কুহোবাসের গল্প নরমা আমাকে আগেই বলেছিল। নরমা মুয়াম্বাজি।
এফিক সম্প্রদায়ের বাস নাইজেরিয়া এবং ক্যামেরুনে। দক্ষিণ নাইজেরিয়ার একটি প্রদেশ ক্রস রিভার, যার রাজধানী কালাবার। কালাবারই হচ্ছে এফিক সম্প্রদায়ের মূল আবাসভূমি। এফিক ভাষায়, আকোয়া আকপা, এটিই কালাবারের আদি নাম। ওবান পর্বতে জন্ম নেয়া কোয়া ফলস থেকেই তৈরি হয় খরস্রোতা কোয়া নদী। এই নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করাই ছিল এফিকদের আদি পেশা। অর্থাৎ এফিকরা ছিল মূলত কৈবর্ত জাতি। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীতে যখন ইউরোপীয়রা পশ্চিম আফ্রিকায় দাস সংগ্রহের জন্য আসে তখন তাদের সাথে হাত মেলায় এফিকরা, হয়ে ওঠে দাস ব্যবসার মধ্যস্থতাকারী। কালক্রমে ইউরোপীয় ভাষা এবং তাদের আচার আচরণ এফিকরাই রপ্ত করে সকলের আগে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কিছু আদি সংস্কৃতি আজো পালন করে এফিক সম্প্রদায়ের মানুষেরা। সেগুলোরই একটি কুহোবাস।
এফিকরা বিশ্বাস করে যে মেয়ের কোমর যত মোটা সেই মেয়ে তত বেশি সুন্দরী। বিষয়টি এফিকদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওদের সংস্কৃতি এবং জীবনব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রথা হলো মেয়েদের ‘কোমর মোটাকরণ’ প্রক্রিয়া। প্রতিটি মেয়েকেই ‘কোমর মোটাকরণ’ পর্বটি পালন করতে হয়। ঋতুবতী হওয়ার পর থেকে বিয়ের আগ পর্যন্ত যেকোন এক সময়ে এটি করতে হয়।
এফিকরা ছিল মূলত কৈবর্ত জাতি। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীতে যখন ইউরোপীয়রা পশ্চিম আফ্রিকায় দাস সংগ্রহের জন্য আসে তখন তাদের সাথে হাত মেলায় এফিকরা, হয়ে ওঠে দাস ব্যবসার মধ্যস্থতাকারী। কালক্রমে ইউরোপীয় ভাষা এবং তাদের আচার আচরণ এফিকরাই রপ্ত করে সকলের আগে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কিছু আদি সংস্কৃতি আজো পালন করে এফিক সম্প্রদায়ের মানুষেরা। সেগুলোরই একটি কুহোবাস
প্রথাগত কোমর মোটাকরণ প্রক্রিয়ার জন্য রয়েছে কোমর মোটাকরণ গৃহ। এফিক ভাষায় এই ঘরকে বলা হয় কুহো। আধুনিক এফিক মেয়েরা এই পর্বটি পালন করে বিয়ের আগে আগে। কেউ কেউ করে বিয়ের কথা পাকা হয়ে যাওয়ার পরে। কুহোতে কনের দেখাশোনা করেন বাড়ির বয়স্কা এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বৈবাহিক জীবনে সফল নারীরা। এ সময়ে কনেকে বাইরের কারো সাথে দেখা করতে দেওয়া হয় না। শুধু তাই নয়, এ সময়ে কুহোর বাইরে বের হওয়াও নিষেধ। কুহোবাসকাল ছয় মাস থেকে এক বছর, কখনো কখনো তিন বছরেও গড়ায়। তবে আধুনিক এফিক মেয়েরা এটিকে ছয় সপ্তাহে নামিয়ে এনেছেন। ইউরোপ, আমেরিকায় শিক্ষিতা অতি আধুনিক এফিক মেয়েকেও ‘কুহোবাস’ পালন করতে দেখা যায়। একজন এফিক মেয়ের জীবনের এই সময়টাকে ‘বিচ্ছিন্নকাল’ও বলা হয়।
এ সময়ে কুহোবাসিনীকে সংক্ষিপ্ত মসৃণ এবং স্বচ্ছ পোশাক পরানো হয়। প্রতিদিন দিবালোকে কুহোবাসিনীর শরীর ম্যাসাজ করা হয়। তিনবেলা প্রচুর খাবার খেতে দেওয়া হয়। এসব খাবারের মধ্যে প্রথাগতভাবে প্লান্টেইন (আফ্রিকার বিশেষ কলা), কাসাবা, সুজি জাতীয় খাবার এবং সাথে মরিচের ঝোল থাকে। আধুনিককালে বিভিন্ন ধরনের কার্বোহাইড্রেড এবং প্রোটিন যুক্ত হয়েছে। খাওয়া, ম্যাসাজ নেওয়া এবং সুনির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ গ্রহণ ছাড়া বাকি সময়টা কুহোবাসিনীকে বাধ্যতামূলকভাবে ঘুমিয়ে কাটাতে হয়।
কুহোতে কনেকে গৃহস্থালি কাজ-কর্মও শেখানো হয়। যেমন, রান্না করা, সন্তান পালন করা, স্বামীর যত্ন করা ইত্যাদি। স্বামীর যৌনচাহিদা মেটাতে সক্ষম হওয়া, তাকে সুখী করা এবং সুখী রাখার যাবতীয় কলাকৌশলও শেখানো হয়। সাধারণত সুখী পরিবারের বয়স্কা নারীরা তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে কুহোবাসিনীকে এই শিক্ষা দেন। প্রত্যেকেই তাদের জীবনের সফলতার গল্পগুলো পালাক্রমে তুলে ধরেন। এখন অবশ্য অনেক পেশাগত কুহো প্রশিক্ষক তৈরি হয়েছে যারা কুহোবাসকালের মধ্যে ৩ বা ৫ দিনের একটি নিয়মতান্ত্রিক এবং পেশাগত প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। কুহোবাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণ হলো সম্প্রদায়ের প্রথাগত আচার-আচরণ এবং নাচ-গান শেখা। এফিক সম্প্রদায়ের প্রধান নৃত্য ইকোম্বি শেখার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ত্রুটি যেন না থাকে তা কুহোবাসকালেই নিশ্চিত করা হয়। কালাবাসের (শুকনো লাউ বা কুমড়োর মতো ফল) ওপর কারুকর্ম করা এফিকদের প্রথা। এই কাজ প্রতিটি এফিক মেয়েকেই শিখতে হয়। কুহোবাসের সময় এটিও নিখুঁতভাবে শিখতে হয়। মোটকথা একটি মেয়ে কুহোবাসের মধ্য দিয়ে হয়ে ওঠে একজন পরিপূর্ণ এফিক নারী, যৌবনবতী এবং আবেদনময়ী। শেষের ক’সপ্তাহ খাওয়া-দাওয়া এবং ঘুমের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
প্রতিদিন দিবালোকে কুহোবাসিনীর শরীর ম্যাসাজ করা হয়। তিনবেলা প্রচুর খাবার খেতে দেওয়া হয়। এসব খাবারের মধ্যে প্রথাগতভাবে প্লান্টেইন (আফ্রিকার বিশেষ কলা), কাসাবা, সুজি জাতীয় খাবার এবং সাথে মরিচের ঝোল থাকে। আধুনিককালে বিভিন্ন ধরনের কার্বোহাইড্রেড এবং প্রোটিন যুক্ত হয়েছে। খাওয়া, ম্যাসাজ নেওয়া এবং সুনির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ গ্রহণ ছাড়া বাকি সময়টা কুহোবাসিনীকে বাধ্যতামূলকভাবে ঘুমিয়ে কাটাতে হয়
কুহো থেকে যেদিন মেয়েটি বেরিয়ে আসে সেটা উৎসবের দিন। সামর্থ অনুযায়ী মেয়ের পরিবার গ্রামের বা সম্প্রদায়ের লোকজনকে দাওয়াত করে। উৎসব শুরু হয় বিকেল থেকে, চলে সমস্ত রাত। প্রচুর খাওয়া-দাওয়া এবং মদ্যপান করা হয়। প্রথাগত বাজনা এবং ইকোম্বি নৃত্য চলে সমস্ত রাত। প্রতিবেশি, বন্ধু, আত্মীয়েরা কুহোত্তীর্ণ মেয়ের জন্য নানান রকম উপহার সামগ্রী নিয়ে আসে। গান-বাজনার ফাঁকে ফাঁকে সেইসব উপহার সামগ্রী প্রদর্শন করা হয় এবং উপহার প্রদানকারীর নাম ঘোষণা করা হয়। তখন সমবেত হর্ষধ্বনি ও করতালিতে ফেটে পড়ে মজলিশ।
সবশেষে মেয়েটি তার হবু স্বামীকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায় এবং যুগল নৃত্য করে। উপস্থিত অতিথিরা তখন উঠে দাঁড়ায়, করতালি দেয় এবং ওদের নতুন জীবনকে স্বাগত জানায়। এরপর ঢোল-বাদ্য আরো জোরে জোরে বাজতে থাকে এবং সকলে একসঙ্গে নাচতে থাকে। এভাবেই এফিক সম্প্রদায়ের মেয়েদের কুহোবাস সম্পন্ন হয়।
জাতিসংঘ দিবসে প্রতিবছরই আমরা সুন্দরী নির্বাচনের একটি অনুষ্ঠান করি। এ বছরের সেরা সুন্দরী নির্বাচিত হয়েছেন নরমা মুয়াম্বাজি। নরমা যখন ওর সুবিশাল নিতম্বখানি ভূমিকম্পের মতো কাঁপাচ্ছিল, বলতে দ্বিধা নেই ওর দুইমণি শরীর আমাদের চোখে যেমনই লাগুক না কেন ওর অসাধারণ শৈল্পিক নিতম্বের কাঁপনে আমরা সবাই মুগ্ধ। এ শিল্পকর্ম প্রদর্শনের দক্ষতা কেবল আফ্রিকীয় নারীরই জানা, আর কারো পক্ষে তা সম্ভব নয়। নরমা যখন ওর নিতম্বে পামপাতার অভূতপূর্ব বিরামহীন কাঁপন তুলে হাস্যোজ্জ্বল দাঁতের ঝিলিক দেখাচ্ছিল বিচারকদের আমার তখন কেবলি মনে হচ্ছিল ওই তো এফিক দেবী আতাই মহান ঈশ্বর আবাসির কৃপা প্রার্থনায় নিজেকে সমর্পণের জন্যে তৈরি। উল্লেখ্য, নিতম্বে কাঁপন তুলে আফ্রিকান এই নৃত্যকে সৌন্দর্য প্রদর্শনের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
নরমা মুয়াম্বাজি ক্রেস্ট হাতে নিয়ে আরো একবার দর্শকদের উদ্দেশে নিতম্বে ঝড় তুলল। আমি খানিকটা গর্ব অনুভব করছিলাম এই ভেবে যে এই মেয়েটি শুধু আমার সহকর্মীই নয়, একজন ভালো বন্ধুও। মনে মনে সেই চেনা রবীন্দ্রসঙ্গীতটি একটু বদলে দিয়ে গাইতে শুরু করলাম, আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো কুহোবাসিনী।
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ৮, ২০১৫