ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

কালকেউটের সুখ উপন্যাসে সমাজ ও রাজনীতি

বই আলোচনা ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০১৫
কালকেউটের সুখ উপন্যাসে সমাজ ও রাজনীতি

পলাশ মজুমদার ||

মসাময়িককালে বাংলা-ভাষার কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে তরুণ লেখক স্বকৃত নোমানের সৃষ্টি নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রম, যা ইতোমধ্যে পাঠকমহলকে কৌতূহলী করে তুলেছে। দৃষ্টিগ্রাহ্য মাত্রা সংযোজন করে উপন্যাসে তিনি সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন নিজস্ব শিল্পরীতি ও নির্মাণশৈলী।

বলা যায়, পূর্বসূরি কাউকে অনুসরণ বা অনুকরণ না করে সম্পূর্ণ নিজস্ব একটি ধারা তৈরি করতে তিনি নিভৃতে সাধনা করে চলেছেন। ‘কালকেউটের সুখ’ স্বকৃত নোমানের তেমনি এক ব্যতিক্রমধর্মী প্রয়াস। তার অন্যান্য উপন্যাসের মতো এটিও বিষয়বস্তু, ঘটনার বিশ্লেষণ, চরিত্র চিত্রণ, বর্ণনারীতি ও গ্রামীণ প্রেক্ষাপটসহ সব বিষয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। উপস্থাপনার সাবলীলতা ও বিশ্লেষণধর্মী গতিময়তা উপন্যাসটিকে করে তুলেছে প্রাণবন্ত ও সুখপাঠ্য।

লেখকের মানবিক মূল্যবোধ, ইতিহাস-সচেতনতা, অসাম্প্রদায়িক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা, সব মত ও পথের প্রতি নিরপেক্ষ বিচারবোধ উপন্যাসটিকে প্রতিষ্ঠা করেছে অনন্য উচ্চতায়। ইতোপূর্বে বা বর্তমানে আর কারো উপন্যাসে এমন বিষয় এভাবে উঠে আসেনি। উপন্যাসের ভূমিকায় উল্লেখ আছে, ‘কালকেউটের সুখ মূলত বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতা, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নীরব দেশত্যাগ এবং কালকেউটের মতো বিষধর স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর উত্থানকেন্দ্রিক একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক উপন্যাস। গরানপুরের পটভূমিকায় লেখক ধরেছেন বাংলাদেশের বাস্তবতা। শিল্পিত ভাষা ও আঙ্গিকে বাস্তবতাকে দিয়েছেন শিল্পরূপ। ’



হিন্দু, মুসলমান, কাদিয়ানী, সুন্নী ও আহমদিয়া মতবাদকে একসঙ্গে মুখোমুখি দাঁড় করায় লেখক কারো পক্ষাবলম্বন না করে খুব সচেতনভাবে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছেন। লেখকের উদার দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন মতবাদীদের স্বরূপ উদঘাটন করতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। ধর্ম যে অত্যাবশ্যকীয় ব্যাপার নয় বরং একটা অভ্যাস ও অনুসরণের ব্যাপার তাই যেন তিনি সচেতনভাবে তুলে ধরতে প্রয়াস চালিয়েছেন, যদিও লেখকের উদ্দেশ্য অস্পষ্ট



সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানাধীন সুন্দরবন-ঘেঁষা গ্রাম গরানপুর যেখানে মূলত বাস করে মৌয়াল বাওয়ালি জেলে কিষাণ—যাদের জীবিকার প্রধান অবলম্বন সুন্দরবন। শিক্ষা ও সভ্যতাবিবর্জিত বাংলাদেশের এই প্রান্তিক জনপদের মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ও জীবনযাপন চিত্র ‘কালকেউটের সুখ’ উপন্যাসটির উপজীব্য। মুক্তিযোদ্ধা কেশবচন্দ্র মণ্ডল ও তার পরিবারকে কেন্দ্র করে উপন্যাসটির কাহিনী এগিয়ে গেছে। কেশব মাস্টারকে উপন্যাসটির মূল চরিত্র বললেও অতিশয়োক্তি হবে না। চরিত্রটি উপন্যাসের অন্য চরিত্রগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে, যেন কেশব মাস্টারই উপন্যাসটির প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। অন্য সব চরিত্র তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত।

একটি জনপদের মানুষের জীবন-সংগ্রামের কাহিনী চিত্রায়ণ করতে গিয়ে লেখক উপন্যাসটির নামকরণে কিছুটা অপারদর্শিতার প্রমাণ দিয়েছেন। যে স্বাধীনতাবিরোধীদের তিনি কালকেউটে বলে অভিহিত করেছেন এবং এ নামে উপন্যাসটির নামকরণ করেছেন তাদের চেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে কেশব মাস্টার, তার পরিবার ও পরিবারকেন্দ্রিক ঘাত-প্রতিঘাত, একই সঙ্গে অত্রাঞ্চলের হিন্দু-মুসলমান জনগোষ্ঠীর জীবন্ত সমাজচিত্র।

পিতা অনন্তচন্দ্র মণ্ডলকে মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্মত্যাগ করে মুসলমান না হওয়ার অপরাধে পাকসেনাদের হাতে প্রাণ দিতে হয়। অথচ তার দুই মেয়ে প্রেমে পড়ে পূর্বপুরুষের ধর্ম ছেড়ে মুসলমান ছেলে বিয়ে করে হয়ে যায় মুসলমান। তিনি নিজেও শেষ পর্যন্ত কোনো রহস্যজনক কারণে মুসলমান হয়ে নাম নিয়েছিলেন ‘কিশোয়ার মণ্ডল’, যদিও বিষয়টি উপন্যাসের শেষ পর্যন্ত রহস্যাবৃত ছিল। ‘পুরো ব্যাপারটাই রহস্যঘেরা। যে মানুষ হিন্দু সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, রামায়ণ-মহাভারত আর উপনিষদের শত শত শ্লোক যার মুখস্থ, যার বাবা মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও ধর্ম ত্যাগ করতে রাজি হননি, দুই মেয়ে মুসলমান হয়ে যাওয়ায় যিনি তাদের মেয়ে বলে স্বীকার করতে রাজি নন, তার হঠাৎ মুসলমান হয়ে যাওয়াটা রহস্যের বৈকি। ’

অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী, সংস্কারমুক্ত, প্রগতিশীলতায় বিশ্বাসী এই মানুষটির বৈচিত্র্যময় জীবনে একের পর এক ধাক্কা লাগলেও তিনি ভেঙে পড়েননি, হয়ত ভেতরে ভেতরে কষ্টের বাণে জর্জরিত ছিলেন যার কোনো বহিঃপ্রকাশ ছিল না। তার দুই মেয়ের ধর্মত্যাগ তার হৃদয়কে খানখান করে দিলেও তিনি নিজের আদর্শে অটল ছিলেন এবং তখন স্ত্রী চারুবালাকে মনোবল জুগিয়ে অসীম দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন। উপন্যাসের শুরুতেই লেখক জানিয়েছেন, ‘মানুষ হিসেবে তিনি কিছুটা ভিন্ন ধাঁচের। এই কাহিনীর পটে যেসব মানুষ দেখা যাবে তাদের চেয়ে তিনি আলাদা, অথবা তারা তার চেয়ে আলাদা। দূর গ্রামের একটা মানুষ, যে কোনোদিন তাকে দেখেনি, লোকমুখে কেবল তার নাম শুনেছে, সেও তাকে আলাদা করে চিনে নিতে পারবে। ’

নিজের বাড়ির আঙিনায় গ্রামের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দেয়ার জন্য পাঠশালা খুলে, বিনে পয়সায় চিকিৎসা দিয়ে তিনি সমাজের এক অনন্য ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন যা হিন্দুবিদ্বেষী ও স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মান্ধগোষ্ঠী মেনে নিতে পারেনি। চৌষট্টির দাঙ্গায় নিহত তার আত্মীয় প্রসূন মাইতির পরিত্যক্ত ভিটায় স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে শুরু হয় তার বিরুদ্ধে বিভিন্নমুখী ষড়যন্ত্র। নিজের গোয়ালের গরু খোয়ানো ও নদীর চরে গরুর রক্তের দাগ দেখা, বাড়ির খড়ের গাদায় আগুন, বাড়ির চালে ঢিল এবং সর্বোপরি বেনামি চিঠি দিয়ে দেশত্যাগের ও জীবননাশের হুমকি তার মনোজগতে এমন পরিবর্তন আনে যে, তিনি ধর্মত্যাগ করে মুসলমান হয়ে যান। তবু এক রাতে তিনি গুম হয়ে যান। দোষ চাপানো হয় এলাকার হিন্দুদের ওপর, হিন্দুধর্ম ত্যাগ করায় তারাই কুখ্যাত মোছলেম ডাকুকে দিয়ে তাকে খুন করায়। এই অজুহাতে ধর্মান্ধ উগ্রবাদীরা শুরু করে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা। শুরু হয় দেশত্যাগের স্রোত। উপন্যাসটি এখানে শেষ হয়ে যেতে পারত, কিন্তু তার স্ত্রী চারুবালার মৃত্যুর পর পুত্র গোপেশচন্দ্র ও ছোট মেয়ে তাপসীর জীবন-সংগ্রামের মাধ্যমে লেখক যবনিকা টানতে গিয়ে পাঠককে এক অতৃপ্তির মধ্যে ঠেলে দিয়েছেন যেন শেষ হয়েও হলো না শেষ।

এমন পরিসমাপ্তি ছোটগল্পে প্রযোজ্য হলেও উপন্যাসের ক্ষেত্রে কাম্য নয়। অস্পষ্টতায় উপসংহার, ‘আমরা জানি না তাপসী আর কোনোদিন গরানপুরে ফিরবে কি না। গোপেশ ফিরবে কি না তারও কিছু জানি না। জানার মধ্যে জানি শুধু এটুকু, চুনকুড়িতে জোয়ার আসবে, ভাটা পড়বে। প্রতি জ্যোৎস্নার রাতে মুকনোলির প্রান্তরে এক অপার্থিব মায়া খেলা করবে। আর অনুমান করতে পারি, তখন সেই মায়াবী জ্যোৎস্নার রাতে অনন্ত মণ্ডল ও কেশব মণ্ডল ওরফে কিশোয়ার মাস্টারের অশরীরী আত্মা চুনকুড়ির আড়ায় দাঁড়িয়ে বিরান মণ্ডলবাড়ি বা বেদখল মণ্ডলবাড়ির দিকে তাকিয়ে গুমরে গুমরে কাঁদবে। ’

লেখকের অসাধারণ তুলির আঁচড়ে প্রতিটি ঘটনা এমন জীবন্ত হয়ে উঠেছে যা পাঠকের হৃদয়কে আন্দোলিত করে, কখনো করে রোমাঞ্চিত, বেদনাহত। তবে প্রতিটি ঘটনার আকস্মিকতা পাঠককে হঠাৎ একটু ধন্দে ফেলে দেয়। যেমন উপন্যাসের শুরুতে কেশবচন্দ্রের স্কুল প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ থেমে যায় পরপর দুটি ঘটনায় : বড় মেয়ে নমিতার প্রাইভেট মাস্টার হালিমের সঙ্গে পলায়ন এবং তার কিছুদিন পরই মেজো মেয়ে দীপিকার নিজ স্কুলের শিক্ষক কাদিয়ানী মতাদর্শী দিদারের সঙ্গে গৃহত্যাগ ও ধর্মান্তর। সেই ঘটনাগুলো টানতে গিয়ে তিনি এমনভাবে তার পেছনের ঘটনা নিয়ে এসেছেন যেন প্রয়োজনীয়তাই ঘটনাগুলো সৃষ্টি করেছে। মনে হলো, কেবল উপন্যাসের কলেবর বৃদ্ধির জন্য তিনি কাহিনী সৃষ্টি করেছেন।

কেশব মণ্ডল নিখোঁজ হওয়ার পর ধর্মান্তরিত মেয়েদের জামাইসহ বাড়িতে এসে অবস্থান নানা ঘটনার জন্ম দেয়। হিন্দু, মুসলমান, কাদিয়ানী, সুন্নী ও আহমদিয়া মতবাদকে একসঙ্গে মুখোমুখি দাঁড় করায় লেখক কারো পক্ষাবলম্বন না করে খুব সচেতনভাবে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছেন। লেখকের উদার দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন মতবাদীদের স্বরূপ উদঘাটন করতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। ধর্ম যে অত্যাবশ্যকীয় ব্যাপার নয় বরং একটা অভ্যাস ও অনুসরণের ব্যাপার তাই যেন তিনি সচেতনভাবে তুলে ধরতে প্রয়াস চালিয়েছেন, যদিও লেখকের উদ্দেশ্য অস্পষ্ট।

ছবেদালি মোড়ল যে ’৭১ সালে শান্তি কমিটির নেতা ছিল ও ডেয়ারিং ছবু নামে এলাকায় পরিচিত ছিল, এটি উপন্যাসটির একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র। তার গুরু জিয়ারত আলী ও তার প্রচেষ্টায় গরানপুরে ধীরে ধীরে স্বাধীনতাবিরোধীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। যুদ্ধের পর পালিয়ে গিয়ে পাঁচ বছর গা-ঢাকা দিয়ে হঠাৎ একদিন তারা এলাকায় আবির্ভূত হয় এবং সাধারণ মানুষকে ধর্মের আফিম খাইয়ে হেদায়াতে ইসলামির শাখা প্রতিষ্ঠা করে। একে একে পুরো জেলায় কমিটি গঠন করে কর্মী-সমর্থকদের সংখ্যা বাড়াতে থাকে। দীর্ঘদিনের ইউপি চেয়ারম্যান খসরু চেয়ারম্যানকে পরাজিত করে ছবেদালি মোড়ল নিজেদের প্রভাব আরো জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠা করে। গরানপুরের দেশান্তরিত হিন্দুদের ভিটে জাল দলিলের মাধ্যমে দখলকারী ও কুচক্রী আলাউদ্দিন হয়ে উঠে তার ডান হাত।

কেশব মাস্টার নিখোঁজ হওয়ার পর তারা মাস্টারের ধর্মান্তরের কারণকে দায়ী করে হিন্দুদের বাড়িঘর লুট করে, মন্দিরে আক্রমণ করে। অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ধ্বংসের অজুহাতে গরানপুর-হরিনগরে তারা দাঙ্গা বাঁধায়। হিন্দুরের বাড়িঘর ও মন্দিরে যে হামলা হয় তার নেতৃত্বে থাকে হেদায়াতে ইসলামির নেতা ছবেদালি, মসজিদের ইমাম গোফরান মৌলানা। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নীরব দেশত্যাগের কাহিনী লেখকের সংবেদনশীল কলমের আঁচড়ে মানবতাবাদী মানুষকে ব্যথিত করে। অমানবিক সমাজেও আতা মৌলভী, জাবেদ খান ও খসরু চেয়ারম্যানদের মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ থাকে যাদের মন প্রতিবেশি হিন্দুদের দেশত্যাগে ব্যথিত হয়।

বন্ধুপুত্র বিপিন যেদিন কেশব মাস্টার হত্যা-মামলার হাত থেকে বাঁচতে দেশত্যাগ করে সেদিন হরিনগর বাজারে আতা মৌলভীর বক্তব্য মানুষকে অশ্রুসিক্ত ও বেদনাহত করে। আতা মৌলভী যিনি আগুনি হুজুর নামে পরিচিত, যাকে এলাকার লোকজন ভালো চোখে দেখে না, তার একাত্তরে চারজন পাকসেনা পুড়িয়ে মারার ঘটনা ও মানবতাবাদ নিঃসন্দেহে সংকীর্ণতার মাঝে সাহসিকতা ও শৌর্যের প্রকাশ।

মোছলেম তালুকদার উপন্যাসটির আরেকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র। মুক্তিযোদ্ধাপুত্র হয়েও হেদায়াতে ইসলামির নেতা খুন করে সে হয়ে ওঠে দুর্ধর্ষ বনদস্যু যার রয়েছে শত শত সাগরেদ। তার ছত্রচ্ছায়ায় সুন্দরবনের আশপাশে ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা হয়েছে এবং তার নাম শুনলে দিনে-দুপুরে মানুষের গা কাঁপে। অথচ কেশব মাস্টার অপহরণ-ঘটনায় তার ভূমিকা একজন মুক্তিযোদ্ধার প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন। জেলখানায় কেশব মণ্ডলের পুত্র গোপেশকে পেয়ে সে কিছু বলতে গিয়েও না বলা একজন অপরাধীর ভেতরকার মহত্ত্ব প্রকাশ করে।

ঘটনার প্রয়োজনে অসংখ্য চরিত্রের আবির্ভাব ঘটিয়েছেন লেখক। অনেক ক্ষেত্রে উপন্যাসটিকে চরিত্র-ভারাক্রান্ত বলে প্রতীয়মান হয়। আবার প্রায় সব চরিত্র কিছু কৃতিত্ব দাবি করে ঘটনা পরম্পরায়। জাবেদ খান, খসরু চেয়ারম্যান, মুক্তিযোদ্ধা চৈতনদাস, ভক্তদাস, নিবারণ সাধক, মাজেদ গাইন, আজিবর বাওয়ালি, রাখাল ময়রা, মহেশ্বর, রাধামাধব, বিপিন, জগতী বেওয়া, শৈলেন, মোতালেব, জিয়ারত আলী, গোফরান মৌলানা, মহব্বত সাজুনি, কোবাত মাঝি, গোলাপ গাজী, পচাব্দী গাজী, ছেরু, চারুবালা, নমিতা, দীপিকা, তাপসী, গোপেশ, হালিম, দিদার, খালেক ব্যাপারী, জালালুদ্দিন, নাজমুল দারোগাসহ আরো অনেক চরিত্রই উপন্যাসে কোথাও না কোথাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। হয়ত এটা লেখকের নিজস্ব ঢং বা বর্ণনারীতি। তথাপি পাঠকের মনে কখনো তা বিরক্তির উদ্রেক করে।

অসংখ্য মিথ, উপমা, লোকজ প্রবাদ, স্থানীয় বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণা উপন্যাসটিতে একটা ভিন্নযাত্রা সংযোজন করেছে, যেন লেখক দীর্ঘদিন ওই সমাজে বসবাস করে সমাজচিত্রকে তুলে ধরায় ব্রতী হয়েছেন। হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের শাস্ত্রীয় বিষয়গুলোকে তিনি প্রয়োজনানুযায়ী এমন স্থানে ব্যবহার করেছেন যা পাঠকের মনে তার অধীত জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলে। ওই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপন প্রণালীতে বনবিবি, দক্ষিণ রায় ও শাজঙ্গলীর ভূমিকা অতি সুনিপুণভাবে তিনি তুলে ধরেছেন। যেমন—পুবের বনে বাঘের পিঠে চড়ে আঠারো ভাটি শাসন করে বনবিবি। দক্ষিণ রায় বাঘের পালকে তাড়িয়ে দক্ষিণের জঙ্গলে জড়ো করে। শাজঙ্গলী মানুষের রূপ ধারণ করে বাঘ চালানের মন্ত্র দিয়ে যায়। তবুও বনজীবীরা হারিয়ে যায়, গুম, খুন হয়ে যায়। বাঘ কুমিরের শিকারে পরিণত হয়।

মূলত ‘কালকেউটের সুখ’ একটি সমাজভিত্তিক রাজনৈতিক উপন্যাস। স্বাধীন বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে ধর্মীয় অনুভূতি ও উন্মাদনা কাজে লাগিয়ে কিভাবে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা হয়—তাই স্বকৃত নোমান উপন্যাসটিতে তুলে ধরতে সচেষ্ট ছিলেন। সংখ্যাগুরু মুসলমানের দেশে সংখ্যালঘু হিন্দুরা কিভাবে নির্যাতিত হয়, কেন ধর্মান্তরিত হয়ে বাপ-ঠাকুর্দা চৌদ্দপুরুষের ধর্ম ত্যাগ করে, ধর্ম ছাড়তে না পারলে কিভাবে নীরবে দেশ ছাড়ে, তাদের পরিত্যক্ত ভিটেমাটি কিভাবে বেদখল হয়ে যায়, কিভাবে কালকেউটের মতো বিষধর স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে বাংলাদেশে, তারই একটি খণ্ডচিত্র ঔপন্যাসিক উপন্যাসটিতে আঁকতে চেয়েছেন। এখানে প্রকাশ পায় লেখকের অসীম সাহসিকতা, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দায়বদ্ধতা, মানবিকতা এবং ধর্মের নামে সমাজে প্রচলিত নোংরামি তুলে ধরার সদিচ্ছা। যে সৎ সাহসের ওপর ভর করে তিনি এমন একটি বাস্তবভিত্তিক ও সময়োপযোগী উপন্যাস রচনা করেছেন তা নিঃসন্দেহে সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।



বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।