প্রতিটি মানুষেরই বলার উপযোগী নিজস্ব একটি গল্প থাকে, এর পাশাপাশি সমষ্টিগতভাবে তারা একটি দেশের যৌথ ইতিহাসের কথ্য রূপের ধারক ও বাহক। সম্প্রতি সাহিত্যে নোবেল জয়ী বেলারুশের লেখক সভেৎলেনা আলেক্সিয়েভিচ তার লেখা প্রতিটি বইতে এমনই পাঁচ থেকে সাতশ’ ব্যক্তিত্বের জবানবন্দী বা বক্তব্য তুলে ধরেছেন।
সাহিত্যে সবশেষ এই নোবেল বিজয়ী লেখক আরো বলেন, “টানা বিশ বছর প্রামাণিক উপাদান নিয়ে কাজ করা এবং এসবের ওপর ভিত্তি করে পাঁচটি বই রচনার পর আমি সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করি যে শিল্প মানুষের অনেক কিছুই অনুধাবনে অক্ষম। ” কিন্তু তার কালজয়ী সৃষ্টি সেই ‘উপন্যাসের কণ্ঠস্বরে’ তার বাস্তব আর অনুভূতির বর্ণনা সর্বতভাবেই শিল্প হয়ে উঠেতে পেরেছে। ডালকেই আর্কাইভ প্রেস ২০০৫ সালে তার ‘ভয়েস ফ্রম চেরেনবিল’ উপন্যাসটি ছাপে, এটা ছিল আলেক্সিয়েভিচের পঞ্চম, এবং ইংরেজিতে অনূদিত দ্বিতীয় বই। তার আর কোনো বই-ই এভাবে যুগপৎ ইংরেজিতে অনুদিত হয়নি।
আমি এমন এক সাহিত্য পদ্ধতির অনুসন্ধান করছিলাম যা সম্ভাব্য জীবন ঘনিষ্ঠ বাস্তব ছবি তুলে ধরতে সক্ষম। বাস্তবতা সব সময়ই আমাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করেছে, এটা আমাকে পীড়ন দিয়েছে এবং সম্মোহিত করে রেখেছে। সেই অভিজ্ঞতাকেই আমি কাগজে বন্দী করে রাখতে চেয়েছি। আর তাই আমি মানুষের সত্যিকার কণ্ঠস্বর এবং স্বীকারোক্তি, প্রামাণ্য সাক্ষ্য এবং নথি তুলে ধরার উপযোগী মাধ্যম হিসেবে সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যের এই ধরনটিকে যথোচিত বলে মনে করেছি। ব্যক্তিক কোরাস এবং প্রতিদিনকার খুঁটিনাটি চিত্রের মাধ্যমে—এভাবেই আমি আমার চারপাশের বিশ্বকে দেখতে এবং শুনতে অভ্যস্ত। এভাবেই আমার চোখ এবং কান কাজ করে। এভাবেই আমার মানসিক এবং আবেগী সম্ভাব্যতা সম্পূর্ণকে অনুধাবন করতে পারে। এভাবেই আমি একাধারে একজন লেখক, প্রতিবেদক, সমাজবিদ, মনস্তাত্ত্বিক এবং প্রচারক হয়ে উঠতে পেরেছি
উপসংহারহীন বৃত্তান্ত আর প্রতিবেদনের মিশেল আলেক্সিয়েভিচের এমন কাজের সঙ্গে প্রথম পরিচিত হলেও, কেন ‘ভয়েস ফ্রম চেরেনবিল’ খোদ আমেরিকার মাটিতেই তিনি ছাপাতে রাজি হলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে, বর্তমানে ওপেন লেটার বুক-এর প্রকাশক তৎকালীন ডালকেই-এর সহযোগী পরিচালক চাদ পোস্ট বলেন, “আমরা কেন বলতে পারি না, আমি আর দাস হতে চাই না?” ২০১৩ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন: কেন আমরা বারবার দুর্ভোগ পোহাব? কেন এটা আমাদের বোঝা আর নিয়তি হয়ে থাকবে?... আমার কাছে এর কোনো জবাব নেই, তবে আমি চাই আমার বই পাঠকদের তাদের নিজের মতো করে এই সব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে অনুপ্রেরণা যোগাক। ”
বিগত ত্রিশ বা চল্লিশ বছর সভেৎলেনা সোভিয়েত এবং সোভিয়েত পরবর্তী লোকেদের মানসচিত্র নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তবে তা ঘটনা নির্ভর কোনো ইতিহাস নয়। এ হলো আবেগের এক ইতিহাস। তিনি সত্যিকার অর্থেই আমাদের সামনে এক আবেগী জগৎ এনে উপস্থিত করেছেন। আর এইসব ঐতিহাসিক ঘটনাবলিকেই তিনি তার বিভিন্ন বইতে তুলে ধরেছেন—উদাহরণ হিসেবে চেরেনবিল দুর্যোগ, এবং আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের কথা বলা যেতে পারে—এসব ঘটনাক্রম, বিভিন্নভাবে, সোভিয়েত এবং সোভিয়েত পরবর্তী ব্যক্তিসাতন্ত্র্যের স্বরূপ উদঘাটনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তিনি এই উদ্দেশ্যে নারী, শিশু এবং পুরুষ মিলিয়ে হাজার খানেক লোকের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন, এবং এভাবে তিনি আমাদের সামনে সম্পূর্ণ অজানা এক মানব ইতিহাসের দ্বার উন্মোচন করেছেন।
নিজস্ব ব্লগের মাধ্যমে আলেক্সিয়েভিচ জানিয়েছেন বেলারুশিয়ান লেখক এলেস এডামোভিচ-এর অনুপ্রেরণায় তিনি তার এই কণ্ঠস্বর প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। উল্লেখ্য, বেলারুশিয়ান এই লেখক—এলেস এমন এক সাহিত্য প্রকারের উদ্ভাবক যিনি তার এই প্রকরণকে একাধারে ‘যৌথ উপন্যাস’, ‘একক ও সমবেত উপন্যাস’, ‘সাক্ষ্য-উপন্যাস’, ‘লোকেদের নিজেদের কথা’, এবং ‘এপিক কোরাস’ নামে অবিহিত করেছেন।
এক সাক্ষাৎকারে সভেৎলেনা বলেন, “আমি এমন এক সাহিত্য পদ্ধতির অনুসন্ধান করছিলাম যা সম্ভাব্য জীবন ঘনিষ্ঠ বাস্তব ছবি তুলে ধরতে সক্ষম। বাস্তবতা সব সময়ই আমাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করেছে, এটা আমাকে পীড়ন দিয়েছে এবং সম্মোহিত করে রেখেছে। সেই অভিজ্ঞতাকেই আমি কাগজে বন্দী করে রাখতে চেয়েছি। আর তাই আমি মানুষের সত্যিকার কণ্ঠস্বর এবং স্বীকারোক্তি, প্রামাণ্য সাক্ষ্য এবং নথি তুলে ধরার উপযোগী মাধ্যম হিসেবে সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যের এই ধরনটিকে যথোচিত বলে মনে করেছি। ব্যক্তিক কোরাস এবং প্রতিদিনকার খুঁটিনাটি চিত্রের মাধ্যমে—এভাবেই আমি আমার চারপাশের বিশ্বকে দেখতে এবং শুনতে অভ্যস্ত। এভাবেই আমার চোখ এবং কান কাজ করে। এভাবেই আমার মানসিক এবং আবেগী সম্ভাব্যতা সম্পূর্ণকে অনুধাবন করতে পারে। এভাবেই আমি একাধারে একজন লেখক, প্রতিবেদক, সমাজবিদ, মনস্তাত্ত্বিক এবং প্রচারক হয়ে উঠতে পেরেছি। ”
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণকারী পদাতিক, স্নাইপার, ডাক্তার এবং নার্সসহ বিভিন্ন ভূমিকায় অবতীর্ণ লাখ লাখ রাশিয়ান নারীর মাঝ থেকে আলেক্সিয়েভিচ শ’খানেক মহিলার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন। তার বই সম্পর্কে বিবৃতির এক জায়গাতে বলা হয়েছে: “নারীদের সম্পর্কে আমরা যতটুকু জানি তা কেবল ‘করুণা বা সমবেদনা’ এই একটি শব্দেই সবচেয়ে ভালোভাবে তুলে ধরা সম্ভব। বোন, স্ত্রী, বন্ধু, সবচেয়ে মধুর মা-সহ অন্যান্য আরো কিছু শব্দও রয়েছে। কিন্তু এর সবগুলো ধারণার সঙ্গে, তাদের উপাদানের সঙ্গে, তাদের উদ্দেশ্যের সঙ্গে এবং তাদের চূড়ান্ত অর্থবহতার মাঝে কি এই করুণা শব্দটি সমানভাবে জড়িয়ে নেই? একজন নারী হলো জীবনদাত্রী, একধারে তিনি এর রক্ষাকবচও, তাই ‘নারী’ এবং ‘জীবন’ এই দুই-ই সমার্থক। ”
জিঙ্কি বয়েজ: হারানো সোভিয়েত প্রজন্মের এক বিবরণ (১৯৯২)
উপন্যাসটির শিরোনাম বেছে নেয়া হয় তখনকার বহুল আলোচিত এবং নজরকাড়া বিশেষ একটি উপাদান থেকে। আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন চলাকালীন সোভিয়েত পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিতে যাওয়া নিহত মৃত যুবকদের লাশ সব সময় জিঙ্কের কফিনে করে দেশে ফেরত আনা হতো। বইটির ইংরেজি অনুবাদক জুলিয়া আর. রবিন হুইটবাই-এর ভাষায়, “যে সকল নর-নারী এখানে তাদের চিন্তা-চেতনা আর অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন তার কোনো ভূমিকার প্রয়োজন নেই—তারা নিজেদেরই কথা বলেছেন। বেশ কয়েক জনের বিভ্রান্তি এবং মতানৈক্য সমূহের মাঝে খুব সততার সঙ্গে অন্যদের অন্তর্দৃষ্টিও প্রকাশ পেয়েছে। তবু তাদের কথা শুনতে গেলে আমাদের সব সময় মনে রাখা উচিত সোভিয়েত জীবনের নির্দিষ্ট সেই দিকটির হুবহু সমান্তরাল কিছু পশ্চিমে একেবারেই অনুপস্থিত। ” আর লন্ডন রিভিউ অব বুকসকে জন লয়েড বলেন, “কখনো কখনো পড়ে সেই দুঃখ অনুধাবন সম্ভব নয়। ”
ভয়েস ফ্রম চেরেনোবিল: পারমাণবিক দুর্যোগের মৌখিক ইতিহাস (২০০৬)
২৬ এপ্রিল ১৯৮৬, চেরেনবিল পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রের বেশ কয়েকটি রিয়েক্টরে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে বিশ্বকে নজিরবিহীন এক পারমাণবিক দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হয়। সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ তেজস্ক্রিয় ধ্বংসযজ্ঞের মাঝে হাজার খানেক অদক্ষ লোক প্রেরণ করে। এই বইতে, আলেক্সিয়েভিচ মানব সৃষ্ট এই বিপর্যয়ের প্রত্যক্ষদর্শী ফায়ারফাইটার, পরিচ্ছন্নকর্মী দলের সদস্য, রাজনীতিক, চিকিৎসক, পদার্থবিদ এবং দশবছর বয়সের বেশি সাধারণ নাগরিকসহ পাঁচ শ’র বেশি লোকের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন।
ওয়ার’স আনওমেনলি ফেইস (১৯৮৫)
আলেক্সিয়েভিচের লেখা পাঠকদের কাছে প্রায় অপরিচিত, তাই সুইডিশ একাডেমির স্থায়ী সচিব সারা ডেনিয়াস পুরস্কার ঘোষণা কালে পাঠকদের তাঁর উপন্যাস ওয়ার’স আনওমেনলি ফেইস পড়ার পরামর্শ দেন। উপন্যাসটি ১৯৮৫ সালে প্রথম ছাপা হয় এবং ইংরেজিতে পাওয়া যায় ১৯৮৮ সাল থেকে। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা শ’খানেক সোভিয়েত নারীর সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে রচিত। ডেনিয়াস একে এক অজানা ইতিহাস বলে উল্লেখ করেন। যা পাঠককে তখনকার প্রতিটি ব্যক্তিত্বের কাছাকাছি পৌঁছে দিতে সক্ষম। কালজয়ী এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে আলেক্সিয়েভিচ তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা এইসব নারী-কণ্ঠকে অমর করে তুলেছেন, যারা এর পরের কয়েক বছরের মধ্যেই চিরতরে পৃথিবী তথা আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেছেন।
ভয়েস অব ইউটোপিয়া: ওয়ার’স আনওমেনলি ফেইস (১৯৯৭)
‘ভয়েস অব ইউটোপিয়া’ নামে পরিচিত ওয়ার’স আনওমেনলি ফেইস উপন্যাসটি আলেক্সিয়েভিচের সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ। এতে তিনি ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির পরম্পরায় সোভিয়েত ইউনিয়নকে চিত্রিত করবার চেষ্টা করেছেন। পরবর্তীতে তিনি তার লেখায় বৈপ্লবিক ঐতিহাসিক প্রণালীর প্রয়োগ ঘটিয়েছেন, ‘ভয়েস ফ্রম চেরেনবিল’ উপন্যাসে। প্রথম প্রকাশের একই বছর, ১৯৯৭ সালে এর ইংরেজি সংস্করণও বাজারে আসে। ১৯৯০ সালে ছাপা হওয়া এবং ১৯৯২ সালে ইংরেজিতে অনূদিত, আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের ওপর লেখা উপন্যাস ‘জিঙ্কি বয়েস’ও একই ধাঁচের সাহিত্য ধারায় রচিত।
বেলারুশিয়ান এই লেখক, ঔপন্যাসিক সভেৎলেনা আলেক্সিয়েভিচ তার এই অনন্য লেখনীর জন্য সম্প্রতি ২০১৫ এর সাহিত্যে নোবেল জিতেন। বৃহস্পতিবার স্টকহোমে স্থানীয় সময় বেলা একটায় এই পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। চেরেনোবিল পারমানবিক দুর্যোগের ঘটনাক্রম সাহিত্য কর্মে তুলে ধরা এবং বহুস্বরিক লেখনীর জন্য বিশেষভাবে আলোচিত এই লেখক সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী চৌদ্দতম নারী। সুইডিশ একাডেমির স্থায়ী সচিব সারা ডেনিয়াস পুরস্কার ঘোষণার সময় বলেন আলেক্সিয়েভিচ তার “বর্তমান সময়ের দুর্ভোগ এবং সাহসিকতাকে তার বহুস্বরিক লেখার মাধ্যমে চিত্রিত করবার কারণে এই পুরস্কারের জন্য বাছাই হয়েছেন। ”
ডেনিয়াসের কথায় এ বছর সাহিত্যের নতুন প্রকরণ বা ধারণা ‘ওয়াইডেনড’ ধাঁচ-এর জন্য এই পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। আলেক্সিয়েভিচের মতে তিনি নতুন ধারার এই সাহিত্য প্রকার প্রচলনের মুনশিয়ানা অর্জনের ক্ষেত্রে কেবল এর উপাদনই নয় ফর্মেরও পরিবর্তন সাধন করেছেন। সোভিয়েত ব্যক্তিসাতন্ত্র্যকে জানতে সেখানকার হাজার হাজার মহিলা, সেই সঙ্গে পুরুষ এবং শিশুর সঙ্গে কথা বলেছেন, সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। তিনি তার লেখার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের আবেগের এক ইতিহাস রচনা করেছেন, একাধারে তাদের আত্মারও অনন্য এক ইতিহাস তুলে ধরেছেন।
সভেৎলেনা আলেক্সিয়েভিচ ১৯৪৮ সালে ইউক্রেনের ইভানো-ফ্রাঙ্কিভস্ক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার মা একজন ইউক্রেনিয়ান এবং বাবা বেলারুশ। সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেবার পর পরিবারটি বেলারুশে স্থানান্তরিত হয়; সভেৎলেনা পড়ালেখার পাট চুকাবার আগেই একজন শিক্ষক এবং সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন।
বরাবরের মতো সোভিয়েত এবং বেলারুশিয়ান জান্তার প্রতি সমালোচনায় মুখর থাকায়, আলেক্সিয়েভিচকে বারবার দেশ ত্যাগ করে ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি এবং সুইডেনসহ ইউরোপের দেশে আশ্রয়ের আশায় দেশান্তরী অবস্থায় ছুটে বেড়াতে হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০১৫