ঢাকা, শুক্রবার, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ০৩ মে ২০২৪, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

ঈদ-উল-আযহায়—

গাজী তানজিয়ার গল্প | ফেরা

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৫
গাজী তানজিয়ার গল্প | ফেরা অলঙ্করণ : খেয়া মেজবা

ফিরে এসেছে।
কে?
ঐ যে গিয়ে দেখো, নিচতলার ড্রইংরুমে বসে আছে।


শমী রেডি হচ্ছিল বাইরে যাবার জন্য। ভ্রুতে ভাঁজ ফেলে তাকাল তার ভাবীর দিকে—তুমি সহজ করে কিছু বলতে পারো না ভাবী?
সহজ করে কী বলব শমী? তোমাদের বাড়িতে কি সহজ কিছু ঘটে যে বলব!
রুপা ভাবীর দুচোখ দিয়ে যেন এখুনি আগুন ঝরবে। কিন্তু না, সেই আগুন বিচ্ছুরিত হবার আগেই প্লাবন বইল। এই এক সমস্যা এদেরকে নিয়ে। এরা ভেতরের আগুনকে বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে না। আগুনটা ফুঁসে ওঠার আগেই পানি ঢেলে দেয়। আর তাই যত জটিলতা এদের জীবনে।
কী হয়েছে, পরিষ্কার করে না বললে আমিই বা কী করে বুঝব।
পারব না, তুমি নিজে গিয়ে দেখো। প্রেমিকের হাত ধরে স্বামীর ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়া অনেক দেখেছি। কিন্তু সেই পুরনো স্বামীর ঘরে আবার ফিরে আসা! ছি ছি ছি। কেউ কখনো দেখেছে না শুনেছে!

ভদ্রমহিলাকে নিয়ে এই এক সমস্যা। কোনো কথা সরাসরি বলবে না। বিরক্তির একশেষ! পৃথিবীটা যে কত ফার্স্ট হয়ে গেছে—এখন যে আর প্যাঁচাপেঁচির সময় নেই সেই কথাটা একে কে বোঝাবে। তার তুলনায় ভাইয়ার প্রথম স্ত্রী কণক ভাবী ছিল অনেক স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড ধরনের মহিলা। অন্যদিকে তার ঐ সহজ করে বোঝা বা পৃথিবীর তাবৎ ব্যপারগুলোকে সহজ করে দেখতে গিয়ে তিনি তাদের সংসারে বিশেষ করে ভাইয়ার জীবনে যে গেরো বাঁধিয়ে দিয়ে গেছেন তাতে করে তার কথা আর মনে না করাই ভালো।

মুহূর্তে শমীর মস্তিস্কের ভেতর দিয়ে বর্শার ফলার মতো এক ঝলক বিদ্যুৎ খেলে যায়। তাহলে কি কণক ভাবী! ফিরে এসেছেন! নিচে ড্রইংরুমে বসে আছেন? আর সেই কথাটাই রুপা ভাবী উচ্চারণ করতে পারছে না?

কে এসেছে ভাবী? স্পষ্ট করে বলো তো , নিচে কে এসেছে? কণক ভাবী না তো?

রুপাভাবী কোনোভাবে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে তার স্থুল শরীরটা নিয়ে শমীর ঘর থেকে বের হয়ে যেতে যেতে বলল ‘হ্যাঁ। ’

শমীদের বাড়ির ড্রইংরুমটা নিচতলায়। লম্বা ড্রইংরুমে সাজিয়ে রাখা সারি সারি সোফার ঠিক প্রান্তের সোফাটায় বসে এ সপ্তাহের টাইমসের পাতা ওল্টাচ্ছেন কণক। পরনে হালকা নীলের ওপরে সাদা যশোর-স্টিচের কাঁজ করা বারগেণ্ডি শাড়ি। গলায় মুক্তোর মালা, কানে ছোট্ট মুক্তোর দুল, কপালে গাঢ় নীল টিপ। সারা ঘরে এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দিয়ে বসে আছেন তিনি। বসবার ভঙ্গিটা রাজেন্দ্রাণীর মতো মনে হলো শমীর কাছে। একসময় তিনি কবিতা লিখতেন, বইও ছিল একটা। এখনো লেখেন কি না শমী জানে না। চাকরি বাকরি নিয়ে এতো ব্যস্ত থাকতে হয় যে, পত্রিকার সাহিত্য পাতা আর পড়া হয়ে ওঠে না।


ভাইয়া! শমী ভেতরে ভেতরে ভীষণ অবাক হতে লাগল। এই ভাইয়াই তো ভাবী চলে যাবার পর তার ওপর শোধ নিতে বছর না ঘুরতেই রুপা ভাবীকে বিয়ে করে নিয়ে এলো। তবে এটা ঠিক কণকের সাথে যে একবার জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার পক্ষে রুপা ভাবীর সাথে অ্যাডজাস্ট করাটা খুব টাফ। ভদ্রমহিলার না আছে রূপ না আছে রুচিবোধ। তবে একজন বৌ ভেগে যাওয়া পুরুষের পক্ষে এত দ্রুত সময়ের মধ্যে এর চেয়ে ভালো আর কী জোটানো সম্ভব ছিল। যদি না আগে থেকেই প্রেম ভালোবাসা কিছু একটা থেকে থাকে। সেটা তো আর ভাইয়ার ছিল না তাই রুপাই সই। কিন্তু সেই ভাইয়া তলে তলে আবার গিয়ে কণক ভাবীর কাছেই করুণা ভিক্ষা করল! কী আছে এই নারীর মধ্যে যে কেউ তার আকর্ষণ এড়াতে পারে না! খুব বেশি সুন্দরী তো তিনি নন। শ্যামলা রঙ তবে চেহারায় ব্যক্তিত্বের প্রখরতা চোখে মুখে দ্যুতি ছড়ায় এই যা।


শমীকে ঢুকতে দেখে স্মিত হেসে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। কণক ভাবীর এই সৌজন্যবোধ বরাবরই ভীষণ মুগ্ধ করে তাকে। কেমন আছো? ‘ভাবী’ কথাটা বলতে গিয়েও বলল না সে। শমীর বলতে অসুবিধা নেই কোনো; শেষে তিনি কিছু মনে করেন, তাই বলল না।
কণক তেমনি মিষ্টি হেসে বললেন, ভালো, তুমি ভালো তো?
হ্যাঁ। বসো প্লিজ!
বাবা এখন কেমন আছেন?
বাবার অসুস্থতার কথা তুমি জানো?
হ্যাঁ, ইনফ্যাক্ট বাবাকে দেখতেই এতদূর আসা।
শমীর চোখে স্পষ্টতই কৌতূহলের ছাপ পড়ে। তুমি কী করে জানলে? আই মিন তোমাকে কে বলল?
তোমার ভাইয়া।
ভাইয়া! শমীর যেন বিস্ময়ের আর সীমা থাকে না। তার মানে রুপা ভাবীর সন্দেহ ঠিক!
হ্যাঁ তোমার ভাইয়াই জানিয়েছেন আমাকে।
মানে? কথাটা বলতে না চাইলেও মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো।
মানে খুব সহজ। বাবার সাথে তো আমার বরাবরই যোগাযোগ ছিল।
বাবার সাথে?
হ্যাঁ শমী তুমি এমন একজন বাবার মেয়ে, এমন সৌভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে কম মানুষই জন্মায়।
সেটা আমি জানি।
জানবে তো অবশ্যই! মানুষের মহানুভবতা তো কখনো চাপা থাকে না। এমন একজন জাস্টিজ।
হুম, শুধু নিজের পরিবারে সদস্যদের ব্যপারেই হয়ত উদাসীন ছিলেন। যাক, এসব কথা এখন বলতে চাচ্ছি না। বাবার শারীরিক অবস্থা এখন খুব একটা ভালো না। আর্টিফিশিয়াল রেসপিরেটর দিয়ে রাখা হয়েছে।
বলো কী! আমাকে তো এটা জানানো হয়নি।
না, গতকাল রাতেই দিয়েছে। এর আগে ঠিকই ছিল।

বাবার অসুস্থতা নিয়ে অনেক কথাই বলা যায়। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। হসপিটালে ভর্তি হতে না চাওয়া। সার্বক্ষণিক দুজন নার্স ও একজন হাউজ ফিজিশিয়ানের তত্ত্বাবধানে থাকা—আরো কত কী। কিন্তু শমীর এখন কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে না। তবে সে যেন এই মুহূর্তে বলবার মতো কোনো কথাও খুঁজে পাচ্ছে না এমন ভঙ্গিতে বলল, আর ভাইয়া? ভাইয়ার সাথে দেখা হয়েছে তোমার? সে তো বোধহয় এখন বাড়িতে নেই। আজ এত সকালেই অফিস চলে গেল!
এ নিয়ে তুমি ভেবো না, তোমার ভাইয়ার সাথে আমার দেখা হয়েছে। তিনি আমাকে এয়ারপোর্টে আনতে গিয়েছিলেন। আর আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েই তিনি অফিস গেলেন।
ভাইয়া! শমী এবার রুপার চেয়েও বিস্মিত ভঙ্গিতে কণকের দিকে তাকায়।
কিন্তু বাবা যে বাড়িতে নেই, তাকে যে হসপিটালে শিফট করা হয়েছে সেকথা তো তোমার ভাইয়া একবারও বলেনি। তাহলে আমি...
বাবা বাড়িতেই ছিলেন, তাঁকে গতকালই হসপিটালে শিফট করা হয়েছে। আসলে সবরকম সাপোর্ট তো বাড়িতে দেয়া সম্ভব না।
হ্যাঁ বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি যদি বিষয়টা আগে জানতে পারতাম..! আই মিন তোমার ভাইয়া তো এয়ারপোর্টে কিছুই বললেন না। শুধু শুধু... কথা শেষ করে না কণক। আবার অস্থিরভাবে টাইমসের পাতা ওল্টাতে লাগল।

আর এই সুযোগে শমীর মনের মধ্যে হাজারও প্রশ্ন কিলবিল করতে লাগল। অথচ সৌজন্য বশত কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারছে না। তাহলে কি রুপা ভাবীর সন্দেহই ঠিক? কণক ভাবী পাকাপাকিভাবে ফিরে এসেছে? ভাইয়াই তাকে নিয়ে এসেছে? আর তাই রুপা ভাবীর এই প্রতিক্রিয়া? তাহলে কণক ভাবীর সেই প্রেমিক যার কাছে তিনি ছুটে গিয়েছিলেন সে-ই বা কোথায়? বেঁচে আছে? মরে গেছে, না কি মোহ কেটে গেছে!

আড়ষ্টতা, সৌজন্যবোধ, ভদ্রতা, এইসব ছিন্ন করে বের হয়ে শমী কিছুতেই কোনো প্রশ্ন করতে পারে না। তাই খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, চা খাবে নিশ্চই?
চায়ের কথা শুনে কণক একটু নড়ে চড়ে বসল। এক কাপ চা পেলে বেশ হয়, তবে রেড-টি।
ওহ শিওর! আমি জানি তো তুমি রেড-টি খাও। তার আগে তুমি একটু ফ্রেশ হয়ে নাও—এতটা পথ জার্নি করে এসেছো। কণক এবার বেশ ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল, আসলে শমী আমি এসে বোধহয় তোমাদেরকে একটু সমস্যায় ফেলে দিলাম। তোমাদের বাড়িতে ওঠার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না; আমি হোটেলেই উঠতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তোমার ভাইয়া এত জোর করলেন!
আচ্ছা একট প্রশ্ন করি, কিছু মনে করবে না তো?
মনে করবার মতো কিছু?
না, অতটা সীমালংঘন আমি করব না কখনো। সেই সৌজন্যবোধটুকু আমার আছে।
আমি সেটা জানি, ইউ ক্যান আস্ক।
ভাইয়ার সাথে তোমার কী ধরনের যোগাযোগ ছিল বলো তো?
কণক মুখে কিছু বলল না, একবার শুধু তাকাল শমীর দিকে। সেই দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল যে কারণে শমী খুব অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল, না মানে এক ধরনের কৌতূহল থেকে জানতে চাইলাম আর কি, সরি।
নো, ইটস ওকে।

ভাইয়া! শমী ভেতরে ভেতরে ভীষণ অবাক হতে লাগল। এই ভাইয়াই তো ভাবী চলে যাবার পর তার ওপর শোধ নিতে বছর না ঘুরতেই রুপা ভাবীকে বিয়ে করে নিয়ে এলো। তবে এটা ঠিক কণকের সাথে যে একবার জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার পক্ষে রুপা ভাবীর সাথে অ্যাডজাস্ট করাটা খুব টাফ। ভদ্রমহিলার না আছে রূপ না আছে রুচিবোধ। তবে একজন বৌ ভেগে যাওয়া পুরুষের পক্ষে এত দ্রুত সময়ের মধ্যে এর চেয়ে ভালো আর কী জোটানো সম্ভব ছিল। যদি না আগে থেকেই প্রেম ভালোবাসা কিছু একটা থেকে থাকে। সেটা তো আর ভাইয়ার ছিল না তাই রুপাই সই। কিন্তু সেই ভাইয়া তলে তলে আবার গিয়ে কণক ভাবীর কাছেই করুণা ভিক্ষা করল! কী আছে এই নারীর মধ্যে যে কেউ তার আকর্ষণ এড়াতে পারে না! খুব বেশি সুন্দরী তো তিনি নন। শ্যামলা রঙ তবে চেহারায় ব্যক্তিত্বের প্রখরতা চোখে মুখে দ্যুতি ছড়ায় এই যা। তবে সেখানে মাস্টারনি ভাবের চেয়ে স্নিগ্ধতাই বেশি। বিদূষী তাতেও সন্দেহ নেই। কিন্তু সেটাই কি সব? শুধুমাত্র এই কারণে কোনো পুরুষ তার আকর্ষণ এড়াতে পারে না? এও কি সম্ভব! এই ভাইয়াই না তার নাম শুনলেও ক্ষেপে উঠত।

কণক ভাবি পত্রিকার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতেই বলল, তুমি ঠিক কী ভাবছো জানি না তবে বাবার কারণে যোগাযোগটা হতো।

তার মানে কি বাবার আনুকূল্য পাবার আশায়.. সম্পত্তি বা অন্য কোনো জাগতিক কারণ কি এর মধ্যে থাকতে পারে?—মনে মনে ভাবলেও শমী এ নিয়ে মুখে কিছু বলল না।

চা কি তুমি বানিয়েছো?
কণকের প্রশ্নে সম্বিত ফিরল শমীর, হুম।
তুমি চাটা খুব ভালো বানাতে পারো তো!
থ্যাংকইউ।
আসলে শমী তুমি হয়ত ভাবছো আমি এলাম কেন?
বুঝতে পারছি বাবাকে দেখতে এসেছো। কিন্তু কেন, সেটা বুঝতে পারছি না। তবে একটা প্রশ্ন দীর্ঘদিন ধরে আমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে আর সেটা হলো, বাবা-মা আমি বা ভাইয়া আমরা সবাই তো তোমাকে কম ভালোবাসিনি, কিন্তু তুমি আমাদের সবাইকে ছেড়ে , সব বন্ধন ছিন্ন করে চলে গিয়েছিলে কেন?

জানি উত্তরটা জানা তোমার জন্য খুব জরুরি, আমি হলেও তাই চাইতাম। চায়ের কাপটা টেবিলে রাখতে রাখতে বলল, ওয়েল, জানতে যখন চাচ্ছো তখন বলি, ভালোবাসা! আসলে ভালোবাসার একটা দাবি আছে। সেই দাবি চাইলেই কেউ উপেক্ষা করতে পারে না শমী! আমি অর্ককে যে ভালোবাসতাম শমী। কিন্তু সব মানবিক সম্পর্ক ভেদ করে ওর দেশ স্পেশিয়ালি ওর ধর্ম ও পারিবারিক পরিচয় আমার বাবা-মায়ের কাছে মুখ্য হয়ে উঠল। ও বিধর্মী কেন? ও অরফানেজে কেন বড় হয়েছে? ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি আমার বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে তাই ওদের ইমোশোন, সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি বিবেচনা করে ওদের অবাধ্য হতে পারিনি তখন। তাছাড়া অর্কের একটা মেইল। সব শুনে ও লিখেছিল..। সে যাক। আর তাই অর্কের কথাটাকেই বাস্তব ধরে নিয়ে শুধুমাত্র একটা সামাজিক রীতির বশবর্তী হয়ে তোমার ভাইয়াকে বিয়ে করলাম। ভেবেছিলাম সব ঠিক হয়ে যাবে। সত্যি বলতে কি জানো, তোমাদের কারো প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। তোমার ভাইয়া আমাকে ভালোবাসতেন সন্দেহ নেই, তাই খুব বেশি পজেসিভ ছিলেন। সবসময় সন্দেহের চোখে দেখতেন। কার সাথে কথা বললাম, কী করলাম। অথচ অর্কের সাথে আমার কোনো কথা হতো না তখন। তাই একদিন কী মনে হলো জানো, মনে হলো তোমার ভাইয়ার সাথে কি আমি প্রতারণা করেছি? একই সাথে অর্কের সাথেও। ধীরে ধীরে এই বোধ এই অনুভূতি আমাকে কুরে কুরে খেতে লাগল। যত ভেবেছিলাম সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে, ততই যেন সবকিছু আরো অস্বাভাবিক হতে লাগল। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম, তোমাকে বুঝিয়ে বললে বুঝবে...

তুমি তো এখন বড় হয়ে গেছো। ধরো, তুমি একজায়গায় ভীষণ জোরে ঠোকর খেলে। এই ধরো পায়ে বা গোড়ালিতে। মনে হলো, ও কিছু না। একটু পানি বা বরফ লাগিয়ে দিলে জায়গাটাতে। কিন্তু অনেক্ষণ পর দেখলে জায়গাটা ফুলে উঠেছে বা অসম্ভব ব্যথা হয়েছে। কালচে হয়ে গেছে। কিছুদিন পর হয়ত টিউমার হয়ে গেল। আমারও ঠিক ওরকম হয়েছিল। শুরুতে মনে হয়েছিল সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু যতই দিন গড়াতে লাগল, ততই একটা অদ্ভুত কষ্ট দানা বাঁধতে লাগল ভেতরে ভেতরে। সবার হয়ত এমন হয় না কিন্তু আমার হলো। একটা অসম্ভব ঘূর্ণিমান আবেগের সঙ্গে একটা অদ্ভুত কষ্ট। সঙ্গে তোমার ভাইয়ার সন্দেহ বাতিকও ক্রমাগত বাড়ছে। যা অনেকটা অত্যাচারের পর্যায়ে চলে গেছে।

আমিও যেন সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি। শুধু একটাই ভাবনা, কী করছে অর্ক এখন আমাকে ছাড়া? কিভাবে চলবে ওর আমাকে ছেড়ে? আর অর্ক ছিল খুব দুখি একটা ছেলে। ওর পৃথিবীতে কেউ ছিল না। মা মারা গিয়েছিলেন ছোটবেলায়, বাবাও ছিল না। শিলংয়ের এক অরফানেজে ওর বেড়ে ওঠা। শিক্ষা দীক্ষা। ও খুব ভালো স্টুডেন্ট ছিল। তাই স্কলারশিপ নিয়ে ও পোস্ট ডক্টরাল করতে গিয়েছিল আমেরিকায়। ম্যাথমেটিক্সে ওর ব্রাঞ্চ ছিল টপোলজি। ওখানেই ওর সাথে আমার পরিচয় হয়। অর্ক একটু অন্য রকম। এই ধরো সাধারণ মানুষেরা যেমন হয়, ও ঠিক সে রকম না। ওর কোনো বন্ধু ছিল না। ভীষণ ইন্ট্রোভার্ট। সহজেই কারো সাথে মিশতে পারত না। ওর জগৎটা ছিল অনেকটা বিষণ্ণতার জগৎ। আর সেখানে হঠাৎ একদিন আমি ঢুকে পড়লাম। ওর বিষণ্ণ ধূসর সেই জগৎটা হঠাৎই সবুজে, হলুদে, নীলে, রৌদ্রে-আলোকে ভরে উঠল। আমি জানি, আমি ভীষণ শূন্যতার ভেতর দিয়ে ওকে অনুভব করতে পারতাম। কিন্তু সেই আমার কাছ থেকেই যে ও এত বড় দুঃখ পাবে সেটা আমি কখনো ভাবতে পারিনি। সমাজ, সংস্কারবোধের মিথ্যা অহংকারের কারণে ও আমাকে এতটা ভালোবেসেও পাবে না! এটা আমি মানতে পারছিলাম না কিছুতেই।

এরই মধ্যে আমি জানতে পারলাম অর্ক খুব অসুস্থ। ওর থিসিস তখনও কমপ্লিট হয়নি। আমার মনে হচ্ছিল এর কারণটা আমি, আমিই। নিঃসঙ্গ অসহায় একটা মানুষ, সেই কোন দূর দেশে একা একা কষ্ট পাচ্ছে। তাও আমার জন্য, আমাকে ভেবে। এ কথাটা জানার পর আর আমি সমাজ, সংসার, সাংসারিক ধারণাবোধের গণ্ডিতে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারছিলাম না। সব মানুষের নিঃসঙ্গতা, সবার একাকীত্ব অসহায়ত্ব কিন্তু বাইরে থেকে বোঝা যায় না। শুধুমাত্র ভালোবাসলে বা ভালোবাসা থাকলেই এটা বোঝা যায়। বাইরে থেকে হয়ত সবাই ভাববে, এমন তো হয়ই। এ এমন নতুন কিছু নাকি! ব্যর্থ প্রেম, এসব আঁকড়ে আজকাল বসে থাকে কেউ? কিন্তু অর্ক সে রকম ছেলে না। আমি জানতাম ওকে। খুব গভীর সেই জানা, আর তাই তো...। তাই আমি এতটাই ব্যকুল হয়ে পড়লাম যে, প্রায় অসুস্থ হয়ে গেলাম। ঐ যে বললাম, যেন জীবম্মৃত।

আর আমার সেই ব্যাপারটা পৃথিবীতে যেন একজনই বুঝতে পারলেন। তিনি তোমার বাবা। তিনি ছিলেন শ্বশুর কম—বন্ধুই বেশি। সেই ছোটবেলা থেকে তিনি তো আমার বাবারও বন্ধু। কী করে হলেন—সেটা একটা বিস্ময়ের ব্যপার যদিও। কারণ তাদের দুজনের মানসিক গঠন দুরকমের। যাক সে কথা।

তো বাবা একদিন আমাকে ডেকে বললেন, “তোর কী হয়েছে আমাকে বলতো মা। সারাদিন কেমন মনমরা হয়ে থাকিস। মনে হয় যেন তুই ঘুরছিস, ফিরছিস, কথা বলছিস আবার যেন নেই। তোর সমস্যাটা কী মা? আমাকে বলতে যদি কোনো অসুবিধা না থাকে বলতে পারিস। ”

আমার তখন মনের অবস্থাটা এমন ছিল যে, এই কথাটা শোনার পর আমি কান্নায় ভেঙে পড়লাম। সব বললাম বাবাকে। তিনি বললেন, “তুই আমাকে এই কথাটা আগে বললি না কেন? বিয়ের আগে?”
বললাম, তাতে কী হতো? আপনি আমার বাবাকে তো চেনেন। তিনি দীর্ঘশ্বাস চেপে শুধু বললেন, “হুম। তা এখন তুই কী করতে চাস? কী করলে তুই শান্তি পাবি, স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবি বলতো মা। আমি তোর জন্য এখন কী করি বলতো? এ যে অন্যায়, এ যে ভীষণ অন্যায়!”

আমি তখন বাবাকে বললাম, বাবা আমি একবার যেতে চাই ওর কাছে। শুধু একবার। ভয় নেই, আমি কথা দিচ্ছি বাবা, আমি আবার ফিরে আসব। শুধু একবার...। আমি জানি, আমি সেখানে গেলেই অর্ক সুস্থ হয়ে যাবে।
তারপর...। একথা শুনে বাবা রাজি হয়ে গেলেন?
হ্যাঁ হলেন। সারাজীবন যিনি ন্যায়ের পেছনে ছুটেছেন, এক্ষেত্রে তিনি সংকীর্ণতা কিভাবে দেখাবেন শমী। তিনি যে কোনো সাধারণ মানুষ নন।
তারপর?

তোমার ভাইয়া আর আমার বাবা-মা কেউ রাজি ছিলেন না, বলাই বাহুল্য। এদের নিষেধ উপেক্ষা করেই আমি চলে গেলাম। আমি তখন প্রায় পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। ভালোবাসা ছাড়িয়েও বিবেকের দংশন আমাকে এতটাই দুর্বল করে ফেলেছিল যে, আমার কিছু ভাববার অবকাশ ছিল না। তুমি তো জানোই আমি একটু অস্থির প্রকৃতির। তাই বাবাই সব ব্যবস্থা করে দিলেন।
দাঁড়াও। বাবা তোমাকে এই পারমিশান দিলেন। বাবা!
দিলেন।
বাবা তোমার বেলায় এতটা উদারতা দেখালেন। কই, আমার বেলায় তো সেটা করলেন না! আমি একটা ছেলেকে ভালোবাসতাম। ইনফ্যাক্ট এখনো বাসি। ছেলেটা একজন মিউজিশিয়ান। আর সে কথাটা বাবাকে বলতে সোজা না করে দিলেন। আর কারণ হিসেবে ঐ ওর বাবার স্যোশাল স্ট্যটাসের কথা বললেন। সেক্ষেত্রে তোমার ব্যপারটা এতো সহজে মেনে নিলেন কী করে?

আসলে শমী এখানে এক্সপেকটেশনের একটা ব্যাপার আছে। বাবা হয়ত তোমাকে নিয়ে বেশি কিছু এক্সপেক্ট করেছেন, তাই...। তাই তোমার জীবনটা উনি একটা পরীক্ষার ভেতর দিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। আর আমাকে নিয়ে তার হয়ত কোনো এক্সপেকটেশনই ছিল না। আর পরীক্ষার কথা যদি বলো, সেটা তো জীবন অনেকবার আমার কাছ থেকে নিয়েছে। কিন্তু আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। বাবা সব ব্যাপারে এত ডিসিপ্লিন্ড, এত কঠোর—আর তোমাকে এমন একটা অনুমতি দিয়ে দিলেন?
বাবার কাছে হয়ত এটা অন্যায় মনে হয়েছিল।
অন্যায়! কোনটা—ভাইয়ার জীবনে তোমাকে টেনে টুনে বসিয়ে দেয়া? নাকি ভাইয়ার জীবন থেকে তোমাকে সো-কলড মুক্তি দেয়া। কোনটা অন্যায় মনে হয়েছিল বাবার কাছে বলতে পারো?
প্রথমটাই। আর সেটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বলেই আমাকে যেতে দিয়েছিলেন। সবাই এই উদারতা দেখাতে পারে না শমী।
তারপর কী হলো? সেই মহামানবকে দেয়া কথা তুমি রাখতে পারলে না। তুচ্ছ মানুষের মতো ওয়াদা ভঙ্গ করলে?
আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। লেট মি ফিনিশ শমী।

এরপর আমি গিয়ে পৌঁছলাম মোরহেড স্টেটে। অর্ক তখনও হসপিটালে। অতিরিক্ত মেন্টাল স্ট্রেসের কারণে ওর নার্ভের ওপরে প্রেসার পড়েছিল যে কারণে কমপ্লিকেশনগুলো দেখা দেয়। অর্ককে যেন চেনাই যাচ্ছিল না। চমৎকার স্বাস্থ্য ছিল তার। লম্বা চওড়া সুপুরুষ হঠাৎ যেন গুটিয়ে ছোট্ট হয়ে গেছে। আমি যখন ওর রুমে ঢুকলাম, ও চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল। আমি ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই চোখ খুলল। জানো, একটুও অবাক না হয়ে, ও যেন জানতোই আমি যাব এমন ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, কখন এলে কণক?

হঠাৎ আমার মনে হলো আমি হয়ত নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারব না। আমার গলা দিয়ে তীব্র কান্নার আওয়াজ বেরিয়ে আসবে। কিন্তু না, আমি নিঃশব্দে আমার কম্পিত একটা হাত রাখলাম অর্কের বুকে। আমরা দুজনেই তখন কাঁদছি ভেতরে-ভেতরে নিঃশব্দে।

এরপর কিছুদিনের মধ্যেই অর্ক সুস্থ হয়ে উঠল। অর্ক তখন সুস্থই না, সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। আমাকে যে ফিরে আসতে হবে এ ব্যাপারে ওর ভেতরে কোনো বিকার দেখা গেল না বা দেখাল না। কারণ ও আমাকে আগে প্রায়ই বলত, “যদি কোনো কারণে আমাদের বিয়ে না হয়—তারপরও আমাদের বন্ধুত্ব থাকবে। ”

আমি তখন অনেকটা নিশ্চিন্ত। শুধু ভাবছি ওর যদি একজন বন্ধু থাকত! তাহলে খুব ভালো হতো। একজন মেয়ে বন্ধু। অন্তত আমাকে ভুলতে পারত হয়ত। এমন আকাশ পাতাল ভাবছি এমন সময় তোমার ভাইয়া ফোন করে বললেন, তোমাকে আর ফিরে আসতে হবে না। থেকে যাও ওখানে। বললাম, বাবা! বাবাকে যে আমি কথা দিয়েছি।
বিয়েটা তো তোমার আমার সাথে হয়েছে, না কি কণক?
বললাম, হ্যাঁ।
সেই আমি বলছি। এসো না। তুমি ফিরে এসো না প্লিজ! রেহাই দাও আমাকে।

তোমার ভাইয়ার ইগোকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আমি বাবাকে দেয়া কথা রাখতে পারিনি। তবে বাবার সাথে আমার যোগাযোগ ছিলই। কিছুদিন পর তোমার ভাইয়াও যোগাগোগ করত মেইলে। ডিভোর্সের কিছু ফর্মালিটিজ ছিল। তারপরও তোমার ভাইয়া যোগাযোগটা কন্টিনিউ করে যাচ্ছিল। সে যাই হোক। এরপর আমি অর্ককে বিয়ে করলাম।

তারপর তুমি সুখি হলে? তোমার বাবা-মা সবাইকে ছেড়ে?

জীবন অনেক বড় শমী। যত বড় আমরা ভাবি, আর ভাবতে পারি—তার চেয়েও বড়। জীবন তো শুধু জীবন নয় আসলে, মহাজীবন। জীবন আকাশের মতো। যা-ই হোক। যত মেঘই জমুক আকাশে, কখনো গ্লানি জমে না। কোনো মালিন্য লুকিয়ে থাকে না। কোটি কোটি বছর ধরে একই রকম। একই রং আর বর্ণচ্ছটা। দ্যুতিময় জীবন একই রকম। এ রকম যদি নাও হয়, তাহলে আস্তে আস্তে ভাবতে ভাবতে জীবনকে এরকম করে ফেলা যায়। কিন্তু শমী জীবনে সুখি হওয়াটা সত্যিকার অর্থেই বিরল এবং খুব বেশি আপেক্ষিক।

এতদিন যত বিষোদগার ও অপবাদে কণককে জর্জরিত করার প্রচেষ্টা সে দেখেছে—সেটা যে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতার একটা দিক, এটা এই প্রথম উপলব্ধি করল শমী। হ্যাঁ, কণক ভাবীর চিন্তার ধারাটা হয়ত একটু অন্য রকম। সাধারণ মানুষ আপাত দৃষ্টিতে তাকে ভুল বুঝবে সন্দেহ নেই। তবে তাকে বুঝতে যে গভীর অন্তর্দৃষ্টি দরকার সেই দৃষ্টি ক’জনের আছে! শমীর বাবার ছিল। এই কথাটা ভাবতেই শমীর চোখ জলে ভরে উঠল। আর সেই চোখের জল চাপা দেয়ার কোনো চেষ্টাই সে করল না।



বাংলাদেশ সময়: ১৬৫০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।