ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

সনির ব্লুজ (৫) | জেমস আর্থার বাল্ডউইন | অনুবাদ: সোহরাব সুমন

অনুবাদ গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ৮, ২০১৫
সনির ব্লুজ (৫) | জেমস আর্থার বাল্ডউইন | অনুবাদ: সোহরাব সুমন

জেমস আর্থার বাল্ডউইন (২ আগস্ট, ১৯২৪-পহেলা ডিসেম্বর, ১৯৮৭) একাধারে একজন আমেরিকান ছোট গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকার, নাট্যকার, কবি এবং সমাজ সমালোচক। তার প্রবন্ধ সংগ্রহ ‘নোট অব আ নেটিভ সন’ (১৯৫৫)-এ তিনি বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়কার আমেরিকার পশ্চিমা সমাজে বিদ্যমান এবং তখনও আলোচিত হয়নি এমন সাম্প্রদায়িক, যৌন এবং নানা ধরনের শ্রেণী বিভেদ এবং এই সংক্রান্ত অনেক অপরিহার্য সমস্যা নিয়ে কথা বলেছেন।

দ্য ফায়ার নেক্সট টাইম (১৯৬৩), নো নেইম ইন দ্য স্ট্রিট (১৯৭২), এবং দ্য ডেভিল ফাইন্ড ওয়ার্ক (১৯৭৬) তার আরো তিনটি বিখ্যাত প্রবন্ধ সংগ্রহ।

বাল্ডউইনের উপন্যাস এবং নাটক সমূহে কৃষ্ণাঙ্গসহ সমকামী এবং উভকামী পুরুষদের মৌলিক ব্যক্তিগত অনেক প্রশ্ন এবং জটিল সব সামাজিক ও মানসিক পীড়ন এবং ন্যায়সঙ্গত চাওয়া পাওয়া কাহিনী হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। একই সঙ্গে এধরনের ব্যক্তিত্বের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে বেশ কিছু আভ্যন্তরীণ বাঁধা বিঘ্নও বর্ণিত হয়েছে। সমকামীদের অধিকারের বিষয়টি আমেরিকা জুড়ে ব্যাপকভাবে সমর্থন পাবার আগেই এসম্পর্কে বল্ডউইন তার বিখ্যাত উপন্যাস, গিওভানি’স রুম (১৯৫৬) লেখেন, এটি তার দ্বিতীয় উপন্যাস। তার প্রথম উপন্যাস, গো টেল ইট ওন দ্য মাউন্টেইন, তার সবচেয়ে বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম।

সনি’স ব্লুজ গল্পটি বল্ডউইনের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং নির্বাচিত গল্পগুলির একটি। এটি ১৯৫৭ সালে প্রথম ছাপা হয়, পরে গোয়িং টু মিট দ্য ম্যান (১৯৬৫) গল্প সংগ্রহে ঠাঁই পায়। - অনুবাদক



চতুর্থ কিস্তি পড়তে ক্লিক করুন



সেদিন থেকে সনি আর পিয়ানো বাজায় না। সন্ধ্যায় ইসাবেলের মা শান্ত হন কিন্তু বাড়িতে যে বৃদ্ধ ছিলেন তিনি ওর গায়ে হাত তুলে বসেন, এবং ইসাবেল নিজেও। ইসাবেল জানায় সে শান্ত থাকার জন্য সর্বত চেষ্টা করেছে তবে সে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে এবং কাঁদতে শুরু করে। বলে, সে শুধু সনির মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। ওকে দেখে ওর ভেতরের ওলট পালট ইসাবেল বুঝতে পারছিল। আর যা ঘটেছিল তাতে করে তারা ওর অলীক কল্পনা ভেদ করে ওর কাছে পৌঁছতে পারে। যদিও তাদের আঙুলগুলো আর সব মানুষের থেকেও যেকোন সময়ের চেয়ে হাজারগুণ ভদ্র ছিল। তাতে করে সে প্রায় বুঝতেই পারেনি যে ওরা ওকে উলঙ্গ করে ছেড়েছে আর সেই উলঙ্গপনার ওপর থুতু ছিটিয়েছে। তাই ওকে ওর দেখতে হয়, সেই সঙ্গীত, যা তার কাছে জীবন মরণ, তা ওদের জন্য যন্ত্রণার এবং সেটা তাদের যথেষ্ট ভুগিয়েছে। এর কারণ আসলে ও নয়, বরং আমি। আজকে এটাকে ও আগের চেয়ে আরো ভালোভাবে নিতে পারত, তবে এখনো ও তাতে অতটা দক্ষ নয়, খোলা মনে বলতে গেলে, আমি এমন কাউকে চিনি না যে সেটা পেরেছে।

পরের কয়েক দিনের নীরবতা, শুরু থেকে ও গানে গানে যে শব্দ করত তার চাইতেও জোরালো হয়ে দেখা দেয়। একদিন সকালে, কাজে বেরুবার আগে ইসাবেল কিছু একটা দরকার হওয়ায় ওর ঘরে যায় এবং হঠাৎই বুঝতে পারে ওর সেই রেকর্ডগুলোর একটাও সেখানে নেই। এবং নিশ্চিত হয় ও চলে গেছে। এবং আসলেই ও চলে এসেছিল। নৌ-বাহিনীর সাহায্যে যতদূর যাওয়া সম্ভব ও ততদূরে চলে যায়। শেষে গ্রিসের কোথাও থেকে আমাকে একটা পোস্টকার্ড পাঠালে আমি জানতে পারি সনি তখনও বেঁচে আছে। দুজনে আবারও নিউইয়র্ক ফিরে যাবার আগে আমাদের আর দেখা হয় না আর ততদিনে দীর্ঘকালীন যুদ্ধটাও শেষ হয়ে গেছে।



তোমার ক্ষুধা লেগেছে?”
“না। ” বিয়ারের ক্যান হাতে ও বসার ঘরে ফিরে আসে। “তুমি কি আজকে রাতে আমার সঙ্গে কোথাও যেতে চাও?”
বুঝতে পারছিলাম না কিভাবে বলব, সম্ভবত তাই আর না বলা হয়ে ওঠে না।
“অবশ্যই, কোথায়?”
ও সোফায় বসে নোটবুকটা নিয়ে পাতা উল্টাতে থাকে। “আমি গ্রামের একটা জায়গাতে কয়েকজন ভক্তের সঙ্গে বসতে যাচ্ছি। ”
“মানে, আজকে রাতে তুমি বাজাবে?”
“ঠিক ধরেছো। ” ও ওর বিয়ারে একটা চুমুক দেয় এবং জানালার কাছে ফিরে আসে। পাশ থেকে আমাকে দেখে। “তুমি যদি সহ্য করতে পারো। ”
“আমি চেষ্টা করব”—আমি বলি



ও তখন পূর্ণবয়স্ক, অবশ্যই, তবে আমি সেটা দেখতে ইচ্ছুক ছিলাম না। ও প্রায়ই বাড়ি আসত, তবে প্রতিবার দেখা হবার সময় আমাদের মাঝে ঝগড়া হতো। ওর বাঁধন ছাড়া আর সব সময় মনমরা ভাব করে থাকাটা আমার মোটেই পছন্দ হতো না আর ওর বন্ধুদের আর জীবনের প্রয়োজনে গান করাটাও আমি পছন্দ করতাম না। আমার কাছে সেটা বাঁধের মতো গোলমেলে ঠেকত।

তারপর আমাদের মাঝে ঝগড়া বাঁধে, প্রচণ্ড একটা ঝগড়া, আর তারপরের মাসগুলোতে ওর দেখা পাই না। পরে ওকে দেখতে যাই, গ্রামের যে সাজানো ভাড়া ঘরে ও থাকে, আর আমি ঝগড়াটা মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করি। কিন্তু ওই ঘরের ভেতর তখন আরো অনেক লোক ছিল আর সনি ওর বিছানায় শুয়ে ছিল আর ও আমার সঙ্গে নিচেও নামেনি, আর ও অন্য লোকগুলোর সঙ্গে এমন আচরণ করছিল যেন ওরা ওর পরিবারের লোক আর আমি ওর কেউ না। তাই আমি রেগে যাই এবং তারপর সনিও রেগে যায়, আর আমি ওকে বলি ও যেমন করে বেঁচে আছে সেটা মরে বেঁচে থাকার মতন। এরপর ও উঠে দাঁড়ায় এবং আমাকে বলে জীবনেও যাতে ওকে নিয়ে আর কোনো দুশ্চিন্তা না করি, কেননা আমার কাছে ও মরেই গেছে। তারপর ও আমাকে ধাক্কা দিয়ে দরজা দিয়ে বের করে দেয় আর অন্যেরা তখন এমনভাবে তাকিয়ে ছিল যেন কিছুই হয়নি এবং ও আমার পেছন থেকে দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। আমি দরজাটার দিকে তাকিয়ে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকি। শুনতে পাই ভেতরে কেউ একজন হাসছে তারপর আমার চোখে গড়গড় করে জল নেমে আসে। আমি ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসি, আপনা আপনি ফুঁপিয়ে গাইতে শুরু করি, আমাকে তোমার দরকার হবে, সোনা, এমন শীতল বৃষ্টিময় কোনো এক দিনে।

বসন্তে আমি সনির সমস্যাটা জানতে পারি। শরতে ছোট্ট গ্রেস মারা যায়। ও ছিল খুব সুন্দর একটা মেয়ে। কিন্তু মাত্র দুবছর বেঁচে ছিল। ও পলিওতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। দুদিন ধরে সামান্য জ্বর ছিল, তবে এর বেশি কিছু মনে হয়নি তাই আমরা ওকে বিছানায় শুইয়ে রাখি। আর আমরা ডাক্তারও ডাকতাম, তবে তার আগেই জ্বরটা পড়ে যায়, ওকে সুস্থ বলে মনে হয়। তাই আমরা ভাবি বোধহয় ঠাণ্ডা লেগেছিল। তারপর একদিন, ও উঠে, খেলতে শুরু করে। ইসাবেল ছিল রান্না ঘরে, সে দুপুরের খাবার তৈরি করছিল, যাতে দু ছেলে স্কুল থেকে ফিরেই খেতে বসতে পারে। আর তখনই সে বসার ঘরে গ্রেসের পড়ে যাবার শব্দ শুনতে পায়। যখন অনেকগুলো ছেলে মেয়ে থাকে তখন তাদের কেউ একজন পড়ে গেলে সব সময় সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে যাওয়া হয় না, যদি না তারা চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে। আর, সে সময়, গ্রেস চুপ ছিল। যদিও, ইসাবেল জানায়, সেই প্রকাণ্ড শব্দটা সে শুনেছে এবং তারপর সেই নীরবতা, ওর কিছু একটা হয়েছে এটা ভেবে সে ভীত হয়ে পড়ে। এবং সে বসার ঘরের দিকে দৌড়ে যায় আর সেখানে ছোট্ট গ্রেস উপুড় হয়ে কুঁকড়ে মেঝেতে পড়ে ছিল, আর একারণেই নিঃশ্বাস নিতে পারেনি বলে সে চেঁচাতে পারেনি। আর যখন সে চেঁচিয়ে ওঠে, শব্দটা ছিল খুবই ভয়ানক, ইসাবেল বলে, জীবনে সে এরকম চিৎকার আগে কখনো শোনেনি, আর মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখার সময় সে এরকম করে। পরে কখনো কখনো শ্বাসরুদ্ধকর মৃদু গোঙানি শুনে বহুবার আমার ঘুম ভাঙ্গে, সঙ্গে সঙ্গে আমি ওকে জাগিয়ে জড়িয়ে ধরি, ইসাবেল তখন আমাকে আঁকড়ে ধরে এমনভাবে কাঁদতে থাকে যেন প্রাণঘাতী কোনো ব্যথায় কাহিল হয়ে পড়েছে।

যেদিন ছোট্ট গ্রেসকে কবর দেই সেদিন আমার মনে হয় সনিকে খবরটা জানানো উচিত। আমি বসার ঘরে অন্ধকারে একা একা বসে ছিলাম, আর হঠাৎই আমার সনির কথা মনে পড়ে। আমার সমস্যাটা ওকে জীবন্ত করে তোলে।

একদিন রোববার বিকেলে, যখন সনি আমাদের সঙ্গে থাকত, বা, আমাদের ঘরে ছিল, প্রায় দুসপ্তাহের মতো, তখন একদিন সনির ঘরটা একটু ঘেঁটে দেখতে বসার ঘরে উদ্দেশ্যহীন পায়চারি করে ক্যান বিয়ারে চুমুক দিয়ে সাহস সঞ্চয় করে নিচ্ছিলাম। ও তখন বাইরে ছিল, আমি বাড়ি থাকার সময়টাতে ও স্বভাবতই বাইরে থাকত, আর তখন ইসাবেল বাচ্চাদের নিয়ে তাদের নানা নানুর কাছে গিয়েছে। হঠাৎ আমি বসার ঘরের জানালার সামনে স্থির দাঁড়িয়ে, সাত নম্বর অ্যাভিনিউর দিকে তাকাই। সনির ঘরটা ঘেঁটে দেখার চিন্তাটা তখনও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তখনও জানতাম না জিনিসটা খুঁজে পাবার পর আমি সেটা নিয়ে কী করব। অথবা যদি সেটা না পাই।

আমার অন্যপাশের হাঁটাপথে, বারবিকিউ জয়েন্টে প্রবেশ পথের কাছে, কয়েকজন লোক পুরাতন দিনের মতো জড়ো হয়ে আড্ডা মারছিল। বারবিকিউর বাবুর্চি, সাদা রঙের একটা নোংরা অ্যাপ্রোন পরেছিল, তার ঢলে পড়া চুলগুলো ম্লান রোদের আলোয় লালচে আর ধাতব বলে মনে হচ্ছিল, আর ঠোঁটে গুঁজে রাখাছিল একটা সিগারেট, লোকটা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তাদের দেখছিল। বাচ্চা আর কয়েকজন বুড়ো ওদের সেই জটলার মাঝদিয়ে যাতায়াত করছিল এবং পাশেই দাঁড়িয়ে থেকে কয়েকজন বৃদ্ধ আর এক জোড়া সুন্দরী মহিলা অ্যাভিনিউ জুড়ে ঘটতে থাকা চলমান সব কিছুর দিকে এমনভাবে নজর রাখছিল, যেন তারাই একে অর্জন করে নিয়েছে বা এর দ্বারা অর্জন করেছে। ভালো, তারা সেটা দেখছে। জটলার মাঝে কালো তিন বোন ও এক ভাই ছিল। তারা খঞ্জনী বাজিয়ে তাদের বাইবেল থেকে আপন মনে গাইছিল। ভাইটি সাক্ষ্য দিচ্ছিল আর দু বোন তখন একসঙ্গে উঠে দাঁড়ায়, যেন আমেন বলছে, এবং তৃতীয় বোন তার খঞ্জনীটা বাড়িয়ে ধরে হাঁটতে শুরু করে আর কয়েকজন লোক তাতে মুদ্রা ফেলে। এরপর ভাইটির সাক্ষ্য শেষ হয় এবং যে বোনটি মুদ্রা সংগ্রহ করছিল সে এসে সেগুলো জড়ো করে তার লম্বা জামাটার পকেটে চালান করে। এরপর সে খঞ্জনীটা দিয়ে বাতাসে আর অন্য হাতে আঘাত করতে করতে দুহাত তুলে ধরে, গাইতে শুরু করে। এবং বাকি দুবোন আর ভাইটি তার সঙ্গে যোগদেয়।

হঠাৎ দেখে অবাক হই, যদিও জীবনভর আমি এইসব পথসভা দেখে আসছি। অবশ্য যে কেউ সেদিকে তাকাবে সেই অবাক হবে। তবু, ওরা বিরতি দেয় এবং দেখে আর শোনে আর জানালার কাছে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। “এই হলো জিয়নের প্রাচীন জাহাজ”—ওরা গায় আর খঞ্জনী হাতে থাকা বোনটা একটানা ঝনঝন করে তাল ধরে, “এটা হাজার হাজার জনকে উদ্ধার করেছে!” সেই শব্দের আওতার মাঝে থাকা কেউই এই স্বর প্রথম শুনছে না, তাদের একজনকেও উদ্ধার করা হয়নি। এদের কেউই তাদের আশপাশে উদ্ধার কাজের খুব বেশি কিছু কখনোই দেখতে পায়নি। এদের কেউই আলাদা করে এই তিন বোন এবং ভাইয়ের পবিত্রতায় বিশ্বাস করে না, এরা সবাই ওদের সম্পর্কে অনেক বেশি জানে, জানে ওরা কোথায় থাকে, এবং কিভাবে। খঞ্জনী হাতে থাকা মেয়ে লোকটা, যার গলার স্বর বাতাসকে ছাপিয়ে যায়, যার চেহারা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে আছে, সে কাছে যে মহিলা দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে তার কাছ থেকে খানিকটা দূরে অবস্থান করে, সেই মহিলার পুরু খসখসে ঠোঁট দুটার মাঝে একটা সিগারেট আঁটা, তার চুলগুলো কোকিলের বাসার মতো, মুখটা অজস্র আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়ে ফুলে আছে, আর কালো চোখ জোড়া কয়লার মতো জ্বলজ্বল করছে। খুব সম্ভবত ওরা দুজনেই তা জানে, কেন কখন কোনটা করতে হবে, কালেভদ্রে, ওরা একে ওপরকে সম্বোধন করে, ওরা একে ওপরকে বোন বলে ডাকে। গানের স্বরে বাতাস ভরাট হয়ে এলে দেখতে থাকা, শুনতে থাকা মুখগুলোতে একটা পরিবর্তন আসে, চোখগুলো কিছু একটার দিকে তাকিয়ে থাকে; মনে হতে থাকে সঙ্গীতের গরল তাদেরকে সত্যিসত্যি প্রভাবিত করেছে; এবং সময়টাকে একেবারে গুমোট, বৈরি বলে মনে হয়, ভগ্ন মুখগুলো যেন তাদের আগের অবস্থাতে ফিরে যায়, ঠিক শেষবার যখন স্বপ্ন দেখেছিল সেই অবস্থাতে। বারবিকিউ বাবুর্চি আধো মাথা ঝাঁকায় আর হাসে তাতে করে ঠোঁটের সিগারেটটা নিচে পড়ে হারিয়ে যায়। ভাংতির জন্য আসা একটা লোক তার পকেট হাতড়ায় এবং নোটটা হাতে ধরে ব্যগ্রতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, যেন অ্যাভিনিউর কোথাও কারো সঙ্গে দেখা করার কথা মনে পড়ল। তাকে অনেকটাই ক্ষিপ্ত বলে মনে হয়। এরপর আমি সনিকে দেখতে পাই, ভিড়ের একেবারে কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার হাতে বড় একটা সবুজ রঙের নোটবুক, আর তাতেই সে আমার নজর কাড়তে সক্ষম হয়, আমি যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে ওকে দেখতে একেবারে একটা স্কুলছাত্র বলে মনে হচ্ছিল। তামাটে সূর্যটা ওর ত্বকে একটা তামাটে আভা এনে দিয়েছিল, স্থির দাঁড়িয়ে থেকে ও খুব মৃদু করে হাসছিল। তারপর গানটা থামে, খঞ্জনীটা আবারও মুদ্রা সংগ্রহের থালায় পরিণত হয়। ক্ষেপাটে লোকটা তাতে একটা মুদ্রা ফেলে মিলিয়ে যায়, সেই মহিলা দুজনও, আর সনি মৃদু হেসে মেয়ে লোকটার দিকে সরাসরি তাকিয়ে, সেই থালা থেকে ভাংতি পয়সা তুলে নেয়। সে সড়ক পেরিয়ে বাড়ির দিকে এগোতে থাকে। খুব ধীর পায়ে হাঁটে, ঠিক হারলেমের আধুনিক লোকেদের মতো, কেবল ওর আগের আধো-হতবুদ্ধি ভাবটা তখনও রয়েছে। আগে সেটা কখনোই আমার চোখে পড়েনি।

আমি স্বস্তি আর উৎকণ্ঠা এই দুটা জিনিস এক সঙ্গে মনের মাঝে পুষে, জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকি। সনি আমার দৃষ্টির আড়াল হবার সঙ্গে সঙ্গে ওরা আবারও গেয়ে ওঠে। এবং যখন ওর চাবিটা তালা খুলে তখনও ওরা গাইছিল।
“এই”—ও বলে।
“এই”—তোমাকে বলছি। তুমি কি বিয়ার চাও?”
“না। ঠিক আছে, চাইলে দিতে পারো। ” কিন্তু ও জানালার কাছে এসে আমার পেছনে দাঁড়িয়ে, বাইরে তাকায়। “কী গরম স্বর”—ও বলে।
ওরা তখন গাইছিল—যদি শুনতে পেতাম আমার মা আবারও প্রার্থনা করছে!
“হ্যাঁ”—আমি বলি, “এবং সে ওই খঞ্জনীটা বাজাচ্ছে। ”
“কিন্তু গানটা কী ভয়ানক”—ও বলে, হেসে ওঠে। সোফাতে নোটবুকটা রেখে রান্না ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে।
“ইসাবেল আর বাচ্চারা সব কোথায় ?”
“মনে হয় নানা নানুকে দেখতে গেছে। তোমার ক্ষুধা লেগেছে?”
“না। ” বিয়ারের ক্যান হাতে ও বসার ঘরে ফিরে আসে। “তুমি কি আজকে রাতে আমার সঙ্গে কোথাও যেতে চাও?”
বুঝতে পারছিলাম না কিভাবে বলব, সম্ভবত তাই আর না বলা হয়ে ওঠে না।
“অবশ্যই, কোথায়?”
ও সোফায় বসে নোটবুকটা নিয়ে পাতা উল্টাতে থাকে। “আমি গ্রামের একটা জায়গাতে কয়েকজন ভক্তের সঙ্গে বসতে যাচ্ছি। ”
“মানে, আজকে রাতে তুমি বাজাবে?”
“ঠিক ধরেছো। ” ও ওর বিয়ারে একটা চুমুক দেয় এবং জানালার কাছে ফিরে আসে। পাশ থেকে আমাকে দেখে। “তুমি যদি সহ্য করতে পারো। ”
“আমি চেষ্টা করব”—আমি বলি।

ষষ্ঠ কিস্তি পড়তে ক্লিক করুন



বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ৮, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।