ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

হরিচরণ, কেরামত আলী এবং ঝড় সংক্রান্ত | অপূর্ব সাহা

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০১৫
হরিচরণ, কেরামত আলী এবং ঝড় সংক্রান্ত | অপূর্ব সাহা

মোটা লেন্সের প্রায় একযুগ পুরনো চশমার ভেতর দিয়ে ডাক্তার হরিচরণ বাইরের দিকে তাকান। তাকান আর ঝুপ করে একটা পাঁশুটে অন্ধকার নামে নারকেলবেড়ীয়া বাজারের ওপর।

অবেলার অন্ধকার। সন্ধ্যা এখনো কয়েক পা তফাৎ। তবে কি জ্যৈষ্ঠের বিকেলে কালবোশেখির বার্তা দিয়ে অন্ধকারকে পাঠাল আকাশ?

অভিজ্ঞ চোখ। পরিপক্ব সংবেদনশীলতা। তাই হবে। তাই হবে। অন্ধকারের আগমন এবং ৪২০ ভোল্টের বিদ্যুতের প্রস্থান প্যারালালি সংঘটিত হয়। ফলে বাজারের দোকান আর ঝুপড়িগুলোতে একসাথে জ্বলে ওঠে কুপি আর হারিকেন। হরিচরণ সিদ্ধান্ত নেন হারিকেন জ্বালবেন না। বরং ঝড় আসার আগেই বাড়ি চলে যাবেন। জামকাঠের প্রায় পৌরাণিক চেয়ারটা ছেড়ে উঠে দরজায় এসে বাজারের ওপর চোখ বুলান। ইতোমধ্যে জনবিয়োগ করতে শুরু করেছে হৈ হট্টগোলে ভরা বাজারটা। আসন্ন ঝড়ের ইঙ্গিত লেখা হয়ে গেছে সবখানে।



কেরামত কিছুক্ষণ ভ্যাবলার মতো হরিচরণের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে, তারপর কান্নার মতো একটা ভাব করে আজব একটা কণ্ঠে বলে, “অ্যাখন কী করব?”
“এতক্ষণ ছিলে কোথায়, অ্যা? নাকে সর্ষের তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছিলে? অ্যা? তোমার গ্রাম থেকে বাঘারপাড়ার হাসপাতাল কি ম্যালা দূর?”



বাড়ি চলে যাবেন, ঠিক করেন হরিচরণ। একটু পা চালাতে হবে, এই যা। কদম পিসিমার শরীর ক’দিন ধরে ঠিক যাচ্ছে না। ঔষধপত্তর আর কাজ করছে না। এই চান্সেই তিনি আকাশে—স্বর্গের দিকে ডানা মেলবেন কিনা, কে জানে। কদম পিসিমার যে বয়স তাতে মরে গেলে পৃথিবীর ওজন বরং কমে, কিন্তু মহাক্ষতির ভেতরে পড়ে যাবেন হরিচরণ। মৃত্যুর আগে শেষবারের মতো নিঃস্ব হয়ে যাবেন। আপনারজন বলতে হাতের কাছে কে আর আছে এই পৃথিবীতে? ওই পিসিমা ছাড়া? যারা ছিল, গণআন্দোলনের মতো হৈ হৈ রৈ রৈ করে কিছু মরে গেল, কিছু সীমান্ত পার হয়ে চলে গেল ওপার বাংলায়। সর্বশেষ গেল কালীচরণ। হরিচরণের একমাত্র অনুজ। ২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর ভায়োলেন্স গিলতে না পেরে সপরিবারে বাস তুলে দিল। দিগন্তের দিকে বিরক্তি আর বৈরাগ্যে ভারাক্রান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সেদিন বলেছিল কালীচরণ, এই নষ্ট দেশে আর না, দাদা। তুমি তো আর তোমার সাধের দেশ ছাড়ে যাবা না। আমারই যাতি হবে। বউ-বাচ্চাগুলানরে তো আর গুণ্ডা-বদমায়েশদের মুখে ফেলাই রাখতি পারি নে...।

কোনো উত্তর দিতে পারেন নাই হরিচরণ। উত্তর কিছু ছিলও না। দেশের পরিস্থিতি সত্যিই তখন সকল প্রশ্নের উর্ধ্বে উঠে গেছে। আগুন জ্বলছে তখন তিরিশ বছরের লালিত তাসের ঘরে। ধর্ম নিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র সম্ভ্রম হারিয়ে রাতের অন্ধকারে পাছদুয়ারের পচা নর্দমায় কচুরিপানার আবডালে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে প্রাণ বাঁচাচ্ছে।

কিন্তু হরিচরণের কোথাও যাওয়ার নাই। এ মাটি ছেড়ে কোথাও যেতে পারবেন না তিনি। এই মৃত্তিকার সাথে এ জীবনে তিনি সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছিলেন যাকে সেই মাধবীলতা আর যাকে এ জীবনে ভালোবাসার কোনো সুযোগই পান নি সেই নামহীন ছেলেটার শরীরের মৃত্তিকা মিশে আছে যে!

চারদিক একেবারে ফাঁকা হয়ে গেল, যে ফাঁকা হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল পঁচাত্তর পরবর্তী সালগুলো থেকে। সেই হু হু শূন্যতার ভেতর কদম পিসিমা একমাত্র পিদিমটা জ্বালিয়ে রয়ে গেলেন। পঁচানব্বই বছর পথ হেঁটেও বালবিধবা পিসিমাটি তার জীবনের ভার রাখতে চান না; চান না তার কারণ বোধহয় ওই আত্মবিমুখ আলাভোলা হরিচরণ। হরিচরণ ডাক্তার। পল্লীডাক্তারের প্রশিক্ষণ নিয়ে কী এক ইন্দ্রজাল পেতে গোটা এলাকাকে ভালোবাসায়-সেবায় একবৃন্তে এনে গেঁথে ফেললেন। ধন্বন্তরি যেনবা। নিজের হাত দিয়ে একটা মামুলি প্যারাসিটামল দিলেও কালজ্বর থেকে ঝাড়ি দিয়ে উঠে বসে রোগী। শিক্ষক হিসেবেও খ্যাতি কম নেই। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ দিয়ে ঊনিশশ’ আটান্ন সালে নারকেলবেড়ীয়া হাইস্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে সাতানব্বই সালে অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই এলাকার কত কত মানুষের সামনে তিনি উচ্চশিক্ষার পথ অবমুক্ত করে দিয়েছেন তার হিসেব নাই। কিন্তু সবাই  যে আর তার অবদানকে ফুলে ফুলে ডালা সাজিয়ে ফিরিয়ে দেবেন এমনটি ভাবার মত মুর্খ নন তিনি। কিন্তু খুব কষ্ট পান যখন তারই ছাত্ররা তাকে কুচ্ছিত ভাষায় গালাগাল করে। ইন্ডিয়ার দালাল বলে ভর্ৎসনা করে।

করো, ভর্ৎসনা করো। চামড়া ছিলে নাও। আঙ্গুলগুলো একটা একটা করে কেটে নাও; শরীর থেকে বিযুক্ত করে দাও কণ্ঠনালী; আইবল বের করে নাও রেটিনা থেকে; ‘আমি র’য়ে যাবে এই বাংলার ’পরে/দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে’। এই হচ্ছে হরিচরণের স্বগত ডায়ালগ। আজ খুব মন খারাপ তার।

এই মন খারাপের বয়স পঞ্চাশ বছর; কিন্তু ফি বছর এই ১৫ জ্যৈষ্ঠ তার মন-খারাপের দীঘল প্রবাহটা একটা কেন্দ্রে এসে ঘনীভূত হয়। তারপর জমাট কান্নার একটা নীল হ্রদ হয়ে বুকের ভেতরে চেপে বসে থাকে। সেখানে কষ্টের ঢেউগুলো একটা বাষ্পীভূত সুখের সাথে মিলেমিশে থাকে। কষ্ট আর সুখের অভূতপূর্ব কোলাজ। তাই বোধহয় পৃথিবীর অন্য কোনো মন খারাপের সাথে এই মন খারাপের তুলনা চলে না। এ তার ভীষণ রকমের নিজস্ব।

হরিচরণ ডাক্তারের ডিসপেনসারিটা উত্তর-পশ্চিম দুইদিক খোলা। পশ্চিমদিকের দুই দরজাতেই খিল এঁটে দেন তিনি। এখন উত্তর দিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিলেই হয়। বাড়ি পর্যন্ত হেঁটে যেতে দশ মিনিটের বেশি লাগে না। তবে ইদানীং ১২ মিনিটের মতো লাগছে। বয়সের কামড়। বুঝতে পারেন তিনি। আজ একটু পা চালাতে হবে। ঝড়ের আগে বাড়ি পৌঁছাতে চান।
“ডাক্তার কাকা। ”
পরিচিত কণ্ঠস্বরে ঘাড় ঘুরিয়ে হরিচরণ দেখতে পান দরজায় দাঁড়িয়ে কেরামত আলী। তেবিলার দুই বিঘা জমি এই কেরামত আলীই বর্গাচাষ করে। তার আগে তার আব্বা ইমারত আলী চাষ করত। ইমারত আলীর মৃত্যুর পর ছেলে হাল ধরেছে।

“কী হইছে কেরামত?”
“বিপদে পড়ে গিছি কাকা। ”
“বিপদ? কিসির বিপদ?” হরিচরণের কণ্ঠে নিখাদ উদ্বেগ।

কিছুক্ষণ কথা বলতে পারে না কেরামত। নিচের ঠোঁট উপরের ঠোঁটের সাথে কয়েকবার বাড়ি খায়। চোখে বিভ্রান্তি খেলা করে। এমনিতে তিরিশের কোঠা ছোঁয়া এই যুবক সবল, কর্মঠ; হাতের কিলবিলে পেশী তার জ্বলন্ত প্রমাণ। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনো এক দুর্দৈব তার পেশীর টঙ্কারকে ঢিলেঢালা করে ফেলেছে।

“তোঁতলাও ক্যান কেরামত? কী হইছে কও!”
“গোলাপী মানে আপনার বৌমা পোঁয়াতি”...
“তো কী হইছে?”
“ব্যথা উঠিছিল সেই বিয়ানবেলায়। অ্যাহনোতো ডেলিভারি হলো না। খিঁচুনি হচ্ছে। মুখ দিয়ে গ্যাজলা বেরোচ্ছে। অবস্থা ভালো না কাকা। মনে হয় বাঁচপে না নে”...
“বাঁচপে ক্যামনে?” খিঁচিয়ে ওঠেন হরিচরণ। তার রক্ত গরম হয়ে গেছে। চিকিৎসা-বিজ্ঞান কতদূর এগিয়ে  গেল! কিন্তু গ্রাম বাংলার এই হাড়-হাভাতে মানুষগুলোরে কেন যে আজও ছুঁতে পারল না! ভেতরে কষ্টের সাথে ফেনিয়ে উঠতে থাকে ক্রোধ।

কেরামত কিছুক্ষণ ভ্যাবলার মতো হরিচরণের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে, তারপর কান্নার মতো একটা ভাব করে আজব একটা কণ্ঠে বলে, “অ্যাখন কী করব?”
“এতক্ষণ ছিলে কোথায়, অ্যা? নাকে সর্ষের তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছিলে? অ্যা? তোমার গ্রাম থেকে বাঘারপাড়ার হাসপাতাল কি ম্যালা দূর?”

কেরামত আলীর অবস্থা দেখার মতো। শক্ত সমর্থ এক যুবক; অথচ দুই হাতের তালু পরস্পর অবিশ্রান্ত ঘর্ষণে লিপ্ত; চোখে-মুখে কান্নার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। মুখ দিয়ে দুই একটা বিচিত্র শব্দ করে সে কথার খেই ধরার চেষ্টা করছে। প্রচণ্ড রাগের ভেতরও অবাক না হয়ে পারলেন না হরিচরণ। স্ত্রীর ওপর এই যুবকের অবিমিশ্র ভালোবাসা আছে। সাধারণত দেশগেরামের মেহনতি পুরুষদের সাথে তাদের স্ত্রীদের সম্পর্ক  কতিপয় যৌন-সংসর্গে এসে ঠেকে থাকে; তারপর আর এগোয় না। প্রেম, ভালোবাসা—এ ধরনের শব্দগুলো স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে যায় শুধুমাত্র পরিচর্যার অভাবে।

হাত কচলাতে কচলাতে কেরামত বলে, “জরিমন দাই বারণ করল তাই। পুরোন বিশ্বাসী লোক। আমার তিন মায়ে তার হাতে হইছে। ”
হরিচরণ এবার একটু নরম স্বরে বলেন, “তো কও এখন আমি কী করতি পারি?”
“আপনি এট্টু চলেন না কাকা? আপনি ছাড়া গোলাপীরে কেউ বাঁচাতি পারবে না। আমি নিয়ত করে কচ্চি। ”

অহেতুক নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লাভ নেই। জানেন হরিচরণ। নিশ্চিত পরাজয়, কারণ হরিচরণের ভেতরের হরিচরণ একজন ডাক্তার। রুগ্নের ভগবান। আর কেরামত আলীর যখন একবার বিশ্বাস জন্মেছে যে হরিচরণ ডাক্তারের হাত পড়লে তার স্ত্রী ভালো হয়ে উঠবে, তখন সেই বিশ্বাস বাঁচিয়ে রাখার জন্য হরিচরণকে তো শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করতেই হবে। কখনো এর অন্যথা হয় নি, ভবিষ্যতেও হবে না। কাজেই সময় নষ্ট না করে প্রায় দু’যুগ পুরনো জীর্ণ জং-ধরা চামড়ার ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে বাইরে এলেন তিনি। দোকানে তালা লাগালেন।

অধিকাংশ দোকান ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। নিষ্প্রাণ বাজার। চারদিক থ মেরে আছে। উত্তরের আকাশে ক্ষীণ একটু বিজলি চমকায়।

হাঁটা শুরু করলেন হরিচরণ। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, কেরামত একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে পেছন পেছন হাঁটছে। এই দূরত্ব শ্রদ্ধার। জানেন  হরিচরণ। আর এই প্রাপ্তিটুকুই তার সারা জীবনের সকল অপ্রাপ্তিকে, অসম্মানকে ঢেকে দেয়। কেরামতের বাড়ি রহিমপুরে। নারকেলবেড়ীয়া বাজার থেকে এক মাইল দক্ষিণে। সমস্যা হচ্ছে মাঝখানে তেবিলা পার হতে হয়; বে-বহা বিল, জনমনিষ্যিহীন। বুকের কোথাও যেন একটা শঙ্কার কাঁটা কুট কুট করে বিঁধছে। মাঝবিলে ঝড়ে পড়লে আর রক্ষে নেই। না থাকুক, তবু বাইরের ঝড়ের ভয়ে তিনি কিছুতেই ভেতরের ঝড়ে কুপোকাৎ হবেন না। সাইকেল থাকলে দ্রুত চলে যাওয়া যেত। কিন্তু বছর পাঁচেক হলো সাইকেল চালানো ছেড়ে দিয়েছেন। পঞ্চান্ন সালের র‌্যালি কোম্পানির সাইকেলটা শেষের দিকে হাসফাঁস করতে করতে দেহ রেখেছে। দুলাল ম্যাকানিক অনেক চেষ্টা করেও তাকে আর দাঁড় করাতে পারে নাই। আর বয়স বিবেচনা করে নতুন সাইকেল কেনার কথা মনে ঠাঁই দেন নাই হরিচরণ। বয়সকে শ্রদ্ধা করার নীতি পুরোপুরি মেনে চলেন তিনি।

বাজারের শেষ দোকানটা পার হয়ে ওরা নেমে পড়ে তেবিলার রাস্তায়। সরু ইট বিছানো এবড়োথেবড়ো রাস্তা। রহিমপুরের ভেতর দিয়ে আরো মাইল পাঁচেক এগিয়ে থানাসদরে গিয়ে পড়েছে। চারদিকে কেমন ভুষা কালির মতো অন্ধকার। ফ্যাকাশে। সমস্ত শব্দেরা এখন মৃত। ভুষা কালির মতো প্রহরের বোর্ডে শব্দের লাশগুলোকে বিমূর্ত ছবি হয়ে থাকতে দেখলেন হরিচরণ। কেরামত লুঙ্গির ঘেরাটোপ থেকে তিনব্যাটারির টর্চ লাইটটা বের করে জ্বালে। কিন্তু ঝড়ের অন্ধকারে ওসব অচল। এবার উত্তর দিগন্তে ঈষৎ জোরালো মাত্রায় বিজলি চমকায়।

হরিচরণ বলেন, “কেরামত, এবার এট্টু জোরে পা চালাতি হবে যে বাপ। ” কেরামত মাথা নাড়ে আর মুখ দিয়ে ‘ঘোৎ’ ধরনের একটা আজব শব্দ করে। হরিচরণ গেল বৈশাখে আটষট্টি ক্রস করেছেন। তথাপি শরীরে এখনো যথেষ্ট শক্তি ধরেন। চওড়া কাঁধ। লম্বাটে চুল, সবৈব শাদা। বুকের নিচে হালকা ভুঁড়ির আভাস। ত্বকের জৌলুসকে বয়স এখনো ফিকে করতে পারে নাই। শাদাচুলো, আত্মবিশ্বাসী পৌঢ় এই গ্রাম্য-ডাক্তারের ইঙ্গিত পেয়ে টগবগে জোয়ান কেরামত আলী পেশীতে টঙ্কার তুলে পায়ের গতি দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়।

দু’জোড়া ত্রস্ত পা। একটা টর্চের ক্ষীপ্র জ্বলা-নেভা। বে-বহা বিলে এইটুকু ছাড়া আর কোনো সঞ্চারণশীল দৃশ্য নেই। ঝড়ের প্রথম আঘাতটা তাই সেখানেই পড়ে।

হরিচরণের চশমাটা বাতাসের ধাক্কায় উড়ে যাচ্ছিল, হাত দিয়ে ঠেকান।

দূরে কোথাও একটা তালগাছের শুকনো ডগা ক্যাঁ-ক্যাঁ করে কেঁদে ওঠে। তারপরই থেমে যায় কান্নার শব্দ। সম্ভবত ডগাটি কাণ্ডচ্যুত হয়েছে। আর মুহূর্তে  আকাশ এবং মাটির মাঝখানের শূন্যতা গ্রাস করে নেয় কালবোশেখির পাগলা হাওয়া। তীব্র বিদ্যুৎ চমকায়।

আকাশ থেকে নেমে আসে বজ্র। অদূরে একটা পয়মন্ত তাল গাছের মাথায় নীলাভ স্বর্ণাভ ঝিলিক তুলে আমূল বিঁধে যায়। বেচারা গাছ! কষ্টটা বুকে এসে বেঁধে হরিচরণের।

আবার বিজলি।

বাতাসের বেগ প্রতি সেকেন্ডে বাড়তে থাকে। হরিচরণ দু’বার কেরামত কেরামত ব’লে ডাকেন। কিন্তু কোনো সাড়া পান না। কোথায় গেল? পরবর্তী বিজলির আলোয় দেখেন, বিস্রস্ত যুবক তার থেকে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে। ছুটছে পাগলা ঘোড়ার মতো। একদিকে ঝড়ের কালভৈরবী নৃত্য, অন্যদিকে ঘরে প্রসব বেদনায় ছটফট করা প্রিয়তমা স্ত্রীর অসন্ন মৃত্যু তাকে দিশেহারা করে ফেলেছে। হরিচরণ মনে মনে ভাবেন, প্রথমত কেরামতকে থামানো দরকার। কারণ খোলা বিলে উদ্‌ভ্রান্তের মতো দৌড়ানোর অর্থ মাথার চাঁদিতে বজ্রকে আমন্ত্রণ করে আনা। চিৎকার করে কোনো লাভ নেই। ঝড়ের নিজস্ব শব্দের দৌরাত্ম্যের মধ্যে অন্যসব শব্দ কীটাণুর মতো ঢাকা পড়ে যাবে।

মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেন হরিচরণ, কেরামতকে থামাতে হবে। চশমাটা খুলে পাঞ্জাবীর পকেটে ভ’রে হাতের ব্যাগটা রাস্তার একপাশে নামিয়ে রাখেন।

কেরামতের ওপর লক্ষ্য স্থির করে ভো দৌড় লাগান। মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মাঝখানের দূরত্বটুকু কোনো এক অলৌকিক শক্তি বলে তিনি পার হয়ে আসেন। খুব কাছে প্যাঁচালো সর্পিল দ্যুতি ছড়িয়ে একটা বাজ পড়ে। একই সাথে হরিচরণ অনেকটা নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েন কেরামতের ওপর। হরিচরণ, কেরামত এবং ঝড়—তিনটি স্বতন্ত্র গতির একমুখী সংঘাতে তাল সামলাতে না পেরে মনুষ্য প্রাণীদ্বয় ছিটকে পড়ে রাস্তার পাশে। তারপর গড়াতে গড়াতে চলে যায় বিলের মধ্যে এবং ঝড় এই সুযোগে বাধামুক্ত হয়ে ময়ূরভঞ্জের পাইক নৃত্য করতে করতে চলে যায় রহিমপুরের ওদিকে।

নিচে পড়েছে কেরামত; তার ওপর হরিচরণ। হরিচরণের শরীরের নিচে গলাকাটা কবুতরের মতো ছটফট করতে থাকে কেরামত। এদিকে তার বয়সী শরীরের শক্তি নিঃশেষিত প্রায়। বুঝতে পারেন হরিচরণ, এভাবে আর বেশিক্ষণ এই দিশাহারা যুবককে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। হঠাৎ একটা আইডিয়া খেলে যায় মাথায়। সম্মোহন। হরিচরণ জানেন, তার একটা সম্মোহনী শক্তি আছে। সেটাই প্রয়োগ করতে মনস্থ করেন। তিনি কেরামতের কানের কাছে মুখ নিয়ে দূরাগত গলায় আবৃত্তির ঢঙে বলতে থাকেন, “শান্ত হও কেরামত। শান্ত হও বাপ। আমি দেখতি পারতিছি, তোমার এট্টা ফুটফুটে দেবশিশুর মতন সন্তান হয়েছে। ছেলে সন্তান। একেবারে যেন রাজপুত্তুর। কপালে জ্বলজ্বল করতিছে রাজটীকা। কপালে রাজটীকা থাকলি কী হয় জানো তো? ছেলে রাজা-বাদশা হয়। তোমার ছেলেও একদিন বড় হয়ে রাজা-বাদশা হবে, কেরামত। তোমার স্ত্রীর মুখে হাসি। ঐ হাসি তুমি জীবনেও দেখ নাই। আমি দেখতি পারতিছি। তুমি দেখতি পারতিছো না? দেখার চেষ্টা করো কেরামত। দেখার চেষ্টা করো”...

কাজ হয়। হরিচরণের কথার সম্মোহনী শক্তি শান্ত করে দেয় কেরামতকে। স্থির হয়ে যায় সে। হরিচরণের শরীরের নিচে নিশ্চল পড়ে থাকে।

হরিচরণ এবার আধপাক গড়িয়ে বিলের কাদামাটিতে গা ছড়িয়ে দেন। একহাতে ধরে থাকেন কেরামতের একটা হাত। একটা অদ্ভুত শান্তি নেমে আসে ঝড়-প্রান্তরে। কিন্তু শান্তি আসে না মনে। সেখানে শুরু হয় অন্য এক ঝড়। ১৯৬০ সালের এই দিনে—ঠিক এইরকম এক ঝড়-আক্রান্ত রাতে মাধবীলতা মারা যায়।

...মাধবীলতা গর্তবতী। প্রথম সন্তান হবে তাদের। হরিচরণের ছেলের শখ। অনাগত ছেলেকে নিয়ে রাতদিন স্বপ্নের জাল বুনছেন। নিজে ছোটখাটো বিদ্যে নিয়ে গ্রামে ডিসপেনসারি খুলে বসেছেন। যে যাই বলুক, হাতুড়ে ডাক্তার ছাড়া কিছু নন তো তিনি। কিন্তু ছেলেকে এমবিবিএস পড়াবেন। পাশ করা ডাক্তার। অনেক বড় ডাক্তার। লোকের মুখে মুখে নাম ফিরবে। কিন্তু মাধবীলতার ডাক্তার পছন্দ না। তার ইচ্ছা ছেলে রামকৃষ্ণ পরমহংসের মতো বড় সাধক হবে। এই নিয়ে তুমুল ঝগড়া চলছে...

দুপুরের পর ব্যথা ওঠে মাধবীলতার। ছোটভাই কালীচরণ যায় অন্তির পিসিকে ডেকে আনতে। অন্তির পিসি তখন এ অঞ্চলের ডাকসাইটে দাই। নারকেলবেড়ীয়া অঞ্চলের কয়েকটা প্রজন্ম তার হাত দিয়ে পৃথিবীতে এসেছে। ধন্বন্তরী হাত। অন্তির পিসি আসে। বিচক্ষণ স্নায়ু-সবল মানুষ। দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে যায়। অন্তির পিসির নির্দয় পীড়ন আর পেষণে মাধবীলতা ধরাচ্যুত হওয়ার উপক্রম হলে সামান্য ডাক্তারী বিদ্যে দিয়ে হরিচরণ বুঝতে পারেন তাকে জেলা সদর হাসপাতালে নেয়া ছাড়া বাঁচানোর আর কোনো রাস্তা নেই। এদিকে প্রকৃতি বিমুখ। সন্ধ্যের মুখে শুরু হয় ঝড়-বৃষ্টির তাণ্ডব। সদর হাসপাতাল এখান থেকে বিশ মাইল দূর। চাড়াভিটা পর্যন্ত দশ মাইল রাস্তাকে রাস্তা না বলাই শ্রেয়। সামান্য বৃষ্টিতে হাঁটু কাদা। গরুর গাড়ি ছাড়া আর কোনো বাহন নেই। ঝড়-বৃষ্টির রাতে সে বাহন পাওয়াও দুরূহ হয়ে ওঠে। অবশেষে জলিল মণ্ডল রাজি হয়। সেই অসম সাহসী পরোপকারী মানুষটি অবশ্য মারা গেছে অনেক বছর আগে। যাহোক, জলিল মণ্ডলের গরুর গাড়ি প্রস্তুত হয় উঠোনে। হরিচরণের মা, কদম পিসিমা, কালীচরণ আর হরিচরণ মাধবীলতাকে নিয়ে গাড়িতে চাপেন। পথে ডেলিভারি হয়ে যেতে পারে তাই কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গাড়িতে তোলা হয়।

গরুর গাড়ি যাত্রা শুরু করে।

ভেতরে সন্তানসম্ভবার অবিশ্রান্ত কোঁকানি, বাইরে ক্রুদ্ধ প্রকৃতির দাপানি, মা-পিসিমার অবিরাম হরিনাম জপ—সেই দৃশ্য আজও বুকের ভেতরে একবারে জীবন্ত। ঐ যে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, শোনা যাচ্ছে।

মাঝরাতে যখন গরুর গাড়ি সদর হাসপাতালে পৌঁছায়, তার একটু আগে মাধবীলতা লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে তাকে ডেকে বলে, “আমি আর বাঁচপো না। বুঝলে?”

কোনো উত্তর দিতে পারে নাই সেদিন হরিচরণ। লজ্জায় আর শঙ্কায় কাঠ হয়ে বসে ছিলেন। বুকের ভেতরটা ভেঙে যাচ্ছিল। জীবনে এই নারীর অনুপস্থিতির কথা কিছুতেই ভাবতে পারছিলেন না।

মাধবীলতা আবার কাতরাতে কাতরাতে বলে, “তুমি আর একটা বিয়ে করে নিও। আমাগের সন্তানরে বড় করো গো। ”

এবারও কোনো কথা বললেন না হরিচরণ। অথচ অনেক কথা বলার ছিল তার। অন্ততপক্ষে ভালোবাসার কথাটা। তিনি যে তাকে জীবনের চেয়েও ভালোবাসতেন সেই কথাটা। কিন্তু বলা হলো না। শরমে অনুক্ত থেকে গেল বীজমন্ত্র।

হাসপাতালের ডাক্তার জানালেন, অপারেশন ছাড়া উপায় নাই। অপারেশন থিয়েটারে ঢোকানো হলো মাধবীলতাকে। রাত তিনটের দিকে ডাক্তার এসে বললেন, “সরি‌ হরিবাবু, আপনারা প্রসূতির ওপর অনেক অত্যাচার করেছেন। জরায়ুর মধ্যে বাচ্চাটা অনেক আগেই মারা গেছে। রোগীর অবস্থাও ক্রিটিক্যাল। ”

হরিচরণের মা কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

“ছেলে না মেয়ে?” কদম পিসিমার প্রশ্নের জবাবে ডাক্তার জানালেন, “ছেলে। ” শেষ রাতে মারা যায় মাধবীলতা।

স্ত্রীর শেষ কথাটা রাখতে পারেন নাই হরিচরণ। কতবার মা-পিসিমা মাধবীলতার শেষ সংলাপের রেফারেন্স টেনে তাকে ফের বিয়ে করতে অনুরোধ করেছেন। কিন্তু কী করে তিনি তাদের বোঝাবেন যে সবার সব কথা সব সময় রাখা যায় না। মাধবীলতা বেঁচে থাকলে আজ বার্ধক্যে পা দিত; কিন্তু তার ভেতরে যে মাধবীলতার বসবাস সে তো অনন্তযৌবনা। ঊর্বশী। যতদিন হরিচরণ থাকবেন, মাধবীলতাও থাকবে, অপরিবর্তনীয়। ভেতরে তার মৃতজন্মা ছেলেটাও আছে। কিন্তু ধোঁয়াশায় ঢাকা। শতচেষ্টা করেও তার চেহারাটা মনের ভেতর জাগিয়ে তুলতে পারেন না তিনি। মনে হয় মস্তিষ্কের  কোনো একটা নিউরনে ছেলেটার চেহারা গাঁথা আছে; কিন্তু কোষটা কী এক অজানা কারণে ইন-অ্যাক্টিভ হয়ে আছে পঞ্চাশ বছর ধরে। শুধু এইটুকু মনে আছে, ছেলেটার কপালে রক্তচন্দনে আঁকা রাজতিলকের মতো জ্বলজ্বল করছিল একটা জড়ুল।

“ডাক্তারকাকা, ঝড় থামিছে। চলেন যাই। ”

হরিচরণ সম্বিতে ফেরেন। ঝড় থেমে গেছে। তবে মাঝারি ফোঁটার বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে প্রান্তর। উঠে বসেন তিনি। পাঞ্জাবী আর লুঙ্গি জলে-কাদায় ভিজে লেপ্টে আছে শরীরের সাথে। মনে হচ্ছে, কাঁধের ওপর মাথাটা দ্বিগুণ ভারী হয়ে গেছে।

কেরামত একখানা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, “ধ’রে ওঠেন কাকা। ”

কেরামতের হাতখানা ধরে হরিচরণের মনে হয়, “কে বলে অবলম্বন নেই? এই তো অবলম্বন। দেশের ষোলকোটি মানুষই তো অবলম্বন। দুই-পাঁচজন মানুষ বিপথে গেলে কি দেশ উচ্ছন্নে যায়?” শরীরের সমস্ত ভার কেরামতের ওপর ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ান হরিচরণ। কেমন টাল-মাটাল লাগছে। মনটাকে কেন্দ্রীভূত করে দেহে শক্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। কোন মতে রাস্তায় উঠে বলেন, “আমার ব্যাগডা খুঁজে দেখো তো কেরামত। ”

চারদিকে কেমন একটা ঘোলাটে আলো। চামড়ার ব্যাগ বৃষ্টিতে ভিজে ভারী হয়ে গেছে। কেরামত পেছনের ফিকে অন্ধকার থেকে  উদ্ধার করে আনে সেটাকে। কেরামতের হাত থেকে তিন ব্যাটারির টর্চটা ছিটকে পড়েছিল, অন্ধকারে খুঁজে পাওয়া যায় না।

কেরামত বলে, “আপনি আমার হাত ধ’রে রাখে হাঁটেন। ”

হরিচরণ তাই করেন। আসলে তার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। হঠাৎ মনে হয়, বুড়িয়ে গেছেন। মৃত্যু বুঝি খুব বেশি দূরে নেই।

ঝড়ের পরে এক ধরনের ঘোলাটে ভৌতিক আলোর আভাস ছড়িয়ে পড়েছে তেবিলার ওপর। সেই আলোর মধ্য দিয়ে দু’জন ঝড়-বিধ্বস্ত মানুষ হাঁটতে থাকে। হরিচরণের ব্যাগটা কেরামতের হাতে ধরা। বিল শেষ হয় এক সময়। ওরা গ্রামে ঢুকে পড়ে। ইতোমধ্যে চাঁদের ওপর থেকে মেঘের আস্তরণ সরে গিয়ে ভাঙাচোরা নুলো একখানা চাঁদ বেরিয়ে আসে। কঙ্কালসার জোছনা কেমন হলুদ দাঁত বের করে  হি হি করে হাসতে থাকে।

ঝড়ের মস্করা দেখতে দেখতে যায় দু’জন। এখানে ওখানে গাছপালা ভেঙে পড়েছে। হেলে পড়েছে জীর্ণ কুটির। দু’এক জায়গায় রাস্তা পেরুতে রীতিমত হিমশিম খেতে হয় ওদের।

“আর কত দূর কও তো কেরামত?” হরিচরণের প্রশ্ন।
“এই যে চলে আইছি। ” কেরামতের আশ্বাস। কী আশ্চর্য, ঝড়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত অভিযানের হাল ধরে ছিলেন হরিচরণ, এখন হাল ধরেছে কেরামত। এভাবেই সময়ের সাথে হাইলা বদলায়।

চারদিকে ছোট ছোট কিছু কুঁড়ে; মাটির দেয়াল, উপরে খড়ের ছাউনি; মাঝখানে দীর্ঘ উঠোন। এটাই কেরামত আলীর বসতভিটে। উঠানে পা দিতেই কোন একটা ঘর থেকে বেড়াল-ডাকের মতো একটা মন্দ্রস্বর ভেসে আসে। না, ওটা বেড়ালের ডাক না। কোনো নবজাতকের কান্না। কেরামত ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কয়েক লাফে উঠানের দূরত্বটুকু পেরিয়ে যে ঘর থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে সেই ঘরে ঢুকে যায়।

হরিচরণ উঠানে একা। দাঁড়িয়ে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে। এখন অনেকটা হালকা লাগছে। ভাঙাচোরা নুলো চাঁদটাকেও এখন ভালো লাগছে। সদ্যজাতের কান্না এখন আরো প্রকট। শিশুটি কি ছেলে? রাজপুত্রের মতো? কপালে রাজতিলক নিয়ে জন্মেছে? ধুর! ওটা তো ছিল কথার কথা। পরিস্থিতি শান্ত করার জন্যে একটা কৌশল। একটা পারিপাট্যে ভরা মিথ্যে। ছলনা। চাষাভুষাদের ঘরে কি রাজতিলক কপালে নিয়ে শিশু জন্মায়?

মিনিটখানেকের মধ্যে কেরামত আলী ফিরে আসে। উত্তেজিত গলায় বলে, “ও কাকা, আমার তো ছ’ল হইছে। আপনার কথাই ঠিক। আসেন না কাকা। এট্টু দেখে যান। ” কেরামত এক প্রকার জোর করেই হরিচরণকে টানতে টানতে আঁতুড়ঘরের দরজায় নিয়ে যায়।

দরজা দিয়ে হরিচরণ উঁকি দেন ভেতরে। চশমার পুরু লেন্সের ভেতর দিয়ে দেখেন, একটা কুপি জ্বলছে টিম টিম করে। তার উজ্জ্বল আলো ঠিকরে পড়েছে নবজাতকের মুখে। অসম্ভব সুন্দর মুখখানা লণ্ঠনের আলোয় জ্বলজ্বল করছে। কপালে ওটা কী? রাজতিলক? ভুলও হতে পারে। কারণ চশমার কাচে এখনো বিন্দু বিন্দু জল জমে আছে। জলকণায় আলো প্রতিসরিত হয়ে বিভ্রম তৈরি করতে পারে। কিন্তু, তবু হরিচরণ ডাক্তারের মনে হয় কবে কোথায় যেন অবিকল এরকম একটি মুখ দেখেছিলেন তিনি। অনেকদিন ধরে মাথার ভেতরে নিশ্চল হয়ে থাকা কোনো একটা নিউরণ হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে সচল হয়ে ওঠে। একটা উষ্ণ স্রোতধারা মেরুদণ্ড বেয়ে নিচের দিকে নেমে যায়; সেই সাথে বুকের ভেতর পঞ্চাশ বছর ধরে চেপে থাকা একটা পাথর নিঃশব্দে সরে গেলে এক অলৌকিক আনন্দে ভেসে যেতে থাকেন হরিচরণ ডাক্তার।



বাংলাদেশ সময়: ১৮১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।