অসাধারণ। তাঁর গান পড়ে আমার মতো বেরসিক লোকেরও জেলে বসে গাইবার ইচ্ছা হতো। আমাদের প্রাণ নেই তাই অমরা এমন প্রাণময় কবিতা লিখতে পারি না। ”
আসলে সার্বক্ষণিক একটা ইউনিফর্মীয় নজরদারিতেই ছিল নজরুলের কলম। কবিতা লেখার অঙ্গীকারে পৃথিবীর অনেক কবিই নির্বাসিত হয়েছেন। কিন্তু নজরুলের মতো নিজ দেশের ভেতরে এতটা নজরবন্দী কিংবা গ্রন্থ বাজেয়াপ্তের হিরিক আর কোনো লেখকের কপালে জোটে নি। নজরুলের কপালে এই দুর্ভোগ জোটার অন্যতম কারণ বেঙ্গল লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্ত। তিনি ইংরেজদের সেবক হয়ে গ্রন্থগুলোর অনুবাদ করে দিতেন। বিভীষণ কিংবা মীর জাফরের মতো অক্ষয়কুমারও বাঙালির আরেক স্ববংশ নাশক।
অর্থাৎ কারাগারে বসেও আপন অঙ্গীকারে নজরুল জনতাকে জাগিয়ে তুলছিলেন। চেতনার অফুরন্ত শক্তিতেই তিনি গাইতে থাকলেন—“শিকল পরা ছল মোদের এ শিকল পরা ছল,/ এই শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল। ” আসলে প্রশাসন কবিকে নিয়ে তখন যথেষ্ট বিপদেই ছিল। বিচারাধীন সময়ে কবি ছিলেন প্রেসিডেন্সি জেলে। কারাদণ্ডের পর পাঠানো হলো সেন্ট্রাল জেলে। তারপর হুগলি জেলে। হয়ত জনপ্রিয়তাই এর মূল কারণ। নজরুলীয় ধর্মে জেলখানার অসঙ্গতিতে অনশন করেন তিনি। সামান্য কয়েকজন বিরুদ্ধাচারী ছাড়া পুরো দেশ তখন নজরুলের পক্ষে। উদ্বিগ্ন রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, “গিভ আপ হাঙ্গার স্ট্রাইক। আওয়ার লিটারেচার ক্লেমস ইউ। ” অর্থাৎ বাংলা সাহিত্য নজরুলকে চায়। নজরুলের অঙ্গীকারে এভাবেই শ্রদ্ধা দেখান রবীন্দ্রনাথ।
আসলে যেভাবে কবিতা লিখলে স্বার্থবাদীদের চোখ কাঁপে কিংবা বুক কাঁপে, সেই ভাষাতেই কবিতা লিখছিলেন নজরুল। ক্ষেপে গিয়ে স্বার্থবাদীরা ধূমকেতুকে ‘অমঙ্গলের অগ্রদূত’ বলে গালিগালাজ শুরু করেছিল। ‘ইসলাম দর্শন’ পত্রিকায় তাদেরই একজন মুন্সী মোহাম্মদ রেয়াজউদ্দীন আহমদ নজরুলকে আক্রমণ করে বলছেন, “নরাধম ইসলাম ধর্মের জানে কী! খোদাদ্রোহী নরাধম শয়তানের পূর্ণাবতার। ...একটা ধর্মজ্ঞানশূন্য বুনো বর্বরের নিকট—অকাটমূর্খ পাষণ্ডের নিকট আর কী আশা করা যাইতে পারে। ...” শনিবারের চিঠি কিংবা মুন্সী মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দীন সাহেবরা নজরুলকে চিনতে পারেন নি। ইংরেজ সরকার নজরুলকে ঠিকই চিনতে পেরেছিল। তাই এক বছর কারাদণ্ড দেয়ার দেয়ার পরও কবিকে নিয়ে নিশ্চিৎ হতে পারে নি ইংরেজ প্রশাসন। ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসেই বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল ‘যুগ-বাণী’। জেল থেকে বের হবার পর ১৯২৪ নিষিদ্ধ হয় ‘বিশের বাঁশী’ ও ‘ভাঙার গান’। তারপরে ১৯৩০ সালে ‘প্রলয়-শিখা’ এবং ১৯৩১ সালে ‘চন্দ্রবিন্দু’ নামক কাব্যগ্রন্থদ্বয়কেও বাজেয়াপ্ত করা হয়। কবির এই পাঁচটি কাব্যগ্রন্থকেই বাজেয়াপ্ত করেছিল ব্রিটিশ প্রশাসন। কিন্তু বাজেয়াপ্তের সুপারিশকৃত নজরদারিতে ‘অগ্নি-বীণা’, ‘সঞ্চিতা’, ‘ফণি-মনসা’, ‘সর্বহারা’, ও ‘রুদ্র-মঙ্গল’ নামক গ্রন্থগুলোও ছিল।
আসলে সার্বক্ষণিক একটা ইউনিফর্মীয় নজরদারিতেই ছিল নজরুলের কলম। কবিতা লেখার অঙ্গীকারে পৃথিবীর অনেক কবিই নির্বাসিত হয়েছেন। কিন্তু নজরুলের মতো নিজ দেশের ভেতরে এতটা নজরবন্দী কিংবা গ্রন্থ বাজেয়াপ্তের হিরিক আর কোনো লেখকের কপালে জোটে নি। নজরুলের কপালে এই দুর্ভোগ জোটার অন্যতম কারণ বেঙ্গল লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্ত। তিনি ইংরেজদের সেবক হয়ে গ্রন্থগুলোর অনুবাদ করে দিতেন। বিভীষণ কিংবা মীর জাফরের মতো অক্ষয়কুমারও বাঙালির আরেক স্ববংশ নাশক। তবে সবকিছুর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই ছিল সক্রিয়। মুজফফর আহমদের বন্ধু নজরুল কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে যুক্ত এই ছিল সরকারের ধারণা। পার্টির রেজিস্ট্রেশন খাতায় নাম না থাকলেও মানুষের পক্ষে, সর্বহারাদের পক্ষে যিনি কবিতা লিখেন সাম্রাজ্যবাদীদের চোখ তাকে কিভাবে আক্রমণ করে—নজরুল তার স্বাক্ষর।
নজরুলের রাজনৈতিক দর্শন কী ছিল, তা ‘মজুর স্বরাজ পার্টি’র মুখপত্র ‘লাঙল’ পত্রিকার মাধ্যমেই বোঝা যায়। পত্রিকাটির সম্পাদক মণিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের নাম থাকলেও প্রধান পরিচালকের দায়িত্ব পালন করতেন নজরুল। প্রথম সংখ্যাতেই ছাপা হয় ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতা। এই পার্টির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল:
১। নারী পুরুষ নির্বিশেষে রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং অর্থনৈতিক সাম্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা সূচক স্বরাজ্য লাভই এই দলের উদ্দেশ্য।
২। নিরস্ত্র গণ-আন্দোলনের সমবেত শক্তি প্রয়োগ।
৩। দেশের শতকরা আশিজন যাহারা সেই শ্রমিক ও কৃষক তাহাদিগকে জন্মগত অধিকার লাভে সাহায্য করা যাহাতে তাহারা রাজনৈতিক অধিকার সম্বন্ধে আরো সচেতন হইয়া নিজের সমতার এবং নিজেদের স্বার্থে ক্ষমতাশালী স্বার্থপর ব্যক্তিগণের হাত হইতে স্বাধীনতা আনিতে পারে।
সাধারণের মধ্যে রাজনৈতিক বোধ ও অঙ্গীকার স্থাপন করতেই সেই সময়ে কবিতা লিখছিলেন নজরুল। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটাকে তিনি একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন। সাহস এবং অঙ্গীকারের সবটুকু দিয়ে তিনি তার বর্ণমালা সাজিয়েছেন। অঙ্গীকারের এই বর্ণমালাতে আবেগের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে আছে কবির দৃষ্টি ও দর্শন। কবির সেই দর্শনের সম্প্রসারণ আছে, মৃত্যু নেই। যে কোনো চিন্তাই বীজ ধানের মতো; নতুন বীজ জন্ম দিতে আসে। শাসকেরা সেই বীজ ধানকেই নষ্ট করতে চাইবে। সবুজকে পুড়িয়ে পৃথিবীকে বিরাণ করতে চাইবে। কিন্তু শাসকের চাওয়ার মতো করে পৃথিবীর চাকা চলে না। নজরুলের কবিতা শাসকের চাকাকে থামিয়ে দেয়। আমাদেরকে জাগিয়ে দেয় নজরুলের কবিতা।
ইতিহাসের নথি ও সন-তারিখে সময়ের মৃত্যু হয়। কিন্তু ভাষা ও ঐতিহ্যের বহমানতায় কবিতার বোধ এবং বাস্তবতা চিরঞ্জীব। কারণ সময় ফুরিয়ে গেলেও যে ক্রাইসিসটা নিয়ে কবিতা রচিত হয় সেই ক্রাইসিসটা ফুরোয় না। কবির দেখা ক্রাইসিসটা নতুন সময়ে নতুন পোশাকে তার অস্তিত্ব প্রকাশ করে। কবিতার ভেতরে তাকিয়ে থাকা জাগ্রত অক্ষরমালা সেই ক্রাইসিসটাকে মোকাবেলা করে। নজরুল চলে গেছেন কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী অসুরদেরকে নিয়ে সাধারণের ক্রাইসিসটা চলে যায়নি। চলে যে যায় নি তা তৃতীয়বিশ্বের স্বাস্থ্যহীন চোখ ঢেকে যাওয়া মানুষগুলোর চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। ঊনিশ শতকের অসুরধর্মী মোড়ল ইংরেজ একবিংশে এসে মুখোশ বদলেছে। বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির নতুন অসুর চলে এসেছে আমার দরজায়। আমি সে অসুরের খপ্পরে পড়ে গেছি। জানি সে অসুর আমাকেই খাবে। কিন্তু ঘাড় ভাঙা বকের মতো আমি তাকিয়ে আছি। আমার সেই তাকিয়ে থাকার মধ্যে লজ্জা আছে কিন্তু সাহস নেই। আসলে আমি কিংবা আমার মতো তৃতীয় বিশ্বকে সাহস দেবে নজরুলের কবিতা। কারণ নজরুলের কবিতা তৃতীয় বিশ্বের ক্রাইসিসকেই মোকাবেলা করে। শুধু মোকাবেলা না, তৃতীয় বিশ্বের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখে নজরুলের কবিতা। সংস্কৃতির সাথে সংস্কৃতির সেতু রচনা করে নজরুলের কবিতা। সেতু ভেঙে গেলে সংস্কৃতির বিপর্যয় ঘটে। নজরুলের কবিতার অঙ্গীকার, সংস্কৃতির সেতু না ভেঙে সংযুক্ত করার অঙ্গীকার, বাঙালির আত্ম-পরিচয়ের অঙ্গীকার।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৬ ঘণ্টা, আগস্ট ২৭, ২০১৫