পর্ব ১৩ পড়তে ক্লিক করুন
ডাক বাংলোতে বিলাতি মেম |
১৮৪০ সালের দিকে বিলাতিরা ভারতে ডাক বাংলোর গোড়াপত্তন করে। বিলেত থেকে আসা সাহেব এবং মেমরা যেন ভারতের বিভিন্ন শহরে নির্বিঘ্নে ঘোরাফেরা ও আরাম আয়েশের সাথে জীবন যাপন করতে পারে—সেজন্য ডাক বাংলো প্রতিষ্ঠা করা জরুরি ছিল।
প্রতিটি ইউরোপিয়ান নারীর সেবা শুশ্রূষার জন্য হাতে টাওয়েল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত ভারতীয় আয়া। মেরি ফ্রান্সিস নামের এক বিলাতি নারী—পেশায় সাংবাদিক, তিনি ঊনিশ শতকের শেষের দিকে ভারতে অবস্থান করছিলেন। তার বর্ণনায় রেলভ্রমণে খাবারের একটি ফর্দ পাওয়া যায়। তিনি জানাচ্ছেন, “শক্ত খাসির মাংসের চপ, ডিম এবং অতিরিক্ত লবণ দেওয়া শুয়োরের মাংস এবং কারি নামে কিছু বুড়া মুরগির হাড্ডি
আগত বিলাতি নারীদের তুষ্ট করতে কী ছিল সেসব ডাক বাংলোতে? ভারতীয় চাকর-বাকর, যুঁত করে বসার কিছু সৌখিন চেয়ার টেবিল, পরিপাটি একটি বসার ঘর এবং ঘুমানোর জন্যে নরম তুলতুলে বিছানা। প্রতিটি বাংলোতেই রান্নার জন্য ছিল পাচক এবং সেইসাথে বেশ বড়সড় একটা রসুই ঘর। যথেষ্ট পরিমাণ পানীয় থাকাটাও ছিল জরুরি—বিলাতি মেম বলে কথা! তাদের সেবা-শুশ্রূষার জন্য ছিল বিশেষ ব্যবস্থা। সেদিক থেকে গোটা ভারতে জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ডাক বাংলোর চাহিদা ছিল অপরিসীম। ১৮৭০ সালে অ্যাডওয়ার্ড লিয়ার নামের এক ইংরেজ ভদ্রলোক ভারতভ্রমণে এসে বলেন, “সুখ এবং প্রশান্তি বলতে যা আছে তা সম্ভবত ভারতের এই ডাক বাংলোতেই নিহিত। ” (The Raj on the move: story of dak bunglow, Rajika Bhandari)
শহর কিংবা প্রত্যন্ত অঞ্চল—সর্বত্রই ডাক বাংলোর দেখা পাওয়া যায়। মূলত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এই বাংলোগুলো তৈরি করা হতো, যেখানে সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, সেনা কর্মকর্তাগণ সাময়িক বিশ্রাম এবং আরামের জন্য অবস্থান করতেন। প্রতিটি বাংলোতে চাকরদের জন্য ছিল বাংলোর বাইরে নির্মিত আলাদা কক্ষ। বাংলোর সামনে থাকত বাহারি ফুলের বাগান। ভারতে সেই সময় দু ধরনের ডাক বাংলোর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যেত। প্রথমটি ছিল শহর কেন্দ্রিক। শহরের ডাক বাংলোগুলো ‘গেস্ট হাউস’ হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিল। আর দ্বিতীয় সারির ডাক বাংলোগুলো ছিল শহরের বাইরে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে। বিলাতিরা যাতে তাদের যাত্রাপথে কোনো ধরনের ঝামেলায় না পড়ে সে কারণে প্রতিটি রেলস্টেশন এবং উপশহরে ডাক বাংলোর ব্যবস্থা ছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিলাতি মেমদের জন্যে এসব ডাক বাংলোর উদার ব্যবহার করা ছিল খুবই জরুরি একটি বিষয়।
তবে এ কথা ঠিক যে, ডাক বাংলোতে আপাত সুখে বসবাস করা গেলেও ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে ভারতের যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল খুবই নীচুমানের। গোটা ভারতের মূল যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল নৌকা, স্টিমার এবং রেল কেন্দ্রিক। শহরের রাস্তায় ছিল ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়ি, টানা গাড়ি আর গ্রামের পথে ছিল পালকি, গরুর গাড়ি ও নৌকা। বলার অপেক্ষা রাখে না, সেই সময়ের যাত্রাপথ এত মসৃণ বা সহজ ছিল না। নদী ছিল উত্তাল আর অশান্ত, রাস্তাঘাট ছিল এবড়ো-থেবড়ো আর খানা খন্দে ভরপুর। সবরকম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের মানুষদের পাশাপাশি সাহেবরাও পিছিয়ে ছিল না। প্রকৃতির বেসামাল চরিত্রকে সামাল দেওয়ায় তখনকার বিলাতি নারীরাই বা কম কিসে? ১৮৩৭ সালে হনোরিয়া লরেন্স ভারতে এসেছিলেন স্বামীর সাথে পাকাপাকিভাবে বসবাস করতে। তিনি এবং তার স্বামী হেনরি লরেন্স কিভাবে নৌকায় চড়ে কলকাতা থেকে সুদূর উত্তর ভারতের শহর গোরাকপুরে গিয়েছিলেন সেই অভিজ্ঞতার কথা আমরা তার বর্ণনা থেকে জানতে পারি। তার বর্ণনা অনুযায়ী নৌকাটি ছিল লম্বায় ৫৫ ফুট। নৌকার দু মাথায় দুটো বড় বড় মাস্তুল। বাতাসের ভরসা না করে সেইসাথে রয়েছে ১৬টি বৈঠা। হনোরিয়া এবং তার স্বামীর জন্য ছিল নৌকার ছাদে নির্মিত বড় বড় দুটো কেবিন। নৌকার নিচে পাটাতনে ছিল মাঝি এবং চাকর-বাকরদের গাদাগাদি করে থাকার ব্যবস্থা। পেছনের দিকে ছিল রান্নাঘর যেখান থেকে কিছুক্ষণ পরপর মেম সাহেবদের মনোরঞ্জনের জন্যে চা-বিস্কিটসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার সরবরাহ করা হতো। তবে সব বিলাতি নারীরাই যে হনোরিয়ার মতো ভাগ্যবতী ছিল তা বলা যায় না। ১৮৩০ সালে মিসেস পোস্টান বোম্বের এক বিলাতি সামরিক কর্মকর্তাকে বিয়ে করে ভারতে এসেছিলেন। উত্তর ভারতে স্থানীয় একটি ছোট নৌকায় চড়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা তার হয়েছিল। তার বর্ণনায় সেটা ছিল “নোংরা এবং দুর্গন্ধময়। ”
ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ্বে ভারতে বাষ্পচালিত জাহাজ এবং রেল যোগাযোগের কল্যাণে তৎকালীন যাতায়াত ব্যবস্থা অনেক উন্নতি লাভ করে। যোগযোগ ব্যবস্থা অনেক দ্রুত এবং সহজ হতে থাকে। বিলাতিদের কাছে বাষ্পচালিত জাহাজগুলো দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে। ভারতের প্রায় সব বড় নদীতেই বাষ্পচালিত জাহাজ চলাচল শুরু হতে থাকে। উল্লেখ্য, বাষ্পচালিত জাহাজগুলো শহরের হৈচৈমুক্ত থাকায় বিলাতিদের কাছে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যথারীতি বাষ্পচালিত জাহাজেরও উপরের প্রথম শ্রেণীর কেবিনগুলো কেবলমাত্র ইউরোপিয়ানদের জন্যই বরাদ্দ ছিল। প্রথম শ্রেণীর বিশাল কেবিনগুলোর সাথে নারীদের জন্য একটি প্রসাধনী কক্ষও সংযুক্ত ছিল। সেখানে বিলাতি নারীরা নিজেদের বেশভুষা ঠিকঠাক করে নিতেন। গডেন নামে এক বিলাতি নারী বাষ্পচালিত জাহাজের ডেকে খাবারের একটি বর্ণনা দিয়েছেন। “খাবারের টেবিলগুলো ছিল সাদা কাপড়ে আচ্ছাদিত যেখানে টেবিলের মাঝখানে শোভা পাচ্ছিল রুপালি অক্ষরে লেখা কোম্পানির ক্রেস্ট। টেবিলের পাশে বাঁকা হয়ে বসার জন্যে ছিল পারিপাটি করে সাজানো চেয়ার যা লিলেন দিয়ে আবৃত্য। ” (ওমেন অব দ্য রাজ: দ্য মাদারস, ডটারস, ওয়াইভস অ্যান্ড ডটারস অব দ্য ব্রিটিশ এমপায়ার ইন ইন্ডিয়া। লেখক মার্গারেট মেকমিলান, রেনডম হাউস ট্রেড, পৃষ্ঠা-৭৯)।
সেদিক থেকে রেল যোগাযোগও খুব একটা মন্দ ছিল না। প্রথম শ্রেণীর কামরাগুলো ইউরোপিয়ানদের জন্য বরাদ্দ ছিল। সিটগুলো ছিল চামড়ায় বাঁধাই করা নরম তুলতুলে বিলাসী আরামদায়ক বিছানার মতো। প্রতিটি কামরাতেই সংযুক্ত ছিল টয়লেট। গরমের সময় কামরাগুলো ঠাণ্ডা রাখার জন্যে জানালার ট্রেতে বরফের কুচি রাখা হতো যা বাইরের বাতাসের সংস্পর্শে কামরার ভেতরের বাতাসকে ঠাণ্ডা করে তুলত। পরবর্তীতে ট্রেনের কামরায় বৈদ্যুতিক পাখার ব্যবহার শুরু হয়। ট্রেনের জানালাগুলো ছিল বেশ চমকপ্রদ। তিনটি বিশেষ স্তরে জানালাগুলো নির্মিত হতো। প্রথম স্তরে ছিল সাধারণ কাচ, দ্বিতীয় স্তরে সূর্যের আলো রোধক কাচ এবং তৃতীয় স্তরে ছিল নেটের বিশেষ ব্যবস্থা। নেটের মাধ্যমে বাইরের মশা মাছি এবং ধূলাবালি প্রতিহত করা হতো। বিলাতি নারীরা ট্রেন ভ্রমণের পুরো আনন্দটাই নিতেন। প্রথম শ্রেণীর প্রতিটি কক্ষেই বিলাতি মেমদেরকে ‘সার্ভড’ করার জন্যে ‘নেটিভ’ চাকর মজুদ থাকত। চাকরদের কাজ ছিল বিলাতি মেমদের সেবা খেদমত করা। কোনো কোনো রেল কোম্পানিতে চাকরদের জন্য প্রথম শ্রেণীর কামরায় বিশেষ ‘সার্ভেন্ট রুম’ প্রচলিত ছিল। কখনো কখনো ট্রেনগুলো ঘণ্টাখানেকের জন্য দুপুরের খাবার বা রাতের খাবারের জন্য থামত। তখন বিলাতি মেম সাহেবরা আয়েশ করে ট্রেন থেকে নেমে রেলস্টেশন সংলগ্ন বিশেষ ইউরোপিয়ান রেস্তোরাঁয় খাবার খেতে যেতেন। রেস্তোরাঁতেও একই দশা। প্রতিটি ইউরোপিয়ান নারীর সেবা শুশ্রূষার জন্য হাতে টাওয়েল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত ভারতীয় আয়া। মেরি ফ্রান্সিস নামের এক বিলাতি নারী—পেশায় সাংবাদিক, তিনি ঊনিশ শতকের শেষের দিকে ভারতে অবস্থান করছিলেন। তার বর্ণনায় রেলভ্রমণে খাবারের একটি ফর্দ পাওয়া যায়। তিনি জানাচ্ছেন, “শক্ত খাসির মাংসের চপ, ডিম এবং অতিরিক্ত লবণ দেওয়া শুয়োরের মাংস এবং কারি নামে কিছু বুড়া মুরগির হাড্ডি। ”
চলুন আবার ডাক বাংলোতে ফিরে যাই। ডাক বাংলোর রসুই ঘরে একটু উঁকি দিয়ে আসলে কেমন হয়? ঔপনিবেশিক ভারতের ডাক বাংলোগুলোয় বিলাতি খাবারের পাশাপাশি দেশি ভারতীয় খাবারও বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। সেই সময়ে বিলাতি জিহ্বায় ‘কারি’ বেশ জনপ্রিয় একটি পদের নাম। ভারতীয় ‘কারি’ সাধারণত মুরগির মাংসের ঝোল যা সবজি এবং স্যুপের সঙ্গে পরিবেশন করা হতো। বিলাতিরা অনেক সময় তাদের নিজস্ব খাবার খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে উঠত এবং জিহ্বার স্বাদ পরিবর্তনে ডাক বাংলোয় ভারতীয় মশলায় তৈরি বিভিন্ন রকম মুখরোচক খাবারের জন্যে উন্মুখ হয়ে থাকত। ” (অ্যাংলো -ইন্ডিয়ান কুজিন-এ লিগেসি অব ফ্লেবারাস ফ্রম দ্য পাস্ট: অথেনটিক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান রেসেপি, গৌরমেন্ড ওয়ার্লড কুক বুক, ব্রিজ হোয়াইট, ২০১৩, ইংল্যান্ড)।
স্যুপ হিসেবে বিলাতি স্যুপের পাশাপাশি ভারতীয় স্যুপের জনপ্রিয়তাও কম ছিল না। ডাক বাংলোগুলো যেহেতু অস্থায়ী আস্তানা হিসেবে ব্যবহৃত হতো, সেখানকার খাবার দাবারে বৈচিত্র্য নিয়ে আসতেও ভারতীয় পাচকদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না।
সন্দেহ নেই ভারতের ডাক বাংলোগুলোতে বিলেতের সুখ সুবিধা খুঁজতে বিলাতি নারীদেরও চেষ্টার কোনো ত্রুটি থাকত না। কিন্তু ডাক বাংলোর মতো অস্থায়ী একটি ঘরে আপাত সুখ ঠিকানা খুঁজে পেলেও ভারতের মাটিতে সত্যিই কি সেই সুখ তারা কখনো খুঁজে পেয়েছিল?
পর্ব ১৫ পড়তে ক্লিক করুন
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১৫